ব্লগ সংরক্ষাণাগার

শুক্রবার, ৮ জানুয়ারী, ২০২১

বাইবেল কি খোদার বাণী?



মূল: মরহূম জনাব আহমদ দীদাত

অনুবাদ: এডমিন


[Bengali translation of late Ahmed Deedat's booklet "Is the Bible God's Word?" Translator: Admin]


অনুবাদকের আরজ


জনাব মরহূম আহমদ দীদাতের ধর্মপ্রচার মিশনের সাথে আমার পরিচয় ঘটে ১৯৮৫ সালে। ডাক্তার তারেক সিদ্দীকী সাহেবের মাধ্যমে দক্ষিণ আফ্রিকায় অবস্থিত ইসলামিক প্রপাগেশন সেন্টার ইন্টারন্যাশানাল সংস্থার ঠিকানা আমি পাই। পত্র-মারফত যোগযোগ করার পরে সেখান থেকে ২ প্যাকেট-ভর্তি বই আসে। দুবাইয়ের শাখা অফিস থেকে আসে আরো এক প্যাকেট। এগুলোর সবই বিনামূল্যে বিতরণকৃত। আমি অবিলম্বে ‘বাইবেল কি খোদার বাণী?’ পুস্তিকাটির অনুবাদ সুসম্পন্ন করি (১৯৮৬)। কিন্তু পুস্তিকাটির প্রথম সংস্করণ বের হয় ১৯৯৫ সালে। বাংলা সংস্করণের ২টি কপি আমি দক্ষিণ আফ্রিকায় জনাব আহমদ দীদাতের কাছে ডাকযোগে প্রেরণ করি। তিনি খুশি হয়ে আমাকে একটি পত্র লেখেন, কিন্তু কালের বিবর্তনে সেটা সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়নি। 


বর্তমানে এই দ্বিতীয় সংস্করণটিতে আরো সম্পাদনা করা হয়েছে। তবে অষ্টম অধ্যায়ের সূচনায় লেখক বিভিন্ন বাইবেল সংস্করণের মধ্যে ইংরেজি ভাষাগত সূক্ষ্ম পার্থক্য তুলে ধরায় সেই অংশটুকু আমি অনুবাদ করিনি। কেননা তা স্রেফ ইংরেজি পাঠকবৃন্দ-ই ভালো বুঝতে সক্ষম হবেন; বাংলায় তা প্রকাশ করা যেমন কঠিন, তেমনি অনর্থকও। আমাদের ভাষায় প্রকাশিত বাংলা বাইবেলে এসব রেফারেন্স নেই। কেবল দুটো সংস্করণ বাংলায় পাওয়া যায়: পণ্ডিত উইলিয়াম কে’রীর অনূদিত বাংলা বাইবেল (বাংলাদেশ বাইবেল সোসাইটি সংক্ষেপে বিবিএস কর্তৃক প্রকাশিত ১৯৮৪ সংস্করণ) এবং বাংলাদেশ বাইবেল সোসাইটির প্রকাশিত ‘কিতাবুল মোকাদ্দাস’ (২০০০ সংস্করণ)। আমি দুটো সংস্করণের রেফারেন্স-ই এ পুস্তিকায় ব্যবহার করেছি।  


আল্লাহতা’লা আমার পীর ও মুর্শীদ (রহ:)’এর অসীলায় এই ক্ষুদ্র প্রয়াসকে ক্ববূল করে নিলেই আমার শ্রম সার্খক হবে। মরহূম আহমদ দীদাত সাহেবের হক্বও আদায় হবে, ইনশা’আল্লাহ।     

- কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন


প্রথম অধ্যায়: তাঁরা যা বলেন

খৃষ্টানদের স্বীকারোক্তি


বিশ্বের খ্রীষ্টান ইভানজেলিকাল মিশনগুলোর মধ্যে অন্যতম বিখ্যাত যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো নগরীতে অবস্থিত মূডি বাইবেল ইন্সটিটিউটের ড: ডব্লিউ গ্রাহাম স্ক্রগী ‘বাইবেল কি খোদার বাণী?’ শীর্ষক প্রশ্ন, যা তাঁর বইয়েরও শিরোনাম, ওর উত্তরে তাঁর বইয়ের ‘মানবীয় তবু ঐশী’ অধ্যায়ে লেখেন: 

“হ্যাঁ, বাইবেল মানবীয়, যদিও অনেকে জ্ঞান দ্বারা নয়, বরং ধর্মীয় ভাবাবেগ দ্বারা পরিচালিত হয়ে তা অস্বীকার করেছেন (মানে অজ্ঞতার কারণে অস্বীকার করেছেন)। এই বইগুলো (বাইবেল একটি নয় বরং ৬৬ টি বইয়ের সমষ্টি) মানুষের মস্তিষ্কসমূহ হতে নিঃসৃত, মানুষের ভাষায় রচিত, মানব-হস্তে লিখিত, আর এগুলোর রচনাশৈলীতে ছাপ ফেলেছে মানুষেরই গুণগত বৈশিষ্ট্য।” [Is the Bible the Word of God? ১৭ পৃষ্ঠা; এমফেসিস লেখক আহমদ দীদাতের]


অপর এক খ্রীষ্টান পণ্ডিত, জেরুসালেমের এ্যাংলিকান বিশপ মি: কেনেথ ক্র্যাগ তাঁর লিখিত 'The Call of the Minaret' পুস্তকের ২৭৭ পৃষ্ঠায় বলেন: 


“(বাইবেলের) নতুন নিয়মের ক্ষেত্রে তা নয় (আল-ক্বুরআনের বৈসাদৃশ্যস্বরূপ).....এতে রয়েছে সংক্ষিপ্তকরণসম্পাদনা; এতে রয়েছে পছন্দ, পুনর্মুদ্রণসাক্ষ্য। গসপেল তথা সুসমাচারগুলো সেগুলোর রচয়িতাদের সমর্থনদাতা চার্চের মস্তিষ্ক হতে নিঃসৃত হয়েছে। সেগুলো অভিজ্ঞতাইতিহাসের প্রতিনিধিত্ব করে।” 


কথার যদি কোনো মানে থাকে, তাহলে আমাদের দাবিকে প্রমাণ করার জন্যে আর কোনো মন্তব্য যোগ করার প্রয়োজন আছে কি? অবশ্যই না! কিন্তু পেশাদার প্রপাগান্ডাকারীরা থলের বিড়াল বের করে দেয়ার পরও নির্লজ্জভাবে তাঁদের পাঠকদেরকে বিশ্বাস করাতে চান যে তাঁরা এ কথা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করেছেন, বাইবেল হচ্ছে ‘তর্কাতীতভাবে খোদার বাণী।’ তাঁদের কথার মারপ্যাঁচ ও কূটকৌশলপূর্ণ বাক্যজাল সত্যি অবাক করার মতো!


এই দুই ধর্মশাস্ত্রজ্ঞ (Doctors of Religion) মানবের পক্ষে যতোটুকু সম্ভব ততোটুকু স্পষ্ট ভাষায় আমাদের জানাচ্ছেন যে বাইবেল মানব হস্তে লিখিত, অথচ অপর দিকে তাঁরা ভান করছেন এর বিপরীত ধারণাই তাঁরা প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছেন। একটি আরবী প্রবাদের ভাবানুবাদ নিম্নরূপ: “পুরোহিতবর্গ এ ধরনের হলে খোদাতা’লা ধর্মসভার মঙ্গল করুন!”


এ রকম আবোল-তাবোল বকে টাটকা সুসমাচার ও বাইবেলের উগ্র প্রচারকারীরা ‘অবিশ্বাসী’ (ড: স্ক্রগীর একই মুডী প্রেস কর্তৃক প্রকাশিত How Lost are the Heathen? দ্রষ্টব্য)-দেরকে (মানে মুসলিম কিংবা অন্যান্য ধর্মাবলম্বীকে) নাকাল করতে ‘অনুপ্রাণিত’ (প্রত্যাদিষ্ট) হন। উইট্ ওয়াটারস্ র‌্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জনৈক (খ্রীষ্টান) ধর্মশাস্ত্র বিভাগের তরুণ ছাত্র যিনি তখনো শিক্ষা সমাপনের সনদ পাননি, তিনি জোহানেসবার্গের নিউটাউন মসজিদের মুসল্লিদের মাঝে ‘সাক্ষ্য’ (খ্রীষ্টানরা witnessing বা ‘সাক্ষ্য’ বলতে বোঝান প্রচারণা, ধর্মান্তরকরণ) দেবার ‘মহৎ’চিন্তায় ঘনঘন সেখানে আগমন করতে থাকেন। আমাকে (মানে লেখক আহমদ দীদাতকে) তাঁর সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার (এবং আমি তাঁর উদ্দেশ্য জানার) পরে আমি তাঁকে আমার ভাইয়ের বাসা, যেটা মসজিদের পাশেই অবস্থিত ছিলো, সেখানে খাবার গ্রহণের জন্যে দাওয়াত করি। খাবার টেবিলে বাইবেলের প্রামাণিকতা সম্পর্কে আলোচনাকালে এবং তাঁর জেদি কট্টরবাদিতা অনুভব করে আমি তাঁর মনোভাব আগাম জানার উদ্দেশ্যে একটি কৌশল প্রয়োগ করে বলি: “আপনাদের অধ্যাপক গায়জার (ধর্মশাস্ত্র বিভাগ প্রধান) বিশ্বাস করেন না যে বাইবেল খোদার বাণী।” ন্যূনতম বিস্মিতও না হয়ে তিনি উত্তর দেন: “আমি জানি।” আসলে বাইবেল সম্পর্কে অধ্যাপক সাহেবের বিশ্বাসের ব্যাপারে ব্যক্তিগতভাবে আমি কিছুই জানতাম না। ‘ঈসা মসীহ (আলাইহিস্ সালাম)’ ঐশিক/খোদা কি-না সে সম্পর্কে তাঁকে (ওই অধ্যাপককে) জড়িয়ে যে বিতর্কের ঝড় উঠেছিলো, তা থেকেই আমি এটা ধরে নিয়েছিলাম। তিনি কয়েক বছর আগে এ বিষয়ে অর্থডক্স (গোঁড়াপন্থী) খ্রীষ্টানদের সাথে বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন। অতঃপর আমি ওই তরুণ প্রচারককে বলি, “আপনাদের (বিশ্ববিদ্যালয়ের) প্রভাষক-ও বিশ্বাস করেন না যে বাইবেল খোদার বাণী।” ওই তরুণ পাদ্রী আবার উত্তর দেন, “আমি জানি,” তবে তিনি আরো যোগ করেন, “কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, বাইবেল খোদার বাণী!” এই ধরনের মানুষের জন্যে কোনো আরোগ্যকর চিকিৎসা নেই। এমন কী হযরত ঈসা (আলাইহিস্ সালাম)-ও এই ব্যাধি সম্পর্কে শোক প্রকাশ করে বলেছিলেন: “তারা দেখেও দেখে না, শুনেও শুনে না এবং বোঝেও না।” [মথি ভাববাদীর পুস্তক, ১৩:১৩; বিবিএস ১৯৮৪]


মহান আল্লাহতা’লার পবিত্র গ্রন্থ আল-ক্বুরআনও এই জেদি/একগুঁয়ে মানসিকতার নিন্দা করেছে; এরশাদ হয়েছে:


صُمٌّ بُكْمٌ عُمْيٌ فَهُمْ لاَ يَرْجِعُونَ


অর্থ: মূক, বধির ও অন্ধ; তারা (সঠিক পথে) প্রত্যাবর্তন করবে না। [২:১৮; সরাসরি অনুবাদ]


এই পুস্তিকার পরবর্তী পৃষ্ঠাগুলো সে সব আন্তরিক ও বিনয়ী আত্মাকে উদ্দেশ্য করে লেখা হয়েছে, যাঁরা প্রকৃতপ্রস্তাবেই খোদার নূর/জ্যোতি তালাশে আগ্রহী এবং তা দ্বারা হেদায়াত বা সঠিক পথ-প্রদর্শিত হবার আকাঙ্ক্ষী। আর যাদের রূহ (আত্মা) ব্যাধিগ্রস্ত, এখানে উপস্থাপিত তথ্য-উপাত্ত শুধু তাদের অন্তরের ব্যাধিকে আরো বৃদ্ধি করবে মাত্র।


দ্বিতীয় অধ্যায়

মুসলমানদের অবস্থান


পূর্ব অনুমানপ্রবণ খ্রীষ্টান সম্প্রদায়


খ্রীষ্টধর্মের এক হাজার একটি গোত্র ও ডিনোমিনেশনের মধ্যে ক্যাথলিক-ই হোক আর প্রটেষ্টান্ট কিংবা কালটিষ্ট-ই হোক, কখনোই আপনি এমন কোনো মিশনারী পাদ্রী খুঁজে পাবেন না, যিনি আপাতঃ দৃষ্টিতে (prima facie) ধরে নেবেন না যে তাঁর দ্বারা সম্ভাব্য ধর্মান্তরযোগ্য ব্যক্তিটি তাঁরই ‘পবিত্র বাইবেল’-কে সকল ধর্মীয় মতামতে/সিদ্ধান্তে চূড়ান্ত কর্তৃত্বের অধিকারী হিসেবে গ্রহণ করছেন। সম্ভাব্য ধর্মান্তরযোগ্য ব্যক্তির জন্যে একটাই উপায় আছে এবং তা হলো, মিশনারীর প্রচারিত বাইবেলের পংক্তিসমূহের পরিপন্থী পংক্তিসমূহ বাইবেল থেকে উদ্ধৃত করা, অথবা পাদ্রীর ব্যাখ্যাকে চ্যালেঞ্জ করে বিতর্ক করা।


একগুঁয়ে প্রশ্ন 


কোনো মুসলমান যখন খ্রীষ্টানদের নিজস্ব ‘পবিত্র শাস্ত্রলিপি’ থেকে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হন এবং যখন খ্রীষ্টান মিশনারী পাদ্রীবর্গ তা খণ্ডন করতে ব্যর্থ হন, তখন অবশ্যম্ভাবী (বিপর্যয়) এড়ানোর খ্রীষ্টানীয় পন্থা হলো এ প্রশ্নটি - “আপনি কি বাইবেলকে খোদার বাণী হিসেবে স্বীকার করেন?” বাহ্যিকভাবে প্রশ্নটি খুবই সহজ মনে হবে, কিন্তু শুধু ‘হ্যাঁ’ অথবা ‘না’ উত্তরে বলা যাবে না। দেখুন, এক্ষেত্রে কোনো ব্যক্তিকে প্রথমেই তাঁর অবস্থান স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করতে হবে। কিন্তু খ্রীষ্টান মিশনারী তাঁকে সে সুযোগ দেবেন না। তিনি অধৈর্য হয়ে উঠবেন। তিনি পীড়াপীড়ি করবেন, “উত্তর দিন, হ্যাঁ নাকি না?” দুই হাজার বছর আগে ইহুদী জাতিগোষ্ঠী-ও হযরত ঈসা মসীহ (আলাইহিস্ সালাম)’কে একইভাবে পর্যুদস্ত করতে চেয়েছিলেন; শুধু আশ্চর্যজনকভাবে তাঁকে বর্তমানকালের চল অনুসারে স্ট্রেইট-জ্যাকেট (সহিংস বন্দি/মানসিক রোগীর দু হাত আটকানোর জ্যাকেট) পরানো হয়নি।


পাঠক অবশ্যই একমত হবেন যে, কোনো বিষয়ই সদাসর্বদা সাদা অথবা কালো হয় না। এ দুটো প্রান্তিক রংয়ের মধ্যবর্তী বিভিন্ন ধূসরবর্ণ-ও বিরাজমান। আপনি যদি পাদ্রীর প্রশ্নের উত্তরে ‘হ্যাঁ’ বলেন, তাহলে এর অর্থ দাঁড়াবে আপনাকে তাঁর বাইবেলের ‘আদিপুস্তক’ থেকে আরম্ভ করে ‘প্রকাশিত বাক্য’ পর্যন্ত পুরোটুকু-ই হজম করার ধোকায় পড়তে হবে। আর আপনি যদি ‘না’ বলেন, তাহলে তিনি আপনার উপস্থাপিত তথ্য-উপাত্ত হতে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে শ্রোতাদের মাঝে অবস্থিত নিজের সহযোগী ধর্মপ্রচারকদের কাছে সমর্থন চাইবেন এ কথা বলে: “দেখুন, এ লোক বাইবেলে বিশ্বাস করেন না! আমাদের পবিত্রগ্রন্থ থেকে তাঁর নিজের পক্ষে প্রামাণিক দলিল উপস্থাপনের কী অধিকার তিনি সংরক্ষণ করেন?” গ্রীক কিংবদন্তির হাইড্রা নামের বহু শির-বিশিষ্ট জন্তুর মতো সহজে পরাস্ত না হবার ডিগবাজি দিয়ে তিনি নিশ্চিন্ত হন এই ভেবে যে, তিনি বিষয়টি নিরাপদে এড়াতে পেরেছেন। মুবাল্লিগ তথা মুসলিম ধর্মপ্রচারকের এক্ষেত্রে কী করণীয়? তাঁকে প্রথমেই বাইবেলের মোকাবিলায় নিজ অবস্থান পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করতে হবে।


তিন ধরনের সাক্ষ্য


আমরা মুসলমানবৃন্দ বিনা দ্বিধায় বলতে পারি, বাইবেলের মধ্যে তিনটি ভিন্ন ধরনের সাক্ষ্য রয়েছে, যা কোনো বিশেষ প্রশিক্ষণের প্রয়োজন ছাড়াই চেনা যায়। এগুলো হলো:


১/ আপনি বাইবেলে এমন কতোগুলো কথা চিনতে সক্ষম হবেন, যেগুলোকে হয়তো “খোদাতা’লার বাণী” হিসেবে বর্ণনা করা যায়।

২/ আপনি তাতে আরো কিছু কথা দেখতে সক্ষম হবেন, যেগুলোকে হয়তো “খোদার পয়গাম্বরের বাণী” হিসেবে বর্ণনা করা যায়।

৩/ আর আপনি অবশ্যই লক্ষ্য করবেন বাইবেলের বৃহদাংশ চাক্ষুস অথবা শ্রুতি সাক্ষ্য দ্বারা পরিপূর্ণ; কিংবা শোনা কথা থেকে মানুষের লেখনী দ্বারা ভরপুর। এ কারণেই সেগুলোকে “ঐতিহাসিকদের বাণী” হিসেবে বর্ণনা করা যায়। 


বাইবেলের মধ্যে বিভিন্ন কিসিমের এসব উদাহরণ আপনাকে হন্যে হয়ে খুঁজতে হবে না। নিম্নোক্ত উদ্ধৃতিগুলোই বিষয়টিকে জলের মতো পরিষ্কার করে দেবে:


প্রথম ধরন:

(ক) “আমি (মানে খোদাতা’লা) ওদের (ইসরাঈলীদের) জন্যে ওদের ভাইদের (আরবীয়দের) মধ্য হতে তোমার (মূসা-আ:-এর) সদৃশ এক ভাববাদী/পয়গাম্বর প্রেরণ করবো এবং তাঁর মুখে আমার (ঐশী) বাক্য দেবো (মানে স্থাপন করবো); আর আমি তাঁকে যা যা আজ্ঞা/আদেশ করবো, তা তিনি ওদেরকে (ইসরাঈলীদেরকে) বলবেন।” [দ্বিতীয় বিবরণ, ১৮:১৮; বিবিএস সংস্করণ; এই উদ্ধৃতিটি সম্পর্কে বিস্তারিত লেখা হয়েছে জনাব আহমদ দীদাতের ‘প্রিয়নবী (দ:) সম্পর্কে বাইবেলের ভবিষ্যদ্বাণী’ শীর্ষক পুস্তিকায় - বঙ্গানুবাদক]

(খ) “আমি, আমি-ই সদাপ্রভু; আমি ভিন্ন এাণকর্তা নেই।” [ইশাইয়া, ৪৩:১১]

(গ) “হে পৃথিবীর প্রান্ত সকল, আমার প্রতি দৃষ্টিপাত করে পরিত্রাণপ্রাপ্ত হও, কেননা আমি-ই খোদা, আর কেউ নয়।” [ইশাইয়া, ৪৫:২২]


উপরোক্ত উদ্ধৃতিগুলোর মধ্যে উত্তম পুরুষের সর্বনামটির প্রতি লক্ষ্য করুন এবং এক্ষেত্রে কোনো অসুবিধা ছাড়াই আপনি একমত হবেন মন্তব্যগুলো খোদার বাণীর মতো শোনায়।


দ্বিতীয় ধরন:


(ক) ঈসা (আ:) জোরে চিৎকার করে বল্লেন, “এলী, এলী, লামা শবক্তানী...?” [মথি, ২৭:৪৬; বিবিএস]

(খ) উত্তরে ঈসা (আ:) বল্লেন, “সবচেয়ে দরকারি হুকুম এই - হে বনী ইসরাঈল, শোনো; প্রভু যিনি আমাদের খোদা, তিনি এক।” [মার্ক, ১২:২৯; বিবিএস]

(গ) ঈসা (আ:) তাঁকে (লোকটিকে) বল্লেন, “আমাকে ভালো বলছো কেন? খোদা ছাড়া আর কেউই ভালো নয়।” [মার্ক, ১০:১৮; বিবিএস]


এমন কী একটি শিশুও বুঝতে পারবে যে, “ঈসা (আ:) জোরে চিৎকার করে বল্লেন,”  “উত্তরে ঈসা (আ:) বল্লেন” এবং “ঈসা (আ:) তাঁকে (লোকটিকে) বল্লেন” ইত্যাদি মন্তব্য সেই ব্যক্তিরই যাঁর প্রতি সেগুলো আরোপিত; অর্থাৎ, সেগুলো খোদার পয়গম্বরের বাণী


তৃতীয় ধরন: 


তিনি (ঈসা) দূর হতে পাতায় ঢাকা একটা ডুমুর গাছ দেখে তাতে কোনো ফল আছে কি-না তা দেখতে গেলেন। কাছে গিয়ে তিনি (ঈসা) তাতে পাতা ছাড়া আর কিছুই দেখতে পেলেন না, কারণ তখন ডুমুর ফলের সময় (মানে মৌসুম) নয়।” [মার্ক, ১১:১৩; বিবিএস]


বাইবেলের বৃহদাংশ এই তৃতীয় ধরনের সাক্ষ্য। এগুলো নাম পুরুষের (অথবা তৃতীয় ব্যক্তির) বাণী। উদ্ধৃতিটির মধ্যে আন্ডারলাইনকৃত সর্বনামটি লক্ষ্য করুন। এটা খোদাতা’লা কিংবা তাঁর পয়গাম্বরের বাণী নয়, বরং কোনো ঐতিহাসিকের বাণী


কোনো মুসলমানের জন্যে ওপরে বর্ণিত সাক্ষ্যগুলোর ধরনকে পৃথকভাবে চেনাটা অত্যন্ত সহজ; কেননা তাঁর ধর্মবিশ্বাসের মধ্যেও এগুলো আছে। কিন্তু বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীর মাঝে তিনি-ই সর্বাপেক্ষা সৌভাগ্যবান এই বিশেষ কারণে যে, তাঁর দলিলপত্রগুলো ভিন্ন ভিন্ন গ্রন্থে সংরক্ষণ করা হয়েছে!


এক: প্রথম ধরন - খোদার বাণী - সংরক্ষিত আছে পবিত্র ক্বুরআন মজীদ নামের ঐশীগ্রন্থে।


দুই: দ্বিতীয় ধরন - খোদার পয়গাম্বরের বাণী (তথা হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের কথাসমূহ) সংরক্ষিত আছে হাদীস শরীফ নামের বর্ণনাসমূহে।


তিন: তৃতীয় ধরনের সাক্ষ্য বিপুল পরিমাণে মওজূদ আছে ইসলামী ইতিহাসের বিভিন্ন গ্রন্থে, যেগুলো লিখেছেন হয় উচ্চমর্যাদাবান ও জ্ঞানসম্পন্ন আলেম-উলামা, নতুবা আরেকটু কম আস্থাভাজন বিদ্বান; কিন্তু একজন মুসলমান সুপরামর্শক্রমে আপন বইপুস্তক আলাদা আলাদা সংরক্ষণ করে থাকেন!


