ব্লগ সংরক্ষাণাগার

বুধবার, ১৩ মে, ২০১৫

খোদাতা’লার অস্তিত্ব

[Bengali translation of Elijah Daniels' article 'God's Existence' shared on Google+]

অনুবাদ: কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন

পার্থিব জগৎ তথা পদার্থের এই মহাবিশ্বের অস্তিত্ব অবশ্যই কারো (অর্থাৎ, স্রষ্টার) সদাসর্বদা অস্তিত্বশীলতার ওপর নির্ভরশীল। কেননা, পদার্থবিজ্ঞান যাঁরা ভালো বোঝেন, তাঁরা উপলব্ধি করেন যে এই বিশ্বজগৎ শক্তিশালী এক নিয়মের বন্ধনে আবদ্ধ এবং এর সূচনা নিশ্চয়ই যথাযথভাবে হয়েছিল। এর ডিজাইন বা নকশা কোনো নকশাবিদের অস্তিত্ব-ই প্রমাণ করে।

কতিপয় বিজ্ঞানী যে আমাদের এই মহাবিশ্বের নিয়মবদ্ধতার কারণে খোদাতা’লার অস্তিত্বে বিশ্বাসের কথা স্বীকার করেছেন, সে বিষয়টি আমার কাছে কৌতূহলোদ্দীপক মনে হয়েছে। আমাদের এই গ্রহকে এবং এতে প্রাণের অস্তিত্বকে যথাযথ ও যুৎসইভাবে টিকিয়ে রাখার মতো স্থির প্রাকৃতিক নিয়ম এবং ক্রমাগত ঘটনাবলী এতে বিদ্যমান।

উদাহরণস্বরূপ, চারটি মৌলিক প্রাকৃতিক শক্তির (যথা - ইলেকট্রোম্যাগনেটিজম, মধ্যাকর্ষণ, স্ট্রং নিউক্লিয়ার ফোর্স ও উইক নিউক্লিয়ার ফোর্স) যথাযথ বিন্যস্তকরণ মহাবিশ্বের প্রতিটি বস্তুকেই প্রভাবিত করে রেখেছে। এগুলোকে এমন নিখুঁত ভারসাম্যে বিন্যস্ত করা হয়েছে যে এমন কি সামান্যতম পরিবর্তনেও এই মহাবিশ্ব প্রাণশূন্য হয়ে যেতে পারে।

অতএব, যদি এ বিষয়টি প্রমাণও করা যায় যে মহাবিশ্বে পদার্থ ও শক্তি নিজে নিজেই অস্তিত্বশীল হওয়াটা সম্ভব, তবুও মহাবিশ্বের নকশা এতোই জটিল যে তা দৈব ঘটনাক্রমে (random chance) মহাবিশ্বের সূচনার ধারণাকে সম্পূর্ণভাবে নাকচ করে দেয়। যাঁরা সত্যিকার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যায় নির্ভর করেন, তাঁরা তাঁদের সিদ্ধান্ত দৈবঘটনার ভিত্তিতে নেন না।

উদাহরণস্বরূপ, বিবেচনা করুন অসংখ্য রসায়নিক প্রতিক্রিয়া যা ডিএনএ’র গঠনে নিখুঁত পর্যায়ক্রমিক হতে হবে।

বিষয়টির সঠিক মূল্যায়নে নিবেদন এই যে, সম্ভাবনা তত্ত্বের কর্তৃত্বশীল ড: এমিল বোরেল বলেন যে ১ সংখ্যা+৫০টি শূন্যবিশিষ্ট সংখ্যার ১ভাগের চেয়েও যদি কোনো একটি বিষয়ের ঘটার সম্ভাবনা কম থাকে, তাহলে তা কখনোই ঘটবে না, তাকে সময় যতোই দেয়া হোক না কেন।

