ব্লগ সংরক্ষাণাগার

বুধবার, ১ অক্টোবর, ২০১৪

বুযূর্গবৃন্দের মাযার-রওযা ও গুম্বজ নির্মাণের পক্ষে মিসরীয় সাবেক গ্র্যান্ড মুফতী আলী জুমু’আ’র ফতোওয়া


অনুবাদক: কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন
আরবী ও অনলাইন সেট-আপ: রুবাইয়েৎ বিন মূসা
 
[The Egyptian former Grand Mufti Ali Jumua (Goma)'s Online fatwa regarding 'Building domes and shrines over the deceased'. Translator: Kazi Saifuddin Hossain] 


প্রশ্ন: মোহতারাম, আমাদের গ্রামে দুটি মসজিদ পাশাপাশি বিদ্যমান, যার প্রতিটিতেই একজন আল্লাহর ওলী (বন্ধু)-এর মাযার রয়েছে। ১৯৫০-এর দশক হতে মরা (গ্রামবাসীরা) এক শুক্রবার বাদে বাদে (পর পর) এই দুই মসজিদে জুমুআর নামায পর্যায়ক্রমিকভাবে আদায় করে আসছি। কিন্তু সশব্দে (কেরাত পাঠের মাধ্যমে) নামায আদায়ের সময় এবাদতের পরিবেশ বিঘ্নিত হয়। কেননা, দুটি মসজিদ একেবারেই সংলগ্ন। জনৈক ব্যক্তি নিজ খরচে এই দুটি মসজিদ ভেঙ্গে তদস্থলে একটিমাত্র মসজিদ নির্মাণ করতে চান। তবে তাঁর আরোপিত শর্ত হলো, মসজিদগুলোর সংলগ্ন দুটি মাযার ওখান থেকে অপসারণ করতে হবে এবং উভয় বোযর্গের দেহাবশেষ আমাদের গ্রামের কবরস্থানে স্থানান্তর করতে হবে। কতিপয় মুসল্লি ভাই এতে সায় দিয়েছেন সে সকল লোকের কথার ভিত্তিতে, যারা বলে মাযার-সংলগ্ন মসজিদে নামায পড়া নিষেধ। এ ব্যাপারে শরীয়তের হুকুম কী?

জবাব: আল্লাহর আউলিয়া কেরামের মাযার-রওযা সংলগ্ন মসজিদে নামায আদায় করা শরীয়তে শুধু বৈধ ও অনুমতিপ্রাপ্ত-ই নয়, এটি কুরআন-সুন্নাহ, আসহাবে কেরাম  রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম‘র আচরিত প্রথা ও গোটা মুসলিম উম্মাহ তথা মুসলমান সমাজের বাস্তব ঐকমত্যের মৌলিক প্রামাণ্য দলিল দ্বারা প্রশংসনীয় কর্ম বলে প্রতিষ্ঠিতও বটে।
আল-কুরআন হতে প্রমাণ 

মহা পরাক্রমশালী আল্লাহতালা এরশাদ ফরমান,
إِذْ يَتَنَازَعُونَ بَيْنَهُمْ أَمْرَهُمْ فَقَالُوا ابْنُوا عَلَيْهِمْ بُنْيَانًا رَبُّهُمْ أَعْلَمُ بِهِمْ قَالَ الَّذِينَ غَلَبُوا عَلَى أَمْرِهِمْ لَنَتَّخِذَنَّ عَلَيْهِمْ مَسْجِدًا.
-       যখন এই সব লোক তাদের (আসহাবে কাহাফ) ব্যাপারে নিজেদের মধ্যে বিতর্ক করতে লাগলো, অতঃপর (কেউ কেউ) বল্লো, ‘তাদের গুহার ওপর কোনো ইমারত নির্মাণ করো। তাদের রব্ব (খোদা)-ই তাদের ব্যাপারে ভাল জানেন।ওই লোকদের মধ্যে যারা (এ বিষয়ে) ক্ষমতাধর ছিল, তারা বল্লো, ‘শপথ রইলো, আমরা তাদের (আসহাবে কাহাফের পুণ্যময় স্থানের) ওপর মসজিদ নির্মাণ করবো” []
ওপরের আয়াতের প্রেক্ষিত এই ইঙ্গিত বহন করে যে প্রথম উদ্ধৃতিটি ছিল অবিশ্বাসীদের, আর দ্বিতীয়টি ছিল বিশ্বাসীদের। আল্লাহতালা উভয় বক্তব্যকেই কোনো রকম প্রত্যাখ্যান ব্যতিরেকে তুলে ধরেছেন, যার দরুন উভয় মতের প্রতি তাঁর অনুমতি প্রতীয়মান হয়। কিন্তু অবিশ্বাসীদের সন্দেহ মেশানো বক্তব্যের বিপরীতে বিশ্বাসীদের বক্তব্য  স্রেফ ইমারত নয়, বরং মসজিদ নির্মাণের ক্ষেত্রে তাঁদের আকাঙ্ক্ষায় অনুমোদন ও দৃঢ়তার বিষয়টি পরিস্ফুট হয়।
উলেমাবৃন্দের ব্যাখ্যা 
ইমাম আল-রাযী لَنَتَّخِذَنَّ عَلَيْهِمْ مَسْجِدًا. - ‘শপথ রইলো, আমরা তাদের (আসহাবে কাহাফের পুণ্যময় স্থানের) ওপর মসজিদ নির্মাণ করবো’, এই আয়াতটির তাফসীরে বলেন যে এর মানে হলো,
نَعْبُدُ اللَّهَ فِيهِ وَنَسْتَبْقِي آثَارَ أَصْحَابِ الْكَهْفِ.
-       আল্লাহর এবাদত-বন্দেগী করবো এবং আসহাবে কাহাফের দেহাবশেষ (স্মৃতিচিহ্ন) তাতে সংরক্ষণ করবো।’[]
* আল-বায়দাবীর তাফসীরের ব্যাখ্যামূলক গ্রন্থে শেহাবউদ্দীন খাফফাজী লেখেন:
- পুণ্যবান বান্দাদের (মাযার-রওযার) পাশে মসজিদ নির্মাণের অনুমতি এই দলিলে সাব্যস্ত হয়।”[]
সুন্নাহ হতে প্রমাণ

