ব্লগ সংরক্ষাণাগার

সোমবার, ২২ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

জানাজা’র নামাজের পর দোয়া করা

আলহাজ্ব মুফতী এস, এম, সাকীউল কাউছার


প্রসঙ্গ কথা

একজন মুসলমানের এ দুনিয়াতে শেষ অনুষ্ঠান নামাজে জানাজা। ইন্তেকালপ্রাপ্ত ব্যক্তির জানাজার নামাজ পড়া জীবিতদের জন্যে ফরজে কেফায়া। জানাজাতে আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীসহ মোটামুটি অনেক মানুষের সমাগম হয়ে থাকে। জানাজার নামাজের পর অনেক মানুষ চলে যান, দাফন পর্যন্ত থাকেন না। দাফনের পর মুনাজাতে মানুষ কম হয়; তাই জানাজার পরপর-ই দোয়া করা হলে অধিক লোকের হাত আল্লাহ’র দারবারে তোলার কারণে ইন্তেকালপ্রাপ্ত ব্যক্তির ওপর আল্লাহ’র দয়া, মাগফিরাত, তাঁর কবর ও আখিরাতের জীবন আরও উন্নত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে । এই দোয়ার ব্যাপারে শরীয়তের কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই, বরং এটি মুস্তাহাব। অথচ এ পুণ্যময় কাজটিকে অনেকে ’বিদআত’ (শরীয়তগর্হিত নতুন প্রবর্তিত প্রথা) বলে আখ্যা দেয় এবং জানাজা’র নামাজে দোয়া আর মুনাজাতের দরকার নেই বলে সাধারণ মুসলমানকে বিভ্রান্ত করে থাকে। জানাজার পর এবং দাফনের পরেও দোয়া করা হাদীস শরীফ দ্বারা প্রমাণিত। অতএব, এ বিষয়ে শরীয়তের দৃষ্টিকোণ থেকে আলোকপাত করছি। 

জানাজা-নামাজ দোয়া নয়


ফরজ নামাজ দুই প্রকার - ফরজে আইন (৫ ওয়াক্তের নামাজ) ও ফরজে কেফায়া (জানাজার নামাজ)। নামাজের জন্যে অনেক শর্ত রয়েছে, যেমন পবিত্রতা, কেবলামুখি হওয়া, নিয়্যত করা, তাকবীরে তাহরিমা, সালাম ফিরিয়ে নামাজ শেষ করা ইত্যাদি। ৫ ওয়াক্ত নামাজ ও জানাজার নামাজসহ সকল নামাজ তাকবীরে তাহরীমা দ্বারা শুরু হয় এবং ডানে-বামে সালাম দ্বারা শেষ হয়। কিন্ত দোয়া-মুনাজাতের মধ্যে এগুলো শর্ত নয়। অতএব, নামাজ ও দোয়ার মধ্যে অনেক পার্থক্য বিদ্যমান। জানাজার নামাজে নিয়্যতের মধ্যে “সালাসাতিল জানাজা”, অর্থাৎ, জানাজার সালাত বা নামাজ উল্লেখ আছে। তাই তা নামাজ যা ইমামের পেছনে মরদেহকে সামনে রেখে কেবলামুখি হয়ে কাতার-বন্দী অবস্থায় আদায় করতে হয়। অনেকে বলে জানাজার মধ্যে দোয়া আছে, তাই এটাই দোয়া (?)। আমরা বলবো, ৫ ওয়াক্ত নামাজের ভেতরও দোয়া (দোয়া মাসুরা,সানা ইত্যাদি), জিকির (রুকু-সিজদার তাসবীহ ইত্যাদি) ও দারূদ আছে। তাই বলে কি নামাজকে দোয়া, জিকির ও দরূদ বলা হয়? আল্লাহ্‌ পাক বলেন - اقيموا الصلوة لذكرى (আকিমুস্ সালাতা লে জিকরি); অর্থাৎ, আমার জিকির বা স্মরণের উদ্দেশ্যে তোমরা সালাত বা নামাজ কায়েম করো। এখন কি কেউ বলতে পারবে যে নামাজ-ই জিকির, আর তাই জিকির করতে হবে না ?