তাই আমেরিকার ইউটা স্টেট ইউনিভারসিটির ড: ফ্র্যাংক সলসবারী প্রাণের আবির্ভাবের জন্যে প্রয়োজনীয় স্বতঃস্ফূর্ত মৌলিক ডিএনএ অণু গঠনের সম্ভাবনা হিসেব করার সময় দেখতে পান এটি এতোই সামান্য (১ সংখ্যা+৪১৫টি শূন্যবিশিষ্ট সংখ্যার ১ভাগ!) যে তা গাণিতিকভাবে অসম্ভব বলে বিবেচিত।

আসলে প্রাকৃতিক বিবর্তনের সম্ভাবনা এতোই অবিশ্বাস্যভাবে ক্ষীণ যে এমন কি বিখ্যাত বিবর্তনবিজ্ঞানীরাও স্বীকার করেন এটি কার্যত অসম্ভব; কিন্তু তাঁরা তবুও তাতে বিশ্বাস করেন। কেননা, তার একমাত্র বিকল্প (স্রষ্টার সৃষ্টি)
ধারণাটি যে তাঁদের কাছে অপছন্দনীয়।

উদাহরণস্বরূপ, নোবেল পুরস্কার বিজয়ী জীববিজ্ঞানী ড: জর্জ ওয়াল্ড স্বীকার করেন:

“জীবসত্তার/প্রাণির স্বতঃস্ফূর্ত (মানে আপনাআপনি) জন্মলাভের ধারণাটি যে অসম্ভব, তা স্বীকার করে নেয়ার বিশাল বিষয়টি-ই কাউকে স্রেফ ভাবিয়ে তুলবে। তবু আমাদের অস্তিত্ব স্বতঃস্ফূর্ত জন্মলাভের মাধম্যেই হয়েছে বলে আমি বিশ্বাস করি।”

বিবর্তনবিজ্ঞানীদের এই অসম্ভবে বিশ্বাসটি মূলতঃ এই কারণে যে তাঁরা বিকল্পটি (অর্থাৎ, খোদার অস্তিত্বে) বিশ্বাস করতে চান না।

[এই অনুবাদ বিজ্ঞানবিষয়ক হওয়ায় এতে ভুল হতে পারে। আমি এর জন্যে ক্ষমাপ্রার্থী। কেউ ’টার্ম’গুলোর সঠিক বাংলা জানলে আমাকে জানাবেন। আমি প্রয়োজনীয় সংশোধন করে নেবো। ধন্যবাদ।]  


মিরাজ : এক বিস্ময়কর ভ্রমণ!



ইমরান বিন বদরী

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম
নাহমাদুহু ওয়া নুসল্লি আলা রাসূলিহিল কারীম,আম্মা বা’দ।

সমস্ত প্রশংসা পরম করুণাময় রাব্বুল আলামীন আল্লাহ তায়ালার জন্য; আর সালাত (দুরূদ) ও সালাম আমাদের নবী সায়্যাদুল মুরসালীন প্রিয় মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি।

سُبْحَانَ الَّذِي أَسْرَى بِعَبْدِهِ لَيْلاً مِّنَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ إِلَى الْمَسْجِدِ الأَقْصَى الَّذِي بَارَكْنَا حَوْلَهُ لِنُرِيَهُ مِنْ آيَاتِنَا إِنَّهُ هُوَ السَّمِيعُ البَصِيرُ

পরম পবিত্র ও মহিমাময় সত্তা তিনি, যিনি স্বীয় বান্দাকে রাত্রি বেলায় ভ্রমণ করিয়েছিলেন মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যন্ত, যার চারদিকে আমি পর্যাপ্ত বরকত দান করেছি, যাতে আমি তাঁকে কুদরতের কিছু নিদর্শন দেখিয়ে দেই। নিশ্চয়ই তিনি সবকিছু শোনেন এবং দেখেন। (সূরা বনী ইসরাঈল আয়াত ১)

❋ মিরাজ!
═════➲ সুবহান আল্লাহ!
 