প্রত্যেক মুসলমান এই তিন ধরনের সাক্ষ্যসম্বলিত গ্রন্থাবলীকে সেগুলোর কর্তৃত্বের ক্রমানুসারে আলাদা রাখেন। তিনি কখনোই এগুলোকে সমান পর্যায়ে গণনা করেন না। পক্ষান্তরে, ‘পবিত্র বাইবেল’ হচ্ছে চিত্রবিচিত্র বিষয়বস্তুর একখানি গ্রন্থ, যা’তে একই সুতোয় গাঁথা হয়েছে বিব্রতকর, হীন ও অশ্লীল বিষয়াদি - একই প্রচ্ছদের ছায়ায়; কোনো খ্রীষ্টান ব্যক্তিকে ওই সকল বিষয়ের প্রতি একই আধ্যাত্মিক নিহিতার্থ ও কর্তৃত্ব স্বীকার করতে হয়; আর তাই তিনি এক্ষেত্রে একজন হতভাগ্য ব্যক্তি।


তৃতীয় অধ্যায়

বাইবেলের বহু সংস্করণ


কোনো খ্রীষ্টানের পবিত্র গ্রন্থ সম্পর্কে তাঁর দাবি বিশ্লেষণ করা এখন আমাদের পক্ষে সহজ হবে।


তুষ বাছাই


বাইবেলের বিভিন্ন সংস্করণের সূক্ষ্ম বিশ্লেষণের আগে আমরা খোদাতা’লার ঐশীগ্রন্থসমূহ সম্পর্কে আমাদের নিজস্ব আক্বীদা-বিশ্বাস স্পষ্ট করতে সচেষ্ট হবো। আমরা যখন বলি আমরা ঐশীগ্রন্থ তৌরাত, যাবূর, ইনজীল ও আল-ক্বুরআনে বিশ্বাস করি, তখন আমরা আসলে কী বুঝিয়ে থাকি? আমরা ইতোমধ্যেই জানি, পবিত্র ক্বুরআন মজীদ হচ্ছে অভ্রান্ত খোদার বাণী, যা হযরত জিবরীল আমিন ফেরেশতার (আ:) মাধ্যমে অক্ষরে অক্ষরে আমাদের মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’এর প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে এবং যা বিগত চৌদ্দ শ বছর ধরে মনুষ্য হাতের কারসাজি থেকে সংরক্ষিত ও নিরাপদ রাখা হয়েছে [নোট: আপনি মুসলিম কিংবা অমুসলিম-ই হোন, এ দাবিটি আপনাকে কেবল বিশ্বাসের ওপর গ্রহণ করতে হবে না। আপনি এ বাস্তবতাকে যাচাই করতে পারবেন; ক্বুরআন মজীদ একটি গাণিতিক ঐশী বন্ধনে আবদ্ধ যা আপনি আপনার ইন্দ্রিয়গুলো দ্বারা অনুভব করতে পারবেন। বিস্তারিত রয়েছে আমার লেখা Al-Qur'an: The Ultimate Miracle শিরোনামের বইয়ে]। এমন কী ইসলামের বিরূপ সমালোচকবর্গ-ও অনিচ্ছায় পবিত্র ক্বুরআনের নির্মলতা সম্পর্কে সাক্ষ্য দিয়েছেন: “পৃথিবীতে সম্ভবতঃ আর অন্য কোনো গ্রন্থ-ই বারো শ (বর্তমানে চৌদ্দ শ) বছর যাবৎ এ রকম খাঁটি (মানে অবিকৃত) থাকেনি।” [স্যার উইলিয়াম মুইর]


আমরা মুসলমান সমাজ যে তৌরাত গ্রন্থে বিশ্বাস করি, সেটা ইহুদী ও খ্রীষ্টানবৃন্দের Torah বা ‘টোরাহ’ নয়, যদিও শব্দগুলো - একটি আরবী ও অপরটি হিব্রু - একই। আমরা বিশ্বাস করি, হযরত মূসা (আলাইহিস্ সালাম) যা কিছু তাঁর জাতির মাঝে প্রচার করেছিলেন, তার সবই আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রকাশিত হয়েছিলো; কিন্তু পয়গাম্বর মূসা (আ:) ইহুদী ও খ্রীষ্টানবৃন্দ কর্তৃক তাঁর প্রতি আরোপিত ওই সব ‘পুস্তকের’ লেখক/প্রণেতা ছিলেন না। [এ বিষয়ে পরে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে]


অনুরূপভাবে আমরা বিশ্বাস করি, ঐশীগ্রন্থ যাবূর-ও খোদাতা’লা কর্তৃক হযরত দাউদ (আলাইহিস্ সালাম)’এর কাছে প্রকাশিত হয়; কিন্তু বর্তমানকালের ‘জবুর/গীতসংহিতা’ যা তাঁর নামের সঙ্গে জড়ানো হয়েছে, তা সেই ঐশী বাণী নয়। খ্রীষ্টানবৃন্দ নিজেরাই জোরালোভাবে দাবি করেন না যে দাউদ (আ:)-ই ‘তাঁর’ জবুরের একমাত্র লেখক। [খ্রীষ্টান Brains Trust-এর স্বীকারোক্তি: ‘প্রধানতঃ দাউদ (আ:), তবে অন্যান্য লেখকও আছেন’] 


ইনজীলের কী খবর? ইনজীল অর্থ ‘গসপেল’ বা সুসমাচার যা হযরত ঈসা (আ:) তাঁর ক্ষণিক মিশনে প্রচার করেছিলেন। গসপেল লেখকবর্গ ঘনঘন উল্লেখ করেন ঈসা (আ:) ভ্রমণ করতেন এবং ইনজীল প্রচার করতেন:


১/ “আর ঈসা (আ:).....গিয়ে সুসংবাদ/সুসমাচার তাবলীগ করতে লাগলেন।...লোকদের সব রকম রোগও ভালো করলেন।” [মথি, ৯:৩৫; কিতাবুল মোকাদ্দস, বিবিএস, ২০০০ খৃষ্টাব্দ]


২/ “কিন্তু যে কেউ আমার (ঈসা-আ:-এর) জন্যে এবং আল্লাহর দেয়া সুসংবাদের জন্যে তার প্রাণ হারায়, সে তার সত্যিকারের জীবন রক্ষা করবে।” [মার্ক, ৮:৩৫; প্রাগুক্ত]


৩/ “ঈসা (আ:) সুসংবাদ তবলীগ করছিলেন...। [লুক, ২০:১; প্রাগুক্ত]    


গসপেল/সুসমাচার একটি ঘনঘন উচ্চারিত শব্দ, কিন্তু ঈসা (আ:) কোন্ সুসংবাদ প্রচার করেছিলেন? নতুন নিয়মের (New Testament) ২৭ টি পুস্তকের মধ্যে কেবল কিছু অংশকেই ঈসা (আ:)’এর কথা হিসেবে গ্রহণ করা যায়। খ্রীষ্টানবৃন্দ সেইন্ট/ভাববাদী মথি, সেইন্ট মার্ক, সেইন্ট লুক ও সেইন্ট ইউহোন্না/যোহন অনুসারে সুসমাচারগুলো সম্পর্কে গর্ব করে থাকেন; কিন্তু খোদ (সেইন্ট/ভাববাদী) ঈসা (আ:) অনুসারে কোনো গসপেলই বাইবেলের মধ্যে নেই! আমরা আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করি, ঈসা (আ:) যা কিছু প্রচার করেছিলেন, তার সবই খোদা হতে প্রত্যাদিষ্ট ছিলো। সেটাই ছিলো ইনজীল - বনূ ইসরাঈলের জন্যে সুসংবাদ ও সঠিক পথপ্রদর্শন। ঈসা মসীহ (আ:) তাঁর মিশনে কখনোই কোনো বাণী লিপিবদ্ধ করেননি, অথবা কাউকে লিখতে নির্দেশও দেননি। বর্তমানে যা গসপেল হিসেবে পার পেয়ে যাচ্ছে তা বেনামী হাতের কাজ ছাড়া কিছু নয়!


আমাদের সামনে প্রশ্নটি হলো: “আপনি কি বাইবেলকে খোদার বাণী বলে গ্রহণ করেন?” প্রশ্নটি চ্যালেঞ্জের আকারে ছুঁড়ে দেয়া হয়েছে। প্রশ্নকারী স্রেফ জানার উদ্দেশ্যে প্রশ্নটি করেননি, বরঞ্চ বিতর্কের মানসে করেছেন। আমাদেরও একই সুরে দাবি করার অধিকার রয়েছে: “আপনি কোন্ বাইবেল সম্পর্কে কথা বলছেন?” প্রশ্নকারী বিড়বিড় করে বলেন, “কেন, বাইবেল তো একটাই।” 


ক্যাথলিক বাইবেল


আমার হাতে 'Douay' (ডুয়েই) রোমান ক্যাথলিক বাইবেলের সংস্করণটি উঁচিয়ে ধরে আমি প্রশ্নকারীকে জিজ্ঞেস করি: “আপনি কি বাইবেলটিকে খোদার বাণী বলে স্বীকার করেন?” Catholic Truth Society (ক্যাথলিক ট্রুথ সোসাইটি) নিজেদের জ্ঞাত ভালো কোনো কারণেই তাঁদের বাইবেলের সংস্করণটি অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত আকারে প্রকাশ করেছেন। বর্তমানে বাজারে লভ্য বাইবেলের বিভিন্ন সংস্করণের তুলনায় এটাই সবচেয়ে স্বল্প হারে পাওয়া যায়। খ্রীষ্টান প্রশ্নকারী হতচকিত হয়ে প্রশ্ন করেন: “ওটা (আবার) কোন্ বাইবেল?” “কেন, আমি তো ভেবেছিলাম আপনি বাইবেল একটা-ই বলে দাবি করেছিলেন?” - আমি তাঁকে স্মরণ করিয়ে দেই। তিনি দ্বিধান্বিত হয়ে বিড়বিড় করে বলেন: “হ্যাঁ.., কিন্তু ওটা কোন্ সংস্করণ?” আমি (পাল্টা) প্রশ্ন করি: “কেন, এতে কি কোনো পার্থক্য হবে?” অবশ্যই এতে পার্থক্য হবে এবং পেশাদার ধর্মপ্রচারক তা ভালোভাবেই জানেন। তিনি তাঁর ‘এক বাইবেল’ দাবি দ্বারা আসলে ভাঁওতা দিচ্ছিলেন মাত্র।


রোমান ক্যাথলিক বাইবেল সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয় Rheims (রীমস্)-এ, ১৫৮২ খ্রীষ্টাব্দ সালে। এটা Jerome's Latin Vulgate (জেরোমস্ ল্যাটিন ভালগেইট হলো রোমান ক্যাথলিক বাইবেলের উৎস; বিস্তারিত জানতে দেখুন টমসন্স চেইন রেফারেন্স বাইবেল) হতে গ্রহণ করা হয়েছিলো এবং ১৬০৯ খ্রীষ্টাব্দে Douay (ডুয়েই)’তে এটা পুনর্মুদ্রিত হয়। এ কারণে Roman Catholic Version সংক্ষেপে RCV (রোমান ক্যাথলিক সংস্করণ) হচ্ছে সবচেয়ে পুরোনো বাইবেল যা আজো কেউ কিনতে পারেন। এর প্রাচীনত্ব সত্ত্বেও সমগ্র প্রটেষ্টান্ট জগৎ এবং ‘Cult' (অর্থডক্স খ্রীষ্টানদের দ্বারা Jehovah's Witnesses, Seventh Day Adventist-সহ এক হাজারটি খ্রীষ্টান সম্প্রদায়কে প্রদত্ত খেতাব)-সমূহ এ বাইবেলকে দোষারোপ করেন; কেননা এতে সাতটি অতিরিক্ত ‘পুস্তক’ বিদ্যমান, যেগুলোকে তাঁরা ঘৃণা সহকারে 'Apocrypha' তথা ‘সন্দেহজনক কর্তৃত্ব’ বলে উদ্ধৃত করেন। রোমান ক্যাথলিক সংস্করণের Apocalypse (প্রটেষ্টান্ট-বর্গ এর নাম পরিবর্তন করে রেখেছেন ‘প্রকাশিত কালাম/বাক্য’) শীর্ষক শেষ পুস্তকটিতে চরম সতর্কবাণী প্রকাশিত হয়েছে: “কেউ যদি এর সঙ্গে কিছু যোগ করে (বা কাট-ছাঁট করে) তবে আল্লাহও এই কিতাবে লেখা সমস্ত গজব তার জীবনে যোগ করবেন।” [প্রকাশিত কালাম, ২২:১৮-১৯; কিতাবুল মোকাদ্দস, বিবিএস ২০০০]


কিন্তু কে শোনে কার কথা! তাঁরা প্রকৃতই বিশ্বাস করেন না! প্রটেষ্টান্ট-বর্গ দুঃসাহসিকভাবে তাঁদের ঐশীগ্রন্থ হতে সাতটি গোটা পুস্তক অপসারণ করেছেন। যথা:

১/ Book of Judith (জুডিথ পুস্তক);

২/ Book of Tobias (টবিয়াস পুস্তক);

৩/ Book of Baruch (বারক পুস্তক);

৪/ Book of Esther (এসটার পুস্তক) ইত্যাদি।


প্রটেষ্টান্ট বাইবেল


প্রটেষ্টান্ট বাইবেলের Authorized Version (সংক্ষেপে AV) তথা অথরাইজড্ সংস্করণ, যেটা রাজা জেইমস্-এর সংস্করণ (King James Version) নামেও সমধিক প্রসিদ্ধ, সেটা সম্পর্কে স্যার উইন্সটন চার্চিল কিছু প্রাসঙ্গিক মন্তব্য করেছেন: 


বাইবেলের অথরাইজড্ সংস্করণ ১৬১১ খ্রীষ্টাব্দে মহামান্য রাজা ১ম জেইমস্-এর ইচ্ছাআদেশক্রমে প্রকাশিত হয়, যাঁর নাম এটা আজো বহন করছে।


প্রটেষ্টান্ট খ্রীষ্টানবৃন্দ খোদার ‘পুস্তকের’ বিকৃতি সাধন করেছেন মর্মে বিশ্বাস অন্তরে পোষণ করেও ক্যাথলিক খ্রীষ্টানমণ্ডলী প্রটেষ্টান্টদের ‘অপরাধটিকে’ প্রশ্রয় ও সহায়তা করে চলেছেন তাঁদেরই দ্বারা ধর্মান্তরিত বিদেশীদেরকে অথরাইজড্ সংস্করণটি কিনতে বাধ্য করে। এই সংস্করণটি-ই একমাত্র বাইবেল যা বিশ্বের স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে প্রচলিত প্রায় ১৫০০টি ভাষায় পাওয়া যায়। রোমান ক্যাথলিক-বৃন্দ তাঁদের গরুর দুধ দোহন করেন, কিন্তু তাঁদের গরুকে খাওয়ানোর দায়িত্ব প্রটেষ্টান্টদের ওপরই ন্যস্ত! ক্যাথলিক ও প্রটেষ্টান্ট উভয় দলভুক্ত খ্রীষ্টানদের একচেটিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ অথরাইজড্ সংস্করণ তথা রাজা জেইমস্-এর সংস্করণ ব্যবহার করে থাকেন।


গগনচুম্বী প্রশংসাস্তুতি


রাজা জেইমস্ সংস্করণটি স্যার উইন্সটন চার্চিলের ভাষ্যানুযায়ী ১৬১১ খ্রী: সালে প্রথম প্রকাশিত হয়। এরপর ১৮৮১ খ্রী: সালে Revised Version (RV) তথা পুনর্সংস্করণ প্রকাশিত হয় এবং ১৯৫২ খ্রীষ্টাব্দ সালে পুনঃপুনর্সংস্করণ সাধন করে ‘Revised Standard Version' (RSV) তথা ‘রিভাইজড্ স্ট্যান্ডার্ড সংস্করণ’ নামে হালনাগাদ করা হয়। এর পুনঃপুনঃপুনর্সংস্করণ প্রকাশ করা হয় ১৯৭১ সালে (এখনো এর সংক্ষিপ্ত নাম RSV)। বাইবেলের এই সর্বাধুনিক সংশোধিত সংস্করণটি সম্পর্কে খ্রীষ্টান জগতের কী অভিমত, তা-ই এখন অমরা লক্ষ্য করবো: 


“বর্তমান শতাব্দীতে (মানে গত শতাব্দীতে) মুদ্রিত সর্বোৎকৃষ্ট সংস্করণ।” [চার্চ অফ ইংল্যান্ড নিউজপেপার]


 “সর্বোচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন (খ্রীষ্টান) পণ্ডিতবৃন্দের সম্পূর্ণ তাজা অনুবাদ।” [টাইমস্ লিটেরারী সাপ্লেমেন্ট] 


“অভ্রান্ততায় এক নতুনত্বযুক্ত অনুবাদসহ অথরাইজড্ সংস্করণের অতি পছন্দনীয় বৈশিষ্ট্য।” [লাইফ এন্ড ওয়ার্ক] 


“মূললিপির সবচেয়ে নির্ভুল ও প্রায় হুবহু (সংস্করণ)।” [দি টাইমস্]


প্রকাশকবৃন্দ নিজেরাই এ বাইবেলটি সম্পর্কে তাঁদের প্রকাশনার পরিশিষ্টের ১০ নং পৃষ্ঠায় বলেন: “এ বাইবেল বত্রিশ জন পণ্ডিত ও পঞ্চাশটি সহযোগী ডিনোমিনেশনের প্রতিনিধিত্বকারী একটি উপদেষ্টা কমিটির সহায়তার ফল।” (নোট: খ্রীষ্টান সম্প্রদায় বহু ডিনোমিনেশনে বিভক্ত)


কেন এই গুণকীর্তন? সরল বিশ্বাসী সর্বসাধারণকে বোকা বানিয়ে নিজেদের পণ্য ক্রয়ে বাধ্য করার জন্যে? এসব সাক্ষ্য ক্রেতাকে আস্থাশীল করে তোলে এ মর্মে  যে তিনি সঠিক (ঘোড়-দৌড়ের) ঘোড়াটিকেই সমর্থন করছেন - অথচ তিনি সন্দেহ-ই করতে পারছেন না তাঁর সাথে প্রতারণা করা হচ্ছে। 


"পৃথিবীর সেরা কাটতিপূর্ণ পুস্তক” 


“পৃথিবীর সেরা কাটতিপূর্ণ পুস্তক” অথরাইজড্ সংস্করণের কী সুসংবাদ? এর সংস্কর্তাবৃন্দ যাঁরা সবাই দক্ষ বিক্রেতা, তাঁরা এর সম্পর্কে খুব মিষ্টি-মধুর কথা বলেছেন। তবে RSV-এর মুখবন্ধের পৃষ্ঠা সি, ৬ প্যারাগ্রাফে তাঁরা বলেন: 


“রাজা জেইমস্ সংস্করণকে (মানে AV-কে) সঙ্গত কারণেই ‘ইংরেজি গদ্যের মহৎ কীর্তিস্তম্ভ’ বলা হয়। এর সংস্কর্তাবৃন্দ ১৮৮১ সালে এর সরলতা, প্রশান্ত গাম্ভীর্য, ক্ষমতা, আনন্দপূর্ণ অভিব্যক্তি...সুরের মূর্ছনা ও ছন্দের আশীর্বাদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রকাশ করেছিলেন। অন্য যে কোনো বই যা পারেনি, এই পুস্তকটি ইংরেজি ভাষাভাষী জাতিসমূহের ব্যক্তিগত চরিত্র ও গণপ্রতিষ্ঠানগুলো গঠনে প্রভাব ফেলেছে। আমরা এর কাছে গণনাতীতভাবে ঋণী।” [১ নং দলিলচিত্র দেখুন


প্রিয় পাঠক, আপনি কি ‘পুস্তকসমূহের সেরা পুস্তক’ (বলে আখ্যায়িত) বাইবেলের প্রতি প্রদর্শিত এ উচ্চ শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের চেয়ে উত্তম কোনো কিছু ধারণা বা কল্পনা করতে পারেন? আমি তো পারি না। এবার বিশ্বাসী একজন খ্রীষ্টানকে তাঁর প্রিয় ধর্মীয় উকিলদের কাছ থেকে সবচেয়ে হৃদয়বিদারক আঘাত সহ্য করার জন্যে তৈরি হতে বলবো, কারণ একই নিঃশ্বাসে তাঁরা (আরো) বলেন: 

“তবু রাজা জেইমস্ সংস্করণটি মারাত্মক ত্রুটিযুক্ত” এবং “এ সকল ত্রুটি এতো বেশি ও এতো গুরুতর যে এগুলো সংশোধন করা জরুরি...।” এটা একেবারেই (ঘোড়-দৌড়ের) ঘোড়ার মুখ তথা ‘সর্বোচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন’ অর্থডক্স খ্রীষ্টান পণ্ডিতদের মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছে। এখন তাঁদের পবিত্র পুস্তকে ‘মারাত্মক’ ও ‘গুরুতর ত্রুটি’ উপস্থিত থাকার কারণ এবং সেগুলো অপসারণের কারণ ব্যাখ্যা করে একটি বিশ্বকোষ প্রকাশ করার জন্যে আরেক দল ধর্মশাস্ত্রজ্ঞের প্রয়োজন হবে।

চতুর্থ অধ্যায়

পঞ্চাশ হাজার ত্রুটি (?)

Jehovah's Witnesses (জেহোভার সাক্ষী)-বর্গ তাঁদের ৮ই সেপ্টেম্বর ১৯৫৭ খ্রী: তারিখের ম্যাগাজিন পত্রিকায় নিম্নোক্ত চমকপ্রদ শিরোনামটি প্রচার করেন: “বাইবেলে ৫০,০০০ (পঞ্চাশ হাজার) ত্রুটি?” [দলিলচিত্র-২ দেখুন]

আমি এ পুস্তিকার বিষয়বস্তু প্রণয়নকালে এক রোববার সকালে আমার ঘরের দরজায় টোকা শুনতে পাই। দরজা খুলতেই দেখতে পেলাম এক ইউরোপীয় ভদ্রলোক সামনে দাঁড়িয়ে দাঁত বের করে হাসছেন। তিনি বল্লেন, “সুপ্রভাত।” আমিও উত্তরে বল্লাম, “সুপ্রভাত।” তিনি আমাকে তাঁর AwakeWatchtower ম্যাগাজিনগুলো উপহার হিসেবে এগিয়ে দিলেন। হ্যাঁ, তিনি একজন জেহোভার সাক্ষী! আপনার দরজায় এঁদের কয়েকজন যদি ইতিপূর্বে টোকা দিয়ে থাকেন, তাহলে আপনি এঁদেরকে সাথেসাথেই চিনতে পারবেন। মানুষের দরজায় টোকা প্রদানকারীদের মধ্যে সবচেয়ে উন্নাসিক লোকের দল এঁরা! আমি তাঁকে ঘরের ভেতরে আমন্ত্রণ করলাম।

ভদ্রলোক উপবিষ্ট হওয়ার অনতিবিলম্বে আমি তাঁকে তাঁর ম্যাগাজিনের সেই সংখ্যাটি দিলাম, যা ২ নং দলিলচিত্রে পুনর্মুদ্রিত হয়েছে। পত্রিকার মনোগ্রাফটি তাঁকে প্রদর্শন করে জিজ্ঞেস করলাম, “এটা কি আপনার?” তিনি সহজেই তাঁর নিজস্ব পত্রিকাটি চিনতে পারলেন। আমি বল্লাম, “এ পত্রিকাটি বলে: বাইবেলে ৫০,০০০ ত্রুটি বিরাজমান; এ কথা কি সত্য?” তিনি চেঁচিয়ে বল্লেন, “ওটা কী?” আমি আবার বল্লাম, “আমি বলেছি, এ পত্রিকা বলে আপনার বাইবেলে ৫০,০০০ ত্রুটি বিদ্যমান।” তিনি পাল্টা আমাকে প্রশ্ন করলেন, “আপনি এটা কোথায় পেয়েছেন?” [এটা ২৩ বছর আগে প্রকাশিত হয়েছিলো যখন এ ভদ্রলোক মায়ের দুধ পান করতেন]। আমি বল্লাম, “হেঁয়ালিপূর্ণ কথা বাদ দিন; এটা কি আপনার?” - পত্রিকার মনোগ্রাফের (Awake শিরোনামের) দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করেই এ কথা বল্লাম। তিনি বল্লেন, “আমি কি এটা একটু দেখতে পারি?” আমি উত্তর দিলাম, “অবশ্যই।” আমি পত্রিকার পাতাটি হস্তান্তর করলাম। তিনি পর্যবেক্ষণ করতে আরম্ভ করলেন। জেহোভার সাক্ষীবর্গ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। তাঁদের ‘Kingdom Hall' (কিংডাম হল)-গুলোতে তাঁরা সপ্তাহে পাঁচবার ক্লাস করে থাকেন। জেহোভার সাক্ষীবর্গ স্বাভাবিকভাবেই এক হাজার একটি খ্রীষ্টান সম্প্রদায়ের মধ্যে সবচেয়ে যোগ্য মিশনারী পাদ্রী। তাঁদেরকে শেখানো হয়, যখন কোণঠাসা অবস্থার মুখোমুখি হবে তখন কোনো কিছুতেই স্বীকৃতি দেবে না, মুখ খুলবে না। পবিত্র আত্মা (الروح القدس) তথা Holy Ghost কর্তৃক অনুপ্রেরণা লাভের অপেক্ষায় থাকেবে। 

আমি নীরবে তরুণ পাদ্রীকে লক্ষ্য করছিলাম, যখন তিনি (Awake পত্রিকার) পাতাটি দেখছিলেন। হঠাৎ তিনি চোখ তুলে তাকালেন। তিনি উত্তর পেয়ে গিয়েছেন। পবিত্র আত্মা তাঁকে কাতুকুতু দিয়েছেন। তিনি বলা আরম্ভ করলেন, “প্রবন্ধটি ব্যক্ত করে অধিকাংশ ত্রুটি-ই অপসারিত হয়েছে।” আমি প্রশ্ন করলাম, “যদি অধিকাংশ-ই অপসারিত হয়ে থাকে, তবে ৫০,০০০-এর মধ্যে কতোগুলো অবশিষ্ট আছে? ৫০০০? ৫০০? ৫০? যদি ৫০টিও অবশিষ্ট থাকে, তাহলে সেগুলোকে কি আপনি খোদার প্রতি আরোপ করবেন?” তিনি নির্বাক হয়ে গেলেন। তাঁর চার্চের আরো প্রবীণ সদস্যদেরকে অন্য আরেক দিন সাথে করে নিয়ে আসার প্রস্তাব দিয়ে তিনি প্রস্থান করার অনুমতি চেয়ে নিলেন। সেটাই হবে দিন!

