ব্লগ সংরক্ষাণাগার

শনিবার, ২৯ আগস্ট, ২০২০

মুসলিম মেধা-মননের দৈন্যদশা

 

-----------এডমিন

জি, শিরোনাম ঠিকই পড়েছেন। আজকে এই বিষয়ে আলোকপাত করবো। আমি ধর্মীয় জ্ঞানে নিরেট অজ্ঞ একজন মানুষ। তবু আমার যতোটুকু অধ্যয়ন, ততোটুকু দ্বারা নিম্নের কয়েকটি বিষয় তুলে ধরছি। প্রথমে হাল্কা বিষয়ের অবতারণা দ্বারা শুরু:
১/ বিয়েতে কনের মটরবাইক চালনা
অতি সম্প্রতি এক যুবতী নারী নিজের বিয়ের গায়ে হলুদ অনুষ্ঠানে ও মুল বিয়েতে দল বেঁধে মোটর সাইকেল চালিয়ে যশোর শহর প্রদক্ষিণ করেছে। সে গায়ে হলুদের সাজসজ্জা পরে সবার সামনে বাইক বহরের নেতৃত্ব দেয়। যদিও সে পরে বলেছে সে ভাইরাল হতে চায় নি বরং বাইক চালিয়ে মজা করেছে, তবুও এ ধরনের অনুষ্ঠানে এই কাজটি করে সে আলোড়ন ফেলে দেয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে ভিডিও আপলোড করায় পক্ষে-বিপক্ষে মতামতও প্রকাশিত হয়। আমার দৃষ্টিতে এ ধরনের অনুষ্ঠানগুলোতে সাধারণতঃ বর-কনে সবার দুআ চায়। আর সবাই তাদের জন্যে শুভ কামনা করেন। এটাই রীতিগত। ওই যুবতী নারীর আত্মপক্ষ সমর্থনমূলক বক্তব্যটির ব্যাপারে বলবো, মটরবাইক চালনা এখানে ধর্তব্য বিষয় নয়। মূল বিষয় হলো, ভাইরাল হওয়ার পন্থার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। এক, মেধা-মনন ও গুণগত বৈশিষ্ট্য দ্বারা ভাইরাল বা পরিচিতি লাভ করা একটা শ্রেষ্ঠত্ব বটে। দুই, চটকদার ও গুরুত্বহীন কাজ দ্বারা ভাইরাল হওয়া, যেমনটি হলো বর্তমানকালের ফিল্মী ধাঁচের কর্মকাণ্ড। তরুণ প্রজন্মের এ পার্থক্যের ব্যাপারে আরো সচেতন হওয়া উচিৎ।
২/ ঈমানের প্রতিফলনমূলক কথা/কাজ সম্পর্কে এক আলেমের বক্তব্য
এবার সিরিয়াস বিষয়ের অবতারণা। জনৈক আলেম অনলাইন ভিডিওতে অনেক লেকচার দেন। সম্প্রতি এক প্রভাষণে তিনি বলেন যে, হানাফী মাযহাবের ইমামের সূত্রে নাকি সুন্নী উলামাবৃন্দ বিবেচনা করেন কারো ১০০ টা কথা অথবা কাজের মধ্যে ৯৯ টা কুফর প্রকাশক হলে আর ১ টা ঈমান প্রতিফলন করলে সে মুসলমান। জানি না এই কথা কোত্থেকে এলো। আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে তুরস্কের বিশিষ্ট ইসলামী জ্ঞান বিশারদ ও গবেষক আল্লামা হুসাইন হিলমী (রহ:)’এর প্রণীত ‘ওহাবীদের প্রতি নসীহত’ বইটির প্রথম খণ্ডের শেষাংশ হতে উদ্ধৃতি দেয়া সমীচীন হবে। তিনি লেখেন:
“যদি কোনো মুসলমানের একটা কথা কিংবা একটা কাজ থেকে এক’শটা অর্থ বের করা যায় এবং যদি সেগুলোর একটা অর্থ তাঁকে মুসলিম হিসেবে প্রতীয়মান করে, আর বাকি ৯৯টা কাফের হিসেবে, তবে আমাদেরকে বলতে হবে যে তিনি একজন মুসলিম। অর্থাৎ, কুফর প্রতীয়মানকারী ৯৯টা অর্থকে ধরা হবে না এবং ঈমান প্রতীয়মানকারী অর্থটাকে গ্রহণ করা হবে। অতএব, ওয়াহহাবীদের দ্বারা ধোকাপ্রাপ্ত কোনো ব্যক্তির উচিত নয় মুসলমানদেরকে কাফের ও মুশরিক আখ্যা দেয়া; মুসলমানদের সম্পর্কে তার বদ চিন্তা থাকা উচিৎ নয়। আমাদের এ কথাকে ভুল না বোঝার জন্যে দুটো বিষয়ের দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। প্রথমতঃ যে ব্যক্তির কথা কিংবা কাজকে পর্যালোচনা করা হচ্ছে, তাঁকে একজন মুসলমান হিসেবে পরিচিত হতে হবে। পক্ষান্তরে, একজন কাফেরের একটা নয় বরং বহু কথা কিংবা কাজ যদি ঈমান প্রতিফলন করে, তবুও তাকে মুসলমান বলা যাবে না। যখন কোনো ফরাসী লোক কুরআনের প্রশংসা করেন কিংবা কোনো বৃটিশ লোক বলেন যে আল্লাহ এক কিংবা একজন জার্মান দার্শনিক বলেন যে ইসলাম-ই সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্ম, তখন এ কথা বলা যাবে না যে তাঁরা মুসলিম হয়ে গিয়েছেন। কোনো কাফেরকে মুসলমান হতে হলে তাকে বলতে হবে – “আল্লাহ হাজির-নাযির আছেন। তিনি এক, অদ্বিতীয়। মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর প্রেরিত রাসূল। তিনি তাঁকে পৃথিবীর শেষ সময় পর্যন্ত আগত সকল মানুষের জন্যে নবী হিসেবে প্রেরণ করেছেন। মহানবী (দ:) যা বলেছেন, তার সব কিছুতেই আমি বিশ্বাসী” এবং সাথে সাথেই ঈমানের ছয়টি ভিত্তি ও তেত্রিশটি ফরয শিখে নিয়ে তাতে বিশ্বাস করতে হবে। দ্বিতীয়তঃ বলা হয়েছিল যে “একটা কথা কিংবা কাজ থেকে এক’শটা অর্থ।” যদি কোনো ব্যক্তির এক’শটা কথা কিংবা কাজের মধ্যে একটা কথা কিংবা কাজ ঈমান প্রতিফলন করে, আর বাকি নিরানব্বইটা যদি কুফর প্রতীয়মান করে, তবে সে লোককে আমরা মুসলমান বলতে আদিষ্ট নই। কারণ, একজন লোকের শুধুমাত্র একটা কথা কিংবা কাজও যদি কুফর প্রতিফলন করে এবং যদি সেটার মধ্যে কোনো ঈমান প্রতিফলনকারী অর্থ না থাকে, তাহলে তাকে কাফের হিসেবে বিবেচনা করা হবে। ঈমান প্রতীয়মানকারী তার অন্যান্য কথা কিংবা কাজ তাকে কুফর থেকে রক্ষা করতে পারবে না।” [ওহাবীদের প্রতি নসীহত, বাংলা সংস্করণ; সাঞ্জেরী পাবলিকেশন, ২০১৬ ইং]
৩/ ‘মসলক’ প্রসঙ্গ
সম্প্রতি ‘মসলক’ নিয়ে তুমুল বিতর্ক চলছে। এরই মধ্যে আবারো একটা ভিডিও আপলোড করেছেন বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থানকারী আলেম সাহেব। তিনি এবার বলেছেন, দেওবন্দীদের আবির্ভাবের আগে তো এই পরিস্থিতি ছিলো না; তাদের আগমনের ফলেই প্রতিরোধমূলক ‘মসলক’ সৃষ্টি হয়েছে। তিনি আরো বলেছেন, চার মাযহাবের ইমামবৃন্দের আগে নাকি এস্তেম্বাত (তথা শরঈ বিষয়াদিতে গবেষণালব্ধ সিদ্ধান্ত) সাহাবা কেরাম (রা:)’এর মাঝে চালু ছিলো না। এ কথাটি জ্ঞাননির্ভর নয়। সত্যি আফসোস, কেননা সাহাবা কেরাম (রা:)’মণ্ডলীর মাঝে অনেকেই এ ধরনের গবেষণায় লিপ্ত ছিলেন, যা বইপত্রে এসেছে [যেমন - মাযহাব অমান্যকারীদের