ব্লগ সংরক্ষাণাগার

সোমবার, ২৪ ডিসেম্বর, ২০১৮

মহিলাদের দ্বারা মাযার যেয়ারতের পক্ষে প্রমাণ

মূল: ড: জি, এফ, হাদ্দাদ
অনুবাদ: এডমিন

[Bengali translation of Dr G.F. Haddad's online article "Proofs for visitation of Graves by Women." Translator: Admin]
 “সবচেয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত হলো, মহিলাদের জন্যে মাযার-রওযা যেয়ারতের রুখসাতের তথা (বিধান) প্রয়োগের বিষয়টি দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত।” - ইমাম ইবনে আবেদীন শা’মী [নোট-১: ইবনে আবেদীন কৃত ‘হা’শিয়া’ (১৩৮৬ হিজরী/১৯৬৬ খৃষ্টাব্দ সংস্করণ, ২:২৪২)]

শায়খ সাইয়্যেদ ইঊসুফ হা’শিম আল-রেফাঈ (রহমতুল্লাহে আলাইহে যিনি কুয়েতের সাবেক তেলমন্ত্রী ছিলেন, তিনি) তাঁর প্রণীত ‘আমাদের নজদী উলামা ভাইদের প্রতি নসীহত’ শীর্ষক পুস্তিকায় (ড: হাদ্দাদ কর্তৃক ইংরেজি ভাষান্তরিত) বলেন: “আপনারা মতৈক্যভিত্তিক স্পষ্ট ও মীমাংসাকারী শরঈ দলিল ছাড়াই মহিলাদেরকে পবিত্র বাক্বী’ (কবরস্থান) যেয়ারত করতে নিষেধ করেন!”

নিচের আলোচনায় খোদায়ী বিধিবিধানের মৌলনীতি (উসূল) ও সুন্নাহর দালিলিক প্রমাণ অনুসারে বাক্বী’ কবরস্থান যেয়ারতের অনুমতি প্রদর্শন করা হবে।

মহিলাদের দ্বারা মাযার-রওযা যেয়ারতের প্রতি যারা আপত্তি উত্থাপন করেন, তারা মূলতঃ তিনটি হাদীসকে নিজেদের প্রমাণ হিসেবে পেশ করে থাকেন; এগুলোর মধ্যে দুটি আবার যঈফ (দুর্বল সনদের) হাদীস: (ক) “আল্লাহ সে সমস্ত নারীদের প্রতি লা’নত/অভিসম্পাত দেন যারা মাযার/রওযা যেয়ারত করে” لعن الله زائرات القبور [নোট-২: হযরত আবূ হোরায়রাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে দুর্বল সনদে ইবনে হিব্বান নিজ ‘সহীহ’ ৭:৪৫২ #৩১৭৮ পুস্তকে বর্ণিত; কেননা উমর ইবনে আবী সালামা ইবনে আবদির রাহমান দুর্বল, যেমনটি উল্লেখ করেছেন আল-আরনা’উত ও মা’রূফ ‘তাহরীর আল-তাক্বরীব’ ৩:৭৪ #৪৯১০ গ্রন্থে। আরো এসেছে দুর্বল সনদে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) হতে হযরত হাসান বিন সাবেত (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’এর সূত্রে ইবনে আবী শায়বা (৩:৩১)’তে; কেননা এতে জনৈক বর্ণনাকারী আবদুর রাহমান ইবনে বাহমান হচ্ছেন মাজহূল তথা অপরিচিত। তবে খোদ হাদীসটি গ্রহণযোগ্য, যেহেতু এটা ‘হাসান লি-গায়রিহি’ তথা ‘সাক্ষী ও সমর্থনকারী সনদ এবং বিবরণসমূহের কারণে হাসান পর্যায়ের’, যেমনটি বিবৃত করেন আল-আরনা’উত ‘মুসনাদ’ ৫:১২৮ নং ২ পুস্তকে]; এবং (খ) “আল্লাহ সেসব নারীর প্রতি অভিসম্পাত দেন যারা কবর যেয়ারত করে এবং সেগুলোকে এবাদতের ও প্রদীপ/মোমবাতির স্থান হিসেবে গ্রহণ করে” لعن زائرا القبور، والمتخذين عليها المساجد والسرج [নোট-৩: হযরত ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে ইমাম তিরমিযী (রহ:)-বর্ণিত (হাসান পর্যায়ের) এবং আবূ দাউদ ও আল-নাসাঈ বর্ণিত ‘আল-সুনান’ ও আল-সুনান আল-কুবরা’ গ্রন্থ দুটোতে (১:৬৫৭ #২১৭৪), ইমাম আহমদ, ইবনে আবী শায়বাহ (২:১৫১, ৩:৩০), আল-তাহাবী কৃত ‘শরহু মুশকিল আল-আসা’র’ (১২:১৭৮-১৭৯ #৪৭৪১-৪৭৪২), আল-বাগাবী ‘শরহুস্ সুন্নাহ’ (২:৪১৬-৪১৭ #৫১০), ইবনে হিব্বান (৭:৪৫২-৪৫৪ #৩১৭৯-৩১৮০), অাল-হাকিম (১৯৯০ সংস্করণের ১:৫৩০) যিনি এটার দুর্বলতা ইঙ্গিত করেন, আল-বায়হাক্বী ‘আল-সুনান আল-কুবরা’ (৪:৭৮ #৬৯৯২), ইবনে আল-জা’আদ নিজ ‘মুসনাদ’ গ্রন্থে (২২৪ পৃষ্ঠায়), আল-তাবারানী ‘আল-কবীর’ (১২:১৪৮) পুস্তকে, এবং আল-হায়তামী ‘মাওয়ারিদ আল-যামআন (২০০ পৃষ্ঠায়) - এগুলোর সব একই দুর্বল সনদে বর্ণিত, যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন আবূ সালেহ মওলা উম্মে হানী, যাকে দুর্বল বলেছেন ইবনে হাজর, যেমনটি উদ্ধৃত করেছেন আল-মুনযিরী নিজ ‘আল-তারগীব’ পুস্তকে (১৯৯৭ সংস্করণের ৪:১৯০) এবং অাল-অারনা’উত ‘সহীহ ইবনে হিব্বান’ ও ‘মুসনাদ’ (৫:১২৮ #২৯৮৪) পুস্তকে। তবে হাদীসটি স্বয়ং গ্রহণযোগ্য, কেননা আল-তিরমিযী ও আল-বাগাবী এটাকে ‘হাসান’ পর্যায়ের বলে ঘোষণা করেছেন; অধিকন্তু ইবনে আল-সাকান এটাকে সহীহ হাদীসের অন্তর্ভুক্ত করেন, যেমনটি বিবৃত করেন ইবনে মুলাক্কিন ‘তোহফাতুল মোহতাজ’ (২:৩১) পুস্তকে]; তৃতীয় হাদীসটি - (গ) “অাল্লাহ ওই নারীদের প্রতি অভিসম্পাত দেন যারা ঘনঘন কবর যেয়ারত করে” لعن الله زوارات القبور [নোট-৪: হযরত আবূ হোরায়রাহ রাদ্বিয়াল্লাহু হতে আল-তিরমিযী (হাসান সহীহ), ইবনে মাজাহ ও আহমদ; হযরত ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে আবূ সালিহ’র কারণে দুর্বল সনদে ইবনে মাজাহ; এবং হযরত হাসান বিন সাবিত রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে আবদুর রাহমান ইবনে বাহমানের কারণে দুর্বল সনদে ইবনে মাজাহ ও আহমদ। নোট: ইবনে মাজাহ’র সংস্করণে زوارات উল্লেখিত হয়েছে]।