আমার এ পুস্তিকাটি যদি তখন লেখা হয়ে যেতো, তাহলে আমি ওই (তরুণ) পাদ্রীকে তা পেশ করতাম এ কথা বলে, “আমি আপনার উপকার করতে চাই; আপনার নাম, ধাম ও টেলিফোন নম্বরখানা আমায় দিন। আমি ‘বাইবেল কি খোদার বাণী?’ পুস্তিকাটি আপনাকে ৯০ দিনের জন্যে ধার দেবো। আমি একটি লিখিত জবাব চাই!” প্রিয় পাঠক, যদি আপনি এ রকম করেন এবং আরো কিছু মুসলমান এ রকম করেন, তাহলে তাঁরা এবং অন্যান্য মিশনারী-বর্গ আর কখনো আপনাদের ঘরের দরজাকে কলুষিত করবেন না। আমি বিশ্বাস করি, এ প্রকাশনাটি বর্তমানকালের সবচেয়ে কার্যকর রক্ষাকবচ হিসেবে প্রমাণিত হবে, ইন-শা’আল্লাহ

‘খোদার বাণী’ নিয়ে খেলার দায়ে অর্থডক্স ত্রিত্ববাদীদের কড়া সমালোচক জেহোভার সাক্ষীদের এই ‘কাল্ট’-টি প্রকৃতপক্ষে নিজেরাই কথার মারপ্যাঁচের সেই একই খেলায় মেতেছেন। “বাইবেলে ৫০,০০০ ত্রুটি?” শীর্ষক আলোচ্য প্রবন্ধটিতে তাঁরা বলেন: “সম্ভবতঃ ৫০,০০০ ত্রুটি বিদ্যমান...ত্রুটি যেগুলো বাইবেলের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেছে...৫০,০০০ এ ধরনের গুরুতর ত্রুটি....ওই সকল তথাকথিত ত্রুটির অধিকাংশ....সামগ্রিকভাবে বাইবেল নিখুঁত।” (!)

রিভাইজড্ ষ্ট্যান্ডার্ড ভারশন (RSV)-এর লেখকবৃন্দ যে সব ছোট ও বড় শতসহস্র ভুলত্রুটি সংশোধন করতে প্রয়াস পেয়েছেন, সেগুলো পর্যালোচনা করার সময় ও সুযোগ আমাদের হাতে (এখানে) নেই। আমরা সেই সুযোগটুকু খ্রীষ্টান পণ্ডিতদের ছেড়ে দিতে চাই। এখানে আমি ওই সব ‘ক্ষুদ্র’ পরিবর্তনের মধ্য হতে প্রায় ‘অর্ধ ডজন’ পরিবর্তনের দিকে দ্রুত নজর বুলাবো।

১/ “কাজেই দ্বীন-দুনিয়ার মালিক নিজেই তোমাদের কাছে একটা চিহ্ন দেখাবেন। তা হলো, একজন অবিবাহিতা সতী মেয়ে গর্ভবতী হবেন, আর তাঁর এক ছেলে (সন্তান) হবেন; তাঁর নাম রাখা হবে ইম্মানুয়েল।” [ইশাইয়া, ৭:১৪; কিতাবুল মোকাদ্দস, বিবিএস ২০০০ সংস্করণ]

ওপরে উদ্ধৃত পংক্তির মধ্যে অপরিত্যাজ্য ‘অবিবাহিতা সতী মেয়ে’ ('VIRGIN') বাক্যটি এখন RSV-তে বদলে ‘এক যুবতী নারী’ ('a young woman') বসানো হয়েছে, যা হিব্রু ‘আলমাহ’ (almah) শব্দের সঠিক অনুবাদ। হিব্রু বাইবেলে সব সময়েই ‘আলমাহ’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়ে এসেছে, ‘বেথিউলাহ’ (bethulah) শব্দটি ব্যবহৃত হয়নি, যার অর্থ কুমারী (VIRGIN)। এই সংশোধনীটি শুধু ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত বাইবেলের অনুবাদেই পাওয়া যায়, কেননা RSV সংস্করণ কেবল এ ভাষাতেই প্রকাশিত হয়ে থাকে। কিন্তু আফ্রিকী ও আরবী, অথবা জুলু ভাষায়, বস্তুতঃ বিশ্বের বাকি ১৫০০-টি ভাষায় খ্রীষ্টানমণ্ডলীকে আজো ‘কুমারী/অবিবাহিতা সতী মেয়ে’ মর্মে ভুল শব্দটি গেলানো হচ্ছে। (বাংলা ‘কিতাবুল মোকাদ্দস’-এও তাই পরিদৃষ্ট)

একজাত (Begotten), সৃষ্ট নয় 

“ঈসা মসীহ (আ:) হলেন খোদার একমাত্র ‘একজাত’ (Begotten) পুত্র, সৃষ্ট নয় বরং একজাত” - এই বাক্যটি অর্থডক্স খ্রীষ্টানদের দ্বারা প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে ধর্মশিক্ষা দানের লক্ষ্যে এক সংযোজন, যা নিম্নের বাইবেলীয় শ্লোকের সমর্থনের ওপর নির্ভরশীল: 

২/ “কারণ আল্লাহতা’লা জগতকে এতো মহব্বত করলেন যে, তাঁর একমাত্র (Begotten/একজাত) পুত্রকে তিনি দান করলেন, যেনো যে কেউ সেই পুত্রের প্রতি ঈমান আনে সে বিনষ্ট না হয়, কিন্তু আখেরী (মানে অনন্ত পারলৌকিক) জীবন পায়।” [ইউহোন্না/যোহন, ৩:১৬; কিতাবুল মোকাদ্দস ২০০০ খ্রী: বিবিএস; তবে এ সংস্করণে begotten/একজাত তথা প্রজননকৃত সন্তান মর্মে বাক্যটি নেই। সেটা আছে ১৯৮০ সালের বিবিএস সংস্করণে, যা বৃটিশ পাদ্রী উইলিয়াম কেয়ারীর দ্বারা ১৮২০-৩০ সালে অনূদিত; Authorized Version]

সম্ভাব্য ধর্মান্তরযোগ্য ব্যক্তির মাঝে প্রচারের সময় কোনো মিশনারী পাদ্রী-ই ‘পিতার একমাত্র একজাত পুত্র’ - বাক্যটি উদ্ধৃত করতে ব্যর্থ হবেন না। কিন্তু এই বানোয়াট - ‘একজাত’ (BEGOTTEN) - শব্দটি এখন অকস্মাৎ বাইবেল সংস্কর্তাদের দ্বারা কোনো কারণ দর্শানো ছাড়াই কর্তন করা হয়েছে। তাঁরা গীর্জার ইঁদুরের মতো নীরবতা বজায় রেখেছেন এবং পাঠকদের মনোযোগ তাঁদের গোপন অপসারণ-কর্মের দিকে আকৃষ্ট করতে চান না। এই ধর্মহীনতাপূর্ণ ‘একজাত’ শব্দটি ‘পবিত্র বাইবেলে’ প্রক্ষিপ্ত বহু কথার একটি। এর প্রচলনের অনতিবিলম্বেই সর্বশক্তিমান আল্লাহতা’লা অত্যন্ত কঠোর ভাষায় এ মিথ্যাচারের সমালোচনা করেন। তিনি বাইবেল পণ্ডিতদের দ্বারা এ প্রতারণা ফাঁস করার জন্যে ২০০০ বছর অপেক্ষা করেননি। ক্বুরআন মজীদে তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেন:    
    
وَقَالُواْ ٱتَّخَذَ ٱلرَّحْمَـٰنُ وَلَداً

এবং তারা বল্লো, ‘পরম দয়াময় সন্তান গ্রহণ করেছেন’ 

لَّقَدْ جِئْتُمْ شَيْئاً إِدّاً

নিঃসন্দেহে তোমরা চরম সীমার ভারী কথা নিয়ে এসেছো;

 تَكَادُ ٱلسَّمَٰوَٰتُ يَتَفَطَّرْنَ مِنْهُ

এতে আসমান বিদীর্ণ হবার উপক্রম হবে

وَتَنشَقُّ ٱلأَرْضُ

এবং পৃথিবী খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে যাবে

 وَتَخِرُّ ٱلْجِبَالُ هَدّاً

আর পাহাড় চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে আপতিত হবে

 أَن دَعَوْا لِلرَّحْمَـٰنِ وَلَداً

এ জন্যে যে তারা পরম করণাময়ের প্রতি সন্তান আরোপ করেছে

وَمَا يَنبَغِي لِلرَّحْمَـٰنِ

এবং পরম দয়াময়ের জন্যে শোভা পায় না

أَن يَتَّخِذَ وَلَداً

এ মর্মে যে, তিনি সন্তান গ্রহণ করবেন। [আল-ক্বুরআন, ১৯:৮৮-৯২; নূরুল এরফান]

মুসলিম জাহানের উচিৎ খ্রীষ্টান জগতের ‘পঞ্চাশটি সহযোগিতাকারী ডিনোমিনেশান’কে এবং তাঁদের Brains Trust ‘সর্বোচ্চ মর্যাদাবান বত্রিশ জন পণ্ডিত’কে সাধুবাদ জানানো; কেননা তাঁরা নিজেদের ‘পবিত্র বাইবেল’কে ক্বুরআনী মহাসত্যের এক মাত্রা নিকটতর নিয়ে এসেছেন।

 لَمْ يَلِدْ

না তাঁর কোনো সন্তান আছে

وَلَمْ يُولَدْ

এবং না তিনি কারো থেকে জন্মগ্রহণ করেছেন। [আল-ক্বুরআন, ১১২:৩; প্রাগুক্ত]

খ্রীষ্টান গাণিতিক গরমিল

৩/ “বস্তুতঃ আসমানে তিনজন সাক্ষ্য দিচ্ছেন - পিতা (The Father/খোদা), কালাম/বাক্য (The Word মানে ঈসা মসীহ-আ:) ও পবিত্র আত্মা (The Holy Ghost), এবং সেই তিনের সাক্ষ্য একই।” [ইংরেজি অথরাইজড্ ভারশনের সরাসরি অনুবাদ; যোহনের প্রথম পত্র, ৫:৭]

এই শ্লোকটাই হলো বাইবেল নামের বিশ্বকোষে খ্রীষ্টানবৃন্দ যাকে ‘পবিত্র ত্রিত্ব’ বলেন, তার সবচেয়ে সন্নিকটবর্তী অনুমান। খ্রীষ্টান বিশ্বাসের এই ভিত্তিপ্রস্তরটিকেও ব্যাখ্যাসদৃশ কোনো কিছু ছাড়াই RSV হতে ছেঁটে ফেলা হয়েছে। এটা প্রথম থেকেই একটা পুণ্যময় প্রতারণা ছিলো এবং যথোচিৎভাবে এটাকে ইংরেজি ভাষাভাষী জাতিগোষ্ঠীর RSV থেকে বাদ দেয়া হয়েছে। কিন্তু বিশ্বের অবশিষ্ট ১৪৯৯-টি ভাষাভাষী জাতিগোষ্ঠী যাঁরা খ্রীষ্টানদের সাজানো গল্প নিজেদের মাতৃভাষায় পড়ে থাকেন, তাঁদের জন্যে এই ধোকাবাজি এখনো বিরাজমান। এই লোকেরা শেষ বিচার দিবসের আগ পর্যন্ত আর কখনোই সত্য সম্পর্কে জানতে পারবেন না। তবে আমরা মুসলমান সমাজ আবারো সেসব ধর্মশাস্ত্রজ্ঞ ও ঐশীতত্ত্ব বিশারদের (Doctor-in-Divinity) প্রতি ধন্যবাদ জানাতে বাধ্য, যাঁরা ইংরেজি বাইবেল থেকে আরেকটি মিথ্যে অপসারণ করার সততা প্রদর্শন করেছেন এবং ফলশ্রুতিতে তাঁদের ‘পবিত্র পুস্তক’কে ইসলামী শিক্ষার আরেক ধাপ কাছে নিয়ে এসেছেন। কেননা ক্বুরআন মজীদ ঘোষণা করে:

وَلاَ تَقُولُواْ ثَلاَثَةٌ

‘ত্রিত্ব’ বলবে না,

ٱنتَهُواْ خَيْراً لَّكُمْ

বিরত হও, তা তোমাদের জন্যে উত্তম,

إِنَّمَا ٱللَّهُ إِلَـٰهٌ وَاحِدٌ

নিশ্চয় আল্লাহতা’লা এক ইলাহ্/উপাস্য। [আল-ক্বুরআন, ৪:১৭১; সরাসরি অনুবাদ]

ঊর্ধ্বগমন

RSV (রিভাইজড্ ষ্ট্যান্ডার্ড ভারশন)-এর লেখকবৃন্দ ‘গুরুতর ত্রুটিসমূহের’ মধ্যে অন্যতম মারাত্মক যে ত্রুটি সংশোধন করার প্রয়াস পেয়েছেন, তা হলো হযরত ঈসা মসীহ (আ:)’এর ঊর্ধ্বগমন সংক্রান্ত। খ্রীষ্টধর্মের সবচেয়ে বিস্ময়কর ঘটনা - ‘ঈসা (আ:)’এর বেহেশতে তুলে নেয়া’ সম্পর্কে মথি, মার্ক, লুক ও যোহনের সুসমাচারে কেবল দুইটি উদ্ধৃতি-ই বিদ্যমান। ১৯৫২ খ্রীষ্টাব্দে RSV আবির্ভূত হওয়ার আগে প্রত্যেক ভাষায় অনূদিত প্রতিটি বাইবেলেই এগুলো পাওয়া যেতো। এগুলো হলো:

৪/ - (ক) “উম্মতদের কাছে এই সব কথা বলবার পরে হযরত ঈসা (আ:)’কে বেহেশতে তুলে নেয়া হয়। সেখানে তিনি আল্লাহর ডান দিকে বসলেন।” [মার্ক, ১৬:১৯; কিতাবুল মোকাদ্দস, বিবিএস ২০০০ খৃষ্টাব্দ]

- (খ) “দোয়া করতে করতেই তিনি (ঈসা) তাঁদের ছেড়ে গেলেন এবং তাঁকে বেহেশতে তুলে নেয়া হলো।” [লুক, ২৪:৫১; প্রাগুক্ত]

এবার অনুগ্রহ করে ৩ নং দলিলচিত্র দেখুন, যেখানে উপরোক্ত ৪ (ক) নং উদ্ধৃতিটি দৃশ্যমান হবার কথা। আপনি এটা লক্ষ্য করে বিস্মিত হবেন যে, মার্ক ১৬ অধ্যায়টি ৮ নং শ্লোকে সমাপ্ত হয়েছে এবং বিব্রতকর এক বিস্তীর্ণ শূন্যস্থান পার হয়ে পৃষ্ঠার একেবারে তলদেশে ‘ছোট ছাপায়’ হারানো শ্লোকগুলো পাদটীকারূপে নিজেদের অবস্থান ঘোষণা করেছে। আপনি যদি ১৯৫২ সালের RSV হস্তগত করতে পারেন, তাহলে দেখতে পাবেন ৪ (খ) নং উদ্ধৃতির শেষ কয়টি কথা ‘ঊর্ধ্বে বেহেশতে তুলে নেয়া হয়’ একটি ছোট ‘a' দ্বারা পরিবর্তিত হয়েছে এবং সেই 'a' আপনাকে অনুরোধ করছে দয়া করে পাদটীকা দেখতে, যেখানে আপনি ওই হারানো কথাগুলো খুঁজে পাবেন। প্রত্যেক সৎ ও নিষ্ঠাবান খ্রীষ্টানকে এ কথা স্বীকার করতে হবে যে তিনি কোনো বাইবেলে কোনো পাদটীকাকেই খোদার বাণী হিসেবে বিবেচনা করেন না। তাহলে কেন খ্রীষ্টধর্মের বেতনভুক সেবকবৃন্দ তাঁদের ধর্মের সবচেয়ে শক্তিশালী অলৌকিকত্বকে সামান্য একটি পাদটীকার মধ্যে সমর্পণ করছেন? [৩ নং দলিলচিত্র নিচে]


ইংরেজি বাইবেলের উৎস ও ক্রমবিকাশ”-এর নকশা যা ৪ নং দলিলচিত্রে প্রদত্ত হয়েছে (নিচে) - 

তাতে আপনি লক্ষ্য করবেন যে ১৮৮১ খ্রীষ্টাব্দের রিভাইজড্ ভারশনের পূর্ববর্তী সকল ‘বাইবেলের সংস্করণ-ই” “প্রাচীন কপিসমূহের” ওপর নির্ভরশীল ছিলো, যেগুলো হযরত ঈসা (আ:)’এর মাত্র পাঁচ কিংবা ছয় শ বছর পরের। ১৯৫২ সালের RSV-এর সংস্কর্তাবৃন্দই প্রথম বাইবেল পণ্ডিত যাঁরা “সবচেয়ে প্রাচীন কপিসমূহ” সম্পূর্ণভাবে খুঁজে বের করতে সক্ষম হন, যে সব কপি হযরত ঈসা (আলাইহিস্ সালাম)’এর তিন বা চার শ বছর পরের সময়কার। আমরাও একমত যে, উৎসের যতো নিকটবর্তী হবে ততোই প্রমাণসিদ্ধ হবে দলিলপত্র। স্বাভাবিকভাবেই কেবল ‘প্রাচীনের’ চেয়ে ‘সবচেয়ে প্রাচীন’ আরো অধিক বিশ্বাসযোগ্য হবে। কিন্তু ‘সবচেয়ে প্রাচীন’ লিপিগুলোতে হযরত ঈসা (আ:)’কে ‘বেহেশতে তুলে নেয়া’ অথবা তাঁর ‘ঊর্ধ্বগমন’ সম্পর্কে কোনো কথা না পেয়ে খ্রীষ্টান পাদ্রী-পরোহিতবৃন্দ ১৯৫২ সালের RSV (রিভাইজড্ ষ্ট্যান্ডার্ড ভারশন) থেকে সে সব উদ্ধৃতি (আপত্তিহেতু) অপসারণ করেন।

গাধার সার্কাস

উপরোল্লিখিত তথ্যাবলী হচ্ছে খ্রীষ্টান জগতের হতভম্বকর স্বীকারোক্তি এ মর্মে যে, ক্যানোনিকাল গসপেল তথা মথি, মার্ক, লুক ও ইউহোন্নার চারটি সুসমাচারের ‘অনুপ্রাণিত/প্রত্যাদিষ্ট’ লেখকবৃন্দ হযরত ঈসা (আ:)’এর ঊর্ধ্বগমন সম্পর্কে একটি কথাও লিপিবদ্ধ করেননি। অথচ এই সকল ‘অনুপ্রাণিত/প্রত্যাদিষ্ট’ লেখক-ই আবার তাঁদের প্রভু ও ত্রাতার মিশনের শেষ পর্যায়ে তাঁর দ্বারা একটি গাধার পিঠে চড়ে জেরুসালেমে প্রবেশের বিবরণটি লিপিবদ্ধ করার ব্যাপারে ঐকমত্যে পৌঁছুতে দেরি করেননি।

“....আর তিনি (ঈসা-আ:) তাদের (গর্ধভের) ওপর বসলেন।” [মথি, ২১:৭; বাংলা বাইবেল, ১৯৮০, বিবিএস]
“....আর তিনি (ঈসা মসীহ) তার (গর্ধভের) ওপরে বসলেন।” [মার্ক, ১১:৭; প্রাগুক্ত]
“....তার (গর্ধভের) ওপরে ঈসাকে বসালেন।” [লুক, ১৯:৩৫; প্রাগুক্ত]
“....ঈসা মসীহ তার (গর্ধভের ওপরে বসলেন।” [যোহন, ১২:১৪; প্রাগুক্ত]

সর্বশক্তিমান আল্লাহতা’লা কি এই অসঙ্গতিপূর্ণ পরিস্থিতিসূচক বিবরণের রচয়িতা হতে পারেন, তাঁরই নিজস্ব রীতির বাইরে যেয়ে এটা তত্ত্বাবধান করতে যেনো সুসমাচার লেখকবৃন্দ তাঁরই ‘পুত্রের’ গর্ধভ পিঠে আরোহণ ও পবিত্র নগরীতে প্রবেশের বিবরণ লিপিবদ্ধ করার বেলায় নিজেদের মূল অবস্থান না হারান, অথচ ফেরেশতাবৃন্দের পাখায় চড়ে তাঁরই ‘পুত্রের’ আসমানে উড্ডয়নের সুসমাচার সম্পর্কে নিশ্চুপ থাকতে যেনো তাঁরা (মানে গসপেল-লেখকবৃন্দ) ‘অনুপ্রাণিত/প্রত্যাদিষ্ট হন?’

দীর্ঘক্ষণের জন্যে নয়!