খণ্ডন, সাঞ্জেরী পাবলিকেশন, ২০১৬]। বিশেষ করে, হযরত মু’য়ায বিন জাবাল (রা:)’কে ইয়েমেনে প্রাদেশিক শাসনকর্তা নিয়োগের সময় প্রিয়নবী (দ:) তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “হে মুয়ায, তুমি কোনো বিষয়ের মুখোমুখি হলে কী করবে?” তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, “ক্বুরআন মজীদে সমাধান খুঁজবো।” তাঁকে আবারো প্রশ্ন করা হয়েছিলো, “যদি তাতে না পাও?” তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, “হাদীসে খুঁজবো।” আবারো প্রশ্ন করা হয়েছিলো, “যদি তাতেও না পাও?” এমতাবস্থায় তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, “তাহলে আমি আমার রায় (গবেষণালব্ধ সিদ্ধান্ত) প্রয়োগ করবো [সহীহ হাদীসগ্রন্থাবলী দেখুন]।” এটাই তো সাহাবী (রা:)’দের এস্তেম্বাতের সবচেয়ে বড় দলিল!* দ্বিতীয়তঃ দেওবন্দীরা বাতিল মতবাদ প্রচারের এই কাজে প্রথম নয়। এর আগে ইবনে তাইমিয়া সারা আরব-আজমে মনগড়া গোমরাহ মতবাদের প্রসার করেছিলো। উপমহাদেশ তো সেই তুলনায় ক্ষুদ্র একটা জায়গা! ওই সময় ইমাম তকীউদ্দীন সুবকী (রহ:)-সহ অনেক আলেম-উলামা প্রতিরোধমূলক ফতোয়াসম্বলিত বইপত্র লেখেন। এরপর ১২২১ হিজরী/১৮০১-২ খৃষ্টাব্দে ওহাবীরা মক্কা-মদীনা আক্রমণ করে তাণ্ডব চালালে হারামাইন শরীফাইনের আলেম-উলামা ওহাবী মতবাদ রদকারী ফতোয়া লেখেন (সাইফুল জব্বার)। তাঁদের ক্ষেত্রে আলাদা আলাদা ‘মসলক’ হয়েছে কি?
শেষ কথা
বর্তমানে যে ‘মসলক’ নিয়ে এতো হৈচৈ, সেটার প্রবর্তক কি ফিক্বহী ক্ষেত্রে সেটা জারি করেছিলেন? উত্তর - না, কেননা তিনি হানাফী ফিক্বাহ অনুসরণ করতেন। তাহলে সেটা কি তাসাউফ-তরীক্বতভিত্তিক? উত্তর - না, কেননা তিনি তরীক্বত হিসেবে ক্বাদেরীয়ার অনুসারী ছিলেন। তাহলে এটা কী? আমি ভাই এক মূর্খ লোক। এ মতামত ব্যক্ত করার সাথে সাথেই মন্তব্য সেকশনে কড়া সমালোচনা আরম্ভ হবে। কিন্তু আমি জানি, ইসলামের আধ্যাত্মিকতার আলো অগ্রাধিকারভিত্তিতে আলেম সমাজই পাবার হক্বদার, আমরা আম পাবলিক হক্বদার নই। তাঁরা প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’এর উত্তরাধিকারী। মওলানা রূমী (রহ:)’এর মতো যাঁরা নিজেদের নফস/কুপ্রবৃত্তিকে দমন করতে সক্ষম হয়েছেন, কেবল তাঁরাই তা পাবেন। আপনারা আলেম-উলামা ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত। আল্লাহর ওয়াস্তে সেই রাস্তাটি চর্চা করুন না, যাতে তরুণ প্রজন্ম আলোর দিশা পায়!
পবিত্র মহর্রম উপলক্ষে ইমাম হুসাইন (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) ও অন্যান্য শুহাদা-এ-কারবালার (রা:) প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানিয়ে শেষ করছি। ধন্যবাদ সবাইকে।
*সমাপ্ত*