শায়খ রেফাঈ (রহ:)’র কথানুযায়ী ওপরের বিবরণগুলো ইসলামে মহিলাদের দ্বারা মাযার-রওযা যেয়ারত নিষেধকারী ‘মতৈক্যভিত্তিক স্পষ্ট ও মীমাংসাকারী শরঈ দলিল হিসেবে সাব্যস্ত হয় না।’ সেই অনুযায়ী সংখ্যাগরিষ্ঠ উলামা ঐকমত্য পোষণ করেন যে মহিলাদের দ্বারা মাযার/রওযা যেয়ারত করা জায়েয, যদি প্রলোভন ও পাপের বিপদ বর্তমান না থাকে [নোট-৫: যেমনটি বর্ণিত হয়েছে ইবনে হাজরের ‘ফাতহুল বারী’ (১৯৫৯ সংস্করণের ৩:১৪৮) পুস্তকে, আল-শওকানীর ‘নায়ল আল-আওতার’ (জানায়েয ও কবর সংক্রান্ত ফতোয়া অধ্যায়গুলো), এবং আল-মোবারকপুরীর ‘তোহফাতুল আহওয়াযী (৪:১৩৯)]

উপরোল্লিখিত বক্তব্য নিম্নের প্রামাণ্য দলিল দ্বারা সুপ্রতিষ্ঠিত:

১/ - প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) এরশাদ ফরমান - كنت نهيتكم عن زيارة القبور ألا فزوروها অর্থাৎ, “আমি তোমাদেরকে প্রাথমিক যুগে কবর যেয়ারত করতে নিষেধ করতাম; এখন তোমরা কবর যেয়ারত করো” [নোট-৬: একটি দীর্ঘ হাদীসের অংশ হিসেবে বর্ণনা করেন হযরত বোরায়দা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে ইমাম মুসলিম (রহ:), আল-তিরমিযী حسن صحيح (হাসান সহীহ), আবূ দাউদ, নাসাঈ, আবদুর রাযযাক্ব (৩:৫৬৯) ও অন্যান্যরা; হযরত আবূ সাঈদ আল-খুদরী (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে সহীহ সনদে ইমাম আহমদ (রহ:), যেমনটি বিবৃত করেছেন আল-হায়তামী (৩:৫৮), মালেক (রহ:), আল-হাকিম (১৯৯০ সংস্করণের ১:৫৩১) যিনি ইমাম মুসলিমের মানদণ্ডে এটাকে সহীহ বলেছেন, আল-বায়হাক্বী কৃত ‘আল-সুনান আল-কুবরা’ (৪:৭৭ #৬৯৮৪), এবং সহীহ সনদে আল-বাযযার, যেমনটি উল্লেখ করেছেন আল-হায়তামী (৩:৫৮); হযরত ইবনে মাসউদ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে ইবনে মাজাহ, আদ-দারাক্বুতনী নিজ ‘সুনান’ (৪:২৫৯) পুস্তকে, আবদুর রাযযাক্ব (৩:৫৭২-৫৭৩), ইবনে হিব্বান (৩:২৬১), আল-হাকিম (১৯৯০ সংস্করণের ১:৫৩১) এবং আল-বায়হাক্বী নিজ ‘আল-সুনান আল-কুবরা’ (৪:৭৭ #৬৯৮৩), যা আল-আরনাউতের মতানুসারে (এ সূত্রের) সবগুলোই দুর্বল সনদের; হযরত আনাস (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে ইমাম আহমদ ও আল-বাযযার, যাঁদের এসনাদে রয়েছেন আল-হারিস ইবনে নাবহান যিনি আল-হায়তামী (৪:২৭), আল-হাকিম (১৯৯০ সংস্করণের ১:৫৩১-৫৩২) ও আল-বায়হাক্বী (সুনানে কুবরা ৪:৭৭ #৬৯৮৪)’র দৃষ্টিতে দুর্বল বর্ণনাকারী]। এই নিঃশর্ত অনুমতি স্রেফ পুরুষদের জন্যে খাস তথা সুনির্দিষ্ট করার পক্ষে কোনো প্রামাণ্য দলিল-ই নেই।

২/ - হযরত আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা বলেন: “রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) কবর যেয়ারত নিষেধ করেন; অতঃপর এর অনুমতি দেন। আর আমার মনে হয় তিনি বলেছিলেন, ‘নিশ্চয় কবর যেয়ারত তোমাদেরকে আখেরাতের কথা স্মরণ করিয়ে দেবে’ [নোট-৭: আল-বাযযার কর্তৃক নির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারীদের সহীহ সনদে বর্ণিত, যেমনটি বিবৃত করেন আল-হায়তামী (৩:৫৮); বঙ্গানুবাদকের নোট: মুসলিমে অন্য সূত্রে বর্ণিত আরেকটি হাদীসের এবারতে এসেছে এভাবে - فإنها تذكركم الآخرة]।” হযরত মা আয়েশা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা)’র অনুশীলিত রীতি ও অন্যান্য মন্তব্য নিশ্চিত করেছে যে তিনি প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’র এই আজ্ঞাকে নিঃশর্ত জানতেন।

৩/ - হযরত আয়েশা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা) তাঁর ভাইয়ের ইন্তেক্বালের পরে মক্কা শরীফে এসে জিজ্ঞেস করেন, “আমার ভাইয়ের কবর কোথায় অবস্থিত?” তিনি কবরে গিয়ে সেখানে দুআ পাঠ করেন; আর এই ঘটনাটি তাঁর ভাইয়ের ইন্তেকালের এক মাস পরের [নোট-৮: ইবনে আবী মুলায়কা হতে বর্ণনা করেন আল-বায়হাক্বী নিজ ‘আল-সুনান আল-কুবরা (৪:৪৯) গ্রন্থে]। আরেকটি ভাষ্যে ইবনে আবী মুলায়কা বলেন, “হযরত আয়েশা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা)’র ভাই মক্কা শরীফ হতে ছয় মাইল দূরে ইন্তেক্বাল করেন; তাই আমরা তাঁকে বহন করি যতোক্ষণ না মক্কা শরীফে পৌঁছুই এবং তাঁকে সেখানে দাফন করি। অতঃপর হযরত আয়েশা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) আমাদের কাছে আসেন এবং আমাদেরকে ওরকম করার জন্যে তিরস্কার করেন। এরপর তিনি জিজ্ঞেস করেন, ‘আমার ভাইয়ের কবর কোথায় অবস্থিত?’ আমরা তাঁকে তা প্রদর্শন করলে তিনি তাঁর হাওদা (সওয়ার) থেকে নামেন এবং তাঁর ভাইয়ের কবরে (দাঁড়িয়ে) দুআ করেন” [নোট-৯: আবদুর রাযযাক্ব (৩:৫১৮) ও ইবনে আবদিল বার্র কর্তৃক নিজ ‘আল-তামহীদ’ (৬:২৬১) গ্রন্থে বর্ণিত]