ঠাট্টাটি হৃদয়ঙ্গম করতে ‘টাটকা সুসমাচার প্রচারকারী’ ও ‘বাইবেলের উগ্র প্রচারকবর্গ’ একটু দেরি করে ফেলেছিলেন। যতোক্ষণে তাঁরা অনুধাবন করতে পারেন যে তাঁদের প্রচারণার ভিত্তিস্তম্ভ - “ঈসা (আ:)’এর ঊর্ধ্বগমন” - খ্রীষ্টান বাইবেল পাণ্ডিত্যের ফলশ্রুতিতে অবনমিত হয়েছে, ততোক্ষণে RSV-এর প্রকাশকবৃন্দ দেড় কোটি (পনেরো মিলিয়ন) ডলারের নেট মুনাফা তাঁদের ফেলা জালে উঠিয়ে নিয়েছেন! প্রপাগান্ডাকারীবর্গ এক মহা হৈচৈ বাধিয়ে পঞ্চাশটি ডিনোমিনেশনের মধ্যে দুটোর সমর্থন আদায় করে খোদার ‘প্রত্যাদেশসূচক’ বাণীতে সংযোজনাগুলো আবারো যোগ করতে প্রকাশকদেরকে বাধ্য করেন। ফলে ১৯৫২ সালের পরবর্তী যে কোনো নতুন RSV-এর সংস্করণেই কর্তিত অংশটুকু মূল লিপিতে ‘পুনঃসংরক্ষণ’ করা হয়েছে। 

এটা পুরোনো - বহু পুরোনো খেলা। ইহুদী ও খ্রীষ্টানবৃন্দ তাঁদের ‘ঐশী পুস্তকের’ মধ্যে ওর সূচনালগ্ন হতেই সম্পাদনা করে আসছেন। বর্তমানের জালিয়াত তথা নকলবাজদের সাথে প্রাচীন নকলবাজদের পার্থক্য হলো এই যে, পূর্ববর্তীরা ‘মুখবন্ধ’ ও ‘পাদটীকা’ লেখার কলাকৌশল সম্পর্কে অজ্ঞ ছিলেন। নইলে তাঁরাও আমাদের আধুনিককালের নায়কদের মতোই পরিষ্কারভাবে ব্যক্ত করতেন তাঁদের সাধিত অনধিকার পরিবর্তন সম্পর্কে এবং নকল মুদ্রাকে উজ্জ্বল স্বর্ণে রূপান্তরের সহজ অজুহাত সম্পর্কে। 

“বিভিন্ন ব্যক্তি ও দুটো ডিনোমিনেশনের কমিটিগুলো (প্রকাশক) কমিটির কাছে (বাইবেলে) পরিবর্তন সাধনের জন্যে অনেকগুলো প্রস্তাব পেশ করেন। এগুলোর সবগুলোকেই কমিটি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করেন।

“দুটো উদ্ধৃতি - মার্ক (১৬:৯-২০)’এর দীর্ঘতর সমাপ্তি...এবং লুক ২৪:৫১ মূললিপিতে পুনঃসংরক্ষিত হয়েছে।” [মুখবন্ধ, Collins, পৃষ্ঠা - vi ও vii]

প্রশ্ন: “কেন এই পুনঃসংরক্ষণ?” উত্তর: কারণ সেগুলো আগেই কাটছাঁট করা হয়েছিলো। প্রশ্ন: ঊর্ধ্বগমন সংক্রান্ত উদ্ধৃতিগুলো কেন প্রথমাবস্থাতেই কাটছাঁট করা হয়েছিলো? উত্তর: কারণ ‘সবচেয়ে’ প্রাচীন লিপিগুলোতে ঊর্ধ্বগমন সংক্রান্ত কোনো উদ্ধৃতি-ই ছিলো না। সেগুলো যোহন/ইউহোন্না প্রথম পত্র ৫:৮-এর মতোই সংযোজনা ছিলো মাত্র (পূর্ববর্তী ‘খ্রীষ্টান গাণিতিক গরমিল’ শীর্ষক প্যারাগ্রাফের ৩ নং উদ্ধৃতি দ্রষ্টব্য)। তাহলে কেন একটাকে অপসারণ করে অপরটাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াস? আশ্চর্য হবার কিছু নেই! আপনি যতোক্ষণে একটি RSV হস্তগত করবেন, ততোক্ষণে কমিটিকে হয়তো তাঁদের মহামূল্যবান মুখবন্ধের সমস্তটুকুই কর্তন করার সিদ্ধান্ত নিতে হতে পারে। ‘জেহোভার সাক্ষী’-বর্গ ইতোমধ্যেই তাঁদের New World Translation of the Christian Greek Scriptures (তাঁদের দেয়া ‘নতুন নিয়মের’ শিরোনাম)-এর মুখবন্ধের ২৭টি খোলাসাকারী পৃষ্ঠা বাদ দিয়ে ফেলেছেন।

রেভারেন্ড সি, আই, স্কোফিল্ড (C.I. Scofield) নামের এক ধর্মশাস্ত্রজ্ঞ (Doctor-in-Divinity) অপর আটজন ধর্মশাস্ত্রজ্ঞের একটি উপদেষ্টা কমিটিসহ তাঁদের Scofield Reference Bible শিরোনামের পুস্তকে হিব্রু ‘এলাহ’ (Elah) শব্দটিকে বিকল্পস্বরূপ ‘আলাহ’ (Alah) উচ্চারণ করা যথাযথ বিবেচনা করেছেন। ফলে খ্রীষ্টান সমাজ উট হজম করেছেন; তাঁরা অবশেষে মনে হয় স্বীকার করে নিয়েছেন খোদার নাম আল্লাহ; তবে তাঁরা পূর্ণ স্বীকৃতি দেননি, কেননা তাঁদের উচ্চারিত শব্দটিতে একটি L (ল) বিরাজমান [৫ নং দলিলচিত্র দেখুন]



আমি এ বিষয়ে জনসমক্ষে প্রভাষণ দিয়েছি। বিশ্বাস করুন, পরবর্তী Scofield Reference Bible সংস্করণের ‘পয়দায়েশ/আদিপুস্তক’ ১:১-এর সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ পূর্বের মতো অটুট থাকলেও এক জাদুকরী হাতের কারসাজিতে গোটা ‘Alah'  (‘আলাহ’) শব্দটি উধাও হয়ে গিয়েছে। যেখানে ‘আলাহ’ শব্দটি অবস্থিত ছিলো, সেখানে আর এখন খালি জায়গাও নেই। এটা অর্থডক্স তথা সনাতনী খ্রীষ্টানদের বাইবেলের মধ্যেই ঘটেছে। তাঁদের ভোজবাজির খেলায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা যে কারো পক্ষেই কষ্টসাধ্য ব্যাপার।

পঞ্চম অধ্যায়

মারাত্মক স্বীকারোক্তি 

সেভেন্থ ডে এডভেনটিষ্ট চার্চ (Seventh Day Adventist Church)-এর জনৈকা মহিলা পাদ্রী মিসেস এলেন জি, ওয়াইট তাঁর বাইবেল ব্যাখ্যামূলক পুস্তকের প্রথম খণ্ডের ১৪ পৃষ্ঠায় ‘পবিত্র বাইবেল’-এর ত্রটিপূর্ণতা সম্পর্কে নিম্নবর্ণিত স্বীকারোক্তি প্রদান করেন: 

“বর্তমানকালে আমাদের দ্বারা পঠিত বাইবেলটি হচ্ছে নকলনবিস-বর্গের কর্ম, যাঁরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাঁদের কর্মটি চমকপ্রদ অভ্রান্ততায় সম্পাদন করেছেন। কিন্তু নকলনবিস-বর্গ ত্রুটি থেকে মুক্ত ছিলেন না এবং খোদাতা’লা-ও স্পষ্টতঃ তাঁদেরকে তাঁদের নকলনবিসি-কর্মে ত্রুটি থেকে হেফাযত করা যথার্থ মনে করেননি।” তাঁর ব্যাখ্যামূলক পুস্তকে মিসেস ওয়াইট আরো সাক্ষ্য দেন: “আমি দেখেছি, খোদা বাইবেলকে বিশেষভাবে হেফাযত করেছেন (কী জিনিস হতে?); “....তবু যখন এর কপি/সংখ্যা কম ছিলো, তখন পণ্ডিতবৃন্দ কয়েকটি ক্ষেত্রে এর শব্দাবলী পরিবর্তন করেছিলেন এ কথা চিন্তা করে যে, তাঁরা এটাকে সহজ-সরল করছেন; অথচ প্রকৃতপক্ষে তাঁরা তাঁদের প্রতিষ্ঠিত দৃষ্টিভঙ্গি যা ঐতিহ্য দ্বারা পরিচালিত ছিলো, তার দিকে ঝুঁকিয়ে সে সব বিষয়কে ধাঁধাপূর্ণ করে ফেলেছিলেন, যেগুলো ছিলো সহজ-সরল।”

লালিত ব্যাধি

এই মানসিক ব্যাধি লালিত। ওই লেখিকা ও তাঁর অনুসারীবর্গ এরপরও বাসার ছাদের ওপর থেকে ঢোল পিটিয়ে এ কথা বলতে পারেন: “নিশ্চয় বাইবেল হচ্ছে খোদার অভ্রান্ত বাণী;” “হ্যাঁ, এটা দূষিত কিন্তু খাঁটি/নির্মল;” “এটা মানবীয়, তবু ঐশী।” তাঁদের ভাষায় শব্দ বা বাক্যের কোনো অর্থ আছে? হ্যাঁ, তাঁদের বিচারালয়ে এগুলোর মানে আছে, কিন্তু তাঁদের ধর্মশাস্ত্রে নেই। তাঁরা তাঁদের ধর্মপ্রচারে ‘কাব্যিক লাইসেন্স’ সংরক্ষণ করেন।

فِي قُلُوبِهِم مَّرَضٌ

তাদের অন্তরগুলোতে ব্যাধি রয়েছে;

فَزَادَهُمُ ٱللَّهُ مَرَضاً

অতঃপর আল্লাহ তাদের ব্যাধি আরো বৃদ্ধি করে দিয়েছেন;

 وَلَهُم عَذَابٌ أَلِيمٌ

এবং তাদের জন্যে অবধারিত রয়েছে কষ্টদায়ক শাস্তি;

 بِمَا كَانُوا يَكْذِبُونَ

তাদের মিথ্যের পরিণামে। [আল-ক্বুরআন, ২:১০; নূরুল এরফান]

সাক্ষ্যসমূহ

বাইবেলের উগ্র প্রচারকারীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি চিৎকার-চেঁচামেচিকারী হচ্ছেন জেহোভার সাক্ষীবর্গ। তাঁদের পূর্বোল্লিখিত ‘মুখবন্ধের’ ৫ নং পৃষ্ঠায় তাঁরা স্বীকার করেন: 

“অনুপ্রাণিত/প্রত্যাদিষ্ট মূল (সুসমাচার) হতে হস্ত দ্বারা নকল করার সময় মানবীয় দুর্বলতার অনুপ্রবেশ ঘটে, আর তাই মূল ভাষায় যে সহস্র সহস্র কপি বর্তমানে প্রচলিত, তার কোনোটা-ই অপরটার নিখুঁত প্রতিলিপি (Duplicate) নয়। ফলশ্রুতিতে কোনো দুটি কপি-ই হুবহু অনুরূপ নয়।” পাঠক, এখন নিশ্চয় আপনি বুঝতে পারছেন কেন ২৭ পৃষ্ঠা-সম্বলিত ‘মুখবন্ধটি’ তাঁদের বাইবেলগুলো হতে অপসারণ করা হয়েছে। আল্লাহতা’লা তাঁদেরকে তাঁদেরই বিদ্যার দৌড় দ্বারা ফাঁসিতে ঝুলাবার ব্যবস্থা করেছেন।

সুবিধামতো বাছাই

চার হাজার পরস্পরবিরোধী পাণ্ডুলিপি যেগুলো সম্পর্কে খ্রীষ্টানবৃন্দ গর্ব করে থাকেন, সেগুলোর মধ্যে খ্রীষ্টান চার্চের পাদ্রী-পুরোহিতবর্গ নিজেদের কুসংস্কারের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ স্রেফ চারটি পাণ্ডুলিপি বেছে নিয়েছেন এবং সেগুলোর নাম দিয়েছেন মথি, মার্ক, লুক ও যোহন/ইউহোন্না। সেগুলোর নির্দিষ্ট স্থানে আমরা সেগুলো সম্পর্কে আলোকপাত করবো। এখানে জেহোভার সাক্ষীদের পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফলাফল নিয়ে ব্যাপৃত হবো, যে ফলাফল বা সিদ্ধান্ত তাঁরা বর্তমানে কর্তন করেছেন তাঁদেরই মুখবন্ধ হতে: 

“অতএব, সাক্ষ্য হচ্ছে এই যে, খ্রীষ্টান গ্রীক পাণ্ডুলিপি (মানে নতুন নিয়ম)’এর মূল কপি নিয়েও অনধিকার পরিবর্তন সাধন করা হয়েছে, যেমনটি করা হয়েছিলো LXX (মানে জেহোভার সাক্ষীদের ভাষায় বাইবেলের পুরাতন নিয়ম)-এর বেলায়।” [মুখবন্ধ, New World Translation of the Christian Greek Scriptures]

তবু এই সংশোধনের অযোগ্য সম্প্রদায় এতোখানি ধৃষ্টতা দেখিয়েছেন যে, তাঁরা 'Is the Bible Really the Word of God?' - শিরোনামযুক্ত ১৯২ পৃষ্ঠাসম্বলিত বইয়ের প্রথম সংস্করণেই নয় মিলিয়ন (নব্বই লাখ) কপি প্রকাশ করেছেন। আমরা এক অসুস্থ মানসিকতার মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছি। কেননা তাঁদের ভাষ্যানুযায়ী যতো অনধিকার পরিবর্তন-ই বাইবেলে সাধন করা হোক না কেন, তা বাইবেলের বিশ্বস্ততায় তাৎপর্যপূর্ণ ক্ষতি সাধন করবে না (?)! এ-ই হচ্ছে খ্রীষ্টান যুক্তি।  

ধৈর্যশীল শুনানি

ড: গ্রাহাম স্ক্রগী তাঁর পূর্বোক্ত ‘Is the Bible Really the Word of God?' পুস্তকের ২৭ পৃষ্ঠায় বাইবেলের পক্ষ সমর্থন করে বলেন: 

বাইবেল কি খোদার বাণী? - এই বিষয়টি উপলব্ধি করতে হলে আমদেরকে পুরোপুরিভাবে নিরপেক্ষ হতে হবে; এ কথা মনে রাখতে হবে যে বাইবেল স্বয়ং নিজের সম্পর্কে যা বলে তা আমাদের শুনতে হবে। বিচারালয়ে আমরা ধরে নেই যে একজন সাক্ষী সত্য কথা বলবেন এবং সে অনুযায়ী তাঁর কথাকে স্বীকার করে নেই, যদি না আমরা তাঁকে সন্দেহ করার অথবা মিথ্যেবাদী সাব্যস্ত করার মজবুত প্রমাণ পাই। নিশ্চয় বাইবেলকেও একই ধরনের শুনানির সুযোগ দেয়া উচিৎ, আর তাই অনুরূপ এক ধৈর্যশীল শুনানি তার লাভ করা উচিৎ।”

ড: স্ক্রগীর এ দোহাই বা অজুহাত যুক্তিসঙ্গত। তিনি যা চান আমরা ঠিক তা-ই করার এবং বাইবেলকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেবো।

বাইবেলের প্রথম পাঁচটি পুস্তক, যথা - পয়দায়েশ (আদি পুস্তক), হিজরত (যাত্রা পুস্তক), লেবীয় (পুস্তক), শুমারি (গণনা পুস্তক) ও দ্বিতীয় বিবরণ (পুস্তক) ইত্যাদিতে সাত শতাধিক বাক্য আছে যেগুলো প্রমাণ করে খোদাতা’লা এ বইগুলোর রচয়িতা তো নন-ই, এমন কী পয়গাম্বর মূসা (আলাইহিস্ সালাম)-এরও এ ব্যাপারে কোনো হাত নেই। এই বইগুলো দৈবচয়নের ভিত্তিতে খুল্লেই দেখতে পাবেন:

* “মা’বূদ (পয়গাম্বর) মূসাকে বল্লেন, তুমি নিচে যাও....” [হিজরত/যাত্রা পুস্তক, ১৯:২৪; কিতাবুল মোকাদ্দস, বিবিএস ২০০০ খ্রীষ্টাব্দ]
* “জবাবে মূসা মা’বূদকে বল্লেন, কিন্তু লোকেরা তুর পাহাড়ের ওপরে আসতে পারবে না....” [প্রাগুক্ত, ১৯:২৩; যাত্রা পুস্তক]
* “তখন মা’বূদ মূসাকে বল্লেন,.... তুমি লোকদের আগে চলে যাও....।” [প্রাগুক্ত, ১৭:৫; যাত্রা পুস্তক]
* “এতে মা’বূদ মূসাকে বল্লেন......।” [লেবীয় পুস্তক, ২৪:১৩; প্রাগুক্ত কিতাবুল মোকাদ্দস, বিবিএস ২০০০ খ্রীষ্টাব্দ]
* “মা’বূদ মূসাকে বল্লেন, তুমি নিচে নেমে গিয়ে লোকদের সাবধান করে দাও....।” [যাত্রা পুস্তক, ১৯:২১; প্রাগুক্ত, বিবিএস ২০০০]

এটা স্পষ্ট যে এগুলো খোদা কিংবা মূসা (আ:)’এর বাণী নয়। এগুলো শোনা কথা থেকে লিপিবদ্ধ তৃতীয় ব্যক্তির বাণী হওয়ার ইঙ্গিতবহ।

মূসা (আ:) নিজেই নিজের মৃত্যু সংবাদ (Obituary) লিখেছিলেন কি?

পয়গাম্বর মূসা (আলাইহিস্ সালাম) কি তাঁর বেসাল (পরলোকে আল্লাহর সাথে মিলন)-প্রাপ্তির আগে নিজেই নিজের মৃত্যুসংবাদ লেখায় অবদান রেখেছিলেন? ইহুদী জাতিগোষ্ঠী কি নিজেদের মৃত্যুসংবাদ আগেভাগেই লিখে রাখতেন? “মূসা...ইন্তেকাল করলেন...(আর) মা’বূদই তাঁকে দাফন করলেন....ইন্তেকাল করার সময় মূসার বয়স ছিলো এক শ বিশ বছর....আজ পর্যন্ত বনি-ইসরাঈলদের মধ্যে মূসার মতো আর কোনো নবীর জন্ম হয়নি।” [দ্বিতীয় বিবরণ, ৩৪:৫-১০; কিতাবুল মোকাদ্দস, বিবিএস ২০০০ খ্রীষ্টাব্দ] 

আমরা সহসা পুরাতন নিয়মের (Old Testament) বাকি অংশকে অন্যান্য দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করবো।

ষষ্ঠ অধ্যায় 

‘নতুন নিয়ম’- খ্রীষ্টনাম (Christened)-কৃত বইটি

তথাকথিত নতুন নিয়ম [নোট: New Testament তথাকথিত, কেননা এতে কোথাও এর নাম ‘নতুন নিয়ম’ বলা হয়নি; ‘পুরাতন নিয়মেরও’ একই অবস্থা; এমন কী ‘বাইবেল’ শব্দটিও এর পৃষ্ঠাগুলোতে অজ্ঞাত! মনে হয় খোদা বইগুলোর শিরোনাম দিতে ভুলে গিয়েছিলেন (?)]-এর কী সুসংবাদ? প্রতিটি সুসমাচারই কেন ‘অমুক অনুসারে’ পরিচিতি দ্বারা আরম্ভ হয়েছে? [৬ নং দলিলচিত্র দ্রষ্টব্য

কেন ‘অনুসারে?’ কারণ দম্ভকৃত বিরাজমান চার হাজার কপির মধ্যে একটাও সেটার লেখকের সই বহন করছে না! আর তাই এই ‘অনুসারে’ অনুমানটির জন্ম! এমন কী এর অভ্যন্তরের সাক্ষ্য-ও প্রমাণ করে যে মথি স্বয়ং প্রথম সুসমাচারটির লেখক ছিলেন না, যেটা আজকে তাঁর নাম বহন করছে। 

“ঈসা যখন সেখান থেকে চলে যাচ্ছিলেন তখন (তিনি) মথি নামে একজন লোককে খাজনা আদায় করবার ঘরে বসে থাকতে দেখলেন।  ঈসা তাঁকে বল্লেন, ‘এসো, আমার উম্মত হও।’ মথি তখনই উঠে তাঁর সঙ্গে গেলেন।” [মথি, ৯:৯; কিতাবুল মোকাদ্দস, বিবিএস ২০০০ খ্রী:]

যে কেউ কোনো কল্পনা ছাড়াই এ কথা উপলব্ধি করতে পারবেন যে ওপরের (বাইবেলীয়) শ্লোকে উদ্ধৃত ‘তিনি’‘তাঁকে’ লেখক হিসেবে ঈসা (আ:) বা মথির বর্ণনা নয়, বরং তৃতীয় কোনো ব্যক্তির বিবরণ যা তিনি শোনা কথা থেকে লিখেছেন। আমরা যদি এই ‘স্বপ্নসমূহের পুস্তক’ (প্রথম সুসমাচারটির অপর নাম)-কে শিষ্য মথিরই প্রতি আরোপ করতে না পারি, তবে কীভাবে আমরা এটাকে খোদার বাণী হিসেবে গ্রহণ করতে পারি? ‘সেইন্ট/ভাববাদী মথি অনুসারে সুসমাচার’ যে মথি রচনা করেননি এবং এটা যে বেনামী হাতের কাজ, তা আবিষ্কার করার ক্ষেত্রে আমরা কিন্তু একা নই। জে,বি, ফিলিপ্স্ (J.B. Phillips) সাহেবও আমাদের প্রাপ্ত তথ্যের সাথে একমত। তিনি এ্যাংলিকান চার্চের মায়নাপ্রাপ্ত কর্মচারী; ইংল্যান্ডের চিচিষ্টার ক্যাথিড্রাল-এর জনৈক প্রেবেন্ডারী। তাঁর চার্চের প্রাতিষ্ঠানিক দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষতিসাধন করার জন্যে মিথ্যে কথা বলার বা চার্চের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করার কোনো কারণই তাঁর নেই! ‘সেইন্ট মথির সুসমাচার’ সংক্রান্ত তাঁর পরিচিতি এখানে স্মর্তব্য। [৭ নং দলিলচিত্র দেখুন]

উক্ত সুসমাচারের লেখক সম্পর্কে ফিলিপ্স সাহেব বলেন: 

“প্রাথমিক বিবরণ (Tradition) এই সুসমাচারটিকে হাওয়ারী/বার্তাবাহক মথির প্রতি আরোপ করে; কিন্তু বর্তমানে পণ্ডিতবৃন্দ প্রায় সবাই এ অভিমতকে প্রত্যাখ্যান করেছেন।” 

আরেক কথায়, সেইন্ট মথি সেই সুসমাচারটি লেখেননি, যেটা তাঁর নাম বহন করছে। এটা সর্বাধিক প্রসিদ্ধ খ্রীষ্টান পণ্ডিতবৃন্দের আবিষ্কৃত তথ্য, কোনো হিন্দু, মুসলিম কিংবা ইহুদী পণ্ডিতের নয়, যাঁদেরকে হয়তো পক্ষপাতিত্বের দোষারোপ করা হতে পারে। আমাদের এ্যাংলিকান বন্ধুকে আরো বলতে দেয়া যাক - “এর লেখককে আমরা তবুও সুবিধার্থে মথি নামে ডাকতে পারি।” ‘সুবিধার্থে,’ নইলে যতোবার ‘মথিকে’ উদ্ধৃত করবো, ততোবারই আমাদেরকে বলতে হবে - “নতুন নিয়মের প্রথম পুস্তকটি,” অতো অতো অধ্যায়ের অতো অতো পংক্তি। এবং পুনরায় “নতুন নিয়মের প্রথম পুস্তকটি....” ইত্যাদি ইত্যাদি। সুতরাং জে,বি, ফিলিপ্স সাহেবের মতানুযায়ী এটা ‘সুবিধাজনক’ যে আমরা পুস্তকটির একটি নামকরণ করি। এমতাবস্থায় কেন ‘মথি’ নয়? এটা তো যে কোনো নামের মতো ভালো শোনায়! ফিলিপ্স্ সাহেব আরো বলেন, “লেখক সাধারণভাবে রহস্যময় 'Q'-এর শরণাপন্ন হয়েছেন, যা হয়তো বা মুখস্থ বিবরণগুলোর সংকলন হতে পারে।” এই রহস্যময় ‘Q'-টি কী? ‘Q' হচ্ছে জার্মান 'Quella' শব্দের সংক্ষিপ্তকরণ, যার অর্থ ‘উৎসসমূহ।’ এখানে আরেকটি দলিল - একটি সাধারণ উৎস ছিলো বলে ধারণা করা হয়, যার মধ্যে আমাদের বর্তমান মথি, মার্ক ও লুক প্রবেশ করতে পারতেন। এই তিনজন লেখক - তাঁরা কে ছিলেন স্বয়ং প্রভু আল্লাহতা’লা-ই ভালো জানেন - লভ্য দলিলের ওপর এক সার্বিক দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখতে পেরেছিলেন। তাঁরা ‘একই’ চোখ দ্বারা-ই যেনো দেখে লিখছিলেন। আর যেহেতু তাঁরা একই মতের ধারক-বাহক ছিলেন, সেহেতু প্রথম তিনটি ‘সুসমাচার’ Synoptic Gospels (সামগ্রিক সংকলিত সুসমাচার) নামে পরিচিতি লাভ করে।

পাইকারি নকল

কিন্তু ‘অনুপ্রাণিত/প্রত্যাদিষ্ট’ ব্যবসার কী সুসংবাদ? এ্যাংলিকান প্রেবেন্ডারী সাহেব একেবারে মাথায় হাতুড়ির বাড়ি দিয়েছেন। তবে এ ব্যাপারে তাঁর অধিকারই সবচেয়ে বেশি। চার্চের একজন বেতনভুক কর্মচারী, একজন অর্থডক্স/সনাতনী ইভানজেলিকাল খ্রীষ্টান এবং একজন বিখ্যাত বাইবেল পণ্ডিত যিনি ‘মূল’ গ্রীক লিপিগুলোতে সরাসরি প্রবেশে সক্ষম, তাঁকেই বলতে দেয়া যাক। দেখুন কতো সন্তর্পণে তিনি থলের বিড়াল বের করে দিয়েছেন: “তিনি (মথি) মার্কের সুসমাচারটি স্বাধীনভাবে ব্যবহার করেছেন,” যেটা বিদ্যালয়ের শিক্ষকের ভাষায় হবে - “তিনি মার্কের সুসমাচারটি হতে পাইকারি নকল করেছেন!” তবুও খ্রীষ্টানবৃন্দ এই পাইকারি নকলকে খোদার বাণী আখ্যায়িত করে থাকেন কীভাবে?

