ব্লগ সংরক্ষাণাগার

শনিবার, ২৪ মার্চ, ২০১৮

শবে বরাতের ফযীলত সম্পর্কে মিসরীয় শায়খের বক্তব্য



মূল: শায়খ সালিম আল-সানহুরী (মিসর)
সম্পাদনা: শায়খ সালিহ আল-জাফরী (মিসর)
অনুবাদ: কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন

আরবী ও অনলাইন সেট-আপ: মুহাম্মদ রুবাইয়েৎ বিন মূসা


[”রেসালাত আল-কাশফ ওয়াল-বয়ান আন ফাযায়েলে লায়লাত আন-নিসফে মিন শাবানশীর্ষক পুস্তিকা থেকে সংগৃহীত]

ইবনে মাজাহ, ইবনে হিব্বান, আত্ তাবারানী, আদ্ দারু কুতনী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ও অন্যান্য হাদীসবেত্তা বর্ণনা করেন যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ ফরমান,

إِنَّ اللَّهَ لَيَطَّلِعُ فِي لَيْلَةِ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ فَيَغْفِرُ لِجَمِيعِ خَلْقِهِ إِلَّا لِمُشْرِكٍ أَوْ مُشَاحِنٍ.
-          আল্লাহতালা শাবান মাসের ১৫ তারিখের রাতে সবাইকে মাফ করেন, কেবল তাঁর সাথে শরীককারী ব্যক্তি ও মুসলমানদের প্রতি বিদ্বেষ ও বৈরিতা পোষণকারী ব্যক্তি (মোশায়াহিন) ছাড়া। []

আদ্ দারু কুতনী ও অন্যান্য উলেমা বর্ণনা করেন যে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ ফরমান,

يَطْلُعُ اللهُ عَلَى عِبَادِهِ لَيْلَةَ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ فَيَغْفِرُ لِلْمُؤْمِنِينَ وَيُمْهِلُ الْكَافِرِينَ، وَيَدَعُ أَهْلَ الْحِقْدِ بِحِقْدِهِمْ حَتَّى يَدْعُوهُ.
-          শবে বরাতের রাতে আল্লাহ পাক ঈমানদারদের ক্ষমা করেন এবং অবিশ্বাসীদের শাস্তি বিলম্বিত করেন; এর ব্যতিক্রম হলো (অন্তরে) আক্রোশ (হিকদ) লালনকারী ব্যক্তিবর্গ, যাদেরকে তিনি (শাস্তির মধ্যে) ছেড়ে দেবেন যতোক্ষণ না তারা আক্রোশ পরিত্যাগ করে।[২]

ইমাম আবদুল্লাহ ইবনে মোবারক রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন যে তিনি ইমাম আওযাঈ রহমতুল্লাহি আলাইহি-কেমোশায়াহিন’ (অন্তরে বিদ্বেষভাব পোষণকারী ব্যক্তিবর্গ) শব্দটির ব্যাখ্যা করতে শুনেছেন এভাবে যে,
أَرَادَ بِالْمُشَاحِنِ هَاهُنَا صَاحِبُ الْبِدْعَةِ اْلمُفَارِقِ لِجَمَاعَةِ الْأُمَّةِ.
-          ওই লোকেরা হলো বেদআতী (ধর্মে নতুন প্রথা প্রবর্তনকারী) যারা জামাআত ও উম্মাহকে ত্যাগ করেছে।

হযরত উমর ইবনে হানীবলেন,

هُوَ الْتَّارِكُ لِسُنَّةِ نَبِيِّهِ صَلَّىَ  اَللهُ عَلَيْهِ وَآَلِهِ وَسَلَّمَ اَلْطَّاعِنُ عَلَىْ أُمَّتِهِ، اَلْسَّافِكُ لِدِمَائِهِمْ.
-          আমি হযরত ইবনে সওবান রহমতুল্লাহি আলাইহি-কে মোশায়াহিন’-দের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে তিনি উত্তরে বলেন, এই ব্যক্তি মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাহকে ত্যাগ করেছে, তাঁর উম্মাহর প্রতি বিষোদগার করছে এবং তাঁদের রক্ত ঝরাচ্ছে।[৩] 