এটি এমন এক বিশ্ময়কর ঘটনা যার বর্ণনা দিতে গিয়ে স্বয়ং আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামীনও
(سُبْحٰنٰ )''সুবহান'' শব্দটি উল্লেখ করেছেন (যা শুধু আশ্চর্যজনক ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়)। শব্দটির অর্থ হচ্ছে পবিত্র ও মহিমাময়। এ বিশেষণ কেবল আল্লাহ পাকের জন্যই নির্দিষ্ট (খাস্)। তাই এ কথা সহজেই বোঝা যায় যে, মিরাজের ঘটনার পরিকল্পনাকারী ও সংঘটনকারী ছিলেন স্বয়ং আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামীন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অন্যতম শ্রেষ্ঠ মু’জিযা বা অলৌকিক ঘটনাগুলোর একটি এই মি’রাজ। মানবজাতির ইতিহাসে এটি একটি বিরল ঘটনা, যার গুরত্ব মানব ইতিহাসে বিশেষ করে মুসলিম ইতিহাসে খুবই গুরত্বপূর্ণ । নবী (আ:)-মণ্ডলীর মুজেজার মাঝে আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এই মুজেজা মানব ইতিহাসে অকল্পনীয় একটি অলৌকিক ঘটনা, যার বর্ণনা বা আলোচনা করার সেই সাহস আমাদের নেই। সত্যিকার অর্থে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আঙ্গুলের ইশারায় চন্দ্র দ্বিখণ্ডিত হওয়ার কোনো ব্যাখাও কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞান দিতে পারবে না। মূলতঃ নবী রাসূল (আ:)-বৃন্দের মুজেজা তো তাকেই বলা হয় যা মানুষের চিন্তা-কল্পনার বাইরে। মিরাজের বর্ণনা ব্যাপক। স্বল্পজ্ঞানে সংক্ষেপে যতোটুকু বুঝেছি, তাই আলোচনা করার চেষ্টা করেছি। ভুল হলে আশা করি ক্ষমা করবেন।


══(المعراج) মিরাজ শব্দের অর্থ উর্ধ্বে গমন, কেননা আল্লাহ্পাক তার হাবীবকে ওই দিনে মহাকাশ ভ্রমণ করিয়ে ছিলেন । হাদিস শরীফে মিরাজ শব্দটি উল্লেখ করা হলেও কিন্তু আল্লাহ্পাক পবিত্র কুরআনে করিমে (اَسْراى) 'আসরা' শব্দ উল্লেখ করেছেন, আর আসরা শব্দের অর্থ সফর করা বা কাউকে রাতের বেলায় নিয়ে যাওয়া, কেননা মিরাজ হয়েছিল রাতের বেলায় ।

➲ মিরাজের তারিখ নিয়ে একাধিক মত থাকলেও গৃহীত মত হচ্ছে আল্লাহর নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’এর নবুওতের দশম বছর মক্কি জীবনের শেষলগ্নে পিতৃব্য আবু তালিব ও উম্মুল মুমেনীন হযরত খাদিজাতুল খুবরা রাদিয়াল্লাহু আনহা ইহ-জগৎ ত্যাগ করার পরে এবং হিজরতের আগে যখন আরবের কাফির মূনাফিকরা মুসলমানদের প্রতি 
বেশি বেশি অত্যাচার-অবিচার শুরু করে দিলো, তখনি আল্লাহ তাঁর হাবীব (দ:)-কে মিরাজের এই সফর করিয়ে ছিলেন। মিরাজের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা তাঁর বন্ধুকে নিজের সান্নিধ্যে ডেকে এনে সান্ত্বনা দিয়ে সমাজ সংস্কারের একটি পরিপূর্ণ দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন। হাদিস শরীফের বিভিন্ন বর্ণনাতে দেখা যায়, মক্কা থেকে আল্লাহর হাবিব (দ:)-কে জিব্রাইল (আ:) বায়তুল মুকাদ্দাস্ নিয়ে যান, সেখানে সমস্ত আম্বিয়ায়ে কেরাম (আ:)-গণের সাথে ২ রাকাত সালাতের ইমামতি করে ঊর্ধ্বগমনে যান। এভাবে প্রথম, দ্বিতীয় ,তৃতীয় আসমান অতিক্রম করে ''বায়তুল মামুরে'' একত্ববাদের পরিচয় দানকারি নবী হজরত ইব্রাহীম (আ:)-এর সাথে সাক্ষাত হয় । এরপর 'সিদ্রাতুল মুনতাহা' থেকে আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’কে মহান রাব্বুল আলামীন তাঁর কুদরতের সাক্ষাতে নিয়ে যান।