আপনাদের কাছে এটা কি আজব মনে হয় না যে পয়গাম্বর ঈসা (আ:)’এর ধারণাকৃত শিষ্য মথি, যিনি হযরত ঈসা (আ:)’এর প্রচারক-জীবনের চাক্ষুস ও শ্রুতি সাক্ষী ছিলেন, তিনি ‘আপন মনিবের’ নুবূয়্যত-সংক্রান্ত নিজস্ব প্রত্যক্ষ সাক্ষ্যসম্বলিত বর্ণনাগুলো না লিখে এক তরুণের (মার্কের) কাছ থেকে (বিবরণগুলো) চুরি করবেন - তাও আবার যে তরুণ দশ বছর বয়স্ক ছিলেন যখন নবী ঈসা মসীহ (আ:) তাঁর জাতিকে সংশোধন করার ক্ষেত্রে সচেষ্ট ছিলেন? কোনো শ্রুতি ও চাক্ষুস সাক্ষী কেন এমন একজনের কাছ থেকে নকল করবেন যিনি নিজেই শোনা কথা থেকে শিখেছিলেন? শিষ্য মথি এ রকম নির্বোধের মতো কাজ করেননি। কারণ তাঁর নির্মল/নির্দোষ নামের ওপর একটি বেনামী দলিল চাপিয়ে দেয়া হয়েছে।

নকলবাজি নাকি সাহিত্যগত অপহরণ

নকলবাজির অর্থ সাহিত্যগত চুরি। কারো লেখার সম্পূর্ণ অংশ হুবহু নিজের নামে চালিয়ে দেয়াই নকলবাজি। বাইবেলের পুস্তকগুলোর মধ্যে চল্লিশ কিংবা প্রায় অনুরূপ সংখ্যক পুস্তকের অজ্ঞাতনামা লেখকদের সবাই এই সাধারণ (common) বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। প্রটেষ্টান্ট খ্রীষ্টানদের ৬৬টি পুস্তক ও রোমান ক্যাথলিকদের ৭৩টি পুস্তক, যেগুলোকে ‘পবিত্র সুসমাচার’ (বাইবেল) বলা হয়, সেগুলোর লেখকদের মধ্যে ধারণাকৃত একটি ‘সার্বিক রজ্জু’ (common cord) সম্পর্কে খ্রীষ্টান সম্প্রদায় বড়াই করে থাকেন। হ্যাঁ, সার্বিক রশি/রজ্জু-ই বটে! এমনই ‘সার্বিক’ যে, মথি ও লুক - তাঁরা যে-ই হোন - মার্ক থেকে ৮৫% হুবহু নকল করে ফেলেছেন! সর্বশক্তিমান খোদাতা’লা তো সিনোপটিষ্টদেরকে (তথা ‘একই চোখ’ দ্বারা দর্শনকারী মথি, মার্ক ও লুককে) একই শব্দগুলো লিখতে নির্দেশ দেননি। খ্রীষ্টানবৃন্দ-ও এ কথা স্বীকার করে থাকেন; কেননা খোদা কর্তৃক অবতীর্ণ (ঐশী) বাণী (মানে কালাম)-সম্বলিত অনুপ্রেরণা বা প্রত্যাদেশে তাঁরা বিশ্বাস করেন না, যেমনিভাবে বিশ্বাস করেন মুসলিম সমাজ নিজেদের ঐশীগ্রন্থ ক্বুরআন মজীদ সম্পর্কে। [বিস্তারিত জানতে পড়ুন মরহূম আহমদ দীদাত সাহেবের রচিত ‘al-Quran: The Ultimate Miracle’]

মথি ও লুকের এই ৮৫% নকলবাজি গুরুত্বহীনতায় ম্লান হয়ে যায়, যখন-ই সেটাকে ‘পুরাতন নিয়মের’ লেখকদের কৃত সাহিত্যগত অপহরণের সাথে তুলনা দেয়া হয়, যেখানে তথাকথিত খোদার পুস্তকের অভ্যন্তরে ১০০% চুরি সংঘটিত হয়েছে। বিশপ কেনেথ ক্র্যাগের মতো বড় বড় খ্রীষ্টান পণ্ডিতবৃন্দ এই চুরিকে সহজ-সরলকরণের উদ্দেশ্যে আখ্যা দিয়েছেন ‘পুনর্মুদ্রণ’ এবং এতে তাঁরা ভীষণ গর্বিত-ও। [বিশপ কেনেথ ক্র্যাগের সম্পূর্ণ উদ্ধৃতি এই পুস্তিকার প্রথম পৃষ্ঠায় বিদ্যমান]

বিকৃত মান

ড: স্ক্রগী (ইতিপূর্বে উদ্ধৃত) বাইবেল সম্পর্কে জনৈক ড: যোসেফ পার্কার সাহেবের অনন্য গুণকীর্তনের জন্যে তাঁকে নিজ ‘Is the Bible Really the Word of God?' (Moody Press) পুস্তকে অত্যন্ত উৎসাহ সহকারে উদ্ধৃত করেন: 

“বিভিন্ন বিষয়ের সমাহারের ক্ষেত্রে কী অপূর্ব এই পুস্তক বাইবেল!....অস্পষ্ট নামসমূহ দ্বারা গোটা গোটা পৃষ্ঠা পরিপূর্ণ; আর শেষ বিচার দিবসের চাইতে একটি বংশ পরিচয় সম্পর্কে বেশি বিবরণ প্রদান করা হয়েছে। ঘটনাগুলো অর্ধবর্ণিত; আর বিজয়ের অবস্থান কোথায় তা আমাদের দ্বারা উপলুব্ধ হবার আগেই (ঘটনার) যবনিকাপাত ঘটেছে। এর সমতুল্য কোনো কিছু কোথায় আছে (সারা দুনিয়ার ধর্ম-সাহিত্যে)?”

এটা বাক্যসমূহের একটা সুন্দর অলঙ্কার নিঃসন্দেহে! তবে তা অযথা হৈচৈ ছাড়া কিছু নয়। আর তা সর্বশক্তিমান আল্লাহতা’লার প্রতি ওই রকম বিব্রতকর জগাখিচুড়িকে কর্তৃত্ব দানের মতো ধর্মবিরোধী অভিযোগ উত্থাপন-ও। তবু খ্রীষ্টান সম্প্রদায় তাঁদের ‘ঐশী পুস্তকের’ ত্রুটিবিচ্যুতির দিকেই বিমোহিত নেত্রে চেয়ে থাকতে পছন্দ করেন, ঠিক যেমনিভাবে জুলিয়েটের ঠোঁটের ওপরে অবস্থিত কালো দাগের দিকে রোমিও বিমোহিত নেত্রে চেয়ে থাকতে পছন্দ করতো!

১০০%-এর চেয়ে কোনো অংশে কম নয়

কেইপটাউন (দক্ষিণ অফ্রিকা) বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত ‘বাইবেল কি খোদার বাণী?’-বিষয়ক একটি সিম্পোজিয়াম, যা (ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের) ধর্মশাস্ত্র বিভাগ-প্রধান অধ্যাপক কাম্সটি ও আমার (স্বয়ং লেখকের) দ্বারা পরিচালিত হয়েছিলো, তাতে ‘অনুপ্রাণিত/প্রত্যাদিষ্ট’ বাইবেল লেখকদের কৃত নকলের মাত্রা প্রদর্শন করতে আমি আমার দর্শকশ্রোতাদেরকে তাঁদের বাইবেল খুলতে বলি। 

এমন কিছু খ্রীষ্টান আছেন, যাঁরা ধর্মীয় আলোচনা বা বিতর্কে বগলের নিচে নিজেদের বাইবেলগুলো বহন করতে খুবই পছন্দ করেন। এই পুস্তকটি ছাড়া তাঁরা একেবারেই অসহায় বলে মনে হয়। আমার অনুরোধে দর্শকশ্রোতাদের একাংশ বাইবেলের পৃষ্ঠা উল্টানো আরম্ভ করেন। আমি তাঁদেরকে ‘ইশাইয়া/যিশাইয়’ পুস্তকের ৩৭ নং অধ্যায়টি খুলতে বলি। দর্শকশ্রোতাবৃন্দ প্রস্তুত হলে আমি আমার (হাতের) ‘ইশাইয়া ৩৭’-এর সাথে তাঁদের ‘ইশাইয়া ৩৭’ মিলিয়ে দেখতে বলি, যাতে সেগুলো অনুরূপ কি-না তা পরিদৃষ্ট হয়। আমি পড়া আরম্ভ করি ধীরে ধীরে। শ্লোক ১, ২, ৪, ১০, ১৫...এভাবে অধ্যায়ের শেষ অবধি পাঠ করি। প্রতিটি শ্লোকের পরপরই আমি তাঁদেরকে জিজ্ঞেস করতে থাকি শ্লোকগুলো মিলছিলো কি-না। তাঁরা বারবার সমস্বরে চিৎকার করছিলেন - “হ্যাঁ, হ্যাঁ।” অধ্যায়টির শেষে আমার পাঠকৃত পৃষ্ঠায় বাইবেল তখনো নিজের হাতে খোলা রেখে আমি সিম্পোজিয়ামের সভাপতি সাহেবের মাধ্যমে দর্শকশ্রোতাদের অবহিত করাই যে আমি ‘ইশাইয়া ৩৭’ থেকে পড়ছিলাম না, বরং ‘২ বাদশাহ-নামা/রাজাবলী ১৯ অধ্যায়’ থেকে পড়ছিলাম। এতে দর্শকশ্রোতাদের মাঝে এক চরম হতবিহ্বলতা দেখা দেয়! ফলে আমি ‘পবিত্র বাইবেলের’ মধ্যে ১০০% নকল প্রমাণ করতে সক্ষম হই। [৮ নং দলিলচিত্র দেখুন]

আরেক কথায়, ইশাইয়া ৩৭ ও ২ বাদশাহ-নামা/রাজাবলী ১৯ অধ্যায় দুটো হুবহু একই ভাষায় লিখিত [বঙ্গানুবাদকের নোট: বাংলাদেশ বাইবেল সোসাইটি (বিবিএস) কর্তৃক প্রকাশিত বাংলা ‘কিতাবুল মোকাদ্দস’ ও উইলিয়াম কেরী বাইবেল সংস্করণেও এই নকল পরিদৃষ্ট হয়]। অথচ এগুলো দু জন ভিন্ন ভিন্ন লেখকের প্রতি আরোপ করা হয়, যাঁরা শতাব্দীসমূহ দ্বারা পৃথক এবং যাঁদেরকে খ্রীষ্টানবৃন্দ খোদাতা’লা কর্তৃক ‘অনুপ্রাণিত/প্রত্যাদিষ্ট’ বলে দাবি করে থাকেন।

কে কার থেকে নকল করেছেন? কে কার থেকে চুরি করেছেন? RSV-এর বত্রিশজন প্রখ্যাত বাইবেল পণ্ডিত বলেন যে ২ বাদশাহ-নামা/রাজাবলী পুস্তকের লেখকের পরিচয় ‘অজ্ঞাত!’ [Collins-এর RSV-এর পুনর্মুদ্রণ দেখার জন্যে ৯ নং দলিলচিত্র দেখুন]।


    
বাইবেলের এসব টীকা প্রস্তুত ও সম্পাদনা করেছেন ‘রাইট’ রেভারেন্ড (Right Reverend) ডেভিড জে, ফ্যান্ট Litt. D., যিনি নিউ ইয়র্ক বাইবেল সোসাইটির জেনারেল সেক্রেটারী (সাবেক)। স্বাভাবিকভাবেই, খ্রীষ্টান জগতের সর্বাধিক সম্মানিত (Most Reverend) ভদ্রলোকদের যদি এ মর্মে বিশ্বাস থাকতো যে বাইবেল ঐশীবাণী, তাহলে তাঁরা তা বলতেন। কিন্তু তাঁরা সততার সাথে (নাকি লজ্জাহীনভাবে?) স্বীকারোক্তি প্রদান করেন: “লেখক - অজ্ঞাত!” তাঁরা সেসব লিপির প্রতি তোষামোদ করতেও প্রস্তুত, যেগুলো হয়তো যে কোনো যদু, মধু, রাম, শাম কর্তৃক লিখিত হয়েছিলো, আর তাঁরা এর পরও আশা করেন সবাই এগুলোকে ঐশীবাণী হিসেবে বিবেচনা করবেন, আল্লাহ মাফ করুন!

কোনো বাচনিক অনুপ্রেরণা/প্রত্যাদেশ নয় 

ইশাইয়া/যিশাইয়’ ভাববাদীর পুস্তক সম্পর্কে খ্রীষ্টান পণ্ডিতবৃন্দের কী বলার আছে? তাঁরা বলেন: “প্রধানতঃ ইশাইয়া’র প্রতি আরোপিত। অংশসমূহ হয়তো অন্যান্যদের দ্বারা লিখিত হতে পারে।” বাইবেল পণ্ডিতদের এই স্বীকারোক্তির আলোকে আমরা আর বেচারা ইশাইয়া-কে নিয়ে টানাহেঁচড়া করবো না। তাহলে আমরা কি এই ‘নকল’-কে আল্লাহতা’লার দ্বারে সেঁটে দিতে পারি? কী মিথ্যের বেসাতি! উপরোক্ত সিম্পোজিয়ামের শেষে প্রশ্নোত্তর পর্বে অধ্যাপক কাম্সটি স্বীকার করেন: “খ্রীষ্টান সম্প্রদায় কোনো বাচনিক অনুপ্রেরণা বা প্রত্যাদেশে বিশ্বাস করেন না।” তাই সর্বশক্তিমান খোদাতা’লা মনভোলা হয়ে বুঝি একই কাহিনি দু’বার লেখাবার নির্দেশ দিয়েছিলেন! মানুষের হাত - একেবারেই রক্ত-মাংসের হাত - এই তথাকথিত খোদার বাণী বাইবেলের বারোটা বাজিয়ে ছেড়েছে! তবু বাইবেলের উগ্র প্রচারকবর্গ জোর গলায় দাবি করেন, “বাইবেলের প্রতিটি শব্দ, কমা ও দাঁড়ি হচ্ছে আল্লাহতা’লার কালাম/বাণী।”

সপ্তম অধ্যায়
এসিড টেষ্ট/অগ্নি-পরীক্ষা

যে পুস্তকটিকে খোদার বাণী বলে দাবি করা হয়, তা যে সত্যিসত্যি খোদাতা’লার বাণী সে সম্পর্কে আমরা কীভাবে জানতে পারি? এই ধরনের বহু পরীক্ষার মধ্যে একটি হলো, ঐশী সত্তার কাছ থেকে অবতীর্ণ বার্তা/বাণীটি অবশ্যঅবশ্য নিজের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হতে হবে। সেটাকে সমস্ত অসামঞ্জস্য ও স্ববিরোধিতা থেকে মুক্ত হতে হবে। আর এটাই আল্লাহতা’লার সর্বশেষ বিধান বা নিয়ম (Testament) ঘোষণা করেছে:

أَفَلاَ يَتَدَبَّرُونَ ٱلْقُرْآنَ

তারা কি আল-ক্বুরআনকে (সযত্ন) বিবেচনা করে না?

 وَلَوْ كَانَ مِنْ عِندِ غَيْرِ ٱللَّهِ

আর যদি তা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো কাছ থেকে হতো,

لَوَجَدُواْ فِيهِ ٱخْتِلاَفاً كَثِيراً 

তবে নিশ্চয় তারা তাতে খুঁজে পেতো বিস্তর অসঙ্গতি। [আল-ক্বুরআন, ৪:৮২; সরাসরি অনুবাদ]

খোদাতা’লা, নাকি শয়তান?

খোদাতা’লা যদি এই এসিড টেষ্ট দ্বারা আমাদেরকে তাঁর ঐশীগ্রন্থের (তথা আল-ক্বুরআনের) বিশ্বাসযোগ্যতা যাচাই করতে বলে থাকেন, তাহলে আমরা কেন একই পরীক্ষা তাঁরই কাছ থেকে অবতীর্ণ বলে দাবিকৃত অন্য যে কোনো পুস্তকের বেলায় প্রয়োগ করবো না? আমরা তো আর খ্রীষ্টান (মিশনারী)-দের মতো কথার মারপ্যাঁচে মানুষকে প্রতারিত করতে চাই না। আমার (লেখকের) পেশকৃত খ্রীষ্টান পণ্ডিতদের বরাতে উদ্ধৃতিগুলো হতে অতি সহজেই এ মর্মে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় যে, তাঁরা আমাদের কাছে এ কথা প্রমাণ করতে পেরেছেন বাইবেল খোদার বাণী নয়; অথচ আমাদেরকে এর উল্টোটা বোঝাবার ভান-ই তাঁরা করেছেন সব সময়।

এই রোগের এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ কিছু দিন আগের একটি ঘটনায়ও প্রতীয়মান হয়। গ্রাহামস্-টাউনে এ্যাংলিকান সিনেড (Synod) বা ইংরেজ চার্চসমূহের পাদ্রীদের সম্মেলনে সর্বোচ্চ রেভারেন্ড (most reverend) বিল বার্নেট, যিনি আবার আর্চ-বিশপ পদেও অধিষ্ঠিত, তিনি তাঁর মেষপালের কাছে টাটকা সুসমাচার প্রচার করছিলেন। তিনি তাঁর এ্যাংলিকান খ্রীষ্টান সমাজকে একটি গোলক ধাঁধায় ফেলে দেন। অথচ তিনি একজন শিক্ষিত ইংরেজ এবং তাঁর মাতৃভাষাও ইংরেজি, আর তিনি ভাষণও দিচ্ছিলেন শিক্ষিত ইংরেজ পাদ্রী-পুরোহিতবৃন্দের মাঝে! কিন্তু তাঁর বক্তব্যকে তাঁরই সতীর্থবৃন্দ মারাত্মক ভুল বোঝেন। এ ভুল বোঝাবুঝি এতোই মারাত্মক ছিলো যে ‘দি নেইটেল মারকেউরী’ (The Natal Mercury) শীর্ষক ইংরেজি দৈনিক পত্রিকার সম্পাদক মি: মকমিলান পত্রিকার ১১/১২/১৯৭৯ তারিখের সংখ্যায় নিম্নোক্ত মন্তব্যটি ওই ভুল বোঝাবুঝি সম্পর্কে তুলে ধরেন: 

“সিনেডে আর্চ-বিশপ বার্নেট সাহেবের বক্তব্যটি মোটেও স্পষ্টতার মডেল ছিলো না; আর তাঁর বক্তব্যকে সেখানে উপস্থিত অনেকেই ব্যাপক ও নাটকীয়ভাবে ভুল ব্যাখ্যা করেছেন।” 

ভাষা হিসেবে ইংরেজির কোনো দোষত্রুটি নেই। কিন্তু আপনি কি দেখতে পাচ্ছেন না একজন খ্রীষ্টান তাঁর সমস্ত ধর্মীয় বিষয়ে এলোমেলো চিন্তা করতেই কেবল প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। তাঁর পবিত্র ধর্মসভায় ‘রুটি’ অর্থ রুটি নয়, বরং ‘গোস্ত!’ ‘শরাব/মদ’ হচ্ছে ‘রক্ত!’ ‘তিনজন’ হলেন ‘একজন!’ আর ‘মানবীয়’ মানে ‘ঐশী!’ কিন্তু ভুল করবেন না, তাঁর পার্থিব/দুনিয়াবী সাম্রাজ্যের কারবারে তিনি অতো সহজ নন; বরঞ্চ একেবারে নির্ভুল। তাঁর সাথে কোনো চুক্তি সম্পাদন করতে হলে আপনাকে সাবধানে দু’বার ভেবে দেখতে হবে! কেননা আপনার বোঝার আগেই তিনি আপনাকে হাটে বিক্রি করে দিতে পারেন! 

খোদাতা’লার তথাকথিত পুস্তকের অসঙ্গতিসমূহ সম্পর্কে উত্থাপিত আমার অভিযোগগুলো নিম্নবর্ণিত দৃষ্টান্ত দেখলে ছোট শিশুদের কাছেও বোধগম্য হবে:

১/ - ২ শামুয়েল: অধ্যায় নং ২৪; শ্লোক নং - ১ 

“মা’বূদ আবার বনী ইসরাঈলদের ওপর রাগে জ্বলে উঠলেন। তিনি দাউদকে তাদের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করে তুলে বল্লেন, ‘তুমি গিয়ে ইসরাঈল ও এয়াহুদার লোকদের গণনা করো’।” [কিতাবুল মোকাদ্দস, বিবিএস ২০০০ খ্রীষ্টাব্দ]

২/ - ১ খান্দাননামা/বংশাবলী: অধ্যায় নং ২১; শ্লোক নং - ১ 

“শয়তান এবার (বনী) ইসরাঈলের বিরুদ্ধে উঠে পড়ে লাগলো। ইসরাঈল জাতির লোক গণনা করবার জন্যে সে দাউদের মনে ইচ্ছা জাগালো।” [১০ নং দলিলচিত্র দ্রষ্টব্য]   



পাঠক, আপনি লক্ষ্য করবেন, ‘খান্দাননামা/বংশাবলী’ ও ‘শামুয়েল’ পুস্তক দুটোর লেখকবর্গ দাউদ (আ:) কর্তৃক ইসরাঈলীদের শুমারি গ্রহণ করার একই কাহিনি আমাদের কাছে বর্ণনা করেছেন। এ মহৎ কাজটি করার ‘অনুপ্রেরণা/প্রত্যাদেশ’ দাউদ (আ:) কোথায় পেলেন? ২ শামুয়েল ২৪:১-এর লেখক বলছেন ‘মা’বূদ’ (সদাপ্রভু) খোদাতা’লা-ই তাঁকে ‘প্রবৃত্তি’ দিয়েছিলেন (বাংলা বাইবেল উইলিয়াম কে’রীর ১৯৮০ সংস্করণ, আর,এস,ভি), কিন্তু ১ খান্দাননামা/বংশাবলী ২১:১-এর লেখক বলেছেন শয়তান-ই প্রকৃতপক্ষে দাউদ (আ:)’কে এ রকম একটি কাপুরুষোচিত ও ঘৃণিত কাজ করতে ‘প্রবৃত্তি’ দিয়েছিলো (কিতাবুল মোকাদ্দসের ভাষায় ‘ইচ্ছা জাগালো’)। এ পরস্পরবিরোধী ‘অনুপ্রেরণা/প্রত্যাদেশের’ উৎস কীভাবে সর্বশক্তিমান আল্লাহতা’লা হতে পারেন? এটা খোদা, নাকি শয়তান? পৃথিবীর কোন্ ধর্মে খোদাতা’লার অপর নাম শয়তান? আমি 'Satanism' (শয়তানবাদ) সম্পর্কে কথা বলছি না, যা খ্রীষ্টধর্ম হতে গজানো সাম্প্রতিক এক ছত্রাক বিশেষ; তাতে প্রাক্তণ খ্রীষ্টানবর্গ শয়তানকে পূজা করে থাকেন। বিভিন্ন মতবাদ সৃষ্টিতে খ্রীষ্টধর্ম-ই হচ্ছে সবচেয়ে বেশি প্রজনন-ক্ষমতাসম্পন্ন। নাস্তিক্যবাদ, কমিউনিজম, ফ্যাসিজম, নাৎসিবাদ, মরমনবাদ, মুনিজম, খ্রীষ্টান বিজ্ঞানবাদ এবং এখন শয়তানবাদ। খ্রীষ্টবাদ এরপর আর কী কী জন্ম দেবে?