হাদীসের ভাষ্যানুযায়ী শবে বরাতকে লাইলাতুল হায়াহতথা জীবনের রাতও বলা হয়। নবী পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ ফরমান,

مَنْ أَحْيَا لَيْلَةَ الْعِيدِ، وَلَيْلَةَ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ لَمْ يَمُتْ قَلْبُهُ يَوْمَ تَمُوتُ الْقُلُوبُ
-          যে ব্যক্তি ঈদের রাত ও মধ্য-শাবানের রাতকে (এবাদত দ্বারা) জীবন্ত করে তুলবে, তার অন্তর ওই দিন মারা যাবে না যেদিন অন্তরসমূহ মারা যাবে” [হাদীসবেত্তা ইমাম মুনযিরী কর্তৃক বর্ণিত]। [৪]

এর মানে হলো, ওই পুণ্যবান ব্যক্তির অন্তর দুনিয়ার মোহে দুষ্ট হবে না, যেহেতু এর দরুন তিনি নেক আমল ও ধর্মীয় কাজে ব্যস্ত থাকবেন; কেননা, অন্য এক হাদীসে এরশাদ হয়েছে,
-          মৃতদের সাথে বসো না!

অর্থাৎ, দুনিয়ার মোহাচ্ছন্ন লোকদের এখানে মৃতবলা হয়েছে।
لَمْ يَمُتْ قَلْبُهُ يَوْمَ تَمُوتُ الْقُلُوبُ
-          অন্তরসমূহ যেদিন মারা যাবে সেদিন তার অন্তর মারা যাবে না

এই হাদীসটির অর্থ,
وَاَلْمُرَادُ بِعَدَمِ مَوْتِ قَلْبِهِ عَدْمِ تَحَيَّرهِ عِنْدَ الَنَّزْعِ وَالْقِيَامَةْ
-          তার রূহ কবজের সময় বে-ঈমান হবে না এবং পুনরুত্থান দিবসেও সে বিভ্রান্ত (পেরেশান) হবে না।

তথ্যসূত্র
[] ইবনে মাজাহ : আস সুনান, বাবু মা জাআ ফি লায়লাতিন নিসফি, ১:৪৪৫ হাদীস নং ১৩৯০।
(ক) ইবনে হিব্বান : আস সহীহ, ১২:৪৮১ হাদীস নং ৫৬৬৫।
[২] তাবারানী : আল মু‘জামুল কাবীর, মাকহূল আন আবী ছা‘লাবা, ২২:২২৩। (ক)বায়হাকী : আস সুনান আস সগীর, বাবু সাওমি ফিশ শা‘বান, ২:১২২ হাদীসনং ১৪২৬।
[৩] আত তারগীব ওয়াত তারহীব, ২:৩৯৭।
[৪] ইবনে আ‘রাবী : আল মু‘জাম, ৩:১০৪৭ হাদীস নং ২২৫২।

                                         *সমাপ্ত*

রবিবার, ১১ মার্চ, ২০১৮

আল্লাহতা’লা যে উদ্দেশ্যে বিশ্বজগৎ সৃষ্টি করেন





[এই জওয়াবটি মুফতী জাফরউদ্দীন আল-বিহারী রেযভী সাহেব কৃত ‘‘নাফিই আল-বাশার ফী ফাতাওয়ায়ে জাফরশীর্ষক ফতোওয়াগ্রন্থ থেকে সংকলিত হয়েছে। সংকলক হলেন মুহাম্মদ আকদস (যুক্তরাজ্য)। এটি রাওয়ালপিণ্ডির শায়খ রহীম বখশ সাহেবের এক প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতে প্রদত্ত, যা মুফতী সাহেব ১৩২৪ হিজরী সালের ১৫ই রজব তারিখে হাতে পান। মুফতী সাহেব ছিলেন ইমাম আহমদ রেযা খান সাহেবের প্রথম দিককার ছাত্র]

