ব্লগ সংরক্ষাণাগার

শনিবার, ২৯ আগস্ট, ২০২০

মুসলিম মেধা-মননের দৈন্যদশা

 

-----------এডমিন

জি, শিরোনাম ঠিকই পড়েছেন। আজকে এই বিষয়ে আলোকপাত করবো। আমি ধর্মীয় জ্ঞানে নিরেট অজ্ঞ একজন মানুষ। তবু আমার যতোটুকু অধ্যয়ন, ততোটুকু দ্বারা নিম্নের কয়েকটি বিষয় তুলে ধরছি। প্রথমে হাল্কা বিষয়ের অবতারণা দ্বারা শুরু:
১/ বিয়েতে কনের মটরবাইক চালনা
অতি সম্প্রতি এক যুবতী নারী নিজের বিয়ের গায়ে হলুদ অনুষ্ঠানে ও মুল বিয়েতে দল বেঁধে মোটর সাইকেল চালিয়ে যশোর শহর প্রদক্ষিণ করেছে। সে গায়ে হলুদের সাজসজ্জা পরে সবার সামনে বাইক বহরের নেতৃত্ব দেয়। যদিও সে পরে বলেছে সে ভাইরাল হতে চায় নি বরং বাইক চালিয়ে মজা করেছে, তবুও এ ধরনের অনুষ্ঠানে এই কাজটি করে সে আলোড়ন ফেলে দেয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে ভিডিও আপলোড করায় পক্ষে-বিপক্ষে মতামতও প্রকাশিত হয়। আমার দৃষ্টিতে এ ধরনের অনুষ্ঠানগুলোতে সাধারণতঃ বর-কনে সবার দুআ চায়। আর সবাই তাদের জন্যে শুভ কামনা করেন। এটাই রীতিগত। ওই যুবতী নারীর আত্মপক্ষ সমর্থনমূলক বক্তব্যটির ব্যাপারে বলবো, মটরবাইক চালনা এখানে ধর্তব্য বিষয় নয়। মূল বিষয় হলো, ভাইরাল হওয়ার পন্থার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। এক, মেধা-মনন ও গুণগত বৈশিষ্ট্য দ্বারা ভাইরাল বা পরিচিতি লাভ করা একটা শ্রেষ্ঠত্ব বটে। দুই, চটকদার ও গুরুত্বহীন কাজ দ্বারা ভাইরাল হওয়া, যেমনটি হলো বর্তমানকালের ফিল্মী ধাঁচের কর্মকাণ্ড। তরুণ প্রজন্মের এ পার্থক্যের ব্যাপারে আরো সচেতন হওয়া উচিৎ।
২/ ঈমানের প্রতিফলনমূলক কথা/কাজ সম্পর্কে এক আলেমের বক্তব্য
এবার সিরিয়াস বিষয়ের অবতারণা। জনৈক আলেম অনলাইন ভিডিওতে অনেক লেকচার দেন। সম্প্রতি এক প্রভাষণে তিনি বলেন যে, হানাফী মাযহাবের ইমামের সূত্রে নাকি সুন্নী উলামাবৃন্দ বিবেচনা করেন কারো ১০০ টা কথা অথবা কাজের মধ্যে ৯৯ টা কুফর প্রকাশক হলে আর ১ টা ঈমান প্রতিফলন করলে সে মুসলমান। জানি না এই কথা কোত্থেকে এলো। আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে তুরস্কের বিশিষ্ট ইসলামী জ্ঞান বিশারদ ও গবেষক আল্লামা হুসাইন হিলমী (রহ:)’এর প্রণীত ‘ওহাবীদের প্রতি নসীহত’ বইটির প্রথম খণ্ডের শেষাংশ হতে উদ্ধৃতি দেয়া সমীচীন হবে। তিনি লেখেন:
“যদি কোনো মুসলমানের একটা কথা কিংবা একটা কাজ থেকে এক’শটা অর্থ বের করা যায় এবং যদি সেগুলোর একটা অর্থ তাঁকে মুসলিম হিসেবে প্রতীয়মান করে, আর বাকি ৯৯টা কাফের হিসেবে, তবে আমাদেরকে বলতে হবে যে তিনি একজন মুসলিম। অর্থাৎ, কুফর প্রতীয়মানকারী ৯৯টা অর্থকে ধরা হবে না এবং ঈমান প্রতীয়মানকারী অর্থটাকে গ্রহণ করা হবে। অতএব, ওয়াহহাবীদের দ্বারা ধোকাপ্রাপ্ত কোনো ব্যক্তির উচিত নয় মুসলমানদেরকে কাফের