*
হযরত উরওয়া ইবনে আল-যুবায়র রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন,
وَيَنْفَلِتُ مِنْهُمْ أَبُو جَنْدَلِ بْنِ سَيْهَلٍ فَلَحِقَ بِأَبِي بَصِيرٍ، حَتَّى اجْتَمَعَتْ مِنْهُمْ عِصَابَةٌ.
-    হযরত আল-মুসাওয়ের ইবনে মাখরামা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ও মারাওয়ান ইবনে আল-হাকীম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে এই মর্মে যে, আবূ বাসীর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু যখন ইন্তেকাল করেন, তখন আবূ জানদাল ইবনে সোহায়ল ইবনে আমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু তিনশ জন সাহাবী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু-এর উপস্থিতিতে সাইফ আল-বাহরনামের স্থানে তাঁকে দাফন করেন এবং সেখানে তাঁর মাযার-সংলগ্ন একটি মসজিদ নির্মাণ করে দেন ।[]
এই রওয়ায়াতের এসনাদ সহীহ (বিশুদ্ধ) এবং এতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন আস্থাভাজন উলেমাবৃন্দ। এই কাজটি মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম  সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আড়ালে গোপনে সংঘটিত হতে পারে না; এতদসত্ত্বেও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেই মাযার অপসারণ বা (ওই সাহাবীর) দেহাবশেষ অন্যত্র স্থানান্তরের নির্দেশ দেননি।

*
বিশুদ্ধ রওয়ায়াতে হুযূর পূর নূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কথা উদ্ধৃত হয়েছে; তিনি বলেন:
فِي مَسْجِدِ الْخَيْفِ قَبْرُ سَبْعِينَ نَبِيًّا.
      - আল-খায়ফ মসজিদে সত্তর জন আম্বিয়া আলাইহিস সালাম-এর মাযার-রওযা বিদ্যমান। []
* বোযর্গানে দ্বীনের বিভিন্ন বর্ণনা থেকে জানা যায়, হযরত ইসমাঈল আলাইহিস সালাম ও তাঁর মাতা সাহেবানী হযরত হাজার রাদ্বিয়াল্লাহু আনহ উভয়-ই (মক্কার) হারাম শরীফের অন্তর্গত আল-হিজর নামের স্থানে সমাহিত হন। এই তথ্য আস্থাভাজন ইতিহাসবিদগণ উল্লেখ করেছেন এবং তা প্রসিদ্ধ ইসলামী ইতিহাসবেত্তাবৃন্দ কর্তৃক সমর্থিত হয়েছে; এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ইবনে এসহাক নিজ সীরাহগ্রন্থে, ইবনে জারির তাবারী তাঁর তারিখপুস্তকে, আস্ সোহায়লী স্বরচিত আল-রওদ আল-উনুফকেতাবে, ইবনুল জাওযী নিজ মুনতাযেমবইয়ে, ইবনুল আসির তাঁর আল-কামেলপুস্তকে, আয্ যাহাবী স্বরচিত তারিখ আল-ইসলামগ্রন্থে এবং ইবনে কাসীর নিজ আল-বেদায়া ওয়ান্ নেহায়াকেতাবে। হুযূর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল-খায়ফ মসজিদে আম্বিয়া আলাইহিস সালাম-এর মাযার-রওযা এবং আল-হিজর স্থানে ইসমাঈল আলাইহিস সালাম ও তাঁর মায়ের দাফন হবার দুটি খবরেরই সত্যতা নিশ্চিত করেছেন, অথচ সে সব মাযার-রওযা সরিয়ে ফেলার নির্দেশ দেননি।
সাহাবা-এ-কেরাম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু-এর আচরিত প্রথা

ইমাম মালেক রহমতুল্লাহি আলাইহি তাঁর মুওয়াত্তাগ্রন্থে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর রওযার স্থান নির্ধারণ নিয়ে সাহাবা-এ-কেরাম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু-এর মধ্যকার মতপার্থক্য উদ্ধৃত করেছেন। তিনি উল্লেখ করেন কতিপয় সাহাবী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হুযূর পূর নূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে মসজিদে নববীর মিম্বরের কাছে দাফন করতে চেয়েছিলেন; অন্যদিকে অপর কিছু সাহাবী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু তাঁকে বাকীকবরস্থানে সমাহিত করতে চেয়েছিলেন। এমতাবস্থায় হযরত আবূ বকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এগিয়ে এসে বলেন,

سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ: «مَا دُفِنَ نَبِيٌّ قَطُّ إِلَّا فِي مَكَانِهِ الَّذِي تُوُفِّيَ فِيهِ» ، فَحُفِرَ لَهُ فِيهِ.
-       আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি, ‘কোনো নবী আলাইহিস সালাম যখনই বেসালপ্রাপ্ত হয়েছেন, তিনি যে জায়গায় বেসালপ্রাপ্ত হয়েছেন তৎক্ষণাৎ সেখানেই তাঁকে দাফন করা হয়েছে” [৬] অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে ঘরে বেসালপ্রাপ্ত হয়েছিলেন, সেখানেই তাঁকে সমাহিত করা হয়।
মসজিদে নববীর মিম্বরের কাছের জায়গা যা নিশ্চিতভাবে মসজিদের অংশ ছিল, তাতে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে দাফন করার পক্ষে পেশকৃত মতামতকে সাহাবী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু-দের কেউই নিষেধ করেননি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বেসালপ্রাপ্ত হবার স্থানে তাঁকে দাফন করার পক্ষে প্রদত্ত তাঁরই আদেশ পালনের উদ্দেশ্যে হযরত আবূ বকর সিদ্দিক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এই মতকে বাস্তবায়ন করেননি। ফলশ্রুতিতে  মা আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহ-এর ঘর, যেটি মুসলমানদের নামায পড়ার স্থান - মসজিদে নববী সংলগ্ন ছিল, তাতে হুযূর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে সমাহিত করা হয়। আমাদের এই যুগের মসজিদগুলোতে তাই একই আদলে সংলগ্ন ঘরে ওলী-আল্লাহবৃন্দের মাযার-রওযা বিদ্যমান।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মোবারক রওযা মসজিদসংলগ্ন ঘরে হওয়া একমাত্র তাঁর জন্যেই খাস বা নির্দিষ্ট বলে যে দাবি করা হয়, তার কোনো বৈধতা নেই। কেননা, তা কোনো প্রামাণিক দলিলের ভিত্তিতে উত্থাপিত নয়। অধিকন্তু, মা আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু যে ঘরে বসবাস করতেন এবং তাঁর ফরয ও নফল এবাদত-বন্দেগী পালন করতেন, তাতে সাহাবা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু-বৃন্দ কর্তৃক সর্ব-হযরত আবূ বকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ও উমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু-কে সমাহিত করার দরুন এই দাবি অন্তঃসারশূন্য বলে প্রমাণিত হয়। হযরতে সাহাবা-এ-কেরাম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু-এর এই কাজ এটি জায়েয বা অনুমতিপ্রাপ্ত হবার পক্ষে তাঁদের এজমাতথা ঐকমত্যের অন্যতম দালিলিক প্রমাণ।