প্রশ্ন:

 لَوْ لَكَ لَماَ خَلَقْتُ الَأَفْلَكْ - হে রাসূল, আপনাকে সৃষ্টি না করলে আমি এই বিশ্বজগৎ সৃষ্টি করতাম না - এই হাদীসে কুদসী সম্পর্কে বিজ্ঞ উলামায়ে দ্বীন ও শরীয়তের মুফতীবৃন্দের অভিমত কী? এটি কোন্ হাদীসগ্রন্থে বিদ্যমান? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কারণেই সৃষ্টিকুলের উৎপত্তি হয়েছে, এ কথা কি সত্য? এই রওয়ায়াতের সমর্থনে আরও আহাদীস আছে কি?

উত্তর: হ্যাঁ, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কারণেই হযরত আদম আলাইহিস সালাম ও সমগ্র জগতের সৃষ্টি হয়েছে। তিনি না হলে আরশ ও ফরশ, লওহ ও কলম, বেহেশত ও দোযখ, গাছ ও পাথর এবং অন্যান্য সকল সৃষ্টি অস্তিত্ব পেতো না। এর সমর্থনে অনেক হাদীস বিরাজমান।

হাদীস নং-১: হাকিম নিজ মোসতাদরেক’, বায়হাকী তাঁর দালাইল আন্ নবুওয়া’, তাবরানী নিজস্ব কবীর’, আবূ নুয়াইম তাঁর হিলইয়া’, এবং ইবনে আসাকির নিজ তারিখে দিমাশকপুস্তকে উদ্ধৃত করেন হযরত আমীরুল মোমেনীন ফারুকে আযম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু-এর বাণী:

عَنْ عُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: " لَمَّا اقْتَرَفَ آدَمُ الْخَطِيئَةَ قَالَ: يَا رَبِّ أَسْأَلُكَ بِحَقِّ مُحَمَّدٍ لَمَا غَفَرْتَ لِي، فَقَالَ اللَّهُ: يَا آدَمُ، وَكَيْفَ عَرَفْتَ مُحَمَّدًا وَلَمْ أَخْلُقْهُ؟ قَالَ: يَا رَبِّ، لِأَنَّكَ لَمَّا خَلَقْتَنِي بِيَدِكَ وَنَفَخْتَ فِيَّ مِنْ رُوحِكَ رَفَعْتُ رَأْسِي فَرَأَيْتُ عَلَىَ قَوَائِمِ الْعَرْشِ مَكْتُوبًا لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ مُحَمَّدٌ رَسُولُ اللَّهِ فَعَلِمْتُ أَنَّكَ لَمْ تُضِفْ إِلَى اسْمِكَ إِلَّا أَحَبَّ الْخَلْقِ إِلَيْكَ، فَقَالَ اللَّهُ: صَدَقْتَ يَا آدَمُ، إِنَّهُ لَأُحِبُّ الْخَلْقِ إِلَيَّ ادْعُنِي بِحَقِّهِ فَقَدْ غَفَرْتُ لَكَ وَلَوْلَا مُحَمَّدٌ مَا خَلَقْتُكَ.
-     হুযূর পূর নূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন যে মহান আল্লাহ বলেছেন, আদম আলাইহিস সালাম যখন গন্দুম খেলেন, তখন তিনি আরয করেন, এয়া আল্লাহ! মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)-এর ওয়াস্তে আমায় মাফ করুন। এমতাবস্থায় আল্লাহ বলেন, ওহে আদম! তুমি কীভাবে তাঁর কথা জানলে যেহেতু আমি তাঁকে এখনো সৃষ্টি করি নি? আদম আলাইহিস সালাম উত্তর দেন, এয়া আল্লাহ! আপনি আমাকে সৃষ্টি করে আমার মাঝে রূহ ফোঁকার পরে আমি মাথা তুলে দেখতে পাই আরশে লেখা রয়েছে লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামতাই আমি বুঝতে পারি যে আপনার সবচেয়ে প্রিয় কারো নাম-ই আপনার নামের পাশে আপনি যুক্ত করেছেন। অতঃপর আল্লাহ বলেন, ওহে আদম! তুমি সত্য বলেছো। নিশ্চয় মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার সবচেয়ে প্রিয়ভাজন, আর তাই তুমি যখনই তাঁর অসীলায় আমার কাছে চেয়েছো, ৎক্ষণাৎ আমি তোমায় ক্ষমা করেছি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম না হলে আমি তোমাকে সৃষ্টি করতাম না [১]