‘পবিত্র বাইবেল’ সব ধরনের পরস্পরবিরোধী ব্যাখ্যায় সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে। এটাই হলো খ্রীষ্টান দম্ভ! “কেউ কেউ সঙ্গত কারণেই দাবি করেন যে, মানুষের জ্ঞাত প্রায় সকল বদকর্মকে ন্যায়সঙ্গত প্রমাণ করার উদ্দেশ্যে বাইবেলীয় উদ্ধৃতিগুলোকে প্রতিনিয়ত অপব্যবহার ও অপপ্রয়োগ করা হচ্ছে।” - The Plain Truth শিরোনামের মার্কিনভিত্তিক সাময়িকীতে প্রকাশিত ‘The Bible - World's Most Controversial Book' (বাইবেল: বিশ্বের সবচেয়ে বিতর্কিত পুস্তক) শীর্ষক প্রবন্ধ (জুলাই, ১৯৭৫)।

প্রকৃত লেখক কারা? 

‘শামুয়েল’‘খান্দাননামা/বংশাবলী’ হতে আরো কিছু দৃষ্টান্ত উপস্থাপনের আগে আমি আল্লাহতা’লাকে এগুলোর অসঙ্গতির মূল উৎস হিসেবে সন্দেহ না করে এগুলোর লেখকদের চিহ্নিতকরণের উপদেশ দান করাকে যথাযথ বিবেচনা করি। RSV সংস্কর্তাবৃন্দ বলেন:

(ক) শামুয়েল: লেখক - “অজ্ঞাত” (স্রেফ একটি শব্দ)।
(খ) খান্দাননামা: লেখক - “অজ্ঞাত, সম্ভবতঃ উযায়ের/এযরা কর্তৃক সংগৃহীত ও সম্পাদিত।”

এ সকল বাইবেল পণ্ডিতের বিনয়ের প্রতি আমাদের প্রশংসা করতেই হয়, কিন্তু তাঁদের ‘হয়তো,’ ‘সম্ভবতঃ’ ইত্যাদি কথাকে তাঁদেরই দ্বারা চামড়া ছাড়ানো মেষপাল ‘সত্য’ হিসেবে ব্যাখ্যা করে থাকেন। ওই সব বেনামী লেখকদের দোষের জন্যে কেন খামোখা এযরা/উযায়ের (আ:)’কে অথবা ইশাইয়া/যিশাইয়কে ‘নন্দঘোষ’ বানানো হচ্ছে?

তিন, নাকি সাত?

নিম্নের দুটো উদ্ধৃতিকে তুলনা করুন:
     
১/ - “গাদ তখন দাউদের কাছে গিয়ে বল্লেন, ‘আপনার দেশে কি সাত বছর ধরে দুর্ভিক্ষ হবে? নাকি আপনি শত্রুদের তাড়া খেয়ে তিন মাস পালিয়ে বেড়াবেন’?” [২ শামুয়েল, ২৪:১৩; কিতাবুল মোকাদ্দস, বিবিএস ২০০০]

২/ - “তখন গাদ দাউদের কাছে গিয়ে বল্লেন, ‘মা’বূদ আপনাকে এগুলোর মধ্য থেকে একটা বেছে নিতে বলেছেন - তিন বছর ধরে দুর্ভিক্ষ, কিংবা আপনার শত্রুদের কাছে হেরে গিয়ে তাদের সামনে থেকে তিন মাস ধরে পালিয়ে বেড়ানো’।” [১ খান্দাননামা/বংশাবলী, ২১:১১-১২; প্রাগুক্ত]       

খোদাতা’লা গাদকে কী বলেছিলেন? সাত বছরের দুর্ভিক্ষ? নাকি তিন বছরের দুর্ভিক্ষ? যদি খোদাতা’লা বাইবেলের প্রতিটি শব্দ, কমা, দাঁড়ির রচয়িতা হয়ে থাকেন, তাহলে এ গাণিতিক অসঙ্গতির রচয়িতাও কি তিনি? [দলিলচিত্র নং ১১ দেখুন]



আট, নাকি আঠারো?

এবার নিম্নের দুটো উদ্ধৃতি মিলিয়ে দেখুন [দলিলচিত্র নং ১২ দেখুন]

১/ - “যিহোয়াখীন আট বছর বয়সে রাজত্ব করা আরম্ভ করেন এবং জেরুসালেমে তিন মাস দশ দিন রাজত্ব করেন; সদাপ্রভুর (মা’বূদের) দৃষ্টিতে যা মন্দ, তা-ই তিনি করতেন।” [২ বংশাবলী/খান্দাননামা, ৩৬:৯, পবিত্র বাইবেল, বিবিএস ১৯৮৪; কিতাবুল মোকাদ্দস পুস্তকে সমালোচনার মুখে উক্ত বয়স ১৮ বছর করা হয়েছে, কিন্তু উইলিয়াম কে’রী বিবিএস সংস্করণে স্পষ্ট ৮ বছর লেখা আছে! দুটো বাইবেলই আমার কাছে মওজূদ]

২/ - “যিহোয়াখীন আঠারো বছর বয়সে রাজত্ব করা আরম্ভ করেন, এবং জেরুসালেমে তিন মাস রাজত্ব করেন; তাঁর মায়ের নাম নাহুষ্টা, তিনি জেরুসালেম নিবাসী ইলনাথনের কন্যা।” [২ রাজাবলী/বাদশাহ-নামা, ২৪:৮, প্রাগুক্ত বিবিএস সংস্করণ ১৯৮৪]






পূর্ববর্তী ২ বংশাবলী/খান্দাননামা ৩৬:৯ উদ্ধৃতিটি আমাদের জানায় যিহোয়াখীন ‘আট’ বছর বয়সে রাজত্ব আরম্ভ করেন। পক্ষান্তরে, ২ রাজাবলী/বাদশাহ-নামা ২৪:৮ ব্যক্ত করে যিহোয়াখীন ‘আঠারো’ বছর বয়সী ছিলেন তাঁর রাজত্ব আরম্ভের সময়। মনে হয় বাদশাহ-নামার ‘অজ্ঞাত’ লেখক ধারণা করেছিলেন আট বছর বয়সে কৃত পাপ রাজত্ব হারাবার মতো শাস্তিযোগ্য নয়। তাই তিনি উদারভাবে আরো দশ বছর যোগ করেছেন যাতে যিহোয়াখীন খোদার শাস্তি পাওয়ার মতো প্রাপ্তবয়স্ক হতে পারেন। তবে তাঁকে অনধিকার পরিবর্তনে ভারসাম্য রক্ষা করতে হয়েছে; আর তাই তিনি শাসনকাল হতে ১০ দিন ছেঁটে ফেলেছেন! বয়সের সাথে দশ বছর যোগ এবং শাসনকাল হতে দশ দিন বিয়োগ! একই বিষয়ে দুটো ব্যাপক পার্থক্যপূর্ণ বিবরণ কি খোদাতা’লা হতে প্রকাশিত হতে পারে?

অশ্বারোহী, নাকি পদাতিক?

নিম্নোক্ত দুটো উদ্ধৃতির মাঝে তুলনা করুন [দলিলচিত্র ১২ দেখুন]:

১/ - “কিন্তু বনী-ইসরাঈলদের সামনে থেকে তারা (মানে সিরীয় সৈন্যরা) পালিয়ে গেলো। তখন দাউদ (আ:) তাদের সাত শ রথচালক ও চল্লিশ হাজার ঘোড়সওয়ারকে হত্যা করলেন। তিনি তাদের সেনাপতি শোবককেও আঘাত করলেন; তাতে শোবক সেখানে মারা গেলেন।” [২ শামুয়েল, ১০:১৮; কিতাবুল মোকাদ্দস, বিবিএস ২০০০ খ্রীষ্টাব্দ]

২/ - “কিন্তু বনী-ইসরাঈলদের সামনে থেকে তারা (সিরীয়রা) পালিয়ে গেলো। তখন দাউদ (আ:) তাদের সাত হাজার রথচালক ও চল্লিশ হাজার পদাতিক সৈন্য হত্যা করলেন। তিনি তাদের সেনাপতি শোবককেও হত্যা করলেন।” [১ খান্দাননামা, ১৯:১৮; প্রাগুক্ত]




দাউদ (আ:) প্রকৃতপক্ষে কতোজন রথারোহীকে হত্যা করেছিলেন? সাত শ, নাকি সাত হাজার? উপরন্তু, তিনি কি চল্লিশ হাজার পদাতিক সৈন্য হত্যা করেছিলেন, নাকি চল্লিশ হাজার অশ্বারোহী সৈন্য? উপরোল্লিখিত দুটি বাইবেলীয় উদ্ধৃতিতে ইঙ্গিত রয়েছে যে, খোদাতা’লা কেবল ‘শত’ ও ‘সহস্র’-এর পার্থক্য বুঝতেই অক্ষম ছিলেন না, বরং তিনি ‘পদাতিক’ ও ‘অশ্বারোহীর’ মধ্যে পার্থক্য বুঝতেও অক্ষম ছিলেন! এটা নিশ্চিত, খ্রীষ্টানদের অভিধানে ‘ঐশী প্রেরণা/প্রত্যাদেশের’ ছদ্মবেশ ধারণ করেছে মিথ্যের বেসাতি! [বঙ্গানুবাদকের নোট: পবিত্র বাইবেল বিবিএস ১৯৮৪ সংস্করণের ২ শামুয়েল ১০:১৮-তে সিরীয় সেনাপতির নাম ‘শোবক’ লেখা হলেও ১ রাজাবলী/খান্দাননামা ১৯:১৮ ছত্রে নামটির বানান ছিলো ‘শোফক’]

প্র্যাকটিকাল হোম-ওয়ার্ক 

সোলায়মান (আ:) আপন মহিমা প্রকাশে একটি রাজপ্রাসাদ নিজের জন্যে নির্মাণ আরম্ভ করেন, যা সম্পন্ন করতে তাঁর লেগেছিলো তেরো বছর। এ কথা আমরা ১ বাদশাহ-নামা/রাজাবলী ৭তম অধ্যায়ে জানতে পেরেছি। প্রিয় পাঠক, আপনার কি ড: পার্কারের সেই দর্পের কথা মনে আছে (‘বিকৃত মান’ প্যারাগ্রাফ দ্রষ্টব্য), যেখানে তিনি বলেছিলেন: “অস্পষ্ট নামসমূহ দ্বারা গোটা গোটা পৃষ্ঠা পরিপূর্ণ?” হ্যাঁ, স্রেফ ছেলেমানুষির জন্যেই এই ৭তম অধ্যায়টি এবং হেজকিল/যিহিষ্কেল ৪৫তম অধ্যায়টি অদ্বিতীয় হয়ে গিয়েছে। আপনার জীবনে অন্ততঃ একবার পঠনের দাবি এগুলো রাখে আপনার কাছে। এরপর আপনি ক্বুরআন মজীদকে সত্যিসত্যি ‘এপ্রিশিয়েট’ করবেন তথা ওর মর্ম উপলব্ধি করবেন! আপনি মুসলমান হয়ে থাকলে, অথচ আপনার কাছে কোনো বাইবেল না থাকলে তাড়াতাড়ি একখানা কপি সংগ্রহ করুন। তারপর আপনি চাইলে এই পুস্তিকায় উপস্থাপিত উদ্ধৃতিগুলোকে আপনার বাইবেলের মধ্যে রং দ্বারা রঙ্গীন করে তুলতে পারেন: ‘হলুদ’ ব্যবহৃত হবে সকল অসঙ্গতির জন্যে; ‘লাল’ ব্যবহার করুন পর্নোগ্রাফিক/অশ্লীল অংশে; আর ‘সবুজ’ ব্যবহার করুন সেসব অর্থপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য উদ্ধৃতির বেলায়, যেগুলো এ পুস্তিকার প্রারম্ভে আমি উদ্ধৃত করেছি - যেসব কথাকে খোদাতা’লা বা তাঁরই পয়গাম্বর (আ:)’এর বাণী বলে সহজেই চেনা যায়। এই প্রস্তুতি দ্বারা আপনি আপনার কাছে আগত টাটকা সুসমাচার প্রচারক মিশনারী পাদ্রীকে খণ্ডন ও হতভম্ব করতে সক্ষম হবেন। 

“আমরা যদি শান্তির সময়ে (পরিশ্রমে) বেশি ঘর্মাক্ত হই, তাহলে যুদ্ধের সময়ে কম রক্তাক্ত হবো।” [চিয়াং কাই শেক]

কতোটুকু স্বাস্থ্যকর?

এবার নিম্নোক্ত বাইবেলীয় উদ্ধৃতিগুলো মিলিয়ে দেখুন [১৩ নং দলিলচিত্র দেখুন]:

১/ - “পাত্রটা ছিলো চার আঙ্গুল পুরো। তার মুখটা একটা পেয়ালার মুখের মতো ছিলো এবং লিলি ফুলের পাপড়ির মতো বাইরের দিকে উল্টানো ছিলো। তাতে চুয়াল্লিশ হাজার লিটার পানি ধরতো।” [১ বাদশাহ-নামা, ৭:২৬, কিতাবুল মোকাদ্দস, বিবিএস ২০০০ খ্রীষ্টাব্দ]

২/ - “পাত্রটা ছিলো চার আঙ্গুল পুরো। তার মুখটা একটা পেয়ালার মুখের মতো ছিলো এবং লিলি ফুলের পাপড়ির মতো বাইরের দিকে উল্টানো ছিলো। তাতে ছেষট্টি হাজার লিটার পানি ধরতো।” [২ খান্দাননামা, ৪:৫, প্রাগুক্ত]


  
লক্ষ্য করুন, ১ রাজাবলী/বাদশাহ-নামা পুস্তকের লেখক সোলায়মান (আ:)’এর প্রাসাদে ২০০০ ‘বাৎ’ (১ বাৎ=৩৭ লিটার) গণনা করেছেন [পবিত্র বাইবেল, ১ রাজাবলী, ৭:২৬, বিবিএস]। কিন্তু ২ বংশাবলী/খান্দাননামা পুস্তকের লেখক এই শাহী গণনাকে ৫০% বাড়িয়ে ৩০০০ ‘বাৎ’ গণনা করেছেন [২ বংশাবলী, ৪:৫, প্রাগুক্ত]! ‘খোদার পুস্তকে’ কী বাড়াবাড়ি ও কতো মারাত্মক ত্রুটি! আল্লাহর যদি কিছু করার না-ও থাকতো, তবুও কি তিনি ইহুদীদের কাছে এ ধরনের তুচ্ছ ও অসঙ্গতিপূর্ণ ছাইপাশ ‘অনুপ্রেরণা/প্রত্যাদেশ’স্বরূপ দেয়ার জন্যে নিজেকে ব্যাপৃত রাখতেন?

অসঙ্গতির স্তূপ

অসঙ্গতির এ সিরিজ সমাপ্ত করবার আগে আমি আরেকটি উদাহরণ পেশ করতে চাই। বাইবেলে এ ধরনের আরো শত শত আছে। এবারের দৃষ্টান্ত আবারো সোলায়মান (আ:)’কে কেন্দ্র করে। সত্যি, তিনি সব কিছু শাহী কায়দায় করতেন। ইরানের সাবেক (রেজা) শাহ-ও তাঁর তুলনায় নার্সারীর শিশু ছিলেন! বাইবেলীয় বর্ণনার দিকে লক্ষ্য করুন [দলিলচিত্র নং ১৪ দেখুন]

১/ - “ঘোড়া ও রথের জন্যে সোলায়মান (আ:)’এর চার হাজার ঘর ছিলো। তাঁর বারো হাজার ঘোড়সওয়ার ছিলো; তাদের তিনি রথ রাখবার শহরগুলোতে এবং জেরুসালেমে নিজের কাছে রাখতেন।” [২ খান্দাননামা/বংশাবলী, ৯:২৫, কিতাবুল মোকাদ্দস, বিবিএস ২০০০ খ্রীষ্টাব্দ]

২/ - “সোলায়মান (আ:)’এর রথের ঘোড়াগুলোর জন্যে ছিলো চল্লিশ হাজার ঘর আর বারো হাজার ঘোড়সওয়ার।” [১ বাদশাহ-নামা/রাজাবলী, ৪:২৬, প্রাগুক্ত]

২ খান্দাননামা পুস্তকের লেখক এখানে ‘বাৎ’সমূহের সংখ্যা থেকে এক হাজার অশ্বশালা বেশি লিখেছেন (’চার হাজার’)। কিন্তু ১ বাদশা-নামা পুস্তকের লেখক তাঁর শাহী পৃষ্ঠপোষকের জন্যে আরো উচ্চ রাজকীয় ধারণা পোষণ করতেন। তাই তিনি সোলায়মান (আ:)’এর অশ্বশালাকে ১০০০% দ্বারা গুণ দিয়েছেন - ফলে ৪০০০ থেকে তা বৃদ্ধি পেয়েছে চল্লিশ হাজারে! আপনাকে ধোকা দেবার জন্যে যদি কোনো ধূর্ত মিশনারী পাদ্রী বলেন যে এ পার্থক্যটি তো শুধু একটি ‘০’ (শূন্য)-এর, যা হয়তো কোনো বাইবেল লেখক ভুলক্রমে যোগ করেছেন, তাহলে আপনাকে আমি জানাচ্ছি - সোলায়মান (আ:)’এর সময়কার ইহুদীবর্গ ‘০’ (শূন্য) সম্পর্কে কিছুই জানতেন না। এর আবিষ্কর্তা হলেন আরব জাতি, যাঁরা প্রথমে মধ্যপ্রাচ্যে এবং কিছু শতাব্দী পরে ইউরোপে এর প্রবর্তন করেন। ইহুদী জাতি গাণিতিক সংখ্যাগুলোকে বানান করে লিখতেন, সংখ্যায় লিখতেন না। এমতাবস্থায় আমাদের জিজ্ঞাস্য: ৩৬,০০০ বা ছত্রিশ হাজারের এ হতভম্বকর অসঙ্গতির প্রকৃত লেখক কে? এটা কি আল্লাহতা’লা? নাকি মানুষ? এতদসংক্রান্ত আরো বিস্তারিত তথ্য জানার জন্যে জনাব এ,এস,কে, জুম্মালের প্রণীত ‘The Bible: Word of God or Word of Man?' শিরোনামের বইটি পাঠ করুন।

অষ্টম অধ্যায়
সর্বাধিক বস্তুনিষ্ঠ ও পক্ষপাতহীন সাক্ষ্য

বাইবেলকে খোদাতা’লার বাণী প্রমাণ করার জন্যে খ্রীষ্টান প্রচারকবর্গ নিম্নলিখিত বাইবেলীয় শ্লোককে ব্যবহার করতে বেশি পছন্দ করেন:

“প্রত্যেক শাস্ত্রলিপি খোদাতা’লা হতে নিঃসৃত এবং শিক্ষার, অনুযোগের, সংশোধনের ও ধার্মিকতা-সম্পর্কিত শাসনের উদ্দেশ্যে উপকারী।” [২ তীমথিয়, ৩:১৬, পবিত্র বাইবেল, বিবিএস ১৯৮৪]

মুসলমান ও খ্রীষ্টান সম্প্রদায় উভয়েই একমত যে, ‘অনুপ্রেরণা/প্রত্যাদেশ’ কিংবা ‘প্রকাশিত’ (নাযেল) হওয়ার মাধ্যমে যা কিছু খোদাতা’লা থেকে আগত হয়, তা নিম্নোক্ত চারটি বিষয়ের যে কোনো একটির উদ্দেশ্যেই ব্যবহৃত হয়:

১/ - আমাদেরকে নীতি ‘শিক্ষা’ দেয়;
২/ - আমাদের ভুলত্রুটির প্রতি ‘অনুযোগ’ করে;
৩/ - আমাদের প্রতি ‘সংশোধনের’ প্রস্তাব পেশ করে; এবং
৪/ - আমাদেরকে ‘ধার্মিকতা-সম্পর্কিত শাসনের’ দিকে পথপ্রদর্শন করে।

আমি বিগত চল্লিশ বছর যাবৎ খৃষ্টান পণ্ডিতদেরকে প্রশ্ন করেছি খোদার বাণীর জন্যে পঞ্চম কোনো শর্ত তাঁরা সরবরাহ করতে পারেন কি-না। তাঁরা লক্ষণীয়ভাবে এ কাজে ব্যর্থ হয়েছেন। তার মানে এই নয় যে আমি এতে সফল হয়েছি। এক্ষণে চলুন আমরা এ সব বস্তুনিষ্ঠ ও পক্ষপাতহীন পরীক্ষা দ্বারা ‘পবিত্র বাইবেল’কে যাচাই করি।

বেশি দূর যাবার প্রয়োজন নেই

বাইবেলের প্রথম পুস্তক - ‘পয়দায়েশ/আদি পুস্তক’-ই আমাদের জন্যে বহু সুন্দর দৃষ্টান্ত পেশ করেছে। সেটার ৩৮ নং অধ্যায়টি খুলুন এবং পড়ুন। আমাদেরকে এতে এহুদা/যিহুদা’র (Judah) ইতিহাস সম্পর্কে জানানো হয়েছে [নোট: আপনার কি প্রথম অধ্যায়ে উদ্ধৃত ড: কেনেথ ক্র্যাগের Call of the Minaret পুস্তকের উদ্ধৃতি ও তাঁর ‘ইতিহাসের’ কথা মনে আছে? এ-ই সেই ইতিহাস]। এহুদা ছিলেন ইহুদী জাতির পিতা আর তাঁর নাম থেকেই Judea ও Judaism নামগুলোর উৎপত্তি। ইহুদীদের এই জনক বিয়ে করার পর খোদাতা’লা তাঁকে তিনজন পুত্র সন্তান মঞ্জুর করেন। তাদের নাম ‘এর,’ ‘ওনন’ ও ‘শেলা।’ প্রথম সন্তান ‘এর’ সাবালক হলে ‘তামর’ নাম্নী জনৈকা নারীর সাথে তার বিয়ে দেন এহুদা। “কিন্তু এহুদার জ্যেষ্ঠ পুত্র ‘এর’ সদাপ্রভু/খোদার চোখে এতো খারাপ ছিলো যে তিনি তাকে আর বাঁচতে দিলেন না।” [পয়দায়েশ/আদি পুস্তক, ৩৮:৭, কিতাবুল মোকাদ্দস ২০০০ খ্রী: ও পবিত্র বাইবেল ১৯৮৪ খ্রী: সংস্করণ]

এই শোক সংবাদকে ‘তীমথিয়ের’ উপরোক্ত চারটি নীতির কোনটিতে অন্তর্ভুক্ত করবেন আপনি? উত্তর: দ্বিতীয়টি - ‘অনুযোগ।’ ‘এর’ দুষ্ট লোক ছিলো, তাই খোদা তাকে মেরে ফেলেছিলেন [পবিত্র বাইবেল, আদি পুস্তক/পয়দায়েশ, ৩৮:৭, বিবিএস ১৯৮৪]। আমাদের জন্যে শিক্ষা - আমরা দুষ্ট প্রকৃতির হলে খোদা ‘অনুযোগ’স্বরূপ আমাদের মেরে ফেলবেন!

