এবার আরেকটি ডেলিভারী ইরানপন্থী জনৈক মৌ-লোভীর (স্ক্রীনশট দেখুন)। তিনি হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)-এর মওলা-বিষয়ক বর্ণনাসমূহের সূত্রগুলোকে প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর মীলাদুন্নবী (দ.) ১২ তারিখ হওয়ার বর্ণনার চেয়েও বিশ্বস্ত বলে মনে করেন। আরে, ঝর্নার জলপ্রবাহের উৎস আগে, না শাখা-প্রশাখা আগে? এজেন্ডার তলে গেছে সব রসাতলে!
অতএব
আসুন, আমার অনূদিত ‘মীলাদুন্নবী (দ.)-এর প্রামাণ্য দলিল’ শীর্ষক বইটি হতে ইমামবৃন্দের বিশুদ্ধ সূত্র বর্ণনা করা যাক [৬০-৬৩ পৃষ্ঠা, সনজেরী পাবলিকেশন, ২০১৭]।
১২ই রবিউল আউয়াল: মীলাদুন্নবী (দ:)-এর সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য তারিখ
কেউ কেউ দাবি করেন যে মীলাদুন্নবী (দ:)-এর প্রকৃত তারিখ জ্ঞাত নয়, আর তাই ১২ই রবিউল আউয়াল তারিখে ঈদে মীলাদুন্নবী (দ:) উদযাপনের কোনো অবকাশ-ই নাকি নেই।
বারো রবিউল আউয়াল তারিখ মীলাদ-দিবস হিসেবে কেবল প্রাথমিক যুগের বুযূর্গানে দ্বীনের কাছেই গৃহীত নয়, এটি সমগ্র ইসলামী বিশ্বের রাষ্ট্র ও সরকারগুলো কর্তৃক স্বীকৃত (মীলাদুন্নবীর) দিনও। এই দিনটি প্রায় ২ ডজন দেশে রাষ্ট্রীয় ছুটি হিসেবে পালিত হয়; ইরান ছাড়া অন্যান্য সকল রাষ্ট্র ১২ রবিউল আউয়াল শরীফকেই মীলাদুন্নবী (দ:) মানে। ইরান ১৭ তারিখে তা পালন করে, কেননা ওই তারিখ ইমাম জা’ফর সাদেক (রহ:)-এর জন্মদিনের সাথে মিলে যায়। [এডমিনের নোট: লক্ষণীয় যে, ইরান এই ১২ তারিখকে মানে না; তাই তাদের পক্ষের এজেন্ডাওয়ালাও মানে না!]
মীলাদুন্নবী (দ:)-এর সঠিক তারিখের ব্যাপারে প্রখ্যাত ইতিহাসবিদদের অভিমত
১. ইমাম ইবনে এসহাক (৮৫-১৫১ হিজরী): ১২ই রবিউল আউয়াল, ‘আম-উল-ফীল’ (হস্তীর বছর)। [ইবনে জওযী কৃত ’আল-ওয়াফা’, ৮৭ পৃষ্ঠা]
২. আল্লামা ইবনে হেশাম (২১৩ হিজরী): সোমবার, ১২ই রবিউল আউয়াল, হস্তীর বছর। [ইবনে হেশাম প্রণীত ‘আস্ সীরাতুন্ নববীয়্যা’, ১ম খণ্ড, ১৫৮ পৃষ্ঠা]
৩. ইমাম ইবনে জারীর তাবারী (২২৪-৩১০ হিজরী): সোমবার, ১২ই রবিউল আউয়াল, হস্তীর বছর। [তারিখুল উমাম ওয়াল মুলূক, ২য় খণ্ড, ১২৫ পৃষ্ঠা]
৪. আল্লামা আবুল হাসান আলী বিন মোহাম্মদ আল-মাওয়ার্দী (৩৭০-৪৮০ হিজরী): ‘আসহাবে ফীল’ ঘটনার ৫০ দিন ও বাবার ইন্তেকালের পরে সোমবার, ১২ই রবিউল আউয়াল তারিখ। [এ’লামুন্ নবুওয়া, ১৯২ পৃষ্ঠা]
৫. ইমাম হাফেয আবুল ফাতাহ আল-আন্দালুসী (৬৭১-৭৩৪ হিজরী): সোমবার, ১২ই রবিউল আউয়াল, হস্তীর বছর। [আইয়ুন আল-আসর, ১ম খণ্ড, ৩৩ পৃষ্ঠা]
৬. আল্লামা ইবনে খালদুন (৭৩২-৮০৮ হিজরী): ১২ই রবিউল আউয়াল, হস্তীর বছর; সম্রাট কাসরা নোশায়রওয়ান শাহের ৪০তম বছর। [ইবনে খালদুন কৃত ‘আত্ তারিখ’, ২য় খণ্ড, ৩৯৪ পৃষ্ঠা]
৭. মোহাম্মদ সাদিক ইবরাহীম আরজূন: বিভিন্ন ‘তুরাক’ (পরম্পরা)-এ সুপ্রতিষ্ঠিত যে মীলাদুন্নবী (দ:) সোমবার, ১২ই রবিউল আউয়াল, হস্তীর বছরে, কাসরা নোশায়ওয়ান শাহের শাসনামলে। [মোহাম্মদ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম, ১ম খণ্ড, ১০২ পৃষ্ঠা]