মুসলিম উম্মাহর বাস্তব ঐকমত্য ও উলেমাবৃন্দের সমর্থন 

* পুণ্যবান পূর্ববর্তী প্রজন্ম (মোতাকাদ্দেমীন) ও পরবর্তী প্রজন্মগুলো (মোতাখেরীন) মসজিদে নববী এবং আম্বিয়া আলাইহিস সালাম ও আউলিয়া রহমতুল্লাহি আলাইহি-মণ্ডলীর মাযার-রওযাবিশিষ্ট অন্যান্য মসজিদগুলোতে নামায আদায় করেছেন বিনা আপত্তিতে।

*
ওয়ালিদ ইবনে আব্দিল মালেক ৮৮ হিজরী সালে মদীনার তদানীন্তন শাসনকর্তা উমর ইবনে আব্দিল আযীযকে নির্দেশ দেন যেন তিনি মসজিদে নববীর চত্বরে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর রওযা মোবারককে অন্তর্ভুক্ত করেন। মদীনা মোনাওয়ারার সাত জন নেতৃস্থানীয় আলেমের মধ্যে প্রায় সবাই এতে সম্মতি জ্ঞাপন করেন; ব্যতিক্রম ছিলেন শুধু সাঈদ ইবনে মুসাইয়েব। তিনি আপত্তি করেছিলেন যাতে মুসলমান সমাজ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ঘরকে নজির হিসেবে গ্রহণ করেন এবং তাঁর কৃচ্ছ্রব্রতপূর্ণ জীবনকে আদর্শ মানেন, আর দুনিয়ার ভোগ-বিলাস পরিহার করে চলেন। তাঁর এই আপত্তি মাযারবিশিষ্ট মসজিদে নামায পড়া হারাম মর্মে কোনো মতের ভিত্তিতে তিনি উত্থাপন করেননি। 

হযরত আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা-এর বর্ণিত হাদীস

হযরত মা আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহ বর্ণনা করেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বাণী, যিনি বলেন:
لَعَنَ اللَّهُ اليَهُودَ اتَّخَذُوا قُبُورَ أَنْبِيَائِهِمْ مَسَاجِدَ.
-       আল্লাহ পাক ইহুদী ও খৃষ্টানদের প্রতি লানত (অভিসম্পাত) দিয়েছেন, কেননা তারা তাদের আম্বিয়া আলাইহিস সালাম-বৃন্দের মাযার-রওযাকে মসজিদসমূহ (উপাসনার স্থান) হিসেবে গ্রহণ করেছিল।” [৭]
এই হাদীসে উদ্ধৃত মসজিদসমূহশব্দটি উপাসনার স্থানকে বুঝিয়েছে; মানে তারা ওই সব মাযার-রওযার দিকে  আরাধনার উদ্দেশ্যে সেজদা করতো, যেমনটি করে থাকে মূর্তি পূজারী অবিশ্বাসীরা তাদের প্রতিমার উদ্দেশ্যে। এটি অপর এক সহীহ রওয়ায়াতে সুস্পষ্ট হয়েছে; ইবনে আসআদ স্বরচিত তাবাকাত-এ-কুবরাগ্রন্থে হযরত আবূ হোরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু-এর সূত্রে বর্ণনা করেন মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাদীস, যিনি এরশাদ ফরমান:
اللَّهُمَّ لا تَجْعَلْ قَبْرِي وَثَنًا يُعْبَدُ اشْتَدَّ غضب اللهعَلَى قَوْمٍ اتَّخَذُوا قُبُورَ أَنْبِيَائِهِمْ مَسَاجِدَ .
-       হে আল্লাহ, আপনি আমার রওযাকে পূজা-অর্চনার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করবেন না। যারা তাদের আম্বিয়া আলাইহিস সালাম-বৃন্দের মাযার-রওযাকে মসজিদহিসেবে গ্রহণ করেছিল, তাদের প্রতি আল্লাহ পাক লানত বর্ষণ করেছেন।” ‘[৮]
যারা তাদের আম্বিয়া আলাইহিস সালাম-বৃন্দের মাযার-রওযাকে মসজিদহিসেবে গ্রহণ করেছিল, তাদের প্রতি আল্লাহ পাক লানত বর্ষণ করেছেন’, এই বাক্যটি উক্ত মাযার-রওযাকে উপাসনার স্থান হিসেবে ইঙ্গিত করে। কাজেই হাদীসটির মানে হলো, ‘হে আল্লাহ, মানুষের দ্বারা আমার রওযা শরীফকে (উপাস্য হিসেবে) অর্চনার বস্তুতে পরিণত করবেন না, যেমনটি ঘটেছিল পূর্ববর্তী আম্বিয়া আলাইহিস সালাম-দের মাযার-রওযা নিয়ে তাঁদের অনুসারীদের বেলায়।’[৯]
ইমাম আল-বায়দাবী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন: আল্লাহতালা ইহুদী ও খৃষ্টানদেরকে অভিসম্পাত দিয়েছেন, কারণ তারা তাদের আম্বিয়া আলাইহিস সালাম-বৃন্দের মাযার-রওযাকে উপাস্য বস্তু হিসেবে গ্রহণ করেছিল এবং কিবলা বানিয়ে সেদিকে ফিরে নামায পড়তো। আল্লাহ পাক মুসলমানদেরকে তা অনুকরণ করতে নিষেধ করেছেন। তবে কোনো বোযর্গ তথা ওলী-আল্লাহর মাযারের পাশে মসজিদ নির্মাণ করার বেলায় কোনো আপত্তি নেই; কিংবা তাঁকে পূজা-অর্চনার লক্ষ্যবস্তু না করে তাঁর মাযারের ভেতরে বরকত আদায়ের উদ্দেশ্যে যিকির-আযকার, ধ্যান সাধনা, দোয়া ইত্যাদি করার ক্ষেত্রেও কোনো আপত্তি নেই। তোমরা কি দেখো না, পবিত্র কাবা শরীফের অভ্যন্তরে অবস্থিত হযরত ইসমাঈল আলাইহিস সালাম-এর রওযা পাক এবং হাতিমেসংরক্ষিত মাযার-রওযা হলো এবাদতের সর্বশ্রেষ্ঠ স্থান? নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়েছে শুধু সে সব কবরের বেলায়, যেগুলো থেকে দেহাবশেষ অপসারণ করা হয়েছে এবং তাতে মাটি-আবর্জনা অবশিষ্ট আছে।