৪/ - আবুদুল্লাহ ইবনে আবী মুলায়কা যখন হযরত আয়েশা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা)’কে তাঁর ভাই আবদুর রাহমানের মাযার যেয়ারত করতে দেখেন, তখন তিনি তাঁকে জিজ্ঞেস করেন: “প্রিয়নবী (দ:) কি এটা (মানে যেয়ারত) নিষেধ করেননি?” তিনি উত্তর দেন: “হ্যাঁ, তিনি নিষেধ করেছিলেন (প্রাথমিক যুগে); অতঃপর সেগুলোর যেয়ারত করতে আদেশ করেন” [নোট-১০: এটা সহীহ সনদে বর্ণনা করেন আবূ এয়ালা (৮:২৮৪), আল-হাকিম (১৯৯০ সংস্করণের ১:৫৩২), আল-বায়হাক্বী নিজ ‘আল-সুনান আল-কুবরা’ (৪:৭৮ #৬৯৯৩), এবং ইবনে আব্দিল বার্র নিজ ‘আল-তামহীদ’ (৩:২৩৪) পুস্তকে]। ইবনে আবদিল বার্র উল্লেখ করেন যে ইমাম আহমদ (রহ:) এই বর্ণনাকে মহিলাদের দ্বারা মাযার যেয়ারতের পক্ষে দলিল হিসেবে সাব্যস্ত করেন [নোট-১১: ইবনে আবদিল বার্র কৃত ‘আল-তামহীদ’ (৩:২৩৪)]

ওপরে উদ্ধৃত রওয়ায়াত/বর্ণনাগুলোতে মহানবী (দ:) ও তাঁর সাহাবা-এ-কেরাম (রা:)’এর ব্যবহৃত বাক্য ও ক্রিয়ার কাল প্রতীয়মান করে যে এসব বিবরণ সুস্পষ্টভাবে নিষেধাজ্ঞা প্রকাশক বর্ণনাগুলোকে রহিত করে দিয়েছে। এটা আল-হাকিম নিশ্চিত করেন, যিনি বর্ণনা করেন নিম্নের হাদীসটি: “আল্লাহ সেসব নারীকে অভিসম্পাত দেন যারা ঘনঘন কবর যেয়ারত করে।” অতঃপর আল-হাকিম বলেন: “মাযার/রওযা যেয়ারত নিষেধকারী এ সমস্ত হাদীস রহিত হয়ে গিয়েছে; আর রহিতকারী হাদীসটি বর্ণনা করেছেন আলক্বামা ইবনে মারতাদ, যিনি তা গ্রহণ করেছেন সুলায়মান ইবনে বোরায়দা হতে, তিনি তাঁর পিতা হতে, তিনি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) হতে, যিনি এরশাদ ফরমান: ‘আমি তোমাদেরকে কবর যেয়ারত করতে নিষেধ করেছিলাম; কিন্তু এখন তোমরা তা যেয়ারত করো’ [নোট-১২: আল-হাকিম (১৯৯০ সংস্করণ ১:৫৩০)]।”

৫/ - (শরীয়তের বিধিবিধান মানার ক্ষেত্রে) হযরত আয়েশা সিদ্দীক্বা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা)’র দৃঢ়তার কারণে এবং হয়তো ইবনে আবী মুলায়কা’র কথার সমর্থনের দরুন তিনি তাঁর ভাই আবদুর রহমানের কবর যেয়ারত করাটা অপছন্দ করতেন, যেমনটি প্রতীয়মান হয় আল-তিরমিযী’তে উদ্ধৃত তাঁর এতদসংক্রান্ত বক্তব্য হতে; তিনি বলেন: “আমি আপনার ইন্তেক্বালের সময় উপস্থিত থাকলে আমি কখনোই (মানে এখন) আপনার কবর যেয়ারত করতাম না” [নোট-১৩: আবদুল্লাহ ইবনে মুলায়কা হতে আল-তিরমিযী বর্ণিত]। অথচ এটা আরেকটা প্রামাণিক দলিল এ মর্মে যে তিনি প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’র ওই (মাযার যেয়ারতের) নিষেধাজ্ঞাকে নিঃশর্ত বলে জানতেন না - তা যদি রহিত না হতো; কেননা তিনি এতদসত্ত্বেও তাঁর ভাইয়ের কবর যেয়ারত করেছিলেন।

৬/ - একবার মহানবী (দ:) জনৈক মহিলার পাশ দিয়ে অতিক্রম করছিলেন, যিনি একটি কবরের পাশে কান্নাকাটি করছিলেন। হুযূর পাক (দ:) তাঁকে বলেন: “আল্লাহকে ভয় করো এবং দৃঢ়/অটল থাকো।” ওই মহিলা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’কে চিনতে না পেরে উত্তর দেন: “আমায় একান্তে থাকতে দিন!” অতঃপর তাঁকে জানানো হয় উনি মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)। মহিলা হুযূরে পাকের (দ:) দর্শনার্থী হতে আসেন এবং দরজায় কাউকে না পেয়ে (সরাসরি প্রবেশ করে) বলেন: “আমি আপনাকে চিনতে পারিনি, (এয়া রাসূলাল্লাহ)!” তিনি উত্তর দেন: “দৃঢ়তা প্রথমবার শোকাহতের সময় হতেই” [নোট-১৪: হযরত আনাস (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে সিহাহ সিত্তা/ছয়টি বিশুদ্ধ হাদীসগ্রন্থে]। মহিলাদের যদি মাযার-রওযা যেয়ারতে নিষেধই করা হতো, তাহলে মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) ওই মহিলাকে প্রথমবারেই তা করা হতে বারণ করতেন।

৭/ - হযরত আয়েশাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা) বলেন: “(বাক্বী কবরস্থানে) আমি কী বলবো, এয়া রাসূলাল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)?” হুযূর পাক (দ:) উত্তর দেন: “বলো: ওহে কবরবাসী ঈমানদার নর-নারী, আপনাদের প্রতি সালাম তথা শান্তি বর্ষিত হোক! আল্লাহ আপনাদের মতো পূর্ববর্তীদের প্রতি এবং আমাদের মতো পরবর্তীদের প্রতি তাঁর অনুগ্রহ মঞ্জুর করুন। নিশ্চয় আল্লাহর ইচ্ছায় আমরা আপনাদের সাথেই মিলিত হবো” [নোট-১৫: মুসলিম ও নাসাঈ বর্ণিত একটি দীর্ঘতর হাদীসের অংশ]

আল-বায়হাক্বী, ইবনে হাজর ও আল-নববী বলেন ওপরের বর্ণনাগুলো পরিদৃষ্ট করে যে, হযরত আয়েশাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা) কর্তৃক তাঁর ভাইয়ের কবর যেয়ারতের সমর্থনে মহিলাদের দ্বারা মাযার-রওযা যেয়ারত অনুমতিপ্রাপ্ত/জায়েয; কেননা মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) ওই শোক প্রকাশকারিনী মহিলাকে কেবল দৃঢ় হতে আদেশ দিয়েছিলেন, কবর যেয়ারত করতে নিষেধ করেননি। আর তিনি হযরত আয়েশা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা)’কে কবর যেয়ারতের সময় কী বলতে হবে, তা-ও শিক্ষা দিয়েছিলেন। [নোট-১৬: আল-বায়হাক্বী, ‘আল-সুনান আল-কুবরা’, (৪:৭৮); ইবনে হাজর, ‘ফাতহুল বারী’, (১৯৫৯ সংস্করণের ৩:১৮৪); আল-নববী, ‘শরহু সহীহ মুসলিম’ (৭:৪১-৪২)]

৮/ - প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) এরশাদ করেন: “আমি তোমাদেরকে কবর যেয়ারত করতে নিষেধ করেছিলাম, কিন্তু মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’কে তাঁর মায়ের কবর যেয়ারত করার অনুমতি দেয়া হয়েছে। অতএব, তোমরা কবর (মাযার/রওযা) যেয়ারত করো, কেননা নিশ্চয় তা তোমাদেরকে আখেরাতের কথা স্মরণ করিয়ে দেবে।” [নোট-১৭: হযরত বুরায়দা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে আল-তিরমিযী বর্ণিত (হাসান সিহীহ হিসেবে)]