৮. শায়খ আবদুল হক্ক মোহাদ্দীসে দেহেলভী (৯৫০-১০৫২ হিজরী): “ভাল করে জেনে রাখো, ’সিয়ার’ ও ’তারিখ’ বিশেষজ্ঞদের (মানে জীবনীকার ও ইতিহাসবিদদের) নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ মত প্রকাশ করেন যে মহানবী (দ:) হস্তীর বছরে ধরণীতে আবির্ভূত হন.....এও ভালভাবে জ্ঞাত যে মাসটি ছিল রবিউল আউয়াল এবং দিনটি ১২ তারিখ। বিভিন্ন আলেম-উলেমা এই তারিখ সম্পর্কে ঐকমত্য পোষণ করেন।” [মাদারিজুন্ নবুয়্যত, ২য় খণ্ড, ১৪ পৃষ্ঠা]
৯. নবাব মোহাম্মদ সাদেক হাসান ভূপালভী: মীলাদুন্নবী (দ:) মক্কায় ফজরের সময় ১২ই রবিউল আউয়াল তারিখ, হস্তীর বছরে হয়েছিল। অধিকাংশ উলেমা এই মত সমর্থন করেন। ইবনে জওযী উলেমাদের ঐকমত্যের বিষয়টি বর্ণনা করেছেন। [আশ্ শোমামাতুল আম্বারিয়া ফী মওলিদে খায়র আল-বারিয়া, ৭ম পৃষ্ঠা]
অতএব, আপনারা দেখতে পেয়েছেন যে হিজরী প্রথম/দ্বিতীয় শতকের ইতিহাসবিদ ও জ্ঞানী-পণ্ডিতবৃন্দ এবং এর পাশাপাশি পরবর্তী যুগের জ্ঞান বিশারদগণও ১২ই রবিউল আউয়ালকে মীলাদ-দিবস হিসেবে নিশ্চিত করেছেন। এই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে ‘সালাফী’ নেতা নবাব সাদেক হাসান ভূপালীও।
ইসলামী বিশ্বে এই দিনটি আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত
কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া সমগ্র ইসলামী বিশ্বে মীলাদুন্নবী (দ:) দিনটি উদযাপিত হয়। লক্ষণীয় ব্যাপার হলো, ইরান ব্যতিরেকে (ওখানে ১৭ তারিখ পালিত হয়) সবগুলো মুসলমান দেশেই ১২ তারিখে তা পালিত হয়।
এখানে ১৬টি ইসলামী দেশের তালিকা দেয়া হলো, যেখানে ১২ই রবিউল আউয়াল তারিখে সরকারি ছুটি থাকে (এর প্রকৃত তালিকা আরও বড়):
জর্দান;
আরব আমীরাত;
বাহরাইন;
জাযিরাতুল আরব;
সুদান;
ইরাক;
কুয়েত;
মরক্কো;
ইয়েমেন;
তিউনিশিয়া;
সিরিয়া;
ওমান;
লেবানন;
লিবিয়া;
মিসর;
মৌরিতানিয়া।
মীলাদুন্নবী (দ:)-এর সর্বজনগ্রাহ্য দিন ১২ই রবিউল আউয়াল তারিখ, যে সম্পর্কে পূর্ববর্তী ও পরবর্তী উলেমাবৃন্দ এবং ইতিহাসবিদগণ ঐকমত্য পোষণ করেছেন; আর ইসলামী দেশগুলোও সরকারিভাবে পালনীয় দিবস হিসেবে গ্রহণ করেছে।
এক্ষণে আমরা এমন এক আলেমের উদ্ধৃতি দেবো যাকে ‘সালাফী’রা তাফসীর ও তাওয়ারিখ বিষয়ে সেরা আলেম মনে করে। তিনি শুধু ১২ তারিখকে মূলধারার উলেমাদের অভিমত বলেই ক্ষান্ত হন নি, বরং এর স্বপক্ষে হাদীসও পেশ করেছেন:
ইবনে আবি শায়বা (রহ:) তাঁর ‘মোসান্নাফ’ গ্রন্থে আফফান থেকে, তিনি সাঈদ থেকে, তিনি জাবের (রা:) থেকে, তিনি হযরত ইবনে আব্বাস (রা:) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (দ:) হস্তীর বছরে ১২ই রবিউল আউয়াল, সোমবার, ধরাধামে শুভাগমন করেন। [ইবনে কাসীর কৃত ‘সীরাতুন্ নবী’, ১ম খণ্ড, ১৯৯ পৃষ্ঠা]
অতঃপর ইবনে কাসীর বলেন, “সংখ্যাগরিষ্ঠ উলেমাদের মধ্যে এটি-ই সুপ্রসিদ্ধ মত।” [প্রাগুক্ত]
ইমাম কসতলানী (রহ:) বলেন: মহানবী (দ:) ১২ই রবিউল আউয়াল তারিখে ধরণীতে আবির্ভূত হন এবং মক্কাবাসী মুসলমানগণ তা পালন করেন; ওই একই দিন তাঁরা (তাঁর) বেলাদত-স্থান যেয়ারত করেন....এটি জ্ঞাত যে মহানবী (দ:)-এর মীলাদ-দিবস ১২ই রবিউল আউয়াল, দিনটি ছিল সোমবার। ইবনে এসহাক (রহ:) এবং অন্যান্যরাও এ কথা বর্ণনা করেছেন। [আল-মাওয়াহিবুল লাদুন্নিয়া, ১ম খণ্ড, ৮৮ পৃষ্ঠা]
*সমাপ্ত*