-      হাদীস নং-২: হাকিম তাঁর মোসতাদরেকগ্রন্থে এবং আবূ শায়খ নিজ তাবকাত আল-ইসফাহানীপুস্তকে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন, যিনি বলেন:
عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا، قَالَ: «أَوْحَى اللَّهُ إِلَى عِيسَى عَلَيْهِ السَّلَامُ يَا عِيسَى آمِنْ بِمُحَمَّدٍ وَأْمُرْ مَنْ أَدْرَكَهُ مِنْ أُمَّتِكَ أَنْ يُؤْمِنُوا بِهِ فَلَوْلَا مُحَمَّدٌ مَا خَلَقْتُ آدَمَ وَلَوْلَا مُحَمَّدٌ مَا خَلَقْتُ الْجَنَّةَ وَلَا النَّارَ.
-      আল্লাহ পাক হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম-কে বলেছেন, ওহে ঈসা! প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি ঈমান আনো এবং তোমার উম্মতকেও তা করতে বলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম না হলে আমি আদমকে সৃষ্টি করতাম না, বেহেশত বা দোযখও সৃষ্টি করতাম না [২]

-   হাদীস নং-৩: ইমাম দায়লামী নিজ মুসনাদ আল-ফেরদউসকেতাবে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন, যিনি বলেন:
عَنْ اِبْنِ عَبَّاسٍ ، قَالَ : قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّىَ اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : أَتَانِيْ جِبْرِيْلُ فَقَالَ : يَا مُحَمَّدُ لَوْلاَكَ مَا خُلِقَتْ اَلجْنَة ، لَوْلاَكَ مَا خُلِقَتْ النَّار  .
-      রাসূলে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন যে হযরত জিবরীল আমীন আলাইহিস সালাম তাঁর কাছে আসেন এবং উদ্ধৃত করেন আল্লাহর বাণী, ‘আমি (খোদা স্বয়ং) আপনাকে (রাসূল-এ-পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামকে) সৃষ্টি না করলে বেহেশত বা দোযখ সৃষ্টি করতাম না [৩]

হাদীস নং-৪: ইবনে আসাকির উদ্ধৃত করেন হযরত সালমান ফারিসী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু-কে, যিনি বলেন: হযূর পূর নূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে জিবরীল আমীন আলাইহিস সালাম এসে পৌঁছে দেন আল্লাহর বাণী,
وَلَقَدْ خُلِقَتِ الدُّنْيَا وَأَهْلهَا لِأَعْرِفَهُمْ كَرَامَتُكَ وَزَادَ يُوْسُفُ عَلَيْ وَقَالَ وَمَنْزِلَتُكَ عِنْدِيْ وَلَوْلَاكَ يَا مُحَمَّدُ مَا خُلِقَتِ الدُّنْيَا.
-      (হে রাসূল) আপনার চেয়ে অধিক সম্মানিত আর কাউকেই আমি সৃষ্টি করি নি। আমি বিশ্বজগৎ ও এর মধ্যে যা কিছু আছে তার সবই সৃষ্টি করেছি যাতে তারা জানতে পারে আপনার মহান মর্যাদা সম্পর্কে। আমি এই বিশ্বজগৎ সৃষ্টি করতাম না, যদি আপনাকে সৃষ্টি না করতাম [৪]