৯/ - আরেকটি ভাষ্যে এভাবে এসেছে: “আমি তোমাদেরকে কবর যেয়ারত করতে নিষেধ করতাম; কিন্তু এখন থেকে যেয়ারত করো; কেননা তা আখেরাতের কথা কাউকে স্মরণ করিয়ে দেয়।” [নোট-১৮: হযরত বুরায়দা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে ইমাম আহমদের বর্ণিত একটি দীর্ঘতর হাদীসের অংশ]

১০/ - অপর একটি সংস্করণে বিবৃত হযেছে: “যে কেউ কবর যেয়ারত করতে চাইলে সে তা করতে পারবে; কেননা নিশ্চয় তা আখেরাতের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।” [নোট-১৯: হযরত বুরায়দা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে আল-নাসাঈ বর্ণিত একটি দীর্ঘতর হাদীসের অংশ]

১১/ - আরেকটি এবারতে এসেছে: “আমি তোমাদেরকে কবর যেয়ারত করতে নিষেধ করতাম; কিন্তু এখন থেকে যেয়ারত করো। কেননা তা দুনিয়াকে প্রত্যাখ্যান করতে সহায়তা করে এবং আখেরাতের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।” [নোট-২০: হযরত ইবনে মাসউদ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে ইবনে মাজাহ বর্ণিত হাদীস]

১২/ - অপর এক ভাষ্যে বিবৃত হয়েছে: “আমি তোমাদেরকে কবর যেয়ারত করতে নিষেধ করেছিলাম; অতঃপর আমার কাছে প্রতীয়মান হয়েছে যে তা অন্তরকে নরম করে, চোখে পানি আনে, আর পরকালের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। অতএব, তোমরা কবর যেয়ারত করো, কিন্তু গর্হিত কথাবার্তা (সেখানে) বোলো না!” [নোট-২১: হযরত আনাস (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে ইমাম আহমদ বর্ণিত দীর্ঘতর হাদীসের অংশ বিশেষ]

১৩/ - এই বিষয়টি প্রতিষ্ঠিত যে প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) হযরত উসমান ইবনে মায’উন (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’এর মাযারের ওপর একটি পাথর (ফলক) স্থাপন করে বলেন: “এর দ্বারা আমি আমার (দুধ-) ভাইয়ের কবর চিহ্নিত করবো এবং পরবর্তীকালে আমার আত্মীয়-স্বজনের কেউ ইন্তেক্বাল করলে এখানেই তাকে দাফন করবো।” [নোট-২২: নাম না জানা এক সাহাবী (রা:) হতে ‘হাসান সহীহ’ সনদে বর্ণনা করেছেন আবূ দাউদ ও আল-বায়হাক্বী নিজ ‘আল-কুবরা’ পুস্তকে (৩:৪১২); দেখুন ইবনে হাজর কৃত ‘তালখীস আল-হাবীর’ (২:১৩৪); ইবনে আল-মুলাক্কিন প্রণীত ‘তোহফাতুল মোহতাজ’ (২:২৯); এবং ইবনে আল-কাইয়্যেম জাওযিয়্যার রচিত ‘যাআদ আল-মাআদ’ (১:৫০৬) গ্রন্থের আল-আরনা’উত সংস্করণ। হাদীসটির পুরো বিবরণে ব্যক্ত হয়েছে যে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) জনৈক ব্যক্তিকে হযরত ইবনে মাযউন (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’এর মাযারের ওপর (ফলক চিহ্ন হিসেবে) একটি পাথর স্থাপন করতে বলেন; যখন ওই ব্যক্তি পাথরটি নড়াতে অক্ষম হন, তখন হুযূর পাক (দ:) নিজের জামার আস্তিন গুটিয়ে তাঁকে সাহায্য করেন, আর এমতাবস্থায় তাঁর ধবধবে সাদা হাত দৃশ্যমান হয়। মুহাজির সাহাবাবৃন্দের (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম) মধ্যে হযরত ইবনে মাযউন (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)-ই ছিলেন প্রথম, যাঁকে বাক্বী আল-গারক্বাদে দাফন করা হয়। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’র পুত্র ইবরাহীম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’কে তাঁর পাশে দাফন করা হয়] 

ওপরে উদ্ধৃত পাঁচটি রওয়ায়াত তথা বিবরণে মহিলাদের দ্বারা মাযার/রওযা যেয়ারতের সপক্ষে প্রমাণ পাওয়া যায় এই মর্মে যে, আখেরাতের স্মরণ, কান্নাকাটি ও অন্তর নরম হওয়ার মতো ইতিবাচক প্রভাবগুলো স্রেফ পুরুষদের জন্যেই খাস্ বা সীমাবদ্ধ করা হয়নি, বরং তা মহিলাদের জন্যেও বিস্তৃত করা হয়েছে। অতএব, এসব বিবরণ মহিলাদেরকেও উদ্দেশ্য করেছে, যা সার্বিকভাবে গ্রহণীয়। এটা প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’র কন্যা হযরত মা ফাতিমা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা)’র আচরিত রীতি দ্বারাও সমর্থিত, যেমনটি প্রতীয়মান হয়েছে নিচের দুটো বর্ণনায়:

১৪/ - ইমাম জা’ফর সাদিক্ব (রহমতুল্লাহে আলাইহে) নিজ এসনাদে বর্ণনা করেন ইমাম হাসান ইবনে আলী (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে এই মর্মে যে, হযরত মা ফাতেমা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা) প্রতি জুমুআ-বার [নোট-২৩: জা’ফর ইবনে মুহাম্মদ হতে, তিনি তাঁর বাবা হতে; ইমাম হাসান (রা:)’এর উল্লেখ ছাড়া আবদুর রাযযাক্ব কর্তৃক বর্ণিত (৩:৫৭২) যা মুনক্বাতী’ তথা সনদ কাটা] রাসূলুল্লাহ (দ:)’এর চাচা হযরতে আমীরে হামযা ইবনে আবদিল মুত্তালিব (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’এর মাযার যেয়ারত করতেন; আর তিনি সেখানে দুআ করতেন এবং কাঁদতেনও [নোট-২৪: হাকিম (১৯৯০ সংস্করণের ১:৫৩৩, ৩:৩০) কর্তৃক বর্ণিত, যিনি এটাকে সহীহ বলেছেন; আল-বায়হাক্বী কৃত ‘আল-সুনান আল-কুবরা’ (৪:৭৮), এবং ইবনে আবদ আল-বার্র রচিত ‘আল-তামহীদ’ (৩:২৩৪), যদিও আল-যাহাবী এটাকে তীব্রভাবে নাকচ করেন এবং আল-বায়হাক্বী এটার দুর্বলতার প্রতি ইঙ্গিত করেন]। আরেকটি ভাষ্যে এসেছে যে হযরত ফাতেমা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা) ওই মাযারকে চেনার জন্যে একটি পাথর দ্বারা চিহ্নিত করেন [নোট-২৫: আল-আতরাম ও ইবনে আবদ আল-বার্র এটা বর্ণনা করেন, যেমনটি উল্লেখ করেছেন আল-ক্বুরতুবী নিজ ‘তাফসীর’ গ্রন্থে (১০:৩৮১); একটি দুর্বল সনদে আবদুর রাযযাক্ব-ও (৩:৫৭৪), কেননা বর্ণনাকারী হিসেবে আল-আসবাগ ইবনে নুবাতা প্রত্যাখ্যাত (মাতরূক্ব)]। অপর এক ভাষ্যে বিবৃত হয়েছে যে হযরত মা ফাতেমা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা) ওই মাযার শরীফ রক্ষণাবেক্ষণ করতেন এবং প্রয়োজনে মেরামতও করতেন। [নোট-২৬: আল-হাকিম তিরমিযী, ‘নওয়া’দিরুল উসূল’ (আসল ১৫)]