*সাহাবী (রা:)’দের অনেকেরই নিজস্ব মাযহাব ছিলো। কিন্তু বইপত্রে লিপিবদ্ধ না হওয়ায় তা বিস্মৃত হয়। চার মাযহাবের ইমামবৃন্দ (রহ:)’এর মাযহাবগুলোকে আল্লাহতা’লা স্থায়িত্ব দান করেন।

মঙ্গলবার, ২৬ মে, ২০২০

হযরত আলী (ক:) প্রদত্ত দায়মুক্তি

হযরত আলী (ক:) আমীরে মু’আবিয়া (রা:)’এর বিরোধিতাসংক্রান্ত নিষ্ঠাকে স্বীকার করে বলেন:
والظاهر أن ربنا واحد و نبينا واحد و دعوتنا في الإسلام واحدة لا نستزيدهم في الإيمان بالله و التصديق برسوله و لا يستزيدوننا: الأمر واحد إلا ما اختلفنا فيه من دم عثمان و نحن منه براء.
অর্থ: (আমাদের ও সিরিয়াবাসীর মধ্যকার যুদ্ধ সম্পর্কে কারোরই ভুল ধারণা থাকা উচিৎ নয়); এটা নিশ্চিত যে, আমাদের রব (প্রভু) এক, নবী (দ:) এক, আর ইসলামের প্রতি আমাদের আহ্বানও এক। আল্লাহতে বিশ্বাস স্থাপন ও তাঁর রাসূল (দ:)’এর প্রতি প্রত্যয় পোষণ যতোক্ষণ পর্যন্ত বর্তমান, ততোক্ষণ আমরা কিছু দাবি করি না, তাঁরাও তা করেন না। আমাদের সব বিষয়ে আমরা একতাবদ্ধ, শুধু এইটুকু ছাড়া যে হযরত উসমান (রা:)’এর রক্তের (বদলার) ব্যাপারে আমরা একে অপরের সাথে ভিন্নমত পোষণ করেছিলাম। আর আমরা এ বিষয়ে দোষারোপ হতে মুক্ত। [নাহজুল বালাগাহ, ১৮৬ পৃষ্ঠা, ৫৮ নং ধর্মোপদেশ]
এই বিষয়ে যাঁরা আরো জানতে চান, তাঁরা নিচে প্রদত্ত ইংরেজি বইয়ের পিডিএফ ডাউনলোড করে পড়তে পারেন। মূল বইটির আরবী সংস্করণের পিডিএফ-ও মাহাজ্জাহ সাইটে ইমেইল করে পাওয়া যেতে পারে। লিঙ্ক:https://mahajjah.com/accusation-of-committing-a-sin/?fbclid=IwAR2PCSSGxuTLNhp2rQEbEmtUHyJL6E1-BzI4Ma9nQD59l9ZxLyUWJm1w6Co

বৃহস্পতিবার, ২১ মে, ২০২০

সুন্নী উলামাদের ফতোয়া সমন্বয়কারী পরামর্শক সভার রূপরেখা

- কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন

বর্তমান প্রযুক্তির যুগে আমাদের ইসলামী আক্বীদা-বিশ্বাসের মাযহাব তথা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’আতের (সুন্নী) পথ ও মতের প্রভূত প্রচার-প্রসার সাধিত হয়েছে। সুন্নী আলেম-উলামা ফেইসবুক-টুইটার ও ইউটিউব চ্যানেল-সহ অনলাইনে অনেক ওয়েবসাইট এখন ব্যবহার করছেন। কয়েকজন তরুণ এ্যাপস্-ও তৈরি করেছেন, যা আগামীতে সুফল বয়ে আনবে ইন-শা-আল্লাহ। সুন্নী দ্বীনী সংস্থাগুলো অনেক মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছে এবং এই কার্যক্রম আরো বেগবান হচ্ছে প্রতিনিয়ত। তবে আমার এই লেখাটি সুন্নীদের একটি মৌলিক বিষয়কে কেন্দ্র করে, যা সত্য-সঠিক ও সহজ-সরল সুন্নী রাস্তা তথা মহাসড়কের আশপাশে অবস্থিত বদ্ধ ও অন্ধকার অলিগলি পথকে রোধ করার মহৎ উদ্দেশ্যেই রচিত।