হাদীস নং-৫: ইমাম শেহাবউদ্দীন ইবনে হাজর আসকালানী বলেন, এই সকল বর্ণনা ব্যক্ত করে যে
وَلَوْلَا مُحَمَّد مَا خلقْتُ الْجنَّة وَالنَّار. لَوْلَاكَ مَا خَلَقْتُ أَرْضِي وَلَا سَمَائِي.
-     মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে সৃষ্টি করা না হলে আল্লাহতালা আসমান-জমিন, বেহেশ্ত-দোযখ, চন্দ্র-সূর্য কিছুই সৃষ্টি করতেন না। [৫]

এই বিষয়ে আরও অনেক আহাদীস আছে যা ইমাম আহমদ রেযা খান সাহেব তাঁর তাজাল্লী আল-এয়াকীন বি আন্না নাবিই-ইয়ানা সাইয়্যেদিল মুরসালীনশিরোনামের চমৎকার গ্রন্থে সংকলন করেছেন; আর নিঃসন্দেহে সত্যপন্থী বুযূর্গানে দ্বীন ও উলামাবৃন্দ মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে হযরত আদম আলাইহিস সালাম ও বিশ্বজগত সৃষ্টির কারণহিসেবে সম্বোধন করেছেন। তাঁদের এ সব বাণী সংকলন করলে বিশালাকৃতির বই হবে। এর মধ্য থেকে কিছু বাণী উদ্ধৃত করা হলো:

উদ্ধৃতি-১: ইমাম সাইফুদ্দীন আবূ জাফর বিন উমর আল-হুমাইরী আল-হানাফী নিজ ‘আদ-দুররূল তানযীম ফী মওলিদিন্ নাবিই-ইল করীম’ শীর্ষক কেতাবে বলেন, 
-      আল্লাহতালা যখন হযরত বাবা আদম আলাইহিস সালাম-কে সৃষ্টি করেন, তখন তিনি তাঁর মনে এই ভাবের উদয় করেন যার দরুন তিনি মহান প্রভুকে প্রশ্ন করেন, ”এয়া আল্লাহ! আপনি আমার কুনিয়া (বংশ-পরম্পরার নাম) কেন আবূ মুহাম্মদ’ (মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের পিতা) করেছেন?” আল্লাহ উত্তরে বলেন, “ওহে আদম! তোমার মাথা তোলো।তিনি শির উঠিয়ে আরশে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নূর (জ্যোতি) দেখতে পান। হযরত আদম  আলাইহিস সালাম জিজ্ঞেস করেন, “এয়া আল্লাহ! এই নূর কোন্ মহান সত্তার?” আল্লাহতালা জবাবে বলেন, “তোমার বংশেই এই মহান নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জন্ম। আসমানে তাঁর নাম আহমদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) এবং জমিনে মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) আমি তাঁকে সৃষ্টি না করলে তোমাকে বা আসমান ও জমিনকে সৃষ্টি করতাম না
  
উদ্ধৃতি-২: সাইয়্যেদ আবূল হুসাইন হামদূনী শাযিলী তাঁর কাসিদায়ে দালিয়াতে লেখেন:
-      প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হলেন সারা বিশ্বজগতের মধ্যমণি এবং সকল সৃষ্টির কারণ (অসিলা)। তিনি না হলে কিছুই অস্তিত্ব পেতো না

উদ্ধৃতি-৩: ইমাম শরফউদ্দীন আবূ মোহাম্মদ বুসিরী তাঁর কৃত কাসিদা-এ-বুরদাকাব্য-পুস্তকে লেখেন,
. لولاه لم تُخْرجِ الدنيا من العـدمِ
-      রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম না হলে দুনিয়া অস্তিত্বশীল হতো না।