১৫/ - মহিলাবৃন্দ হযরত রোক্বাইয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা)’র বেসালপ্রাপ্তিতে কান্নাকাটি করছিলেন; এমতাবস্থায় হযরত উমর ফারূক্ব (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) তাঁদেরকে নিষেধ করতে চান। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) তাঁকে বলেন, “অপেক্ষা করো, হে উমর!” অতঃপর তিনি বলেন: “(মহিলারা), শয়তানের কর্কশ আওয়াজ সম্পর্কে সতর্ক হও! যতোক্ষণ এটা (মানে কান্নাকাটি) চোখ ও অন্তর হতে নির্গত হয়, তা (খোদায়ী) রহমত বা করুণা হতে আগত; আর যখন এটা জিহ্বা ও হাত হতে প্রকাশিত হয় [নোট-২৭: অভিসম্পাত এবং আরব খৃষ্টান ও অমুসলমানদের দ্বারা আজো আচরিত শোকজ্ঞাপক গাল-চাপড়ানোর প্রথার প্রতি উদ্দিষ্ট], তা শয়তান হতে আগত।” এমতাবস্থায় হযরত মা ফাতেমা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা) হযরত রোক্বাইয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা)’র কবরে কাঁদতে আরম্ভ করেন এবং হযরত রাসূলে পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) তাঁর পবিত্র মুখমণ্ডল হতে অশ্রু নিজ মোবারক হাত দ্বারা মুছে দেন; অথবা বর্ণনাকারী বলেন, তাঁর মোবারক বাহু দ্বারা মুছে দেন। [নোট-২৮: হযরত ইবনে আব্বাস (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে ইমাম আহমদ বর্ণিত; আল-তায়ালিসী (২:৩৫১) ও আল-বায়হাক্বী কৃত ‘আল-সুনান আল-কুবরা’ (৪:৭০ #৬৯৪৬) যার এসনাদে রয়েছেন আলী ইবনে যায়দ ইবনে জুদান। আল-বায়হাক্বী এই হাদীসটিকে সহীহ বিবেচনা করেন, কেননা এটা সহীহ বিবরণসমূহ দ্বারা নিশ্চিত হয়েছে। একই এসনাদে এটা আংশিকভাবে বর্ণনা করেছেন আল-হাকিম (৩:১৯০; ১৯৯০ সংস্করণের ৩:২১০), যেখানে আল-যাহাবী বলেন: “এই সনদটি সালেহ তথা গৃহীত;’ তবে তাঁর ‘মীযান’ (৩:১২৯) পুস্তকে তিনি দাফনের সময় হযরত ফাতেমা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা)’র উপস্থিতির কারণে এই বর্ণনাকে ‘মুনকার’ তথা প্রত্যাখ্যাত শ্রেণিভুক্ত করেন]

হানাফী মাযহাবে মহিলাদের দ্বারা মাযার/রওযা যেয়ারত ততোক্ষণ পর্যন্ত জায়েয - যতোক্ষণ তাঁরা যথাযথ (শরঈ) পোশাক পরিধান করেন এবং অযথা অ-মাহরাম পুরুষের সংশ্রবে না আসেন; আর তাঁরা অনিয়মতান্ত্রিক আচরণ না করেন, যেমন - বিলাপসহ কান্নাকাটি। এই মাযহাবের মুখ্য রেফারেন্স-মূলক কেতাবগুলোর অন্যতম ‘ফতোয়া-এ-হিন্দীয়া’ (৫:৩৫০) পুস্তকে লিপিবদ্ধ আছে: “মহিলাদের দ্বারা মাযার/রওযা যেয়ারতের ব্যাপারে উলামাবৃন্দের মাঝে মতপার্থক্য বিদ্যমান। আল-সারাখসী বলেন যে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য মত হলো এটা ভ্রান্তি নয়।” আল-মাবসূত পুস্তকে (২৪:১০) আল-সারাখসী বলেন: “আমাদের (হানাফী) মাযহাবে (মাযার যেয়ারতের পক্ষে) সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য মত হলো এই যে, এটা (মানে রুখসাত তথা বিধান প্রয়োগের বিষয়টি) পুরুষ ও নারী উভয়েরই জন্যে প্রযোজ্য; কেননা বর্ণিত আছে যে হযরত মা আয়েশা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা) সব সময়ই মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’র রওযা মোবারক যেয়ারত করতেন, আর হজ্জ্বে গেলে তিনি তাঁর ভাই হযরত আবদুর রাহমানের (রা:) কবর শরীফ যেয়ারত করতেন...।” এই ঘটনার সত্যতা ইবনে নুজাইম তাঁর ‘আল-বাহর আল-রায়ক্ব’ গ্রন্থে নিশ্চিত করেছেন। ইবনে আবেদীন এই পুস্তকের ওপর লেখা তাঁর মহা ব্যাখ্যামূলক ‘মিনহাত আল-খালেক্ব হাশিয়াত আল-বাহর আল-রায়ক্ব’ কিতাবে (২:২১০) উদ্ধৃত করেন আল-রামলী (রহ:)’র কথা, যিনি বলেন: “অনেকের আচরিত প্রথার অনুসরণে মহিলারা নিজেদের দুঃখ-বেদনা পুনরায় জাগিয়ে তুলতে, কিংবা বিলাপসহ কান্নাকাটি করতে মাযার/রওযা যেয়ারতে গেলে তা তাদের জন্যে জায়েয নেই। হুযূরে পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’এর ঘোষিত - ‘আল্লাহতা’লা কবর যেয়ারতকারিনী নারীদের প্রতি অভিসম্পাত দেন’ - মর্মে হাদীস শরীফটিকে এভাবেই বোঝা হয়ে থাকে। আর যদি মহিলাবৃন্দ গভীর ধ্যান, অনুগ্রহ লাভ ও বরকত-আশীর্বাদ অন্বেষণের লক্ষ্যে আউলিয়ার (রহ:) মাযার যেয়ারত করেন, তাহলে বয়স্কা নারী হওয়ার শর্তে তা তাঁদের জন্যে ভ্রান্তি (বলে বিবেচিত) হবে না। তবে তারা যুবতী নারী হলে তা মকরূহ/অপছন্দনীয় হবে (মানে তাদের অংশগ্রহণের দরুন ফিতনার উদ্ভব হতে পারে)। মহিলাদের দ্বারা মাযার/রওযা যেয়ারত অবৈধ না হওয়ার পক্ষে প্রমাণ হিসেবে যে হাদীসটি পাওয়া যায়, তা হযরত আনাস বিন মালেক (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) বর্ণনা করেছেন, যা’তে প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলােইহে ওয়া সাল্লাম) একটি কবরের পাশে উপবিষ্ট ও ক্রন্দনরত জনৈক মহিলাকে অতিক্রম করছিলেন। তিনি তাঁকে বলেন, ‘আল্লাহকে ভয় করো এবং ধৈর্য ধরো’।” ফুক্বাহা তথা ফেক্বাহবিদমণ্ডলী এ থেকে সিদ্ধান্ত নেন যে বিষয়টি জায়েয, কেননা রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) তাঁকে কবর যেয়ারত করতে বারণ করেননি; বিষয়টি যদি অবৈধ হতো, তাহলে প্রিয়নবী (দ:)’র জন্যে ওই মহিলাকে নিষেধ করা বাধ্যতামূলক হতো। [নোট-২৯: এই প্যারাগ্রাফটি সামান্য সম্পাদনাসহ শায়খ ফারাজ রাব্বানী হতে সংগৃহীত]