বস্তুতঃ জানাজার নামাজের ভেতরে দোয়া থাকলেও তাকে শুধু দোয়া বলা যাবে না; বরঞ্চ তা নামাজ। তাছাড়া দোয়া বার বার করা যায়, এতে উপকার ছাড়া ক্ষতি নাই। জানাজার নামাজ ‘ফরজে কেফায়া’, আর দোয়া হলো ‘সুন্নাত’। হাদীসে বর্ণিত আছে - اكثرو الذعاء অর্থাৎ, বেশি করে দোয়া প্রার্থনা করো। জানাজাও অনেক সময় ২/৩/৪ বার হয়। তাহলে জানাজার পর হাত তুলে আবার আল্লাহ’র দরবারে দোয়া করাতে অসুবিধা কী? আর দোয়াও এক প্রকার ইবাদত। মিশকাত শরীফের কিতাবুদ দাওয়া’তে একখানি হাদীস বর্ণিত আছে - الدعاء هو العبادة অর্থাৎ, দোয়া এক ধরনের ইবাদত। একই জায়গায় এই হাদীস খানাও আছে - الدعاء مخ العبادة অর্থাৎ, দোয়া ইবাদতের মূল বা সারবস্তু। আর জানাজার নামাজ ফরজ ইবাদত।


জানাজা নামাজের পর দোয়ার প্রমাণ
 
আবু দাউদ শরীফ হতে মেশকাত শরীফের ‘সালাতুজ জানাজা’ অধ্যায়ের দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে বর্ণিত একটি হাদিসে ঘোষিত হয়েছে - اذا صليتم على الميت فاخلصوا له الدعاء (ইজা সাল্লাইতুমু আ’লাল মাইয়্যেতে ফাখলিসু লাহুদ দোয়া); অর্থাৎ, যখন তোমরা ইন্তেকালপ্রাপ্ত ব্যক্তির জানাজার নামাজ আদায় করে নাও, তখন আন্তরিকভাবে তার জন্যে দোয়া করো।


ওপরে উদ্ধৃত হাদীসে ‘ফা’ হরফ বা অক্ষর দ্বারা জানাজার নামাজ ও দোয়াকে আলাদা করা হয়েছে। অর্থাৎ, নামাজের পরপর-ইেইন্তেকালপ্রাপ্ত ব্যক্তির জন্যে দোয়া করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। যারা এ হাদীসের অর্থ ‘জানাজার মধ্যে দোয়া করো’ বলে, তারা ‘ফা’-এর অর্থ সম্পর্কে অজ্ঞ। কারণ আরবী ব্যাকরণ অনুযায়ী ‘সাল্লাইতুম’ হচ্ছে শর্ত এবং ‘ফাখলিসূ’ এর জাযা। শর্ত ও জাযার মধ্যে পার্থক্য থাকা বাঞ্ছণীয়, একটা অন্যটার অন্তর্ভুক্ত নয়। আর ‘সাল্লাইতুম’ হলো অতীতকালজ্ঞাপক ক্রিয়া এবং ‘ফাখলিসূ’ হলো আদেশ বা নির্দেশাত্মক ক্রিয়া। তাই বোঝা গেল, নামাজ পড়ার পরই দোয়ার নির্দেশ রয়েছে। যেমন কোরআনে আছে - فااذا طعمتم فانتشروا অর্থাৎ, যখন খাওয়া শেষ হবে, তখন ছড়িয়ে পড়ো। এখানেও ‘ফা’ শব্দ দ্বারা খাওয়ার পর ছড়িয়ে পড়তে বলা হয়েছে, খাওয়ার মাঝখানে নয়।


মেশকাত শরীফের একই জায়গায় আরও উল্লেখ আছে - قرء على الجنازة بفاتحة الكتاب (ক্বারা’আ আ’লাল জানাজাতে বে ফাতিহাতিল কিতাব); অর্থাৎ, হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জানাজায় সূরা ফাতিহা পাঠ করেছেন।
এ হাদীসের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে মেশকাত শরীফের ব্যাখ্যা ‘আশ’আতুল লুময়াত’ কিতাবে উল্লেখ আছে, “সম্ভবত হুজুর সাল্লল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জানাজার নামাজের পরে বা আগে বরকতের জনন্যে সূরা ফাতিহা পাঠ করেছেন, যেমন আজকাল এর প্রচলন দেখা যায়।” এর থেকে বোঝা গেল, মুহাদ্দিসকুল শিরোমণি হযরত আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহেলবী (র:)-এর যুগেও জানাজার নামাজের আগে বা পরে বরকতের জন্যে সূরা ফাতিহা পাঠের প্রচলন ছিল। তিনি এটিকে নিষেধ করেননি, বরং তা হাদীসের অনুসরণ-ই বলতে চেয়েছেন। আর সুরা ফাতিহা পাঠও এক প্রকার দোয়া।