ও মুশরিক আখ্যা দেয়া; মুসলমানদের সম্পর্কে তার বদ চিন্তা থাকা উচিৎ নয়। আমাদের এ কথাকে ভুল না বোঝার জন্যে দুটো বিষয়ের দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। প্রথমতঃ যে ব্যক্তির কথা কিংবা কাজকে পর্যালোচনা করা হচ্ছে, তাঁকে একজন মুসলমান হিসেবে পরিচিত হতে হবে। পক্ষান্তরে, একজন কাফেরের একটা নয় বরং বহু কথা কিংবা কাজ যদি ঈমান প্রতিফলন করে, তবুও তাকে মুসলমান বলা যাবে না। যখন কোনো ফরাসী লোক কুরআনের প্রশংসা করেন কিংবা কোনো বৃটিশ লোক বলেন যে আল্লাহ এক কিংবা একজন জার্মান দার্শনিক বলেন যে ইসলাম-ই সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্ম, তখন এ কথা বলা যাবে না যে তাঁরা মুসলিম হয়ে গিয়েছেন। কোনো কাফেরকে মুসলমান হতে হলে তাকে বলতে হবে – “আল্লাহ হাজির-নাযির আছেন। তিনি এক, অদ্বিতীয়। মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর প্রেরিত রাসূল। তিনি তাঁকে পৃথিবীর শেষ সময় পর্যন্ত আগত সকল মানুষের জন্যে নবী হিসেবে প্রেরণ করেছেন। মহানবী (দ:) যা বলেছেন, তার সব কিছুতেই আমি বিশ্বাসী” এবং সাথে সাথেই ঈমানের ছয়টি ভিত্তি ও তেত্রিশটি ফরয শিখে নিয়ে তাতে বিশ্বাস করতে হবে। দ্বিতীয়তঃ বলা হয়েছিল যে “একটা কথা কিংবা কাজ থেকে এক’শটা অর্থ।” যদি কোনো ব্যক্তির এক’শটা কথা কিংবা কাজের মধ্যে একটা কথা কিংবা কাজ ঈমান প্রতিফলন করে, আর বাকি নিরানব্বইটা যদি কুফর প্রতীয়মান করে, তবে সে লোককে আমরা মুসলমান বলতে আদিষ্ট নই। কারণ, একজন লোকের শুধুমাত্র একটা কথা কিংবা কাজও যদি কুফর প্রতিফলন করে এবং যদি সেটার মধ্যে কোনো ঈমান প্রতিফলনকারী অর্থ না থাকে, তাহলে তাকে কাফের হিসেবে বিবেচনা করা হবে। ঈমান প্রতীয়মানকারী তার অন্যান্য কথা কিংবা কাজ তাকে কুফর থেকে রক্ষা করতে পারবে না।” [ওহাবীদের প্রতি নসীহত, বাংলা সংস্করণ; সাঞ্জেরী পাবলিকেশন, ২০১৬ ইং]
৩/ ‘মসলক’ প্রসঙ্গ
সম্প্রতি ‘মসলক’ নিয়ে তুমুল বিতর্ক চলছে। এরই মধ্যে আবারো একটা ভিডিও আপলোড করেছেন বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থানকারী আলেম সাহেব। তিনি এবার বলেছেন, দেওবন্দীদের আবির্ভাবের আগে তো এই পরিস্থিতি ছিলো না; তাদের আগমনের ফলেই প্রতিরোধমূলক ‘মসলক’ সৃষ্টি হয়েছে। তিনি আরো বলেছেন, চার মাযহাবের ইমামবৃন্দের আগে নাকি এস্তেম্বাত (তথা শরঈ বিষয়াদিতে গবেষণালব্ধ সিদ্ধান্ত) সাহাবা কেরাম (রা:)’এর মাঝে চালু ছিলো না। এ কথাটি জ্ঞাননির্ভর নয়। সত্যি আফসোস, কেননা সাহাবা কেরাম (রা:)’মণ্ডলীর মাঝে অনেকেই এ ধরনের গবেষণায় লিপ্ত ছিলেন, যা বইপত্রে এসেছে [যেমন - মাযহাব অমান্যকারীদের খণ্ডন, সাঞ্জেরী পাবলিকেশন, ২০১৬]। বিশেষ করে, হযরত মু’য়ায বিন জাবাল (রা:)’কে ইয়েমেনে প্রাদেশিক শাসনকর্তা নিয়োগের