মহিলাদের দ্বারা মাযার/রওযা যেয়ারতের প্রতি আপত্তিকারীদের প্রামাণ্য দলিলস্বরূপ প্রদর্শিত তিনটি হাদীসের প্রথম দুটো (ক এবং খ)’কে যদি সহীহ হিসেবে আমরা বিবেচনাও করি, যেমনটি করেছিলেন হাতে গোনা কতিপয় আলেম, তবুও সেগুলো নিষেধাজ্ঞার প্রমাণ সাব্যস্ত হবে না নিচের দুটো কারণে: প্রথমতঃ ইসলামের সঠিক মতানুযায়ী সেগুলো রহিত হয়ে গিয়েছে, যেমনটি ওপরে প্রদর্শিত হয়েছে। দ্বিতীয়তঃ সেগুলো একে অপরের স্পষ্ট ব্যাখ্যা দেয় এবং দালিলিক প্রমাণ হিসেবে (বিরোধীদের) পেশকৃত তৃতীয় (গ) হাদীসটিও সেগুলোকে খোলাসা করে এই অর্থে যে, ওই লা’নত/অভিসম্পাত নিঃশর্তভাবে মাযার যেয়ারতকারিনী মহিলাদের সাথে সংশ্লিষ্ট নয়, বরঞ্চ স্রেফ সেসব নারীদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য যারা (১) অতিমাত্রায় যেয়ারত করে এবং (২) যেয়ারতকালে কিছু শরীয়তগর্হিত কাজে লিপ্ত হয়, যেমনটি বিবৃত করেছেন সর্ব-ইমাম তিরমিযী, বাগাবী, তাহাবী, ক্বুরতূবী ও অন্যান্যরা [নোট-৩০: দেখুন - তিরমিযী নিজ ‘সুনান’ পুস্তকে, হযরত আবূ হোরায়রাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে ‘যাওয়ারাত’-সংক্রান্ত হাদীস বর্ণনাশেষে; আল-তাহাবী কৃত ‘শরহে মুশকিল আল-আসার’ (১২:১৭৯-১৮৬); আল-বাগাবী রচিত ‘শরহে আল-সুন্নাহ’ (২:৪১৭, ৫:৪৬৪); এবং আল-ক্বুরতূবী নিজ ‘তাফসীর’গ্রন্থে (২০:১৭০), যেমনটি উদ্ধৃত করেছেন আল-শওকানী তার ‘নায়ল আল-আওতার’ কিতাবে (জানাযা ও কবর যেয়ারত অধ্যায়গুলো দ্রষ্টব্য)]। এই খাস বা সুনির্দিষ্ট নিষেধাজ্ঞা এ বাস্তবতা দ্বারাও সমর্থিত যে, সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য/বিশুদ্ধ/সহীহ নিষেধাজ্ঞাসূচক হাদীসে ঘোষিত হয়েছে: “আল্লাহতা’লা সেসব নারীদের প্রতি অভিসম্পাত দেন, যারা ঘনঘন কবর যেয়ারত করে থাকে।” এর দরুন (বোঝা যায়) নিষেধাজ্ঞাটি স্পষ্টতঃ খাস, মহিলাদের একটি বিশেষ দলের প্রতি উদ্দিষ্ট; তাঁদের সবার প্রতি নয়।

এই খাস নিষেধাজ্ঞা পুরুষদের প্রতিও যে প্রযোজ্য, তার সমর্থন রয়েছে একটি হাদীসে যা’তে বিবৃত হয়েছে: “আল্লাহ ইহুদী ও খৃষ্টানদের প্রতি লা’নত দেন! (কেননা) তারা তাদের পয়গম্বর (আ:)’বৃন্দের মাযার/রওযাকে এবাদতগাহ হিসেবে গ্রহণ করেছিলো” [নোট-৩১: হযরত আয়েশাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা) হতে সর্ব-ইমাম বুখারী ও মুসলিমবর্ণিত]। এই পুরুষদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নিষেধাজ্ঞা আরেকটি হাদীস শরীফে সমর্থিত হযেছে যা’তে ব্যক্ত হয়েছে: “আমি তোমাদেরকে আগে কবর যেয়ারত করতে নিষেধ করেছিলাম; এখন থেকে যেয়ারত করো। কিন্তু তোমাদের প্রভু খোদাতা’লা যেসব কথায় রাগান্বিত হন সেগুলো উচ্চারণ কোরো না!” [নোট-৩২: হযরত আবূ সাঈদ খুদরী (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে আল-বাযযার সহীহ সনদে বর্ণনা করেন, যেমনটি বিবৃত করেন আল-হায়তামী (৩:৫৮); হযরত ইবনে আব্বাস (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে আল-আযদী নিজ ‘মুসনাদ’ পুস্তকে (১৯৪ পৃষ্ঠা); এবং হযরত আনাস (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে ইমাম আহমদ, আবূ এযালা (৬:২৭২) ও ইবনে আবী শায়বা (৩:২৯)]

এই দালিলিক প্রমাণ উপস্থাপনের সারমর্ম এই নয় যে আজকালের মুসলমান মহিলা নির্বিশেষে তাঁদের সবাইকেই মাযার/রওযা যেয়ারতের অনুমতি প্রদান; কেননা প্রলোভন ও পাপ আমাদের যুগে ব্যাপকভাবে বিরাজমান, আর মাযার যেয়ারতের শরঈ বিধিবিধানের প্রতি মাযার/রওযা যেয়ারতকারী পুরুষ ও যেয়ারতকারিনী নারী উভয় শ্রেণি-ই সামান্য আদবশীল নতুবা একেবারেই আদব-কায়দাশূন্য। আল-বায়হাক্বী (রহমতুল্লাহে আলাইহে)’র বক্তব্য তুলে ধরা এখানে অত্যুক্তি হবে না; তিনি বলেন: “মহিলাবৃন্দ যদি নিজেদেরকে জানাযা’র মিছিল থেকে দূরে রাখেন, কবরস্থানে না যান এবং কবর যেয়ারত না করেন, তাহলে তা তাঁদের ধর্মের জন্যে মঙ্গলজনক হবে; আর আল্লাহর তরফ থেকেই আগমন করে সাফল্য” [নোট-৩৩: আল-বায়হাক্বী, ‘আল-সুনান আল-কুবরা’ (৪:৭৮)]। আল-হাকিম আল-তিরমিযী তাঁর রচিত ‘নওয়া’দিরুল উসূল’ পুস্তকের ‘আসল-১৫’তে এই বক্তব্যের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ পেশ করেছেন।

তবু শহর/নগর ও গ্রামের কবরস্থানে সমসাময়িককালের যেয়ারতকারী মুসলমানদের এই নেতিবাচক অবস্থা আল-বাক্বী কবরস্থান যেয়ারতকারিনী মহিলাদের ক্ষেত্রে মোটেই প্রযোজ্য হবে না; (কেননা) সেখানে মদীনা মোনাওয়ারার স্বাভাবিক শিষ্টতার রীতি আবেগের বহিঃপ্রকাশকে বাধা দেয় এবং এই দুইয়ের মাঝে ভারসাম্য রক্ষা করে। এমতাবস্থায় সেখানে মুসলমান পুরুষদের পাশাপাশি তাঁদের অবস্থাকে নিষেধের পরিবর্তে অনুমতি দেয়া উচিত, যেমনটি উলামা-এ-ইসলামের প্রদত্ত ফতোয়া দ্বারা সমর্থিত হয়েছে, যা প্রয়াত আবদুল আযীয বিন বা’য, মুহাম্মদ ইবনে ইবরাহীম ইবনে আবদ আল-লাতীফ, হাম্মা’দ আল-আনসারী ও তার ছাত্রবর্গ বকর আবূ যায়দ, আবূ বকর আল-জাযায়রীর মতো হাতে গোনা কতিপয় ওহাবী বিরোধিতাকারী এবং হারামাইন শরীফাইনের ধর্মীয় পদে সমাসীন অন্যান্যদের দাবির খেলাফ।