বিখ্যাত ‘ফতহুল কাদির’ কিতাবের ‘জানাজার নামায’ পরিচ্ছেদে বর্ণিত আছে, হজুর আলাইহিস সালাম মিম্বরের ওপর দাঁড়িয়ে মুতা যুদ্ধের খবর দিলেন। এর মধ্যে হযরত জাফর ইবনে আবি তালিব (রা:)-এর শাহাদাতের খবর দিলেন। فصلى عليه رسول الله صلى الله عليه وسلم و دعاله و قال استغفروا له অর্থাৎ, অতঃপর তাঁর নামাজে জানাজা পড়লেন, এবং তাঁর জন্যে দোয়া করলেন; আর মানুষজনকে বললেন, তোমরাও তার মাগফিরাতের জন্যে দোয়া করো। উল্লেখিত ইবারতে ‘দোয়া’ শব্দের আগে ‘ওয়াও’ অব্যয় দ্বারা বোঝা যায়, এ দোয়া নামাজের পর-ই করা হয়েছিল।


মাওয়াহিবে লাদুনিয়া কিতাবের দ্বিতীয় খণ্ডের দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে আরবী  فيما اخبر من الغيوب -এর ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে উপরোক্ত ঘটনা হুবহু বর্ণনা করার পর বলেছেন - ثم قال استغفروا استغفرو له (সুম্মা ক্বালা এস্তাগফেরু এস্তাগফেরুলাহু); অর্থাৎ, মাগফিরাত কামনা করো, তার জন্যে মাগফিরাত কামনা করো। এ রকম হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা (রা:) জানাজার পর দোয়া করেছেন। অতএব, প্রমাণিত হলো যে জানাজার পর মাগফিরাতের জন্যে দোয়া করা জায়েয ও সুন্নাত।


সামশুল আয়িম্মা সরখসি (র:)-এর রচিত “মাবসুত” শীর্ষক কিতাবের দ্বিতীয় খণ্ডের ৬০ পৃষ্ঠায় ‘গোসলিল মাইয়্যেত’ অধ্যায়ে বর্ণিত আছে, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা:) একবার জানাজার নামাজের পর উপস্থিত হন এবং বলেন - ان سبقتمونى بالصلوة عليه فلا تسبقونى بالدعاء অর্থাৎ, যদিও তোমরা আমার আগে নামাজ পড়ে ফেলেছো, কিন্তু দোয়ার সময় আমার আগে যেয়ো না। অর্থাৎ, আমার সাথে দোয়ায় শরীক হও। ‘মাসবুত’ কিতাবের একই জায়গায় সর্ব-হযরত ইবনে উমর (রা:), আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা:) এবং আব্দুল্লাহ ইবনে সালাম (রা:) থেকে প্রমাণ করেছেন যে তাঁরা জানাজার নামাজের পর দোয়া করেছেন; এবং উপরোক্ত হাদীসের ‘ফালা তাশবেকু’ বাক্য দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে জানাজার পর দোয়া করার আমল সাহাবায়ে কিরাম (রা:) পালন করতেন। অতএব, জানাজার পর দোয়া করা বেদআত-নাজায়েয বলা স্রেফ গোমরাহি।