সময় প্রিয়নবী (দ:) তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “হে মুয়ায, তুমি কোনো বিষয়ের মুখোমুখি হলে কী করবে?” তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, “ক্বুরআন মজীদে সমাধান খুঁজবো।” তাঁকে আবারো প্রশ্ন করা হয়েছিলো, “যদি তাতে না পাও?” তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, “হাদীসে খুঁজবো।” আবারো প্রশ্ন করা হয়েছিলো, “যদি তাতেও না পাও?” এমতাবস্থায় তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, “তাহলে আমি আমার রায় (গবেষণালব্ধ সিদ্ধান্ত) প্রয়োগ করবো [সহীহ হাদীসগ্রন্থাবলী দেখুন]।” এটাই তো সাহাবী (রা:)’দের এস্তেম্বাতের সবচেয়ে বড় দলিল!* দ্বিতীয়তঃ দেওবন্দীরা বাতিল মতবাদ প্রচারের এই কাজে প্রথম নয়। এর আগে ইবনে তাইমিয়া সারা আরব-আজমে মনগড়া গোমরাহ মতবাদের প্রসার করেছিলো। উপমহাদেশ তো সেই তুলনায় ক্ষুদ্র একটা জায়গা! ওই সময় ইমাম তকীউদ্দীন সুবকী (রহ:)-সহ অনেক আলেম-উলামা প্রতিরোধমূলক ফতোয়াসম্বলিত বইপত্র লেখেন। এরপর ১২২১ হিজরী/১৮০১-২ খৃষ্টাব্দে ওহাবীরা মক্কা-মদীনা আক্রমণ করে তাণ্ডব চালালে হারামাইন শরীফাইনের আলেম-উলামা ওহাবী মতবাদ রদকারী ফতোয়া লেখেন (সাইফুল জব্বার)। তাঁদের ক্ষেত্রে আলাদা আলাদা ‘মসলক’ হয়েছে কি?
শেষ কথা
বর্তমানে যে ‘মসলক’ নিয়ে এতো হৈচৈ, সেটার প্রবর্তক কি ফিক্বহী ক্ষেত্রে সেটা জারি করেছিলেন? উত্তর - না, কেননা তিনি হানাফী ফিক্বাহ অনুসরণ করতেন। তাহলে সেটা কি তাসাউফ-তরীক্বতভিত্তিক? উত্তর - না, কেননা তিনি তরীক্বত হিসেবে ক্বাদেরীয়ার অনুসারী ছিলেন। তাহলে এটা কী? আমি ভাই এক মূর্খ লোক। এ মতামত ব্যক্ত করার সাথে সাথেই মন্তব্য সেকশনে কড়া সমালোচনা আরম্ভ হবে। কিন্তু আমি জানি, ইসলামের আধ্যাত্মিকতার আলো অগ্রাধিকারভিত্তিতে আলেম সমাজই পাবার হক্বদার, আমরা আম পাবলিক হক্বদার নই। তাঁরা প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’এর উত্তরাধিকারী। মওলানা রূমী (রহ:)’এর মতো যাঁরা নিজেদের নফস/কুপ্রবৃত্তিকে দমন করতে সক্ষম হয়েছেন, কেবল তাঁরাই তা পাবেন। আপনারা আলেম-উলামা ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত। আল্লাহর ওয়াস্তে সেই রাস্তাটি চর্চা করুন না, যাতে তরুণ প্রজন্ম আলোর দিশা পায়!
পবিত্র মহর্রম উপলক্ষে ইমাম হুসাইন (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) ও অন্যান্য শুহাদা-এ-কারবালার (রা:) প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানিয়ে শেষ করছি। ধন্যবাদ সবাইকে।
*সমাপ্ত*


*সাহাবী (রা:)’দের অনেকেরই নিজস্ব মাযহাব ছিলো। কিন্তু বইপত্রে লিপিবদ্ধ না হওয়ায় তা বিস্মৃত হয়। চার মাযহাবের ইমামবৃন্দ (রহ:)’এর মাযহাবগুলোকে আল্লাহতা’লা স্থায়িত্ব দান করেন।