মদীনা মোনাওয়ারায় অবস্থিত মসজিদে নববী ও বাক্বী কবরস্থানসহ সর্বত্র নিঃশর্ত নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগের প্রসঙ্গটি, যেটা নিয়ে সৌদি বকর আবূ যায়দ নিজ ‘জুয’ ফী যিয়ারাত আল-নিসা’ লিল-ক্বুবূর’ [নোট-৩৪: লেখকের ‘আল-আজযা’আ আল-হাদীসিয়্যা’ পুস্তকে অন্তর্ভুক্ত] শীর্ষক পত্রে জোরাজুরি করেন, আর তাঁর অদ্ভুত দাবি এই মর্মে  যে (ক) মুর্দার খাটিয়ার সাথে জানাযার মিছিলে মহিলাদের অংশগ্রহণের নিষেধাজ্ঞাসম্বলিত রওয়ায়াত-গুলো মাযার/রওযা যেয়ারতের বেলায়ও প্রযোজ্য হবে এবং (খ) ’যাওয়ারাত’ শব্দটি অশুদ্ধ এবং তা নারী যেয়ারতকারিনীদের অর্থে ‘যুওয়ারাত’ পড়তে হবে, ঘনঘন যেয়ারতের অর্থে গ্রহণ করা যাবে না [নোট-৩৫: এমন কী আল-মু’আল্লেমীও আপন ‘এমারাত আল-ক্বুবূর’ পুস্তকের ১৫৬ পৃষ্ঠায় এটাকে ‘যাওয়ারাত’ পাঠ করেন এবং এর অর্থ করেন ‘যারা ঘনঘন ক্ববর যেয়ারত করে’], সেই প্রসঙ্গটি সম্পর্কে বলবো: এ ধরনের দাবি অযৌক্তিক ও একগুঁয়েভাবে প্রামাণ্য দলিল অস্বীকার করা ছাড়া কিছুই নয়, আর এ আচরণটি আদি গোত্রীয় ও অসঙ্গতির পরিচিত উৎসমূল - ইবনে তাইমিয়া ও ইবনে ক্বাইয়্যেম আল-জাওযিয়্যার অন্ধ অনুসরণ বটে। কিন্তু পরিচিত ব্যক্তিদের অনুসরণের চেয়ে অনুসরণ-অনুকরণের বেশি হক্বদারিত্ব (অধিকার) হচ্ছে সত্যের।

মারওয়ান ইবরাহীম আল-কায়সী’র লিখিত Morals and Manners in Islam: A Guide to Aadaab (লিস্টার, ইংল্যান্ড: দ্য ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ১৯৮৬; পুনর্মুদ্রণ ১৯৮৯ ও ১৯৯১) শীর্ষক পুস্তকে কবরস্থান যেয়ারত ও মাযার/রওযার নির্মাণ (স্থাপত্য-কৌশল) সম্পর্কে নিম্নবর্ণিত ত্রুটি-বিচ্যুতি বিদ্যমান:

১/ - লেখক (৭১ পৃষ্ঠায়) বলেন: “কোনো মুসলমানের কবরস্থান যেয়ারতের উদ্দেশ্য দুটি : ইন্তেক্বালপ্রাপ্তদের জন্যে দুআ করা এবং আখেরাতের কথা নিজেকে স্মরণ করিয়ে দেয়া।” অথচ তৃতীয় একটি উদ্দেশ্য হচ্ছে বরকত আদায়; আর চতুর্থ উদ্দেশ্যটি হচ্ছে প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) ও আসহাবে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহম) এবং আউলিয়া কেরাম (রহমতুল্লাহে আলাইহে)’এর মাযার/রওযার মতো বিশেষ বরকতময় স্থানগুলো যেয়ারত করে সেখানে নিজের প্রয়োজন পূরণের জন্যে আবেদন-নিবেদন ও প্রার্থনা জানানো (মানে তাওয়াসসুল পালন)। ইসলামী উলামামণ্ডলীর মাঝে এজমা’ তথা ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে)’র রওযা মোবারক যেয়ারত করার উদ্দেশ্যে সফর করা পছন্দনীয় এবাদত (ক্বুরবাত), যেমনটি সাব্যস্ত হয়েছে ইমাম ক্বাজী আয়ায (রহমতুল্লাহে আলাইহে)’এর ‘শেফা শরীফ’ গ্রন্থে; আর ইমাম শাফেঈ (রহমতুল্লাহে আলাইহে)’র কাছ থেকে সহীহ বর্ণনায় এসেছে যে তিনি নিজের প্রয়োজন মেটানোর উদ্দেশ্যে ইমাম আবূ হানীফা (রহমতুল্লাহে আলাইহে)’র মাযার যেয়ারত করে তাঁকে অসীলা করতেন। [নোট-৩৬: আল-খতীব কৃত ‘তারীখে বাগদাদ’ (১:১২৩) এবং ইবনে আবী আল-ওয়াফা প্রণীত ‘তাবাক্বাত আল-হানাফিয়্যা’ (৫১৯ পৃষ্ঠা)]

২/ - বইয়ের একই পৃষ্ঠায় ওই লেখক দুর্বল এক মন্তব্য করেন: “কবরস্থানে অবস্থানকালীন ইসলামী শিক্ষা/বিধানের লঙ্ঘন (নিষিদ্ধ)।” নিশ্চয় সেটা কোনো সময়ই বা কোনো স্থানেই অনুমতিপ্রাপ্ত নয়! আর এটাই হলো ফিক্বাহ-শাস্ত্রে বিজ্ঞ ‍ও অভিজ্ঞ উলামাবৃন্দের সতর্কতাপূর্ণ বাক্য-বিন্যাস হতে বিচ্যুতির বিপদ।

৩/ - ওই লেখক একই পৃষ্ঠায় আরো বলেন: “কবরস্থানে ‘ওহে কবরবাসী ঈমানদার নর-নারী, আপনাদের প্রতি সালাম তথা শান্তি বর্ষিত হোক! আল্লাহ আপনাদের মতো পূর্ববর্তীদের প্রতি এবং আমাদের মতো পরবর্তীদের প্রতি তাঁর অনুগ্রহ মঞ্জুর করুন। নিশ্চয় আল্লাহর ইচ্ছায় আমরা আপনাদের সাথেই মিলিত হবো’ - এই কথাটি বলা এবং ইন্তেক্বালপ্রাপ্তদের জন্যে দুআ করা ছাড়া আর কিছুই বলা যাবে না।” বইয়ের ১৭৯ পৃষ্ঠায় লেখক দাবি করেন: “কেউ ইন্তেক্বাল করার পর তাঁর জন্যে তালক্বীন (বিশেষ উপদেশজ্ঞাপক অনুশীলনী) করা একটি বেদআত।” আসলে লেখকের এসব কথাই ভ্রান্তি, কেননা দাফনের পরে ইন্তেক্বালপ্রাপ্তদেরকে তালক্বীন/নির্দেশনা দেয়া মোস্তাহাব (পছন্দনীয়) বা সুন্নাত, এমন কী শায়খ মুহাম্মদ ইবনে আবদিল ওয়াহহাব নজদীর লেখা ‘আহকাম তাম্মানী আল- মওত’ পুস্তকে পরিবেশিত তাঁর মতানুসারেও। এ ব্যাপারে বিস্তারিত দালিলিক প্রমাণ উপস্থাপিত হয়েছে Encyclopedia of Islamic Doctrine ও Reliance of the Traveler (৯২১-৯২৪ পৃষ্ঠা, ৩২.১-২)। কোনো মানুষ বেসালপ্রাপ্ত হওয়ার বাস্তবতা এই নয় যে তিনি (দুনিয়ায়) জীবিতদের শুনতে পান না। তথাকথিত আধুনিকতাবাদীদের এটা একটা মুখ্য বৈশিষ্ট্য যে এলমে গায়ব/অদৃশ্য জ্ঞানের সাথে সম্পৃক্ত অনেক আক্বীদা-বিশ্বাস ও অনুশীলনীকেই তাঁরা অস্বীকার করেন।