আমরা আবারো ইহুদীদের ইতিহাস প্রসঙ্গে ফিরে যাই - তাদের রীতি অনুযায়ী যদি কোনো ভাই মৃত্যুবরণ করে এবং কোনো সন্তান রেখে না যায়, তাহলে ভাইয়ের স্ত্রীকে ‘বীজ’ (Seed) দান করার কর্তব্য অপর ভাইয়ের ওপর বর্তায়, যাতে মরহূম ভাইয়ের নাম স্থায়ী হয়। এ প্রথার প্রতি সম্মান প্রদর্শনার্থে এহুদা/যিহুদা তাঁর দ্বিতীয় পুত্র ‘ওনন’কে তার কর্তব্য পালনের নির্দেশ দেন। কিন্তু ‘ওননের’ অন্তরে হিংসা প্রবেশ করে। কেননা এটা তার বীজ/seed হবে ঠিক, কিন্তু নাম হবে তারই (বড়) ভাইয়ের! ফলশ্রুতিতে চূড়ান্ত মুহূর্তে “সে বাইরে মাটিতে বীর্যপাত করলো....কিন্তু তার এ ব্যবহারে মা’বূদ নারাজ হলেন। সেই জন্যে তাকেও তিনি আর বাঁচতে দিলেন না” [পয়দায়েশ/আদি পুস্তক, ৩৮:৯-১০, বিবিএস]। এমতাবস্থায় এ হত্যাকাণ্ডটি তীমথিয়ের পরীক্ষার কোথায় খাপ খায়? আবারো উত্তর হলো: ‘অনুযোগ!’ এসব সহজ উত্তরের জন্যে কোনো পুরস্কার নেই। কেননা এগুলো অত্যন্ত মৌলিক বিষয়। মন্দ কাজ করলে তার ফল পেতেই হবে! ‘ঐশী পুস্তকে’ ‘ওনন’ বিস্মৃত হলেও খ্রীষ্টান যৌন বিশেজ্ঞবর্গ তাঁদের ‘যৌন মিলনবিষয়ক বইপত্রে’ coitus interruptus (জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি) সম্পর্কে উল্লেখের সময় সেটাকে ‘Onanism' বা ‘ওননবাদ’ আখ্যা দিয়ে তাকে অমর করে রেখেছেন।

অতঃপর এহুদা তাঁর পুত্রবধূ ‘তামর’কে তার পিত্রালয়ে ফিরে য়েয়ে বসবাস করতে বলেন ঠিক ততোদিন, যতোদিন না ‘শেলা’ প্রাপ্তবয়স্ক হয়, যাতে সে তার দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করতে পারে।

জনৈকা নারীর প্রতিশোধ

’শেলা’ প্রাপ্তবয়স্ক হয় এবং হয়তো অন্য কোনো নারীর পাণি গ্রহণ করে। কিন্তু এহুদা তামরের প্রতি তাঁর ওয়াদা পূরণ করেননি। কেননা অন্তরের গভীরে তিনি ভীষণ ভীত ও পেরেশানিতে ছিলেন। ইতোমধ্যেই এ ‘ডাইনী’র কারণে তিনি তাঁর দুই পুত্রকে হারিয়েছেন - “পাছে ভ্রাতাদের মতো সে-ও (মানে শেলা-ও) মরে” [যাত্রা পুস্তক, ৩৮:১১, পবিত্র বাইবেল, ১৯৮৪] - তাই তিনি সুবিধা বা মওকা মতো নিজ ওয়াদা ভুলে যান। এই যুবতী নারী তার ‘বীজ’-সংক্রান্ত অধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়ার কারণে শ্বশুরের ওপর প্রতিশোধ নেয়ার সংকল্পবদ্ধ হয়।

তামর জানতে পারে এহুদা/যিহুদা নিজের মেষগুলোর লোম কাটাতে তিম্নায় যাচ্ছেন। সে ওই পথের ওপর প্রতিশোধ গ্রহণের ফন্দি আঁটে এবং এহুদার আগে তিম্নার যাত্রাপথে গিয়ে খোলা একটি জায়গায় বসে। এহুদা তাকে দেখার পর তাকে বেশ্যা মনে করেন, কেননা সে মুখ আবৃত করে রেখেছিলো। তিনি তার কাছে যেয়ে প্রস্তাব দেন - “এসো, তোমার কাছে গমন করি (‘শুতে যাই’ - কিতাবুল মোকাদ্দস)।”...তামর বল্লো, “আমার কাছে আসার জন্যে আমাকে কী দেবেন?” [আদি পুস্তক, ৩৮:১৬, পবিত্র বাইবেল ও কিতাবুল মোকাদ্দস, বিবিএস]। এহুদা ওয়াদা করেন তার জন্যে নিজ পাল হতে একটি ছাগলের বাচ্চা পাঠিয়ে দেবেন। কিন্তু তামর সেটার গ্যারান্টী চায়। এহুদা জিজ্ঞেস করেন সে কী জিনিস বন্ধক হিসেবে চায়। তামর তৎক্ষণাৎ উত্তর দেয়, “দড়ি সুদ্ধ আপনার সীলমোহরখানা আর আপনার হাতের লাঠিটা।” [প্রাগুক্ত আদিপুস্তক/পয়দায়েশ, ৩৮:১৮]। ওই বুড়ো তাকে সে মালামাল হস্তান্তর করেই “তার সঙ্গে (যৌন) মিলিত হলেন; আর তার ফলে তামর গর্ভবতী হলো।” [প্রাগুক্ত পয়দায়েশ/আদি পুস্তক, ৩৮:১৮, কিতাবুল মোকাদ্দস ও পবিত্র বাইবেল, বিবিএস]

নৈতিক শিক্ষা

‘খোদার পুস্তকের’ মধ্যে অবস্থিত এই অশ্লীল, নোংরা কাহিনিটিকে তীমথিয় ৩:১৬-এর উপরোক্ত শর্তগুলোর যে কোনোটিতে শ্রেণিকরণের আগে আমি প্রশ্ন করতে প্রলুব্ধ হই: তামরের এই মধুর প্রতিশোধ থেকে আমাদের সন্তানেরা কী নৈতিক শিক্ষা পাবে? অবশ্যই আমরা বিনোদনের উদ্দেশ্য ছাড়াও আমাদের সন্তানদেরকে নানা কাহিনি বলে থাকি, যাতে ওগুলোর মাধ্যমে তাদেরকে নৈতিক শিক্ষা দেয়া যায়। যেমন - ‘শেয়াল ও আঙ্গুর ফল,’ ‘নেকড়ে বাঘ ও মেষ শাবক,’ ‘কুকুর ও তার ছায়া’ ইত্যাদি। এসব কাহিনি যতো সহজ ও সাদামাটা-ই হোক না কেন, এগুলোর মাঝে একটি নৈতিক শিক্ষার দিকনির্দেশনা নিহিত থাকে।

‘খ্রীষ্টান পিতামাতার দ্বিধা’

প্রখ্যাত মার্কিন মনস্তত্ত্ববিদ ড: ভারনন জোন্স একবার বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের কয়েকটি দলের ওপর পরীক্ষামূলক জরিপ পরিচালনা করেছিলেন; তাদেরকে বিশেষ কিছু গল্প বলা হয়েছিলো। তাদের দলগুলোর কাছে গল্পগুলোর নায়কবর্গ একই ছিলেন, কিন্তু এক-এক দল ওই একই নায়কদের আচরণকে এক-একভাবে গ্রহণ করেছিলো, যা ছিলো পরস্পরবিরোধী দৃষ্টিভঙ্গি। একটি দলের দৃষ্টিতে ‘সেইন্ট জর্জ’ কর্তৃক ড্রাগন হত্যা তাঁকে সাহসী বীর হিসেবে প্রতীয়মান করে। কিন্তু অপর দলের মাঝে এটা এমন ভীতির সঞ্চার করে যে তারা দৌড়ে নিজেদের মায়ের কোলে আশ্রয় নেয়। ড: জোন্স পরিশেষে সিদ্ধান্ত নেন: “এ সব কাহিনি ব্যক্তি চরিত্রের মাঝে সামান্য কিন্তু চিরস্থায়ী পরিবর্তন নিশ্চিত করেছে - এমন কী ক্ষুদ্র শ্রেণিকক্ষের পরিবেশ-পরিস্থিতিতেও।”

খ্রীষ্টরাজ্যের সন্তানদের বেলায় ‘পবিত্র বাইবেলের’ ধর্ষণ ও হত্যা, অজাচার ও পাশবিকতা যে কতোখানি স্থায়ী ক্ষতিসাধন করেছে, তা কেবল দৈনিক খবরের কাগজ খুল্লেই বোঝা যায়। পশ্চিমা নৈতিকতার এটাই যদি হয় উৎসস্থল, তাহলে এ দেখে বিস্মিত হবার কোনো কারণ নেই যে রোমান ক্যাথলিক ও মেথডিষ্ট গোষ্ঠী দুটো তাঁদের ‘খোদার ঘরে’ (গীর্জায়) সমকামীদের মধ্যে বিয়ে পড়াচ্ছেন! আর আট হাজার সমকামী জুলাই ১৯৭৯ সালে লন্ডনের হাইড পার্কে সংবাদপত্র ও টিভি সংবাদ সম্প্রচার পাবার তথা ফলাও হবার জন্যে নিজেদের ‘পণ্যসামগ্রী’র প্রদর্শনী দিয়েছিলো।

আপনাকে ‘পবিত্র বাইবেল’ জোগাড় করতেই হবে এবং আদি পুস্তক/পয়দায়েশ পুস্তকের পুরো ৩৮ নং অধ্যায়টি পড়তেই হবে। শব্দ ও বাক্যগুলোকে যোগ্যতানুযায়ী ‘লাল’ রং দেবেন। আমাদের নৈতিক (?) শিক্ষায় আমরা ১৮ নং শ্লোকে পৌঁছে গিয়েছি - “(এহুদা) তার সঙ্গে (যৌন) মিলিত হলেন; আর তার ফলে তামর গর্ভবতী হলো।”

চিরকাল আড়াল করা যায় না

তিন মাস পরে অবশ্যম্ভাবী খবরটি এহুদা/যিহুদার কানে পৌঁছুলো যে তাঁর পুত্রবধূ তামর একজন ‘বেশ্যা’ এবং “ব্যভিচারহেতু তার গর্ভ হয়েছে। তখন এহুদা বল্লেন, তাকে বাইরে এনে পুড়িয়ে দাও” [আদিপুস্তক/কিতাবুল মোকাদ্দস, ৩৮:২৪, বিবিএস]। এহুদা ইচ্ছাকৃতভাবে তামরকে ‘ডাইনী’ বলে আগেই লাথি মেরেছিলেন, আর এখন তিনি ধর্ষকামিতায় তাকে পুড়িয়ে মারতে চাচ্ছেন। কিন্তু ওই ধূর্ত ইহুদী রমনী এহুদার চেয়ে এক কদম এগিয়ে ছিলো। সে ‘সীলমোহর,’ ‘সূত্র’ ও ‘লাঠি’ জনৈক সেবক মারফত তার শ্বশুরের কাছে পাঠালো এবং তার শ্বশুরের কাছে গর্ভের হোতা বদমাইশটিকে খুঁজে বের করার জন্যে আবেদন জানালো। এহুদা ফাঁপরে পড়ে গেলেন। তিনি স্বীকার করলেন তাঁর পুত্রবধূ তাঁর চেয়ে ‘অধিক ধার্মিকা’ এবং “এরপর এহুদা/যিহুদা আর কখনো তামরের সঙ্গে শোননি” [পয়দায়েশ/আদি পুস্তক, ৩৮:২৬, কিতাবুল মোকাদ্দস ও পবিত্র বাইবেল, বি্বিএস]। এই একই ঘটনা বর্ণনার সময় বাইবেলের বিভিন্ন সংস্করণে যে বিচিত্র ভাষা ব্যবহৃত হয়েছে, তার তুলনা করাটাই এক স্মরণীয় অভিজ্ঞতা বটে! জেহোভার সাক্ষীবর্গ (Jehovah's Witnesses) তাঁদের New World Translation-এ শেষ কথাটিকে লিখেছেন এভাবে: “এর পরে তিনি আর তামরের সাথে যৌন মিলনে রত হননি” [জেহোভার সাক্ষীবর্গ অন্যান্য খ্রীষ্টান সম্প্রদায়ের চেয়ে স্পষ্টভাষী]। কথিত ‘খোদার পুস্তকে’ এই তামরকে আমরা আবারো দেখতে পাবো, যাকে সুসমাচার লেখকবৃন্দ ‘তাঁদের প্রভু ঈসা মসীহ (আ:)’এর বংশ পরিচয়ে’ অমর করে রেখেছেন।

অজাচারকে সম্মানিতকরণ

আমি বিস্তারিত বিবরণ দ্বারা আপনাকে বিরক্ত করতে চাই না, কিন্তু ‘পয়দায়েশ/আদি পুস্তক’ ৩৮ অধ্যায়ের শেষ শ্লোকগুলোতে তামরের গর্ভস্থ দুই যমজ সন্তানের মাঝে শ্রেষ্ঠত্বের দ্বন্দ্বযুদ্ধ সংক্রান্ত একটি বর্ণনা রয়েছে; ইহুদীরা তাঁদের ‘প্রথম ভূমিষ্ঠ’দের বৃত্তান্ত লিপিবদ্ধ করার ব্যাপারে খুবই সতর্ক ছিলেন। প্রথম ভূমিষ্ঠ সন্তান পিতার যাবতীয় সম্পত্তির সিংহভাগ পেয়ে যেতো। এই প্রসবপূর্ব দৌড় প্রতিযোগিতায় সৌভাগ্যবান বিজয়ীরা কারা? এই অনন্য প্রতিযোগিতায় চারজন বিজয়ী। তাঁরা হলেন: ‘এহুদা’ হতে ‘তামরের’ গর্ভে ’পেরস্’‘সেরহ।’ কীভাবে? আপনি এখনি তা দেখবেন। কিন্তু প্রথমে আমাদেরকে নৈতিক শিক্ষাটি সম্পর্কে জানতে হবে। এই উপাখ্যানে নৈতিক শিক্ষাটি কী? আপনার নিশ্চয় স্মরণে আছে ‘এর’ ও ‘ওননের’ কথা। তাদের বহু পাপের কারণে কীভাবে আল্লাহতা’লা তাদেরকে ধ্বংস করেছেন, তাও নিশ্চয় আপনার স্মরণে আছে। আর তাদের প্রত্যেকের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নৈতিক শিক্ষা ‘অনুযোগ’ সম্পর্কেও আমরা জেনেছি। তীমথিয়ের কোন্ শ্রেণিতে আপনি এহুদার অজাচারকে এবং তাঁর অবৈধ প্রজন্মকে কাতারবদ্ধ করবেন? কথিত ‘খোদার পুস্তকে’ এসব চরিত্রকে তাঁদের হারামিপনার জন্যে সম্মানিত করা হয়েছে। তাঁরাই হলেন ‘খোদার একমাত্র একজাত/প্রজননকৃত পুত্রের’ দাদা-দাদী তথা পূর্বপুরুষ।(?)

বাইবেলে নতুন নিয়মের মথি ১:৩ দেখুন। প্রতিটি ইংরেজি বাইবেল সংস্করণেই আদি পুস্তক/পয়দায়েশ পুস্তকের ৩৮ নং অধ্যায়ের এ সব চরিত্রের নাম খ্রীষ্টানবর্গ নতুন নিয়মে ভিন্নভাবে বানান করেছেন, যাতে পাঠককে বিভ্রান্ত করা যায় [মথি ১:৩]। ‘পুরাতন’ নিয়মের Pharez থেকে নতুন নিয়মের Pares এবং Zarah থেকে Zara, আর Tamar থেকে Thamar [বাংলা বাইবেলে নামগুলোর পরিবর্তন সাধন করা হয়নি - বঙ্গানুবাদক]! কিন্তু উল্লেখিত ঘটনার নৈতিক শিক্ষাটি কী ছিলো? আপনি যদি দুষ্ট হন (‘এর’), তবে খোদা আপনাকে মেরে ফেলবেন। আর যদি আপনি ‘বীজ’ নষ্ট করেন (‘ওনন’), তাহেলেও খোদা আপনাকে মেরে ফেলবেন। কিন্তু জনৈকা পুত্রবধূ (তামর), যে প্রতিশোধস্বরূপ ও ধূর্তভাবে শ্বশুরের ‘বীজ’ সংগ্রহ করলো, তাকে ঠিকই পুরস্কৃত করা হলো। কথিত ‘খোদার পুস্তকের’ মধ্যে অবস্থিত এই ‘সম্মানকে’ খ্রীষ্টানবৃন্দ কোন্ শ্রেণিবদ্ধ করবেন? এটা কি আপনার -

১/ নীতি শিক্ষা?
২/ অনুযোগ?
৩/ সংশোধন? নাকি
৪/ ধার্মিকতা-সংক্রান্ত শাসন?

আপনার দরজায় এসে টোকা প্রদানকারী সেই পেশাদার মিশনারী প্রচারকারী, সেই টাটকা সুসমাচার প্রচারক, সেই উগ্র বাইবেল প্রচারকারীকে জিজ্ঞেস করুন। এখানে সঠিক উত্তর দিতে পারলে তিনি একটি পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য। উপরোক্ত শ্রেণিগুলোর কোনোটিতে এই নোংরা অশ্লীল পর্নোগ্রাফীর অন্তর্ভুক্তিকে যথাযথ প্রমাণ করবার মতো কেউই আজ পর্যন্ত পৃথিবীতে জন্মায়নি। কিন্তু এটাকে তো কোনো একটা শিরোনাম দিতে হবে। অতএব, এটাকে ‘অশ্লীলতা’/Pornography শিরোনামের অধীনেই কেবল লিপিবদ্ধ করা যেতে পারে!

পুস্তকটি নিষিদ্ধ করা হোক!

জর্জ বার্নার্ড ’শ বলেছেন, “পৃথিবীতে সবচেয়ে বিপজ্জনক পুস্তক (বাইবেল); এটাকে তালাবদ্ধ করুন।” অর্থাৎ, আপনার সন্তানদের হাতের নাগালের বাইরে রাখুন বাইবেল। কিন্তু কে শোনে তাঁর কথা? তিনি তো আর Born Again (B.A.) খ্রীষ্টান ছিলেন না। [নোট: এটা একটা নতুন ব্যাধি। এটাই গায়ানার জোন্সটাউনে রেভারেন্ড জিম জোন্স-এর Suicide Cult তথা আত্মহননকারী সম্প্রদায়কে বিনাশ করেছিলো ১৯৭৮ সালে]

দক্ষিণ আফ্রিকার খ্রীষ্টান শাসকবর্গ যাঁরা নিজেদের উচ্চ নৈতিকতার কারণে শুধুমাত্র চারটি অক্ষরের একটি শব্দের জন্যে 'Lady Chatterley's Lover' শিরোনামের বইটিকে নিষিদ্ধ করেছেন, তাঁরা অবশ্যই ‘পবিত্র বাইবেলের’ ওপরও একটি নিষেধাজ্ঞা জারি করতেন, যদি তা কোনো হিন্দু বা মুসলমান ধর্মগ্রন্থ হতো। কিন্তু তাঁরা তাঁদের ‘পবিত্র ধর্মগ্রন্থের’ মোকাবিলায় একেবারেই অসহায়, কেননা তাঁদের নিজেদের ‘পারলৌকিক পরিত্রাণ’-ই যে এর ওপর নির্ভর করছে!

খ্রীষ্টান মিশনারীদের প্রকাশিত The Plain Truth পত্রিকার অক্টোবর ১৯৭৭ সংখ্যায় লেখা হয়: “শিশুদের কাছে বাইবেলীয় কাহিনিগুলো পাঠের দ্বারা যৌন-নৈতিকতা সম্পর্কে আলোচনার সব ধরনের সুযোগও সৃষ্টি হতে পারে। সংস্কৃত নয় এমন বাইবেল হয়তো কিছু কিছু সংস্কর্তার কাছে X-rating তথা ‘প্রাপ্তবয়স্কদের জন্যে নির্দিষ্ট’ হিসেবে মূল্যায়ন পেতে পারে।”

দুই কন্যা কর্তৃক আপন পিতাকে প্রলুব্ধকরণ

এবার আদিপুস্তক/পয়দায়েশ ১৯ অধ্যায়ের ৩০ নং শ্লোক থেকে অধ্যায়ের শেষ পর্যন্ত পড়ুন এবং পুনরায় যথাবিহিত ‘লাল’ রং ব্যবহার করুন। সংকোচ কিংবা গড়িমসি করবেন না। আপনার ‘রঙ্গীন’ বাইবেলটি আপনার সন্তানদের জন্যে অমূল্য উত্তরাধিকার হয়ে যাবে। বাইবেল তালাবদ্ধ রাখার ব্যাপারে আমি বার্নার্ড ’শ-এর সাথে একমত, কিন্তু খ্রীষ্টান চ্যালেঞ্জের মোকাবিলায় এই অস্ত্রটি আমাদের খুবই প্রয়োজনীয়। আমাদের প্রিয়নবী (صلى اللّٰه عليه وسلم) বলেছেন, “যুদ্ধ হচ্ছে কৌশল,” আর তাই কৌশল এটা দাবি করে যে আমরা আমাদের শত্রুদের অস্ত্র তাদের বিরুদ্ধেই ব্যবহার করি। এতে আমাদের পছন্দ-অপছন্দ ধর্তব্য নয়। বরঞ্চ এটাই একমাত্র অস্ত্র যা আমরা ব্যবহার করতে বাধ্য হচ্ছি সে সব ‘এক বই’ (বাইবেল) অধ্যাপকদের বিরুদ্ধে, যাঁরা আমাদের দরজায় এসে বলছেন, “বাইবেল এ কথা বলে - বাইবেল ও কথা বলে।” তাঁরা চান যেনো আমরা আমাদের পবিত্র ক্বুরআন মজীদকে তাঁদের ‘পবিত্র বাইবেলের’ সাথে বিনিময় করি। তাঁদেরকে ওই ‘পবিত্রতার’ মাঝে অবস্থিত ছিদ্রগুলো প্রদর্শন করুন, যা তাঁরা এখনো দেখেননি। মাঝে মধ্যে তাঁরা এমন ভান করেন যেনো তাঁরা এ সব নোংরামি প্রথমবারের মতো দেখছেন। তাঁদের প্রচার কাজে তাঁদেরকে স্রেফ কিছু বাছাইকৃত শ্লোক-ই শেখানো হয়ে থাকে।

আমরা (উক্ত) ঘটনায় ফিরে আসি: ‘ইতিহাসের’ মধ্যে এটা আছে যে রাতের পর রাত লুত/লোট (আ:)’এর দুই কন্যা তাদের পিতার ‘বীজ’ সংরক্ষণ করার মহৎ (?) উদ্দেশ্যে তাদের মাতাল পিতাকে প্রলোভিত করতো। কথিত ‘পবিত্র পুস্তকে’ (বাইবেলে) ‘বীজ’ শব্দটির বিস্তর ছড়াছড়ি: ছোট্ট ‘আদি পুস্তক/পয়দায়েশ’ পুস্তকেই সাতচল্লিশ বার এর উল্লেখ রয়েছে! এছাড়া, আরেকটি অজাচার থেকে আবির্ভূত হয়েছিলো ‘অম্মোনীয়’ ও ‘মোয়াবীয়’ নামের দুটো গোত্র, যাদের জন্যে ইসরাঈলের খোদার বিশেষ দয়া প্রদর্শিত হয়েছিলো। বাইবেলের পরবর্তী পর্যায়ে আমরা জানতে পারি এই একই দয়াশীল খোদা ইহুদীদেরকে আদেশ করেছিলেন যেনো তাঁরা নির্দয়ভাবে ফিলিস্তিনীদের হত্যা করেন - নারীপুরুষ, ছোটবড় নির্বিশেষে যেনো সবাইকে নিশ্চিহ্ন করা হয়। এমন কী গাছ ও পশুপাখিকেও নিস্তার দেয়া হয়নি এ হত্যাযজ্ঞ থেকে। কিন্তু অম্মোনীয় ও মোয়াবীয়দেরকে ‘ক্লেশ’ দেয়া বা তাদের সাথে ‘বিরোধ’ করা চলবে না, কেননা তারা লুত/লোট (আ:)’এর বীজ! [দ্বিতীয় বিবরণ, ২:১৯, কিতাবুল মোকাদ্দস ও পবিত্র বাইবেল, বিবিএস]

কোনো রুচিশীল পাঠক-ই লুত (আ:)’এর মা, বোন বা কন্যা অথবা তাঁর বাগদত্তা সতী ভাবী বধূ কর্তৃক তাঁকে প্রলোভিত করার কাহিনি-বৃত্তান্ত পাঠ করতে পারবেন না। তবু আপনি এ ধরনের বিকৃত মানসিকতার লোক পাবেন, যারা এই নোংরা অখাদ্য গোগ্রাসে গিলে থাকে। স্বাদকে চাষ করা যায় বৈ কী!