➲ আবদুল আযীয ইবনুূু আবদিল্লাহ (রহ:) হজরত আনাস ইবনুূু মালিক রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -কে এতো উর্ধ্বে আরোহণ করানো হলো, যা সম্পর্কে আল্লাহ ছাড়া আর কেউই জানে না। অবশেষে তিনি সিদরাতুল মুনতাহায় আগমন করলেন। এখানে প্রবল পরাক্রমশালী আল্লাহ তাঁর নিকটবর্তী হলেন। অতিনিকটবর্তীর ফলে তাঁদের মধ্যে দু’ধনূকের ব্যবধান রইল, অথবা তারও কম। (বুখারী ৭০০৯ ই,ফা)
সেখান থেকে ফিরে আসার সময় উম্মতে মুহাম্মদীর জন্যে ৫ ওয়াক্ত সালাত নিয়ে আসেন । সেখানে আল্লাহ তাঁর নিদর্শনগুলো তাঁরই হাবীব (দ:)-কে দেখিয়েছেন, যেগুলো একমাত্র আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-ই দেখেছেন। আগের নবীবৃন্দ (আ:) যে আল্লাহর কথা প্রচার করেছেন, তা সমাপ্ত করেছেন শেষ নবী হজরত মুহাম্মদ মুস্তফা সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। আল্লাহর আয়াত তথা নিদর্শনের একমাত্র সাক্ষী হলেন আমাদেরই নবী রাহমাতুল্লিল আলামীন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।

➲ মিরাজের আরো বিস্তারিত জানার জন্যে সূরা আন নাজাম’এর প্রথম ১ থেকে ১৮ আয়াতগুলো দেখুন; এখানে আরো বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামীন -
وَالنَّجْمِ إِذَا هَوَى ═ নক্ষত্রের কসম, যখন অস্তমিত হয়।
مَا ضَلَّ صَاحِبُكُمْ وَمَا غَوَى ═ তোমাদের সঙ্গি পথভ্রষ্ট হননি এবং বিপথগামীও হননি।
وَمَا يَنطِقُ عَنِ الْهَوَى ═ এবং প্রবৃত্তির তাড়নায় কথা বলেন না।
إِنْ هُوَ إِلَّا وَحْيٌ يُوحَى ═ কোরআন ওহী, যা প্রত্যাদেশ হয়।
عَلَّمَهُ شَدِيدُ الْقُوَى ═ তাঁকে শিক্ষা দান করে এক শক্তিশালী ফেরেশতা,
ذُو مِرَّةٍ فَاسْتَوَى ═ সহজাত শক্তিসম্পন্ন, সে নিজ আকৃতিতে প্রকাশ পেল।
وَهُوَ بِالْأُفُقِ الْأَعْلَى ═ উর্ধ্ব দিগন্তে,
ثُمَّ دَنَا فَتَدَلَّى ═ অতঃপর নিকটবর্তী হলো ও ঝুলে গেল।
فَكَانَ قَابَ قَوْسَيْنِ أَوْ أَدْنَى ═ তখন দুই ধনুকের ব্যবধান ছিল অথবা আরও কম।
فَأَوْحَى إِلَى عَبْدِهِ مَا أَوْحَى ═ তখন আল্লাহ তাঁর দাসের প্রতি যা প্রত্যাদেশ করবার, তা প্রত্যাদেশ করলেন।
مَا كَذَبَ الْفُؤَادُ مَا رَأَى ═ রসূলের অন্তর মিথ্যা বলেননি যা তিনি দেখেছেন।
أَفَتُمَارُونَهُ عَلَى مَا يَرَى ═ তোমরা কি বিষয়ে বিতর্ক করবে যা তিনি দেখেছেন?
وَلَقَدْ رَآهُ نَزْلَةً أُخْرَى ═ নিশ্চয় তিনি তাঁকে আরেকবার দেখেছিলেন,
عِندَ سِدْرَةِ الْمُنْتَهَى ═ সিদরাতুল মুন্তাহার নিকটে,
عِندَهَا جَنَّةُ الْمَأْوَى ═ যার কাছে অবস্থিত বসবাসের জান্নাত।
إِذْ يَغْشَى السِّدْرَةَ مَا يَغْشَى ═ যখন বৃক্ষটি দ্বারা আচ্ছন্ন হওয়ার, তদ্দ্বারা আচ্ছন্ন ছিল।
مَا زَاغَ الْبَصَرُ وَمَا طَغَى ═ তাঁর দৃষ্টিবিভ্রম হয় নি এবং সীমালংঘনও করেনি।
لَقَدْ رَأَى مِنْ آيَاتِ رَبِّهِ الْكُبْرَى ═ নিশ্চয় তিনি তাঁর পালনকর্তার মহান নিদর্শনাবলী অবলোকন করেছেন।
উপরোল্লিখিত আয়াতসমূহের দ্বারা মিরাজের অনেক কিছুই নিশ্চিত করে জানা যায়।