সাম্প্রতিককালে কিছু সুন্নী আলেম-উলামার মাঝে মৌলিক নীতির অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। তাঁদের পারস্পরিক আচার-আচরণ মোটেও সিদ্ধ নয়। একই মতাদর্শের বিভিন্ন মাদ্রাসা হতে পাশ করে এসে তাঁরা ফেইসবুক/ইউটিউব সাইটগুলোতে একে অপরের সাথে ভিন্নমত পোষণ করে বক্তব্য রাখছেন, আর ফলস্বরূপ অনলাইনে অযথা বিতর্কের সূত্রপাত হচ্ছে। এতে সাধারণ মানুষও বিভ্রান্ত হচ্ছেন। বিশেষ করে সুন্নী মতাদর্শের ঘোর বিরোধী খারেজী (ওহাবী/মওদূদী/সালাফী/তাবলীগী গোষ্ঠী) ও রাফেযী (শিয়া চক্র) বিভ্রান্তি ছড়ানোর এই সুযোগকে কাজে লাগাচ্ছে বেশি। তারা কোনো সুন্নী আলেমের নিজস্ব সিদ্ধান্তসম্বলিত বইয়ের স্ক্রীনশট এনে তা ফেইসবুকে তুলে তুলকালাম কাণ্ড বাধাচ্ছে। ফেইসবুক ও অনুরূপ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যে কেউ মন্তব্য করতে পারে বলে অজ্ঞমূর্খ লোকেরাও ওই বিতর্কে শরীক হচ্ছে। অথচ তাদের ওই বিষয়গুলোতে ন্যূনতম জ্ঞানও নেই।

এমতাবস্থায় একটি সুষ্ঠু নীতিমালার ভিত্তিতে সুন্নী উলামাদের আচরণবিধি নির্ধারণ করা অতীব প্রয়োজনীয় বলে আমি মনে করি। এটা যেমন মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থায় যুক্ত করা জরুরি, তেমনি সারা দেশে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’আতভুক্ত আলেম-উলামার মাঝেও প্রয়োগ করা দরকারি। আর এই কাজে সহায়তা করতে পারেন গণ্যমান্য সুন্নীদের একটি পরামর্শক সভা। অতীতে স্রেফ আলেম-উলামাদের দিয়ে অনেক সুন্নী কমিটি করা হয়েছে, কিন্তু দেখা গেছে ওর পাল্টাপাল্টি কমিটিও দাঁড় করানো হয়েছে। অতএব, স্রেফ সুন্নী আলেম-উলামার কমিটি দ্বারা এই কাজ সম্ভব নয়। আমি এখানে ছাঁচাছোলা কথা বলতে বাধ্য হচ্ছি, কেননা অতীত অভিজ্ঞতাই আমাকে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে বাধ্য করেছে। তাহলে প্রশ্ন দাঁড়াচ্ছে, কী হবে ওই পরামর্শক সভার রূপরেখা? 

রূপরেখা:

আমার মতে, সুন্নী মতাদর্শে বিশ্বাসী সমাজ ও রাষ্ট্রের সৎ ও নীতিবান, প্রভাব ও প্রতিপত্তিশালী, বয়োজ্যেষ্ঠ ও অভিজ্ঞ এবং  বিত্তবান কিছু মানুষ, যাঁদেরকে সারা দেশের সুন্নী আলেম-উলামা কোনো না কোনো কারণে মানেন, তাঁদের সাথে বয়োজ্যেষ্ঠ ও মান্যবর সুন্নী বুযূর্গ আলেম-উলামার সমন্বয়ে একটি পরামর্শক সভা গঠন করা উচিৎ। মওলানা হাশেমী সাহেব হুজূর, সূফী মিজান সাহেব প্রমুখের মতো ব্যক্তিত্বই হবেন ওই কমিটির সদস্যবৃন্দ। অন্যূন ১৫ সদস্যের পরামর্শক সভা গঠিত হতে পারে। এটা হবে pressure group তথা চাপ প্রয়োগকারী দল। 

কর্মপরিধি:

পরামর্শক সভার কাজ হবে মূলতঃ সুন্নী উলামাদের অনলাইনে মতপার্থক্যজনিত বিরোধের নিষ্পত্তিকরণ। কোনো সুন্নী আলেম ফেইসবুক/টুইটার/ইউটিউব সাইটে বিতর্ক সৃষ্টিকর নিজস্ব কোনো বক্তব্য উপস্থাপন করলে অন্যান্য সুন্নী আলেম তা নিয়ে পাল্টা বক্তব্য অনলাইনে দিতে পারবেন না। তাঁরা তা পরামর্শক সভার কাছে রেফার করতে পারবেন। কেউই নিজ নিজ অনুসারীদেরকে অনলাইনে তা নিয়ে উস্কানি দিয়ে একে অপরের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিতে পারবেন না। সংশ্লিষ্ট বক্তব্যদাতা আলেম নিজের সিদ্ধান্তের দায়-দায়িত্ব নিজেই বহন করবেন, কোনো জামেআ’ বা অন্য কোনো সুন্নী দ্বীনী প্রতিষ্ঠানের প্রতি সম্বন্ধযুক্ত করতে পারবেন না, অথবা সেগুলোর আড়ালে লুকোতেও পারবেন না। আর প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্তৃপক্ষেরও তাতে জড়িত হওয়া বা সাফাই গাওয়া চলবে না। এটা আচরণবিধির মধ্যে পড়বে। পরামর্শক সভা সংশ্লিষ্ট আলেম বা আলেমবৃন্দের সাথে যোগাযোগ করে নিজেদের এতদসংক্রান্ত সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেবেন। অতঃপর সংশ্লিষ্ট আলেম বা আলেমবৃন্দ সূত্র বর্ণনা করে তা অনলাইনে প্রচার করবেন। তা সঠিক হলে সঠিক বলবেন, আর বিরুদ্ধে গেলেও তাই প্রচার করবেন এবং দুঃখ প্রকাশ করবেন। অন্য কেউ এই ব্যাপারে আর কটাক্ষ করতে পারবেন না; তা করলে পরামর্শক সভার প্রেস কর্মকর্তা অনলাইনে বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে তাঁকে সতর্ক করবেন।

আমার মতে এই পন্থায় অনলাইনে সুন্নীদের নিজেদের মধ্যে ফিতনা-ফাসাদ রোধ করা সম্ভব হবে। আরেকটা কথা বলা আবশ্যক, তা হলো মন্তব্য ফোরামে যারা মন্তব্য করেন, তাঁদের বেশির ভাগই অজ্ঞ লোক। তাঁদের কথায় বা গালিগালাজে মাথা গরম করে ঝগড়ায় লিপ্ত হওয়া মোটেও বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক নয়। আশা করি সবাই ফিতনা এড়িয়ে চলবেন। আমার এই পরামর্শ সুন্নী কর্তৃত্বশীলদের হৃদয়ঙ্গম হলে আমার এ প্রচেষ্টা সার্থক হবে বলে আমি মনে করি। আল্লাহ ক্ববূল করুন, আমীন।

*সমাপ্ত*
  






  

বৃহস্পতিবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২০

ক্বিরতাস্: হযরত উমর (রা:)’এর প্রতি শিয়াদের অপবাদের খণ্ডন

প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم)’এর প্রকাশ্য হায়াতে জিন্দেগীর সায়াহ্নে তিনি উপস্থিত সাহাবা কেরাম (رضي الله عنهم)’কে কাগজ-কলম আনতে বলেন। সহীহ হাদীসে এর বর্ণনা এসেছে এভাবে:

عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ، قَالَ لَمَّا اشْتَدَّ بِالنَّبِیِّ صلّی الله علیه وسلم وَجَعُهُ قَالَ ائْتُونِی بِکِتَابٍ اَکْتُب لَکُمْ کِتَاباً لَا تَضِلُّوْا بَعْدَہُ۔ قَالَ عُمَرُ اِنَّ النَّبِیَّ صلّی الله علیه وسلم غَلَبَهُ الْوَجَعُ وَعِنْدَنَا کِتَابُ اللهِ حَسْبُنَا فَاخْتَلَفُوْا وَکَثُرَ اللَّغَطُ قَالَ قُوْمُوْا عَنِّی، وَلَا یَنْبَغِیْ عِنْدِی التَّنَازُعُ

অর্থ: হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত; তিনি বলেন: যখন রাসূলুল্লাহ (صلى الله عليه وسلم)’এর অসুখ বৃদ্ধি পায়, তিনি তখন বলেন, “আমাকে একটি (লেখার) কাগজ এনে দাও এবং আমি এমন কিছু লিখবো যাতে তোমরা আর কখনো পথভ্রষ্ট না হও।” কিন্তু হযরত উমর (رضي الله عنه) বলেন, “রাসূলুল্লাহ (صلى الله عليه وسلم) গুরুতর অসুস্থ; আর আমাদের কাছে রয়েছে আল্লাহর কিতাব (ক্বুরআন) এবং সেটা আমাদের জন্যে যথেষ্ট।” কিন্তু (উপস্থিত) সাহাবায়ে কেরাম (رضي الله عنهم) এই ব্যাপারে পরস্পর ভিন্নমত পোষণ করেন, যার দরুন বেশ মতপার্থক্যপূর্ণ বাকবিতণ্ডা দেখা দেয়। এমতাবস্থায় মহানবী (صلى الله عليه وسلم) বলেন, “উঠে দাঁড়াও আমা হতে (মানে আমাকে একা থাকতে দাও)! আমার সামনে তোমাদের বাকবিতণ্ডায় লিপ্ত হওয়া উচিৎ নয়।” (সহীহ বুখারী)