প্রত্যেক ফরজ নামাজের পর দোয়া করা সুন্নাত এবং তাতে দোয়া কবুল হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। যেমন - মিশকাত শরীফে ‘আজ জিকরু বা’দাস্ সালাত’ অধ্যায়ে বর্ণিত আছে - قيل يا رسول الله اى الدعاء اسمع قال جوف الليل الاخر و دبر الصلوة المكتوبات অর্থাৎ, হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে আরজ করা হলো, কোন্ সময়ের দোয়া বেশি কবুল হয়। তিনি এরশাদ করেন, শেষ রাত্রির মধ্যবর্তী সময় ও ফরজ নামাজের পরে। জানাজার নামাজও ফরজ (ফরজে কেফায়া)। তাই জানাজার পরেও দোয়া করলে কবুল হওয়ার আশা বেশি। ইন্তেকালপ্রাপ্ত ব্যক্তির জন্যে যা নাজাতের অসীলা হতে পারে।


ইমাম আবূ দাউদ (রহ:) ও ইমাম বায়হাকী (রহ:) ‘হাসান’ এসনাদে হযরত উসমান (রা:) থেকে বর্ণনা করেন; তিনি বলেন: মহানবী (দ:) ইন্তেকালপ্রাপ্ত কারো দাফনের পরে তাঁর (কবরের) পাশে দাঁড়াতেন এবং বলতেন, ‘এই ইন্তেকাল প্রাপ্তের গুনাহ মাফের জন্যে দোয়া করো, যাতে সে দৃঢ় থাকে; কেননা তাকে (কবরে) প্রশ্ন করা হচ্ছে।‘


অতএব, প্রমাণিত হলো যে শরীয়তের দৃষ্টিতে জানাজার পর ও দাফনের পর দোয়া করা সুন্নাত-মোস্তাহাব; বেদআত বা নাজায়েয নয়। 


                                                               সমাপ্ত

বৃহস্পতিবার, ১১ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

হাদীসের দৃষ্টিতে রাসূল (দ:)-এর কৃপা/অসীলা



-- ওয়াহিদ মনজু 

হাদিস নং - ১

হযরত আবু হুরায়রা (রা:) একবার আরয করেন, "ইয়া রাসূলাল্লাহ (দরুদ), আমি আপনার কাছ থেকে অসংখ্য হাদীস শুনি, কিন্তু তা ভুলে যাই; মনে রাখতে পারিনা। আমি কামনা করি আপনার পবিত্র মুখনিঃসৃত বাণী যেন আর কখনোই না ভুলি।” তখন হুজূর (দ:) বললেন, "তোমার চাদর বিছিয়ে দাও।” অতঃপর হযরত আবু হুরায়রা (রা:) তা বিছিয়ে দিলেন। তখন আকা (দ:) তাঁর হাত মুবারকে শূন্য থেকে কী যেন ওই চাদরের মধ্যে রাখেন, অতঃপর বলেন, "চাদর ভাঁজ করে ফেলো।” তিনি তা ভাঁজ করে নিলেন। হযরত আবু হুরায়রা (রা:) বলেন, ”এরপর আর কোনো দিন কিছু ভুলিনি।” [অধ্যায়: কিতাবুল ইলম, বোখারী শরীফ]

সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ

এখানে হযরত আবু হুরায়রা (রা:)-এর মতো প্রসিদ্ধ সাহাবী, যিনি অধিক হাদিস রেওয়ায়েতকারী এবং আহলে সুফফার একজন আল্লাহ-পাগল রাসূল-প্রেমিক, তিনিও হুজুর নবী করীম (দ:) থেকে ভুলে যাওয়ার ব্যাপারে পরিত্রাণ চাচ্ছেন। তাঁর চাওয়াতে হুজুর পাক (ধ:)-এর কোনো অভিযোগ ছিলনা, মুশরিক-ও আখ্যা দেননি।

হাদিস নং - ২

হযরত উসমান ইবনে হানীফ (রা:) থেকে বর্ণিত আছে, এক অন্ধ ব্যক্তি হুযুর (আলাইহিস সালাম)-এর মহান দরবারে উপস্থিত হয়ে অন্ধত্ব দূর হবার জন্যে তাঁর দোয়াপ্রার্থী হয়েছিলেন। হুযুর (আলাইহিস সালাম) তাঁকে শিখিয়ে দিলেন এ দু’আটি: 

اَلَّهُمَّاِنِّىْ اَسْئَلُك
َ وَاَتَوَ جَّهُ اِلَيْكَ بِمُحَمَّدٍ نَّبِىِّ الرَّحْمَةِ يَا مُحَمَّدُ اِنِّىْ قَدْتَوَجَّهْتُ بِكَ اِلَى رَبِّىْ فِيْ حَاجَتِىْ هذِه لِتَقْضِىَ اَللَّهُمَّ فَشَفِّعْهُ فِىَّ قَالُ اَبُوْا اِسْحقَ هذَا حَدِيْثٌ صَحِيْحٌ