ইসলামী আইনে এটি প্রতিষ্ঠিত যে কোনো কবর হয় তার অধিবাসীর ইন্তেকালের আগেই নিজ মালিকানাধীন হতে হবে, নতুবা তাঁর ইন্তেকালের পরে কারো দ্বারা দানকৃত হতে হবে। কবরের জন্যে জমি দাতা (ওয়াকফের) যে সকল শর্তারোপ করবেন, তা (দেশের) আইনপ্রণেতার বিধানের সমকক্ষ বলে বিবেচিত হবে; আর তাই ওই কবরের জমি অন্য কোনো উদ্দেশ্যে ব্যবহার করার অনুমতি নেই।

ইন্তেকাল প্রাপ্তদের পবিত্রতা  
ইসলাম ধর্ম ইন্তেকালপ্রাপ্ত মুসলমানদের পবিত্রতা ক্ষুন্ন করাকে নিষেধ করে এবং কবর থেকে তাঁদের দেহাবশেষ অপসারণের অনুমতি দেয় না। কেননা, ইন্তেকালপ্রাপ্তদের পবিত্রতা জীবিতদেরই পবিত্রতার নামান্তর। যদি কবরবাসী হন আল্লাহতালার কোনো এক প্রিয় বন্ধু, তাহলে এতে আরও জোর নিষেধাজ্ঞা বলবৎ হবে। এমতাবস্থায় তাঁর মাযার বা দেহাবশেষ অপসারণ হবে আরও বড় জঘন্য অপরাধ। এটি এ কারণে যে তাঁরা আল্লাহ পাকের দৃষ্টিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভাবমূর্তির ধারক ও বাহক, আর তাই যে কেউ তাঁদের মাযার-রওযার মান ক্ষুন্ন করলে আল্লাহতালার শাস্তির লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হবে। এতদসংক্রান্ত বিষয়েই হযরত আবূ হোরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন নিম্নের হাদীসে কুদসি, যাতে আল্লাহ পাক এরশাদ ফরমান:
مَنْ عَادَى لِي وَلِيًّا فَقَدْ آذَنْتُهُ بِالحَرْبِ.
-       যে ব্যক্তি আমার ওলী (বন্ধু)-এর প্রতি বৈরী ভাবাপন্ন হবে, তার প্রতি আমি যুদ্ধ ঘোষণা করবো।” [১০]
ফতোওয়া 
ওপরের প্রশ্নে উল্লেখিত দুটি বিদ্যমান মসজিদের পরিবর্তে একটি মসজিদ নির্মাণের অজুহাতে উক্ত দুজন আউলিয়ার মাযার অপসারণ ও তাঁদের পবিত্রতা ক্ষুন্ন করার কোনো অনুমতি-ই নেই। দুটি মসজিদকে সংযুক্ত করা এবং মাযারগুলোকে যেভাবে আছে সেভাবে সংরক্ষণ করা শ্রেয়তর হবে; কেননা কোনো নেক তথা পুণ্যময় কর্ম বিধি-বহির্ভূত পন্থায় সম্পন্ন করার অনুমতি আছে। অনুরূপভাবে, মসজিদের ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে যারা আছেন, মসজিদ নির্মাণের জন্যে মাযারগুলো অপসারণের শর্ত তাদের মেনে নেয়ার কোনো অনুমতিও তাদের নেই।

উপরন্তু, ওই দুটি মসজিদ আলাদা রাখাই শ্রেয়তর হবে, যতোক্ষণ না আল্লাহ পাক তাঁর আউলিয়া কেরামের মর্যাদা ও মাকাম সম্পর্কে জ্ঞানী ন্যায়বান মহাত্মণদের প্রেরণ করেন, যাঁরা আউলিয়াবৃন্দের পবিত্রতা রক্ষা করে দুটি মসজিদের স্থলে একটি মসজিদ নির্মাণ এবং তাতে উভয় মাযার সংরক্ষণ করতে পারবেন, আর ফলশ্রুতিতে ধার্মিকতা ও ধর্মপরায়ণতার ভিত্তিতে মসজিদটিকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হবেন। মহাপরাক্রমশালী আল্লাহতালা-ই সবচেয়ে ভাল জানেন।

তথ্যসূত্র 

[] আল কুরআন : আল কাহাফ, ১৮:২১
[রাযী : মাফাতিহুল গায়িব ওয়া তাফসীরু কবীর, ২১/৪৪৬
[] শিহাবউদ্দিন খাফফাজী : এনায়াতুল কাজী ও কিফায়াতির রাজি।
[] আব্দুর রাযযাক : আল মুসান্নাফ, ৫:৩৩০ হাদীস নং ৯৭২০।
(ক)বূ এসহাক : আল-সীরাহ
(খ) মূসা ইবনে উকবা : মাগাযিয়্যাহ
[] ত্ববরানী : আল মুজামুল কাবীর, ১২:৪১৪ হাদীস নং ১৩৫২৫
     (ক) আল-বাযযার : আল মুসনাদ।
     (খ) ইবনে হাজর নিজ : মোখতাসার যাওয়াঈদ
[] মালেক : আল মুয়াত্তা, ১:২১৪ হাদীস নং ৫৪৯।
[৭] বুখারী : আস সহীহ, ২:৮৮ হাদীস নং ১৩৩০।
     (ক) মুসলিম : আস সহীহ, ১:৩৭৬ হাদীস নং ৫২৯।
[৮] ইবনে আসআদ : তবকাতুল কুবরা, ২:১৮৫।
[৯] অনুবাদকের নোট এই হাদীসে প্রমাণিত হয় যে উম্মতে মোহাম্মদী কখনোই মাযার পূজাকরবেন না। কেননা, উম্মতের জন্যে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দোয়া কবুল হয়ে থাকে। আল্লাহ তা ফিরিয়ে দেন না
[১০] বুখারী : আস সহীহ, বাবুত তাওয়াদ্বিউ, ৮:১০৫, হাদীস নং ৬৫০২।
(ক)ইবনে হিব্বান : আস সহীহ, ২:৫৪ হাদীস নং ৩৪৭।
(খ) ত্ববরানী : আল মু‘জামুল কাবীর, ১২:১৪৫ হাদীস নং ১২৭৫০।
(গ) শরহুস সুন্নাহ : বাগাবী, বাবুত তাকারুব্বি.. ৫:১৯ হাদীস নং ১২৪৭।
(ঘ) ইবনে আসাকীর : আল মু‘জাম, ২:১১০৮ হাদীস নং ১৪৩৮।
(ঙ) বায়হাকী : সুনানুল কুবরা : ৩:৩৪৬ হাদীস নং ৬৬২২।