উদ্ধৃতি-৪: ইমাম বুসিরী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর কাব্যের ব্যাখ্যামূলক পুস্তকে ইমাম শায়খ ইবরাহীম বাইজুরী লেখেন:
-      হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অস্তিত্বশীল না হলে বিশ্বজগত-ই অস্তিত্বশীল হতো না। হযরত আদম আলাইহিস সালাম-কে আল্লাহ বলেন, ‘মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অস্তিত্বশীল না হলে আমি তোমোকে সৃষ্টি করতাম নাহযরত আদম আলাইহিস সালাম হলেন মনুষ্যজাতির আদি পিতা, আর পৃথিবীতে যা কিছু আছে সবই মানুষের জন্যে সৃষ্ট। তাই হযরত আদম আলাইহিস সালাম-কে যেহেতু রাসূলে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অস্তিত্বের কারণে সৃষ্টি করা হয়েছে, সেহেতু সমগ্র জগতই মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কারণে সৃষ্ট বলে প্রতীয়মান হয়। অতএব, সকল অস্তিত্বশীল সত্তার সৃষ্টির কারণ হলেন বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম

উদ্ধৃতি-৫: কাসিদা-এ-বুরদা কাব্য সম্পর্কে আল্লামা খালেদ আযহারী মন্তব্য করেন:
-      রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কারণেই দুনিয়া অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্ব পেয়েছে।

উদ্ধৃতি-৬: মোল্লা আলী কারী লেখেন,  
-      রাসূলুল্লাহ  সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আশীর্বাদ ও মহত্ত্ব ছাড়া সমগ্র এই বিশ্বজগৎ অস্তিত্ব পেতো না এবং আল্লাহ ছাড়া কিছুই অস্তিত্বশীল থাকতো না।

উদ্ধৃতি-৭: আল্লামা আবূল আয়াশ আবদুল আলী লাখনৌভী নিজ ফাওয়াতিহ আর-রাহমূত শরহে মোসাল্লাম আস্ সুবূতপুস্তকে লেখেন:
-      রাসূলে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অস্তিত্বশীল না হলে সৃষ্টিকুল আল্লাহর রহমত-বরকত (আশীর্বাদ)-ধন্য হতো না।

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সৃষ্টিকুলের অস্তিত্বের মূল, এই প্রতিপাদ্য বিষয়ের সত্যতা ও প্রামাণিকতা সম্পর্কে বিতর্ক একমাত্র মূর্খ লোকেরাই করতে পারে। হুযূর পূর নূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কারণেই আল্লাহ পাক সমগ্র বিশ্বজগৎ সৃষ্টি করেন।

তথ্যসূত্র:

[১] হাকিম : আল মুস্তাদরাক, ও মিন কিতাবি আয়াতি রাসূলিল্লাহ, :৬৭২ হাদীস নং ৪২২৮।
(ক) বায়হাকী : দালায়িলুন নবুওয়াত, ৫:৪৮৯
(খ) ইবনে আসাকীর : তারিখে দামেশক, ৭:৪৩৭
  (গ) ইমাম সুবকী : আশ্ শিফাউস্ সিকাম
(ঘ) শেহাবউদ্দীন খাফাজী : নাসীম আর-রিয়াদ
[২] হাকিম : আল মুস্তাদরাক, :৬৭১ হাদীস নং ৪২২৭
(ক) ইমাম সুবকী : আশ্ শিফাউস্ সিকাম
 (খ) আল-বুলকিনী : আল ফাতওয়া।
(গ) ইবনে হাজর : আফদাল আল-কুরআন
 [৩] দায়লামী : আল ফিরদাউস বি মাছূরিল খিতাব, বাবুল ইয়া, :২২৭ হাদীস নং ৮০২৯
[৪] ইবনে আসাকির : তারিখে দামেস্ক, বাবু যিকরি উরুযিহি ইলাস সামায়ি, :৫১৮।
[৫] ইবনে হাজর হায়ছামী : আল ফাতওয়া আল হাদীছা, :১৩৪

                                              --
সমাপ্ত--

[Bengali translation of Muhammad Aqdas' online article 'The reason why Allah created the Universe']

লেখক: মুহাম্মদ আক্বদাস্ (যুক্তরাজ্য)
অনুবাদ: কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন
আরবী ও অনলাইন সেট-আপ: মুহাম্মদ রুবাইয়েৎ বিন মূসা