এ প্রসঙ্গে সহীহ বুখারী ও মুসলিম শরীফের বিভিন্ন হাদীসেও মি’রাজের ঘটনা বিস্তারিত বর্ণনা পরিলক্ষিত হয়। যেমন:

❋═➲ হজরত আবূ যার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত যে, রসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: আমি মক্কাতে ছিলাম। আমার ঘরের ছাদ ফাঁক করা হলো। তখন জিবরাঈল (আলাইহি ওয়াসাল্লাম) অবতরণ করলেন। তিনি আমার বক্ষ বিদীর্ণ করলেন। এরপর তা যমযমের পানি দিয়ে ধৌত করলেন। তারপর হিকমত ও ঈমানে পরিপূর্ণ একটি পাত্র আনা হলো এবং এতে তা রাখা হলো; পুনরায় তা আমার বক্ষে ঢেলে বক্ষ বন্ধ করে দিলেনা এরপর আমার হাত ধরলেন এবং ঊর্ধ্বাকাশে যাত্রা করলেন। আমরা যখন প্রথম আসমানে গিয়ে পৌছলাম, তখন জিবরাঈল (আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এ আসমানের দ্বাররক্ষীকে বললেন, দরজা খুলুন ! তিনি বললেন, কে? জবাবে বললেন, জিবরাঈল। দ্বাররক্ষী বললেন, আপনার সাথে কি অন্য কেউ আছে? তিনি বললেন, হ্যাঁ। আমার সাথে মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) আছেন। দ্বাররক্ষী বললেন, তাঁর কাছে আপনাকে পাঠানো হয়েছিল কি? তিনি বললেন, হ্যাঁ। এরপর দরজা খুলে দেওয়া হলো। আমরা প্রবেশ করে দেখি, এক ব্যাক্তি, তাঁর ডানে একদল মানুষ এবং বাঁয়ে একদল মানুষ। যখন তিনি ডানদিকে তাকান তখন হাসেন, আর যখন বাঁ দিকে তাকান তখন কাঁদেন। তিনি আমাকে বললেন, মারহাবা হে সুযোগ্য নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম , হে সুযোগ্য সন্তান। রসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: আমি জিবরাঈলকে বললাম, ইনি কে? তিনি বললেন, ইনি হযরত আদম (আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আর ডানে ও বাঁয়ের এ লোকগুলো তাঁরই বংশধর। ডান পার্শ্বস্থরা হচ্ছে জান্নাতবাসী আর বাম পার্শ্বস্থরা হচ্ছে জাহান্নামবাসী। আর এ কারণেই তিনি ডান দিকে তাকালে হাসেন এবং বাঁ দিকে তাকালে কাঁদেন। তারপর জিবরাঈল (আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আমাকে নিয়ে আরও ঊর্ধ্বে আরোহণ করলেন এবং দ্বিতীয় আসমানে পৌঁছলেন এবং এর দ্বাররক্ষীকে বললেন, দরজা খুলুন। তিনি প্রথম আসমানের দ্বাররক্ষীর মতো প্রশ্নোত্তর করে দরজা খুলে দিলেন। আনাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, এরপর রসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন যে, তিনি আসমানসমূহে হযরত আদম, ইদরীস, মূসা ও ইবরাহীম (আলাইহিম আস্ সালাম)-এর সাথে সাক্ষাৎ লাভ করেছেন। আদম (আলাইহিস্ সালাম) প্রথম আসমানে এবং ইবরাহীম (আলাইহিস্ সালাম) ষষ্ঠ আসমানে। এছাড়া, অন্যান্য নবীর অবস্হান সম্পর্কে এ রেওয়ায়েতে কিছু উল্লেখ নেই। আনাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, যখন রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও হযরত জিবরাঈল (আলাইহিস্ সালাম) হযরত ইদরীস (আলাইহিস্ সালাম)-এর নিকট দিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন তিনি বলেছিলেন, মারহাবা, হে সুযোগ্য নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ! সুযোগ্য ভ্রাতা। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: আমি জিজ্ঞেস করলাম, ইনি কে? জিবরাঈল (আলাইহিস্ সাসাম) উত্তর দিলেন; ইনি ইদরীস (আলাইহিস্ সালাম)। তারপর আমরা হযরত মূসা (আলাইহিস্ সালাম)-এর নিকট দিয়ে যাচ্ছিলাম। তিনিও বললেন, মারহাবা হে সুযোগ্য নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম , সুযোগ্য ভ্রাতা। জিজ্ঞেস করলাম, ইনি কে? তিনি জবাব দিলেন, ইনি মূসা (আলাইহিস্ সালাম)। তারপর আমরা ঈসা (আলাইহিস্ সালাম)-এর নিকট দিয়ে যাচ্ছিলাম, তিনিও বললেন, মারহাবা হে সুযোগ্য নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম , সুযোগ্য ভ্রাতা ! জিজ্ঞেস করলাম ইনি কে? তিনি বললেন, ইনি হযরত ঈসা (আলাইহিস্ সালাম)। তারপর আমরা হযরত ইবরাহীম (আলাইহিস্ সালাম)-এর নিকট দিয়ে যাচ্ছিলাম, তিনিও বললেন, মারহাবা হে সুযোগ্য নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম , সুযোগ্য সন্তান! জিজ্ঞেস করলাম, ইনি কে? তিনি বললেন, ইনি হযরত ইবরাহিম (আলাইহিস্ সালাম)। ইবনু শিহাব, ইবনু হাযম, ইবনু আব্বাস ও আবূ হাব্বা আনসারী থেকে বর্ণনা করেছেন যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন তারপর জিবরাঈল (আলাইহিস্ সালাম) আমাকে নিয়ে আরো ঊর্ধ্বে চললেন। আমরা এমন এক স্তরে পৌঁছলাম যে তথায় আমি কলম-এর খশখশ (লেখার) শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। ইবনু হাযম ও আনাস ইবনু মালিক বর্ণনা করেন; রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন: তখন আল্লাহ তা’আলা আমার ওপর পঞ্চাশ ওয়াক্ত সালাত (নামাজ) ফরয করেন। আমি এ নিয়ে প্রত্যাবর্তন করার পথে হযরত মূসা (আলাইহিস্ সালাম)-এর সাথে সাক্ষাৎ হয়। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনার প্রতিপালক আপনার উম্মতের ওপর কী ফরয করেছেন? আমি উত্তরে বললাম, তাদের উপর পঞ্চাশ ওয়াক্ত সালাত (নামাজ) ফরয করা হয়েছে। হযরত মূসা (আলাইহিস্ সালাম) আমাকে বললেন, আপনি আপনার রবের কাছে ফিরে যান, কেননা আপনার উম্মাত তা আদায় করতে সক্ষম হবে না। তাই আমি আল্লাহর দরবারে ফিরে গেলাম। তখন আল্লাহ এর অর্ধেক কমিয়ে দিলেন। আমি আবার ফিরে এসে হযরত মূসা (আলাইহিস্ সালাম)-কে জানালে তিনি বললেন, না, আপনি পুনরায় ফিরে যান, কেননা আপনার উম্মাত এতেও সক্ষম হবে না। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: তারপর আমি আল্লাহর দরবারে ফিরে গেলে তিনি বললেন, এ নির্দেশ পাঁচ, আর পাঁচ-ই পঞ্চাশের সমান করে দিলাম, আমার কথার কোনো রদবদল নেই। এরপর আমি হযরত মূসা (আলাইহিস্ সালাম)-এর কাছে ফিরে আসি। তিনি তখনো বললেন, আপনি ফিরে যান আল্লাহর দরবারে। আমি বললাম, আমার লজ্জাবোধ করছি। তারপর জিবরাঈল (আলাইহিস্ সালাম) আমাকে ছিদরাতুল মুনতাহা’য় নিয়ে চললেন; আমরা সেখানে পৌঁছলাম। তা এতো বিচিত্র রংয়ে আবৃত যে, আমি বুঝতে পারছি না আসলে তা কী। তারপর আমাকে জান্নাতে প্রবেশ করানো হল। সেখানে ছিল মুক্তার গম্বুজ আর তার মাটি ছিল মিশকের। (কিতাবুল ঈমান,সহীহ মুসলিম)