                                                             
                                                       সমাপ্ত                 


     
       

সোমবার, ২২ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

জানাজা’র নামাজের পর দোয়া করা

আলহাজ্ব মুফতী এস, এম, সাকীউল কাউছার


প্রসঙ্গ কথা

একজন মুসলমানের এ দুনিয়াতে শেষ অনুষ্ঠান নামাজে জানাজা। ইন্তেকালপ্রাপ্ত ব্যক্তির জানাজার নামাজ পড়া জীবিতদের জন্যে ফরজে কেফায়া। জানাজাতে আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীসহ মোটামুটি অনেক মানুষের সমাগম হয়ে থাকে। জানাজার নামাজের পর অনেক মানুষ চলে যান, দাফন পর্যন্ত থাকেন না। দাফনের পর মুনাজাতে মানুষ কম হয়; তাই জানাজার পরপর-ই দোয়া করা হলে অধিক লোকের হাত আল্লাহ’র দারবারে তোলার কারণে ইন্তেকালপ্রাপ্ত ব্যক্তির ওপর আল্লাহ’র দয়া, মাগফিরাত, তাঁর কবর ও আখিরাতের জীবন আরও উন্নত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে । এই দোয়ার ব্যাপারে শরীয়তের কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই, বরং এটি মুস্তাহাব। অথচ এ পুণ্যময় কাজটিকে অনেকে ’বিদআত’ (শরীয়তগর্হিত নতুন প্রবর্তিত প্রথা) বলে আখ্যা দেয় এবং জানাজা’র নামাজে দোয়া আর মুনাজাতের দরকার নেই বলে সাধারণ মুসলমানকে বিভ্রান্ত করে থাকে। জানাজার পর এবং দাফনের পরেও দোয়া করা হাদীস শরীফ দ্বারা প্রমাণিত। অতএব, এ বিষয়ে শরীয়তের দৃষ্টিকোণ থেকে আলোকপাত করছি। 

জানাজা-নামাজ দোয়া নয়


ফরজ নামাজ দুই প্রকার - ফরজে আইন (৫ ওয়াক্তের নামাজ) ও ফরজে কেফায়া (জানাজার নামাজ)। নামাজের জন্যে অনেক শর্ত রয়েছে, যেমন পবিত্রতা, কেবলামুখি হওয়া, নিয়্যত করা, তাকবীরে তাহরিমা, সালাম ফিরিয়ে নামাজ শেষ করা ইত্যাদি। ৫ ওয়াক্ত নামাজ ও জানাজার নামাজসহ সকল নামাজ তাকবীরে তাহরীমা দ্বারা শুরু হয় এবং ডানে-বামে সালাম দ্বারা শেষ হয়। কিন্ত দোয়া-মুনাজাতের মধ্যে এগুলো শর্ত নয়। অতএব, নামাজ ও দোয়ার মধ্যে অনেক পার্থক্য বিদ্যমান। জানাজার নামাজে নিয়্যতের মধ্যে “সালাসাতিল জানাজা”, অর্থাৎ, জানাজার সালাত বা নামাজ উল্লেখ আছে। তাই তা নামাজ যা ইমামের পেছনে মরদেহকে সামনে রেখে কেবলামুখি হয়ে কাতার-বন্দী অবস্থায় আদায় করতে হয়। অনেকে বলে জানাজার মধ্যে দোয়া আছে, তাই এটাই দোয়া (?)। আমরা বলবো, ৫ ওয়াক্ত নামাজের ভেতরও দোয়া (দোয়া মাসুরা,সানা ইত্যাদি), জিকির (রুকু-সিজদার তাসবীহ ইত্যাদি) ও দারূদ আছে। তাই বলে কি নামাজকে দোয়া, জিকির ও দরূদ বলা হয়? আল্লাহ্‌ পাক বলেন - اقيموا الصلوة لذكرى (আকিমুস্ সালাতা লে জিকরি); অর্থাৎ, আমার জিকির বা স্মরণের উদ্দেশ্যে তোমরা সালাত বা নামাজ কায়েম করো। এখন কি কেউ বলতে পারবে যে নামাজ-ই জিকির, আর তাই জিকির করতে হবে না ?


বস্তুতঃ জানাজার নামাজের ভেতরে দোয়া থাকলেও তাকে শুধু দোয়া বলা যাবে না; বরঞ্চ তা নামাজ। তাছাড়া দোয়া বার বার করা যায়, এতে উপকার ছাড়া ক্ষতি নাই। জানাজার নামাজ ‘ফরজে কেফায়া’, আর দোয়া হলো ‘সুন্নাত’। হাদীসে বর্ণিত আছে - اكثرو الذعاء অর্থাৎ, বেশি করে দোয়া প্রার্থনা করো। জানাজাও অনেক সময় ২/৩/৪ বার হয়। তাহলে জানাজার পর হাত তুলে আবার আল্লাহ’র দরবারে দোয়া করাতে অসুবিধা কী? আর দোয়াও এক প্রকার ইবাদত। মিশকাত শরীফের কিতাবুদ দাওয়া’তে একখানি হাদীস বর্ণিত আছে - الدعاء هو العبادة অর্থাৎ, দোয়া এক ধরনের ইবাদত। একই জায়গায় এই হাদীস খানাও আছে - الدعاء مخ العبادة অর্থাৎ, দোয়া ইবাদতের মূল বা সারবস্তু। আর জানাজার নামাজ ফরজ ইবাদত।


জানাজা নামাজের পর দোয়ার প্রমাণ
 
আবু দাউদ শরীফ হতে মেশকাত শরীফের ‘সালাতুজ জানাজা’ অধ্যায়ের দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে বর্ণিত একটি হাদিসে ঘোষিত হয়েছে - اذا صليتم على الميت فاخلصوا له الدعاء (ইজা সাল্লাইতুমু আ’লাল মাইয়্যেতে ফাখলিসু লাহুদ দোয়া); অর্থাৎ, যখন তোমরা ইন্তেকালপ্রাপ্ত ব্যক্তির জানাজার নামাজ আদায় করে নাও, তখন আন্তরিকভাবে তার জন্যে দোয়া করো।