[হে আল্লাহ, আমি অাপনার কাছে সাহায্য প্রার্থনা করছি রহমতের নবী মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) মারফত; আপনার দিকে মনোনিবেশ করছি। হে মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়ামাল্লাম), আমি আপনার মাধ্যমে আপন প্রতিপালকের দিকে আমার এ উদ্দেশ্য (অন্ধত্ব মোচন) পূরণ করার উদ্দেশ্যে মনোনিবেশ করলাম, যাতে আপনি আমার এ উদ্দেশ্য পূরণ করে দেন। হে আল্লাহ, আমার অনুকূলে হুযুর (আলাইহিস সালাম)-এর সুপারিশ কবুল করুন।]

[রেফারেন্স: ইবনে মাজা শরীফের সালাতুল ‘হাজত’ শীর্ষক অধ্যায়]

এ হাদীসটির বিশুদ্ধতা প্রসঙ্গে হযরত আবু ইসহাক (রহ:) বলেন, এ হাদীসটি বিশুদ্ধ (সহীহ)।

লক্ষ করুন,  দু’আটি কিয়ামত পর্যন্ত ধরাপৃষ্ঠে আগমনকারী মুসলমানদের জন্যে শিক্ষার বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়। এখানে হুযুর (আলাইহিস সালাম)-কে আহবান করা হয়েছে এবং তাঁর সাহায্য ও প্রার্থনা করা হয়েছে। এখানে দুটো শব্দ সুষ্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে, "বি মুহাম্মাদিন" ও "বিকা"; এই শব্দ দুটো সুষ্পষ্টভাবেই রাসূল (দ:)-এর অসীলা উল্লেখ করে। তাতে কন্টেক্সট্ ও কনটেক্সট্ দিয়ে ভুল ব্যাখ্যার সুযোগ নেই।

শিক্ষা 

আল্লাহর কাছে অনুগ্রহপ্রাপ্ত ও সম্মানিত কোনো পুণ্যাত্মার অসীলায় কোনো কিছু চাওয়ার ক্ষেত্রে অন্তর্নিহিত আকীদা থাকে, "তিনি যেহেতু আল্লাহর দরবারে সম্মানিত ও অনুগ্রহপ্রাপ্ত, তাই আল্লাহ-প্রদত্ত ক্ষমতাবলে তিনি সাহায্য-সহযোগিতা করতে সক্ষম, বিপদ থেকে উদ্ধার করতেও সমর্থ।" এতে শিরকের গন্ধ যারা খুঁজে, তাদের জ্ঞানের ব্যাপারে আমি সন্দিহান। অস্পষ্ট আয়াত ও যে আয়াত মূর্তিদের ব্যাপারে নাজিল হয়েছে, তার হুকুম নবী (আ:) ও ওলী (রহ:)-দের প্রতি আরোপ করে আমাদের মুসলিম ভাইদের বিভ্রান্ত করা হচ্ছে। মনে খুব-ই কষ্ট হয়।
 

আমার কিছু ভাইয়ের আপত্তি থাকতে পারে: হুজূর (দ:)-এর বেসালের পর চাওয়া শিরক। তাদের বলছি, প্রতি খলিফার আমলে অনেক রেওয়ায়াতে এই আচার প্রমাণিত, যা অতি বিশুদ্ধ। অনেক হাদীস থেকে মাত্র একখানি এখানে পেশ করা হলো:

اصاب الناس قحط في زمان عمرفجاء رجل الئ قبرالنبئ صلي الله عليه وسلم فقال يا رسول الله استسف لامتك فانهم قد هلكوا فاتي الرجل فى المنام فقيل له اءت عمر فاقرأه السلام واخبره انكم مستقيمون

আল মুসান্নাফ, খণ্ড - ১২, নং ১২০৫১
ফাতহুল বারী, শরহে বোখারী, খণ্ড - ২, পৃষ্ঠা - ৪১২, ৪৯৫