এই হাদীসটি ‘ক্বিরতাসের হাদীস’ নামে বহুল পরিচিত। এটা সুন্নী ও শিয়া সম্প্রদায় দুটোর মাঝে তুমুল বিতর্কের সূত্রপাত ঘটিয়ে থাকে।

শিয়া গোষ্ঠী দাবি করে যে, প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم) কাগজ ও কলম চেয়েছিলেন যাতে তিনি হযরত আলী (رضي الله عنه)’এর পক্ষে একটি উইল লিখে দিতে পারেন এই মর্মে যে, তাঁর বেসালপ্রাপ্তির পরে হযরত আলী (رضي الله عنه)-ই হবেন ইসলামের খলীফা। তবে শিয়ারা আরো অভিযোগ করে হযরত উমর (رضي الله عنه) কাগজ-কলম আনা হতে মানুষকে বাধা দেন যাতে রাসূল (صلى الله عليه وسلم) উইলটি লিখতে না পারেন।

অপর দিকে, সুন্নী মুসলমান সমাজ দাবি করেন যে হযরত উমর ফারূক্ব (رضي الله عنه) সত্যিসত্যি প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم)’এর অসুস্থতাজনিত কষ্টে উদ্বিগ্ন ছিলেন। এই কারণেই তিনি অন্যদেরকে কাগজ-কলম আনতে বারণ করেছিলেন। তিনি চান নি নবী পাক (صلى الله عليه وسلم) আরো কষ্ট পান। সুন্নী মুসলমানবৃন্দ বিশ্বাস করেন হযরত উমর (رضي الله عنه)’এর অন্তরে (হযরত আলী’র পক্ষে লিখিত কোনো উইল গোপন করার) ওই চিন্তাভাবনার উদয়ই হয়নি।

ওপরোক্ত হাদীস হতে পরিস্ফুট হয়:

১/ এটা হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) কর্তৃক বর্ণিত;
২/ প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم) বলেন -  اَکْتُب لَکُمْ کِتَاباً لَا تَضِلُّوْا بَعْدَہُ - অর্থাৎ, “আমি লিখবো এমন কিছু, যা যথাযথভাবে অনুসরণ করলে তোমরা (আর কখনোই) পথভ্রষ্ট হবে না;”
৩/ ওই সময় অনেক মানুষ প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم)’এর ঘরে উপস্থিত ছিলেন;
৪/ হযরত উমর (رضي الله عنه) বলেন - اِنَّ رَسُولَ اللهِ صلی الله علیه وسلم قَدْ غَلَبَهُ الْوَجَعُ وَعِنْدَکُمُ الْقُرْآنُ، حَسْبُنَا کِتَابُ اللهِ - অর্থাৎ, রাসূল (صلى الله عليه وسلم) অসুখে কষ্ট পাচ্ছেন, আর তাঁদের কাছে হেদায়াতের দিশাস্বরূপ আল-ক্বুরআন বিদ্যমান;
৫/ রাসূলুল্লাহ (صلى الله عليه وسلم) অসুখে কষ্ট পাচ্ছেন, হযরত উমর (رضي الله عنه)’এর এই কথাকে উপস্থিত কেউই প্রত্যাখ্যান করেননি;
৬/ অন্যান্য রওয়ায়াত/বর্ণনায় উল্লেখিত - فَاخْتَلَفَ اَھْلُ الْبَیْتِ - উদ্ধৃতিটি (অর্থ: আহলে বায়তবৃন্দের মাঝে মতপার্থক্য দেখা দেয়) ইঙ্গিত করে যে, প্রিয়নবী ((صلى الله عليه وسلم)’এর পরিবার-সদস্যবৃন্দও এই ব্যাপারটিতে পারস্পরিক ভিন্নমত পোষণ করেছিলেন।অনেকে হযরত উমর (رضي الله عنه)’এর সাথে একমত হন, আবার অনেকে ভিন্নমত পোষণ করেন;
৭/ উপস্থিত সবাই এমন মতপার্থক্যে জড়ান যে উচ্চস্বরে বাকবিতণ্ডা হয়;
৮/ এরই ফলশ্রুতিতে প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم) সবাইকে ঘর ত্যাগ করতে আদেশ করেন এই বলে যে, আল্লাহর রাসূল (صلى الله عليه وسلم)’এর উপস্থিতিতে তর্কবিতর্ক করা শোভনীয় বা কাম্য নয়।