❋═➲ জাবির ইবনুূু আবদিল্লাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত; তিনি রসূলাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছেন: যখন (মিরাজের ব্যাপারে) কুরাইশরা আমাকে অস্বীকার করল, তখন আমি কা’বা শরীফের হিজর অংশে দাঁড়ালাম। আল্লাহ তাআলা তখন আমার সম্মুখে বায়তুল মুকাদ্দাসকে প্রকাশ করে দিলেন, যার ফলে আমি দেখে দেখে বায়তুল মুকাদ্দাসের সমস্ত নিদর্শন তাদের কাছে বর্ণনা করছিলাম। বায়তুল্লাহ শরিফের মিযাবে রহমতের নিচে যে অংশটি পাথর দিয়ে ঘেরা তাকে হিজর বলা হয়। [আম্বিয়া কিরাম (আঃ),সহীহ বুখারি]

❖ রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লা ‘এর মিরাজ সম্পর্কে অকাট্য প্রমাণাদি রয়েছে। এজন্যে কোনো মুসলমানের পক্ষে তা অস্বীকার করা কিংবা এ ব্যাপারে সংশয় বোধ করা উচিত নয়। এমনকি একজন খাঁটি মুসলমানের বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে মিরাজের সত্যতা প্রমাণের অপেক্ষা না করে এ বিষয়ে মনেপ্রাণে বিশ্বাস স্থাপন করা ঈমানি কর্তব্য। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মিরাজ থেকে ফিরে আসার পর সর্বসাধারণকে তিনি যখন তা অবহিত করলেন তখন অনেকেই মিরাজ অবিশ্বাস্য বলে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করে উড়িয়ে দিলো। এতো কম সময়ের মধ্যে কীভাবে তা সম্ভব বলে সন্দিহান হলো তো বটেই, একে মোক্ষম সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করলো মক্কার কাফের-মুশরিকরা। তাদের অপপ্রচারে দুর্বল ঈমানের মুসলমানদের মনেও সন্দেহ হলো। ঠিক তখনি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’এর মিরাজে যাওয়ার ঘটনা একজন অবিশ্বাসীর মুখে শুনে হজরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু তৎক্ষণাৎ বিশ্বাস করেছিলেন বলেই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উনাকে ‘সিদ্দিক’বা সত্যবাদী উপাধি দিয়েছিলেন। এজন্যে মিরাজের শিক্ষার বাস্তব প্রতিফলন ঘটানোই একজন আদর্শ উম্মত তথা মুসলমানের কাজ।

➲ আমি চেষ্টা করেছি মাত্র আর সেই চেষ্টা সার্থক হবে তখনি, যখন লেখাটি পাঠকমণ্ডলীর বুঝতে সহজ হবে।