উমার (রা:)-এর জমানায় অনাবৃষ্টিতে মুসলমানবৃন্দ আক্রান্ত হলে এক ব্যক্তি (বিলাল বিন হারিস) নবী (দ:)-এর রওযা শরীফে এসে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ (দ:)! আপনি বৃষ্টির জন্যে দোয়া করুন, আপনার উম্মত ধ্বংসপ্রায়। অতঃপর ওই সাহাবী (রা:)-কে স্বপ্নে মহানবী (দ:) জানান, উমর (রা:)-এর কাছে যাও, সালাম জানাও, অতঃপর তাঁকে এই খবর দাও যে নিশ্চয় তোমাদের বৃষ্টি দেয়া হবে।

এই হাদিসটির শুদ্ধতা সম্পর্কে ইমাম ইবনে আবি শাইবা ও আল্লামা ইবনে হাজার আস্কালানি (রা:) বলেন, হাদীসটি সনদে বিশুদ্ধ।

নুক্তা: দেখুন, এখানে কয়েকটি বৈধ বিষয় উল্লেখ্য।

→হুজুর (দ:)-এর বেসালের পর হযরত বিলাল বিন হারিস (রা:)-এর দ্বারা তাঁর রওযায় যাওয়া।
→ইয়া রাসূলাল্লাহ বলে ডাকা।
→সমস্যা সমাধানের ইঙ্গিত পাওয়া হুজুরে পাক (দ:) থেকে।

উপরেল্লেখিত হাদীসসমূহ সুরা আল মায়িদার ৩৫ নং আয়াতের সুষ্পষ্ট ব্যাখ্যা, যাতে ইরশাদ হয়েছে: 


يا ايها الذين امنوا اتقواالله وابتغوا اليه الوسيلة


হে মুমিনগণ, তোমরা খোদা-ভীরুতা অবলম্বন করো এবং আল্লাহর প্রতি (নৈকট্যের জন্যে) অসীলা তালাশ করো (গহণ করো)।

বি:দ্র: এই বিষয়ে এতো সুষ্পষ্ট দলীলসমূহ আছে যে তা কল্পনাতীত। এটি অনেক আলোচনা সাপেক্ষ। আগামীতে ওয়াসীলা ও ইস্তিগাসা নিয়ে কোরান ও সহীহ হাদীসের আলোকে লেখার আশা রইলো, যা’তে ইমাম বোখারী (রহ:)-এর কিতাবের একটি অধ্যায়, বাবু মান ইস্তায়ানা বিদুয়াফায়ে ও সালিহীন (দুর্বল ও ওলী থেকে সাহায্য প্রার্থনা অধ্যায়) অন্তর্ভুক্ত থাকবে, ইনশাআল্লাহ।

পরিশেষে আবেদন করছি, জিয়ারাত ও অসীলা কেউ মানতে না চাইলে মানবেন না। এটাকে ফিকহি মতানৈক্যের মাসয়ালা হিসেবে নিয়ে আপন পথ অনুসরণ যে কেউ করতে পানে। কিন্তু ফাতোয়াবাজী করে মুসলিম মিল্লাতকে বিভাজন করার অধিকার কারো নেই। একটি আশা জাগানো কথা বলে শেষ করছি, সম্প্রতি হেফাজাত নেতৃবৃন্দের পক্ষ থেকে হুজূর পাক (দ:)-এর রওযা মোবারক অন্যত্র সরানোর প্রতিবাদে
পত্রিকায় প্রদত্ত এক ঘোষণায় বলা হয়, ”আমাদের নবী (দ:) হায়াতুন্নবী, জিন্দা নবী (দরুদ)।” এটি প্রমাণের জন্যে আলেমবৃন্দ সারা জীবন কোরআন-হাদীস দিয়ে বুঝিয়েছেন আমাদের। এখন সবাই ঐকমত্য পোষণ করছেন। আল-হামদু লিল্লাহ! ইনশাআল্লাহ অদূর ভবিষ্যতে আরো অনেক বিষয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়ে এক উম্মায় আমরা পরিণত হবো এবং এই বাণীর اعتصموا بحبل الله جميعا প্রতিফলন ঘটবে।

ইনশাআল্লাহ, জাযাকাল্লাহ, সাল্লু আলাল হাবিব।