আমরা যদি স্বীকার করি নবী করীম (صلى الله عليه وسلم)’এর অব্যবহিত পরে হযরত আলী (رضي الله عنه)’কেই খলীফা নিযুক্ত করার জন্যে মহানবী (صلى الله عليه وسلم) লিখিত উইল করতে চেয়েছিলেন, তাহলে বোঝা যাবে সাহাবা কেরাম (رضي الله عنهم) ইচ্ছাকৃতভাবে তা মান্য করেন নি; আমাদের তখন মানতে হবে তাঁরা এ কাজ করে মিথ্যুক ও সীমালঙ্ঘনকারী সাব্যস্ত হয়েছেন (আল্লাহ মাফ করুন)! কেননা এ কাজটি হযরত আলী (رضي الله عنه)’এর প্রথম খলীফা হবার অধিকারকে খর্ব করবে, যা সাহাবা কেরাম (رضي الله عنهم)’এর পক্ষে একটা ধোকাবাজিপূর্ণ পরিকল্পনা বলে প্রতিপন্ন হবে।

বস্তুতঃ শিয়াপন্থীরা মনে করে সাহাবা কেরাম (رضي الله عنهم) প্রকৃতপ্রস্তাবে হযরত আলী (رضي الله عنه)’এর এই সম্মান জোরজবরদস্তি কেড়ে নিয়েছিলেন। আমরা যদি এই অভিযোগ স্বীকার করি, তাহলে ইসলামী বিজয় অভিযান, উন্নতি-অগ্রগতি ও খেদমতের দীর্ঘ তালিকা এবং খুলাফা আর-রাশেদীনের খেলাফত প্রতিষ্ঠার সমস্ত অর্জনই শূন্যে পরিণত হবে এবং অনৈসলামী হয়ে যাবে।

দ্বিতীয়তঃ প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم)‘এর এই বার্তা যা তিনি হযরত আলী (رضي الله عنه)’এর পক্ষে খলীফা হবার জন্যে উইল করে লিখে দিতে চেয়েছিলেন, আর যেটা মুসলমানদেরকে গোমরাহী হতে রক্ষা করবে বলে তিনি জানিয়েছিলেন, তা জেনেও শিয়া গোষ্ঠী বিচ্যুত হয়েছে কেন? তাদের তো উচিৎ ছিলো সঠিক পথে থাকা এবং বিভক্ত না হওয়া! বাস্তবতা হলো, শিয়ারা বহুধা বিভক্ত এবং এক দল আরেক দলকে জাহান্নামী বলে ফতোয়া দেয়। তাদের একটি দল এমন সীমা লঙ্ঘন করে যে তারা হযরত আলী (رضي الله عنهم)’কে খোদা জ্ঞান করে।

তৃতীয়তঃ প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم)’এর কাছে ওই সময় অন্যান্যরাও উপস্থিত ছিলেন। এ ছাড়া ছিলেন আহলে বায়ত (رضي الله عنهم)’বৃন্দও। হযরত আলী (رضي الله عنه) নিজেও ছিলেন সেখানে উপস্থিত। এমতাবস্থায় হযরত উমর ফারূক্ব (رضي الله عنه)’কে যদি রাসূল (صلى الله عليه وسلم)’এর আদেশ অমান্যকারী সাব্যস্ত করা হয়, তাহলে সেখানে উপস্থিত হযরত আলী (رضي الله عنه), আহলে বায়ত ও অসহাবে কেরাম (رضي الله عنهم) সবাইকেই একইভাবে অবাধ্যতার দোষে অভিযুক্ত করতে হবে! (আল্লাহ মাফ করুন)

অধিকন্তু, যাঁরা জানতেন প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم) হযরত আলী (رضي الله عنه)’কে খলীফা করে একটি উইল লিখতে মনস্থ করেছিলেন, তাঁরাও কাগজ-কলম না আনার দায়ে অভিযুক্ত হবেন। (আল্লাহ মাফ করুন)

সমাপ্ত

[জনৈক ভিন্ন মতাবলম্বীর লেখনীর অনুসরণে]