ওপরে উদ্ধৃত হাদীসে ‘ফা’ হরফ বা অক্ষর দ্বারা জানাজার নামাজ ও দোয়াকে আলাদা করা হয়েছে। অর্থাৎ, নামাজের পরপর-ইেইন্তেকালপ্রাপ্ত ব্যক্তির জন্যে দোয়া করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। যারা এ হাদীসের অর্থ ‘জানাজার মধ্যে দোয়া করো’ বলে, তারা ‘ফা’-এর অর্থ সম্পর্কে অজ্ঞ। কারণ আরবী ব্যাকরণ অনুযায়ী ‘সাল্লাইতুম’ হচ্ছে শর্ত এবং ‘ফাখলিসূ’ এর জাযা। শর্ত ও জাযার মধ্যে পার্থক্য থাকা বাঞ্ছণীয়, একটা অন্যটার অন্তর্ভুক্ত নয়। আর ‘সাল্লাইতুম’ হলো অতীতকালজ্ঞাপক ক্রিয়া এবং ‘ফাখলিসূ’ হলো আদেশ বা নির্দেশাত্মক ক্রিয়া। তাই বোঝা গেল, নামাজ পড়ার পরই দোয়ার নির্দেশ রয়েছে। যেমন কোরআনে আছে - فااذا طعمتم فانتشروا অর্থাৎ, যখন খাওয়া শেষ হবে, তখন ছড়িয়ে পড়ো। এখানেও ‘ফা’ শব্দ দ্বারা খাওয়ার পর ছড়িয়ে পড়তে বলা হয়েছে, খাওয়ার মাঝখানে নয়।


মেশকাত শরীফের একই জায়গায় আরও উল্লেখ আছে - قرء على الجنازة بفاتحة الكتاب (ক্বারা’আ আ’লাল জানাজাতে বে ফাতিহাতিল কিতাব); অর্থাৎ, হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জানাজায় সূরা ফাতিহা পাঠ করেছেন।
এ হাদীসের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে মেশকাত শরীফের ব্যাখ্যা ‘আশ’আতুল লুময়াত’ কিতাবে উল্লেখ আছে, “সম্ভবত হুজুর সাল্লল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জানাজার নামাজের পরে বা আগে বরকতের জনন্যে সূরা ফাতিহা পাঠ করেছেন, যেমন আজকাল এর প্রচলন দেখা যায়।” এর থেকে বোঝা গেল, মুহাদ্দিসকুল শিরোমণি হযরত আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহেলবী (র:)-এর যুগেও জানাজার নামাজের আগে বা পরে বরকতের জন্যে সূরা ফাতিহা পাঠের প্রচলন ছিল। তিনি এটিকে নিষেধ করেননি, বরং তা হাদীসের অনুসরণ-ই বলতে চেয়েছেন। আর সুরা ফাতিহা পাঠও এক প্রকার দোয়া।


বিখ্যাত ‘ফতহুল কাদির’ কিতাবের ‘জানাজার নামায’ পরিচ্ছেদে বর্ণিত আছে, হজুর আলাইহিস সালাম মিম্বরের ওপর দাঁড়িয়ে মুতা যুদ্ধের খবর দিলেন। এর মধ্যে হযরত জাফর ইবনে আবি তালিব (রা:)-এর শাহাদাতের খবর দিলেন। فصلى عليه رسول الله صلى الله عليه وسلم و دعاله و قال استغفروا له অর্থাৎ, অতঃপর তাঁর নামাজে জানাজা পড়লেন, এবং তাঁর জন্যে দোয়া করলেন; আর মানুষজনকে বললেন, তোমরাও তার মাগফিরাতের জন্যে দোয়া করো। উল্লেখিত ইবারতে ‘দোয়া’ শব্দের আগে ‘ওয়াও’ অব্যয় দ্বারা বোঝা যায়, এ দোয়া নামাজের পর-ই করা হয়েছিল।


মাওয়াহিবে লাদুনিয়া কিতাবের দ্বিতীয় খণ্ডের দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে আরবী  فيما اخبر من الغيوب -এর ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে উপরোক্ত ঘটনা হুবহু বর্ণনা করার পর বলেছেন - ثم قال استغفروا استغفرو له (সুম্মা ক্বালা এস্তাগফেরু এস্তাগফেরুলাহু); অর্থাৎ, মাগফিরাত কামনা করো, তার জন্যে মাগফিরাত কামনা করো। এ রকম হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা (রা:) জানাজার পর দোয়া করেছেন। অতএব, প্রমাণিত হলো যে জানাজার পর মাগফিরাতের জন্যে দোয়া করা জায়েয ও সুন্নাত।


সামশুল আয়িম্মা সরখসি (র:)-এর রচিত “মাবসুত” শীর্ষক কিতাবের দ্বিতীয় খণ্ডের ৬০ পৃষ্ঠায় ‘গোসলিল মাইয়্যেত’ অধ্যায়ে বর্ণিত আছে, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা:) একবার জানাজার নামাজের পর উপস্থিত হন এবং বলেন - ان سبقتمونى بالصلوة عليه فلا تسبقونى بالدعاء অর্থাৎ, যদিও তোমরা আমার আগে নামাজ পড়ে ফেলেছো, কিন্তু দোয়ার সময় আমার আগে যেয়ো না। অর্থাৎ, আমার সাথে দোয়ায় শরীক হও। ‘মাসবুত’ কিতাবের একই জায়গায় সর্ব-হযরত ইবনে উমর (রা:), আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা:) এবং আব্দুল্লাহ ইবনে সালাম (রা:) থেকে প্রমাণ করেছেন যে তাঁরা জানাজার নামাজের পর দোয়া করেছেন; এবং উপরোক্ত হাদীসের ‘ফালা তাশবেকু’ বাক্য দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে জানাজার পর দোয়া করার আমল সাহাবায়ে কিরাম (রা:) পালন করতেন। অতএব, জানাজার পর দোয়া করা বেদআত-নাজায়েয বলা স্রেফ গোমরাহি।