৪/ - লেখক বইয়ের ১৭১ পৃষ্ঠায় আরো দাবি করেন: “কোনো মাযার/রওযাকে বরকত লাভের উদ্দেশ্যে স্পর্শ করা নিষিদ্ধ (হারাম)।” এই ধারণাটিও ভুল; সঠিক ফায়সালা হলো এটা মকরূহ [বঙ্গানুবাদকের নোট: সাহাবী হযরত আবূ আইয়ূব আনসারী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর ঘটনার সূত্রে এতে উলামাদের মাঝে মতান্তর বিদ্যমান], যদিও ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহমতুল্লাহে আলাইহে)’এর মতো কিছু উলামার ফতোয়া অনুসারে প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’র রওযা শরীফ স্পর্শ, এমন কী চুম্বন করাতেও কোনো ক্ষতি নেই। আল-যাহাবী এই বিষয়টির অস্বীকারকারীদের এমন কী খারেজীও আখ্যা দিয়েছেন।

৫/ - লেখক ১৮৪ পৃষ্ঠায় দাবি করেন: “কবরের ওপর খাড়াভাবে ফলক স্থাপনও আপনাআপনি নিষিদ্ধ।” খাড়াভাবে স্থাপিত ফলক বলতে যদি বোঝানো হয় কবরের ‘শাহিদান’ তথা সাইনপোস্ট’কে, তাহলে এই দাবি পূর্ব হতে পশ্চিম অঞ্চলজুড়ে যুগ যুগ ধরে অনুশীলিত রীতিসূত্রে পুরোপুরিভাবে প্রত্যাখ্যাত ও অমূলক বলে প্রমাণিত হবে।

৬/ - বইয়ের একই পৃষ্ঠায় লেখক বলেন: “কবরের ওপর কোনো আকৃতির স্থাপনা-ই নির্মাণ করা উচিৎ নয়....কবরগুলোকে জিপসাম (খনিজ পদার্থ) দ্বারা আস্তর করা যাবে না।” সত্যটি হলো, এই বিষয়ে উলামাবৃন্দের মাঝে মতপার্থক্য বিরাজমান; আর মাযার/রওযা নির্মাণ ও জিপসাম দ্বারা সেগুলো আস্তর করা জায়েয হওয়ার পক্ষে দুটি কারণ উল্লেখ করা হয়েছিলো: সাধারণভাবে বলতে গেলে মাযার ভেঙ্গে পড়া থেকে রক্ষা করার লক্ষ্যে, এবং দ্বিতীয়তঃ তা কোনো পীর বা (হক্কানী) আলেম অথবা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’এর বংশের কারো হলে জনগণের মনে শ্রদ্ধাভাব জাগ্রত করার উদ্দেশ্যে, যেমনটি উল্লেখিত হয়েছে ইবনে আবেদীন শামী’র ‘হাশিয়া’ পুস্তকে (১:৬০১)। শায়খ ইসমাঈল হাক্কী তাঁর ‘তাফসীরে রূহুল বয়ান’গ্রন্থে  إِنَّمَا يَعْمُرُ مَسَٰجِدَ ٱللَّهِ مَنْ ءَامَنَ بِٱللَّهِ وَٱلْيَوْمِ ٱلآخِرِ وَأَقَامَ ٱلصَّلَٰوةَ وَءَاتَىٰ ٱلزَّكَٰوةَ وَلَمْ يَخْشَ إِلاَّ ٱللَّهَ فَعَسَىٰ أُوْلَـٰئِكَ أَن يَكُونُواْ مِنَ ٱلْمُهْتَدِينَ (আল্লাহর মসজিদগুলো তারাই আবাদ করে, যারা আল্লাহ ও ক্বেয়ামতের প্রতি ঈমান আনে, নামায ক্বায়েম করে, যাকাত প্রদান করে এবং আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে ভয় করে না; সুতরাং এটাই সন্নিকটে যে এসব মানুষ সৎপথপ্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে - ক্বুরআন মজীদ ৯:১৮, তাফসীরে নূরুল এরফান) - এই আয়াতটির ব্যাখ্যায় বলেন:

“ইমাম আবদুল গনী নাবলুসী (রহ:) নিজ ‘কাশফ আন্ নূর ‘আন্ আসহাবিল ক্বুবূর’ (কবরবাসীদের কাছ থেকে প্রকাশিত জ্যোতি - সানজেরী পাবলিকেশন, বাংলা সংস্করণ দ্রষ্টব্য) শীর্ষক পুস্তিকায় যা বলেছেন, তার সার কথা হলো পবিত্র খোদায়ী বিধানের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের সাথে যে উত্তম নতুন প্রচলন (বেদআতে হাসানা) খাপ খায়, তাকে সুন্নাহ বলে। অতএব, উলামা-এ-হক্কানী/রব্বানী, আউলিয়ায়ে কেরাম ও পুণ্যাত্মাবৃন্দের মাযার/রওযার ওপর গুম্বজ নির্মাণ করা, আর তাঁদের মাযারকে বস্ত্র বা চাদরাবৃত করা জায়েয, যদি সেটার উদ্দেশ্য হয় সাধারণ মানুষের মনে শ্রদ্ধাবোধ জাগ্রত করা, যাতে তাঁরা ওই মাযারের অধিবাসীর (ওলীর) প্রতি ঘৃণা পোষণ না করেন।”

ওপরের বিষয় যদি সঠিক না হয়, অথবা তা যদি সুন্নাহর সাথে সঙ্গতিপূর্ণ না হয়, তাহলে ইমাম আবূ দাউদের ‘সুনান’ গ্রন্থে উদ্ধৃত আমাদের মা আয়েশাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা)’র বক্তব্য সম্পর্কে গভীরভাবে ভাবুন; তিনি বলেন: “(আবিসিনীয়) বাদশাহ নাজ্জাশী যখন বেসালপ্রাপ্ত হন, তখন আমাদেরকে (রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের তরফ থেকে) জানানো হয় যে তাঁর মাযারের ওপর একটি নূর/জ্যোতি নিরন্তর দৃশ্যমান হচ্ছিলো।”

আল্লাহতা’লা আমাদের উপলব্ধি, অন্তর ও আমাদের কবরগুলোকে তাঁর দয়া ও ক্ষমাশীলতা দ্বারা আলোকিত করুন (আমীন)! ওয়া সাল্লাল্লাহু ’আলা সাইয়্যেদিনা মুহাম্মাদিন ওয়া ‘আলা আলিহি ওয়া সাহবিহি ওয়া সাল্লাম। 

                                                    *সমাপ্ত*