প্রত্যেক ফরজ নামাজের পর দোয়া করা সুন্নাত এবং তাতে দোয়া কবুল হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। যেমন - মিশকাত শরীফে ‘আজ জিকরু বা’দাস্ সালাত’ অধ্যায়ে বর্ণিত আছে - قيل يا رسول الله اى الدعاء اسمع قال جوف الليل الاخر و دبر الصلوة المكتوبات অর্থাৎ, হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে আরজ করা হলো, কোন্ সময়ের দোয়া বেশি কবুল হয়। তিনি এরশাদ করেন, শেষ রাত্রির মধ্যবর্তী সময় ও ফরজ নামাজের পরে। জানাজার নামাজও ফরজ (ফরজে কেফায়া)। তাই জানাজার পরেও দোয়া করলে কবুল হওয়ার আশা বেশি। ইন্তেকালপ্রাপ্ত ব্যক্তির জন্যে যা নাজাতের অসীলা হতে পারে।


ইমাম আবূ দাউদ (রহ:) ও ইমাম বায়হাকী (রহ:) ‘হাসান’ এসনাদে হযরত উসমান (রা:) থেকে বর্ণনা করেন; তিনি বলেন: মহানবী (দ:) ইন্তেকালপ্রাপ্ত কারো দাফনের পরে তাঁর (কবরের) পাশে দাঁড়াতেন এবং বলতেন, ‘এই ইন্তেকাল প্রাপ্তের গুনাহ মাফের জন্যে দোয়া করো, যাতে সে দৃঢ় থাকে; কেননা তাকে (কবরে) প্রশ্ন করা হচ্ছে।‘


অতএব, প্রমাণিত হলো যে শরীয়তের দৃষ্টিতে জানাজার পর ও দাফনের পর দোয়া করা সুন্নাত-মোস্তাহাব; বেদআত বা নাজায়েয নয়। 


                                                               সমাপ্ত

বৃহস্পতিবার, ১১ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

হাদীসের দৃষ্টিতে রাসূল (দ:)-এর কৃপা/অসীলা



-- ওয়াহিদ মনজু 

হাদিস নং - ১

হযরত আবু হুরায়রা (রা:) একবার আরয করেন, "ইয়া রাসূলাল্লাহ (দরুদ), আমি আপনার কাছ থেকে অসংখ্য হাদীস শুনি, কিন্তু তা ভুলে যাই; মনে রাখতে পারিনা। আমি কামনা করি আপনার পবিত্র মুখনিঃসৃত বাণী যেন আর কখনোই না ভুলি।” তখন হুজূর (দ:) বললেন, "তোমার চাদর বিছিয়ে দাও।” অতঃপর হযরত আবু হুরায়রা (রা:) তা বিছিয়ে দিলেন। তখন আকা (দ:) তাঁর হাত মুবারকে শূন্য থেকে কী যেন ওই চাদরের মধ্যে রাখেন, অতঃপর বলেন, "চাদর ভাঁজ করে ফেলো।” তিনি তা ভাঁজ করে নিলেন। হযরত আবু হুরায়রা (রা:) বলেন, ”এরপর আর কোনো দিন কিছু ভুলিনি।” [অধ্যায়: কিতাবুল ইলম, বোখারী শরীফ]

সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ

এখানে হযরত আবু হুরায়রা (রা:)-এর মতো প্রসিদ্ধ সাহাবী, যিনি অধিক হাদিস রেওয়ায়েতকারী এবং আহলে সুফফার একজন আল্লাহ-পাগল রাসূল-প্রেমিক, তিনিও হুজুর নবী করীম (দ:) থেকে ভুলে যাওয়ার ব্যাপারে পরিত্রাণ চাচ্ছেন। তাঁর চাওয়াতে হুজুর পাক (ধ:)-এর কোনো অভিযোগ ছিলনা, মুশরিক-ও আখ্যা দেননি।

হাদিস নং - ২

হযরত উসমান ইবনে হানীফ (রা:) থেকে বর্ণিত আছে, এক অন্ধ ব্যক্তি হুযুর (আলাইহিস সালাম)-এর মহান দরবারে উপস্থিত হয়ে অন্ধত্ব দূর হবার জন্যে তাঁর দোয়াপ্রার্থী হয়েছিলেন। হুযুর (আলাইহিস সালাম) তাঁকে শিখিয়ে দিলেন এ দু’আটি: 

اَلَّهُمَّاِنِّىْ اَسْئَلُك
َ وَاَتَوَ جَّهُ اِلَيْكَ بِمُحَمَّدٍ نَّبِىِّ الرَّحْمَةِ يَا مُحَمَّدُ اِنِّىْ قَدْتَوَجَّهْتُ بِكَ اِلَى رَبِّىْ فِيْ حَاجَتِىْ هذِه لِتَقْضِىَ اَللَّهُمَّ فَشَفِّعْهُ فِىَّ قَالُ اَبُوْا اِسْحقَ هذَا حَدِيْثٌ صَحِيْحٌ

[হে আল্লাহ, আমি অাপনার কাছে সাহায্য প্রার্থনা করছি রহমতের নবী মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) মারফত; আপনার দিকে মনোনিবেশ করছি। হে মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়ামাল্লাম), আমি আপনার মাধ্যমে আপন প্রতিপালকের দিকে আমার এ উদ্দেশ্য (অন্ধত্ব মোচন) পূরণ করার উদ্দেশ্যে মনোনিবেশ করলাম, যাতে আপনি আমার এ উদ্দেশ্য পূরণ করে দেন। হে আল্লাহ, আমার অনুকূলে হুযুর (আলাইহিস সালাম)-এর সুপারিশ কবুল করুন।]

[রেফারেন্স: ইবনে মাজা শরীফের সালাতুল ‘হাজত’ শীর্ষক অধ্যায়]

এ হাদীসটির বিশুদ্ধতা প্রসঙ্গে হযরত আবু ইসহাক (রহ:) বলেন, এ হাদীসটি বিশুদ্ধ (সহীহ)।

লক্ষ করুন,  দু’আটি কিয়ামত পর্যন্ত ধরাপৃষ্ঠে আগমনকারী মুসলমানদের জন্যে শিক্ষার বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়। এখানে হুযুর (আলাইহিস সালাম)-কে আহবান করা হয়েছে এবং তাঁর সাহায্য ও প্রার্থনা করা হয়েছে। এখানে দুটো শব্দ সুষ্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে, "বি মুহাম্মাদিন" ও "বিকা"; এই শব্দ দুটো সুষ্পষ্টভাবেই রাসূল (দ:)-এর অসীলা উল্লেখ করে। তাতে কন্টেক্সট্ ও কনটেক্সট্ দিয়ে ভুল ব্যাখ্যার সুযোগ নেই।

শিক্ষা 

আল্লাহর কাছে অনুগ্রহপ্রাপ্ত ও সম্মানিত কোনো পুণ্যাত্মার অসীলায় কোনো কিছু চাওয়ার ক্ষেত্রে অন্তর্নিহিত আকীদা থাকে, "তিনি যেহেতু আল্লাহর দরবারে সম্মানিত ও অনুগ্রহপ্রাপ্ত, তাই আল্লাহ-প্রদত্ত ক্ষমতাবলে তিনি সাহায্য-সহযোগিতা করতে সক্ষম, বিপদ থেকে উদ্ধার করতেও সমর্থ।" এতে শিরকের গন্ধ যারা খুঁজে, তাদের জ্ঞানের ব্যাপারে আমি সন্দিহান। অস্পষ্ট আয়াত ও যে আয়াত মূর্তিদের ব্যাপারে নাজিল হয়েছে, তার হুকুম নবী (আ:) ও ওলী (রহ:)-দের প্রতি আরোপ করে আমাদের মুসলিম ভাইদের বিভ্রান্ত করা হচ্ছে। মনে খুব-ই কষ্ট হয়।
 

আমার কিছু ভাইয়ের আপত্তি থাকতে পারে: হুজূর (দ:)-এর বেসালের পর চাওয়া শিরক। তাদের বলছি, প্রতি খলিফার আমলে অনেক রেওয়ায়াতে এই আচার প্রমাণিত, যা অতি বিশুদ্ধ। অনেক হাদীস থেকে মাত্র একখানি এখানে পেশ করা হলো:

اصاب الناس قحط في زمان عمرفجاء رجل الئ قبرالنبئ صلي الله عليه وسلم فقال يا رسول الله استسف لامتك فانهم قد هلكوا فاتي الرجل فى المنام فقيل له اءت عمر فاقرأه السلام واخبره انكم مستقيمون

আল মুসান্নাফ, খণ্ড - ১২, নং ১২০৫১
ফাতহুল বারী, শরহে বোখারী, খণ্ড - ২, পৃষ্ঠা - ৪১২, ৪৯৫

উমার (রা:)-এর জমানায় অনাবৃষ্টিতে মুসলমানবৃন্দ আক্রান্ত হলে এক ব্যক্তি (বিলাল বিন হারিস) নবী (দ:)-এর রওযা শরীফে এসে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ (দ:)! আপনি বৃষ্টির জন্যে দোয়া করুন, আপনার উম্মত ধ্বংসপ্রায়। অতঃপর ওই সাহাবী (রা:)-কে স্বপ্নে মহানবী (দ:) জানান, উমর (রা:)-এর কাছে যাও, সালাম জানাও, অতঃপর তাঁকে এই খবর দাও যে নিশ্চয় তোমাদের বৃষ্টি দেয়া হবে।

এই হাদিসটির শুদ্ধতা সম্পর্কে ইমাম ইবনে আবি শাইবা ও আল্লামা ইবনে হাজার আস্কালানি (রা:) বলেন, হাদীসটি সনদে বিশুদ্ধ।

নুক্তা: দেখুন, এখানে কয়েকটি বৈধ বিষয় উল্লেখ্য।

→হুজুর (দ:)-এর বেসালের পর হযরত বিলাল বিন হারিস (রা:)-এর দ্বারা তাঁর রওযায় যাওয়া।
→ইয়া রাসূলাল্লাহ বলে ডাকা।
→সমস্যা সমাধানের ইঙ্গিত পাওয়া হুজুরে পাক (দ:) থেকে।

উপরেল্লেখিত হাদীসসমূহ সুরা আল মায়িদার ৩৫ নং আয়াতের সুষ্পষ্ট ব্যাখ্যা, যাতে ইরশাদ হয়েছে: 


يا ايها الذين امنوا اتقواالله وابتغوا اليه الوسيلة


হে মুমিনগণ, তোমরা খোদা-ভীরুতা অবলম্বন করো এবং আল্লাহর প্রতি (নৈকট্যের জন্যে) অসীলা তালাশ করো (গহণ করো)।

বি:দ্র: এই বিষয়ে এতো সুষ্পষ্ট দলীলসমূহ আছে যে তা কল্পনাতীত। এটি অনেক আলোচনা সাপেক্ষ। আগামীতে ওয়াসীলা ও ইস্তিগাসা নিয়ে কোরান ও সহীহ হাদীসের আলোকে লেখার আশা রইলো, যা’তে ইমাম বোখারী (রহ:)-এর কিতাবের একটি অধ্যায়, বাবু মান ইস্তায়ানা বিদুয়াফায়ে ও সালিহীন (দুর্বল ও ওলী থেকে সাহায্য প্রার্থনা অধ্যায়) অন্তর্ভুক্ত থাকবে, ইনশাআল্লাহ।

পরিশেষে আবেদন করছি, জিয়ারাত ও অসীলা কেউ মানতে না চাইলে মানবেন না। এটাকে ফিকহি মতানৈক্যের মাসয়ালা হিসেবে নিয়ে আপন পথ অনুসরণ যে কেউ করতে পানে। কিন্তু ফাতোয়াবাজী করে মুসলিম মিল্লাতকে বিভাজন করার অধিকার কারো নেই। একটি আশা জাগানো কথা বলে শেষ করছি, সম্প্রতি হেফাজাত নেতৃবৃন্দের পক্ষ থেকে হুজূর পাক (দ:)-এর রওযা মোবারক অন্যত্র সরানোর প্রতিবাদে
পত্রিকায় প্রদত্ত এক ঘোষণায় বলা হয়, ”আমাদের নবী (দ:) হায়াতুন্নবী, জিন্দা নবী (দরুদ)।” এটি প্রমাণের জন্যে আলেমবৃন্দ সারা জীবন কোরআন-হাদীস দিয়ে বুঝিয়েছেন আমাদের। এখন সবাই ঐকমত্য পোষণ করছেন। আল-হামদু লিল্লাহ! ইনশাআল্লাহ অদূর ভবিষ্যতে আরো অনেক বিষয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়ে এক উম্মায় আমরা পরিণত হবো এবং এই বাণীর اعتصموا بحبل الله جميعا প্রতিফলন ঘটবে।

ইনশাআল্লাহ, জাযাকাল্লাহ, সাল্লু আলাল হাবিব।