হেজকিল/যিহিষ্কেল ২৩ নং অধ্যায়টি বার বার পড়ুন এবং দাগ দিন। কোন্ রং পছন্দ করতে হবে তা আপনি বুঝবেন। অহলা ও অহলীবা নাম্নী দুই বোনের ‘বেশ্যাগিরি’ এখানে বিধৃত। অধ্যায়টিতে বর্ণিত (অবৈধ) যৌনাচারের বৃত্তান্ত বহু নিষিদ্ধ পুস্তকের অসম্পাদিত সংস্করণকেও হার মানায়। আপনার Born Again খ্রীষ্টান অতিথিদের জিজ্ঞেস করুন, কোন্ শ্রেণিতে তাঁরা এসব অশ্লীলতাকে অন্তর্ভুক্ত করবেন? নিশ্চয় এই নোংরা বস্তুর স্থান খোদার কোনো ’ঐশীগ্রন্থেই’ নেই।

আলহাজ্জ এ,ডি, আজিজোলা তাঁর প্রণীত ‘The Myth of the Cross' শিরোনামের পুস্তকে পাণ্ডিত্যের সাথে বাইবেল ও ‘ক্রুশবিদ্ধকরণের’ ভ্রান্ত বিশ্বাস তথা সমগ্র খ্রীষ্টধর্মীয় ভ্রান্তির স্বরূপ উন্মোচন করেছেন। তুলনামূলক ধর্ম বিদ্যার কোনো শিক্ষার্থীরই এ বইটি এবং ইতিপূর্বে উল্লেখিত 'The Bible: Word of God or Word of Man?' শিরোনামের বইটি নিজের সাথে রাখা ছাড়া গত্যন্তর নেই।

নবম অধ্যায়
ঈসা মসীহ (আ:)/যীশু খ্রীষ্টের বংশ পরিচয়

এবার লক্ষ্য করুন কীভাবে খ্রীষ্টান ‘ফাদার’বৃন্দ ‘নতুন নিয়মের’ মধ্যে তাঁদের ‘প্রভু’ ও ‘ত্রাণকর্তা’ যীশু খ্রীষ্টের ওপর ‘পুরাতন নিয়মের’ সেই অজাচার থেকে ভূমিষ্ঠ প্রজন্মগুলোর তালিকা চাপিয়ে দিয়েছেন। যাঁর কোনো বংশীয় পূর্বপুরুষ নেই, তাঁর জন্যে তাঁরা একটি বংশ পরিচয় তৈরি করেছেন। আর সে কী বংশ পরিচয়! খোদার এই পুতঃ পয়গাম্বর/ভাববাদীর জন্যে দেয়া হয়েছে ছয়জন ব্যভিচারী ও অজাচার থেকে গর্ভজাত পিতৃপুরুষ। এরা সে সব নারীপুরুষ, যারা মূসা (আ:) বা মোশির কাছে অবতীর্ণ খোদার আপন বিধান অনুসারে প্রস্তর নিক্ষেপে হত্যাযোগ্য ছিলো; অধিকন্তু, দশম পুরুষ পর্যন্ত যাদেরকে সদাপ্রভু/খোদার সমাজ থেকে নির্বাসন করা উচিৎ ছিলো। [রেফারেন্স: “জারজ ব্যক্তি সদাপ্রভুর সমাজে প্রবেশ করবে না; তার দশম পুরুষ পর্যন্তও সদাপ্রভুর সমাজে প্রবেশ করতে পারবে না” (দ্বিতীয় বিবরণ, ২৩:২, পবিত্র বাইবেল, বিবিএস)। জেহোভার সাক্ষীবর্গ ’জারজ’ শব্দটির ব্যাপারে খুবই স্পর্শকাতর। তাঁদের হলো ‘বজ্র আঁটুনি, ফসকা গেরো।’]

অসম্মানজনক বংশ পরিচয়

খোদাতা’লা কেন তাঁর ‘পুত্র’ (যীশু)’কে একজন ‘পিতা’ (যোসেফ) দান করতে যাবেন? আর কেনই বা এ রকম একটি অসম্মানজনক বংশ পরিচয় তিনি তাঁকে দান করবেন? বিকৃত মানসিকতার লোকেরা উত্তরে বলেন: “এটাই হলো এর সৌন্দর্য; খোদা পাপীদেরকে এতোই ভালোবেসেছেন যে তিনি তাঁর ‘পুত্রের’ জন্যে এ ধরনের জনকদেরকে দান করতে ঘৃণা করেননি।”

কেবল দু জন অনুমোদিত

চারজন সুসমাচার লেখকের মধ্যে কেবল দু জনকেই খোদাতা’লা ‘অনুপ্রেরণা/প্রত্যাদেশ’ দিয়েছিলেন তাঁর পুত্রের বংশ পরিচয় লিপিবদ্ধ করার জন্যে। ঈসা মসীহ (আ:)’এর ‘পিতা ও প্রপিতামহ’দের ওই দুটো ‘অনুপ্রেরণাপ্রাপ্ত’ তালিকাকে তুলনা করার সুবিধার্থে আমি নিম্নে সেগুলোকে পাশাপাশি তুলে ধরলাম [১৫ নং দলিলচিত্র দেখুন]:

‘দায়ূদ হতে যীশু পর্যন্ত বংশীয় তালিকা’

মথি ১:৬-১৬ অনুসারে দায়ূদ (হতে) -

১/ শলোমন; ২/ রহবিয়াম; ৩/ অবিয়; ৪/ আসা; ৫/ য়িহোশাফট; ৬/ যোরাম; ৭/ উষিয়; ৮/ যোথম; ৯/ আহস; ১০/ হিষ্কিয়; ১১/ মনঃশি; ১২/ আমোন; ১৩/ যোশিয়; ১৪/ যিকনিয়; ১৫/ শলটীয়েল; ১৬/ সরুববাবিল; ১৭/ অবীহূদ; ১৮/ ইলীয়াকীম; ১৯/ আসোর; ২০/ সাদোক; ২১/ আখীম; ২২/ ইলীহূদ; ২৩/ ইলিয়াসর; ২৪/ মত্তন; ২৫/ যাকোব; ২৬/ যোষেফ; ২৭/ যীশু খ্রীষ্ট।

লুক ৩:২৩-৩১ অনুসারে দায়ূদ (হতে)

১/ নাথন; ২/ মত্তথ; ৩/ মিন্না; ৪/ মিলেয়া; ৫/ ইলিয়াকীম; ৬/ যোনম; ৭/ যোষেফ; ৮/ যূদা; ৯/ শিমিয়োন; ১০/ লেবি; ১১/ মত্তত; ১২/ যোরীম; ১৩/ ইলীয়েশর; ১৪/ যোশী; ১৫/ এর; ১৬/ ইলমাদম; ১৭/ কোষম; ১৮/ অদ্দী; ১৯/ মল্কী; ২০/ নেরি; ২১/ শল্টীয়েল; ২২/ সরুববাবিল; ২৩/ রীষা; ২৪/ যোহানা; ২৫/ যূদা; ২৬/ যোষেফ; ২৭/ শিমিয়ি; ২৮/ মত্তথিয়; ২৯/ মাট; ৩০/ নগি; ৩১/ ইষলি; ৩২/ নহূম; ৩৩/ আমোস; ৩৪/ মত্তথিয়; ৩৫/ যোষেফ; ৩৬/ যান্না; ৩৭/ মল্কী; ৩৮/ লেবি; ৩৯/ মত্তত; ৪০/ এলি; ৪১/ যোষেফ; ৪২/ যীশু খ্রীষ্ট। 

দায়ূদ হতে যীশু খ্রীষ্ট পর্যন্ত খোদা তাঁর ‘পুত্রের’ জন্যে মথিকে কেবল ২৬ জন পূর্বপুরুষের তালিকা লিপিবদ্ধ করতে ‘অনুপ্রেরণা’ দিয়েছিলেন। কিন্তু লুক ‘প্রত্যাদিষ্ট’ হয়ে লিপিবদ্ধ করেন ৪১ জন পূর্বপুরুষ। এ দুটো তালিকার মধ্যে একমাত্র সার্বিক নামটি হলো ‘যোষেফ,’ তা-ও আবার লুকের মতানুসারে ‘ধারণাকৃত’ পিতা [লুক, ৩:২৩]। এই নামটি ভীষণ উজ্জ্বল, ফলে এটাকে বেছে নিতে কোনো অসুবিধাই হবার কথা নয়। এটা সূত্রধর যোষেফ। আপনি আরো লক্ষ্য করবেন দুটো তালিকা-ই একদম অসঙ্গতিপূর্ণ। তাহলে এ দুটো তালিকা একই উৎস তথা খোদা থেকে নিঃসৃত হতে পারে কি? 

ভবিষ্যদ্বাণীর পূর্ণতাপ্রাপ্তি?

রাজা দাউদ’কে ঈসা (আ:) বা যীশু খ্রীষ্টের মুখ্য পূর্বপুরুষ বানানোর ক্ষেত্রে মথি ও লুক অতি তৎপর ছিলেন, কেননা তাঁদের ভ্রান্ত এই ধারণা ছিলো যে যীশু “তাঁর (দাউদের) সিংহাসনে বসবেন” [প্রেরিত, ২:৩০; বিবিএস]। সুসমাচারগুলো এই ভবিষ্যদ্বাণীকে ভ্রান্ত প্রমাণ করেছে, কারণ যীশু কর্তৃক তাঁর পিতৃপুরুষের (দাউদের) সিংহাসনে বসার পরিবর্তে রোমান গভর্নর পনতিয়াস্ পীলাত-ই সেই সিংহাসনে উপবেশন করেন এবং ওর ‘প্রকৃত উত্তরাধিকারী (যীশু)’কে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেন। সুসমাচার প্রচারকবর্গ এর জবাবে বলেন: “চিন্তা করবেন না, যদি তাঁর প্রথম আগমনে না হয়, তবে দ্বিতীয় আগমনে অবশ্যই তিনি এ ভবিষ্যদ্বাণী পূর্ণ করবেন এবং এছাড়াও আরো তিন’শটি পুরো করবেন।” কিন্তু দাউদের সঙ্গে যীশুর ‘রক্তমাংসের’ বংশ পরিচয়, যা বাইবেলীয় ভাষ্যানুযায়ী “দাউদের ঔরসজাত” (প্রেরিত ২:৩০) এবং যা রূপকার্থে নয়, বরং আক্ষরিক অর্থেই ব্যক্ত, তা অতি মাত্রায় উৎসাহের সাথে খুঁজতে যেয়ে উভয় ‘প্রত্যাদিষ্ট’ লেখক-ই প্রথম কদমে পা পিছলে পড়ে গিয়েছেন।

মথি ১:১৬ শ্লোকে বলছেন যীশু শলোমনের (সুলায়মান আ:) মাধমে ‘দাউদের’ পুত্র, কিন্তু লুক ৩:৩১ শ্লোকে বলছেন যীশু নাথনের মাধ্যমে ‘দাউদের’ পুত্র। এ কথা বলতে কাউকে ভ্রূণতত্ত্ববিদ হতে হবে না যে দাউদের বীজ একই সময়ে শলোমন ও নাথনের মাধ্যমে কল্পনাতীত উপায়ে যীশুর মায়ের কাছে পৌঁছুতে পারে না! আমরা জানি উভয় লেখকই ডাহা মিথ্যুক, কারণ ঈসা (আ:) খোদায়ী কুদরতে অলৌকিকভাবে জন্মগ্রহণ করেছিলেন; কোনো পিতারই প্রয়োজন হয়নি। আমরা যদি দাউদ (আ:)’এর মাধ্যমে একটি বংশ-পরম্পরা স্বীকারও করে নেই, তবুও উভয় লেখক উপরোক্ত নিশ্চিত কারণে মিথ্যেবাদী প্রমাণিত হবেন।

পক্ষপাতিত্বের বিচূর্ণকরণ

আবেগের দরুন কোনো খ্রীষ্টানের মস্তিষ্ক এতোই পক্ষপাতদুষ্ট যে, তিনি উপরোক্ত যুক্তিটি সহজ হওয়া সত্ত্বেও গ্রহণ করতে একেবারেই অক্ষম। তাই আমরা তাঁকে অনুরূপ একটি উদাহরণ দেবো, যেখানে তিনি পক্ষপাতিত্ব থেকে মুক্ত থাকতে পারবেন।

আমরা ইতিহাস থেকে জানি ইসলাম ধর্মের পয়গাম্বর হযরত মুহাম্মদ (صلى اللّٰه عليه وسلم) হযরত ইসমাঈল (عليه السلام)’এর সূত্রে হযরত ইবরাহীম (عليه السلام) তথা ‘আব্রাহামের’ পুত্র (বংশধর)। অতএব, যদি কোনো ‘প্রত্যাদিষ্ট’ লেখক এসে আমাদের জানান যে তিনি এ মর্মে ‘ঐশীবাণী’ পেয়েছেন হযরত মুহাম্মদ (صلى اللّٰه عليه وسلم) পয়গাম্বর ইসহাক্ব (عليه السلام)’এর সূত্রে পয়গাম্বর ইবরাহীম (عليه السلام)’এর পুত্র, তাহলে আমরা কোনো দেরি না করে তাঁকে একজন মিথ্যুক আখ্যা দেবো; কেননা ‘আব্রাহামের’ বীজ কখনোই একই সময়ে পয়গাম্বর ইসমাঈল (عليه السلام) ও ইসহাক্ব (عليه السلام)’এর সূত্রে মহানবী (صلى اللّٰه عليه وسلم)’এর পিতামাতার ঔরসে পৌঁছুতে পারে না। ‘আব্রাহামের’ এই দুই পুত্রের বংশ দুটোর পার্থক্য হচ্ছে ‘ইহুদী’ ও ‘আরব’ জাতিগোষ্ঠী দুটোর মধ্যে বিরাজিত পার্থক্য।

হযরত রাসূলে পাক (صلى اللّٰه عليه وسلم)’এর ক্ষেত্রে যে ব্যক্তি দাবি করবে তাঁর পিতৃপুরুষ হচ্ছেন পয়গাম্বর ইসহাক্ব (عليه السلام), তাকে আমরা মিথ্যুক ডাকবো। কিন্তু যীশুর ক্ষেত্রে মথি ও লুক সন্দেহভাজন। যতোক্ষণ খ্রীষ্টানবৃন্দ তাঁদের কথিত ‘খোদার’ (মানে যীশুর) জন্যে এ দুটোর কোনো একটি বংশ পরিচয় বেছে নেবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ না করবেন, ততোক্ষণ পর্যন্ত দুটো সুসমাচারকেই প্রত্যাখ্যান করতে হবে। বিগত দুই হাজার বছর যাবৎ খ্রীষ্টান সমাজ এ দুটো বংশ পরিচয়ের রহস্য উদঘাটনের জন্যে মরিয়া হয়ে লড়ছেন। তাঁরা এখনো হাল ছাড়েননি। আমরা তাঁদের নিষ্ঠা ও অধ্যবসায়ী মনোভাবকে শ্রদ্ধা করি। তাঁরা এখনো বিশ্বাস করেন, “সময়ই সকল সমস্যার সমাধান করবে।” 

“এতে দাবিকৃত কিছু অসঙ্গতি আছে যে (খ্রীষ্টান) ধর্মশাস্ত্রজ্ঞবৃন্দ প্রত্যেক নাস্তিকের সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারেননি। মূল পুস্তকে এমন কিছু লিপিগত অসুবিধা বিদ্যমান, যা নিয়ে পণ্ডিতমণ্ডলী এখনো কুস্তিরত। কোনো বাইবেল-অজ্ঞ লোকই কেবল এ সব এবং অন্যান্য সমস্যাকে অস্বীকার করতে পারে।” [The Plain Truth ম্যাগাজিন, জুলাই ১৯৭৫]

লুকের ‘অনুপ্রেরণার’ উৎস

আমরা ইতোমধ্যে মথি ও মার্কের ৮৫% অংশকে মার্ক কিংবা সেই ‘রহস্যময় Q'-এর সাথে দৃঢ়ভাবে বেঁধে ফেলেছি [Quella-সম্পর্কিত ষষ্ঠ অধ্যায়ে মি: জে, বি, ফিলিপ্স-এর উদ্ধৃতি দ্রষ্টব্য]। এবার আমরা লুককে সুযোগ দেবো এ কথা বলতে যে, কে তাঁকে ‘অনুপ্রেরণা’ দিয়েছিলেন তাঁরই ‘মহামহিম থিয়ফিলকে’ (লুক, ১:৩০) যীশু খ্রীষ্টের ঘটনাবলী বর্ণনা করতে। আমরা এখানে লুকের সুসমাচারের মুখবন্ধটি পাঠকের সামনে তুলে ধরছি [১৬ নং দলিলচিত্র দেখুন]:


 

“প্রথম অবধি যাঁরা স্বচক্ষে দেখেছেন এবং (ঐশী) বাক্যের সেবা করে এসেছেন, তাঁরা আমাদেরকে যেমন সমর্পণ করেছেন, তদনুসারে অনেকেই আমাদের মধ্যে সম্পূর্ণভাবে গৃহীত বিষয়াদির বিবরণ লিপিবদ্ধ করতে হস্তক্ষেপ করেছেন; সেই জন্যে আমিও প্রথম থেকে সব বিষয় সবিশেষ অনুসন্ধান করেছি বলে, হে মহামহিম থিয়ফিল, আপনাকে আনুপূর্বিক বিবরণ লেখা বিহিত বুঝলাম যেনো আপনি যে সব বিষয় শিক্ষা পেয়েছেন, সেই সব বিষয়ের নিশ্চয়তা জ্ঞাত হতে পারেন।” [লুক, ১:১-৪, পবিত্র বাইবেল, বিবিএস, ১৯৮৪]

লুক আমাদেরকে সরলভাবে জানিয়ে দিচ্ছেন তিনি অন্যান্যদের পদাঙ্ক অনুসরণ করছিলেন মাত্র, যাঁরা তাঁর থেকেও কম যোগ্যতাসম্পন্ন ছিলেন এবং যাঁদের দুঃসাহস হয়েছিলো তাঁর প্রভু যীশু খ্রীষ্ট সম্পর্কে বৃত্তান্ত লেখার। চিকিৎসক হিসেবে জেলে ও কর-সংগ্রাহকদের তুলনায় তিনি নিঃসন্দেহে অনেক বেশি যোগ্য ছিলেন একটি ‘সাহিত্য রত্ন’ সৃষ্টি করার ক্ষেত্রে। এটা তিনি করতে সক্ষমও হয়েছিলেন, কারণ ‘আনুপূর্বিক বিবরণ লেখা বিহিত বুঝলাম।’ পূর্বসূরীদের ওপরে অগ্রাধিকার পাওয়ার বেলায় এটাই তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণকর ন্যায্যতা প্রতিপাদন।

খ্রীষ্টান পণ্ডিত জে,বি, ফিলিপ্স্ সাহেব তাঁর অনূদিত ‘সেইন্ট লুকের সুসমাচার’ পুস্তকের মুখবন্ধে বলেন: “লুকের নিজের স্বীকারোক্তি অনুসারেই তিনি বিরাজমান দলিলপত্রকে সতর্কতার সাথে তুলনা করেছেন এবং তাতে সম্পাদনা করেছেন। কিন্তু এটা প্রতীয়মান হয় যে তিনি আরো বেশ কিছু অতিরিক্ত দলিলপত্রের সন্ধান পেয়েছিলেন, আর আমরা যুক্তিসঙ্গতভাবে অনুমান করতে পারি তাঁর উপস্থাপিত কিছু কিছু দলিলের উৎস কোথায়।” অথচ এরপরও আপনারা এটাকে ঐশীবাণী বলছেন? প্রিয় পাঠক! Fontana Publications-এর নরম মলাটের The Gospels in Modern English বইটি সংগ্রহ করুন। এটা একদম সস্তা একটা সংস্করণ। অনুগ্রহ করে তাড়াতাড়ি সংগ্রহ করবেন, যাতে জে,বি, ফিলিপ্স সাহেবের অনুবাদ থেকে তাঁর মহামূল্যবান টীকাগুলো খ্রীষ্টানদের দ্বারা কর্তনের সিদ্ধান্ত নেবার আগেই বইটি আপনার হস্তগত হয়! আর আশ্চর্য হবেন না যদি RSV-এর লেখকবৃন্দও তাঁদের অনুবাদ থেকে ‘মুখবন্ধটি’ [পূর্বোদ্ধৃত ১ নং দলিলচিত্র] অপসারণ করেন। এটা অত্যন্ত পুরোনো স্বভাব। খ্রীষ্টধর্মে যাঁদের স্বার্থ নিহিত, তাঁরা যেই বুঝতে পারেন বেখেয়ালে থলের বিড়াল বের করে দিয়েছেন, অমনি তাঁরা প্রায়শ্চিত্ত করতে তৎপর হন। ফলশ্রুতিতে তাঁরা আমার চলতি উদ্ধৃতিগুলোকেও রাতারাতি ‘ইতিহাস’ বানিয়ে দেন!

অবশিষ্ট সুসমাচারটি 

‘সেইন্ট যোহনের সুসমাচারটির’ লেখক কে? খোদাও নন, আবার যোহন/উইহোন্না-ও নন! দেখুন ‘তিনি’ ‘তাঁর’ সম্পর্কে কী বলছেন - যোহন ১৯:৩৫ ও ২১:২৪-২৫ পুস্তকে। [১৭ নং দলিলচিত্র দেখুন]:



“যে ব্যক্তি দেখেছেন, তিনি-ই সাক্ষ্য দিয়েছেন এবং তাঁর সাক্ষ্য যথার্থ; আর তিনি জানেন তিনি সত্য বলেছেন যেনো তোমরাও বিশ্বাস করো।” [যোহন ১৯:৩৫, পবিত্র বাইবেল, বিবিএস]

“সেই শিষ্যই এ সব বিষয়ে সাক্ষ্য দিচ্ছেন এবং এ সব লিখেছেন; আর আমরা জানি তাঁর সাক্ষ্য সত্য। যীশু আরো অনেক (অলৌকিক) কর্ম করেছিলেন; সে সব যদি এক এক করে লেখা যায়, তবে আমার বোধ হয় লিখতে লিখতে এতো গ্রন্থ হয়ে ওঠে যে জগতেও তা ধরে না।” [যোহন ২১:২৪-২৫, পবিত্র বাইবেল ১৯৮৪ সংস্করণ, বিবিএস]

তাঁর (যোহনের) ‘সে,’ ‘তাঁর,’ ‘আমরা জানি’ এবং ‘আমার বোধ হয়’ কে? এটা কি সেই চপল প্রকৃতির লোকটি, যে যীশুকে বাগানে রেখে পালিয়েছিলো, যখন তাঁর সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিলো সাহায্যের? নাকি এটা ‘শেষ ভোজনে’ অংশীদার টেবিলে উপবিষ্ট সেই চৌদ্দ নং ব্যক্তি, যাঁকে ‘যীশু ভালোবাসতেন?’ দু জনেরই নাম ছিলো যোহন। যীশুর সময়কার ইহুদীদের মাঝে এই নামটি বেশ জনপ্রিয় ছিলো এবং আজো খ্রীষ্টানদের মাঝে এটা বেশ জনপ্রিয়। ওই দু জনের কেউই সুসমাচারটির লেখক নন। এটা যে একটা বেনামী হাতের কাজ, তা দিবালোকের মতোই পরিষ্কার। 

বাইবেল লেখকবর্গের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি

আমার এ ‘বাইবেল-প্রণেতাদের নাম-ধাম তালাশ’ ওই বত্রিশজন বাইবেল পণ্ডিত ও তাঁদেরকে সমর্থনদাতা পঞ্চাশটি ডিনোমিনেশনের রায় দ্বারা সুসম্পন্ন করতে চাই। লেখকদের এই দৌড় প্রতিযোগিতা থেকে খোদাতা’লা বহু আগেই বাদ পড়েছেন। Collins-এর RSV-তে ‘বাইবেলের পুস্তকগুলো’ সম্পর্কে মহামূল্যবান টীকাসমূহ (যার প্রথম পৃষ্ঠাটি উত্তরসূরীদের জন্যে ১ নং দলিলচিত্রে সংরক্ষিত) তাঁদের সেই প্রকাশনাটির পিঠে পাওয়া যাবে। আমি সেসব তথ্যের সামান্য কিছু অংশ ৯ নং দলিলচিত্রে পুনর্মুদ্রণ করেছি [ ইতিপূর্বেকার ৯ নং দলিলচিত্র দেখুন]:


      
আমরা বাইবেলের প্রথম বই - ‘আদিপুস্তক/পয়দায়েশ’ দিয়ে শুরু করবো। এর ‘লেখক’ সম্পর্কে বাইবেল পণ্ডিতবর্গ বলেন: “মূসা (আ:) বা মোশির পাঁচটি পুস্তকের একটি।” লক্ষ্য করুন, ‘মোশির পাঁচটি পুস্তক’ শব্দগুলো ইনভার্টেড কমার মধ্যে লিখিত। এটা একটা সূক্ষ্ম স্বীকারোক্তির পদ্ধতি এ মর্মে যে, ওটা লোকের কথা মোশি ওই পুস্তকগুলোর রচয়িতা, কিন্তু আমরা (বত্রিশজন বাইবেল পণ্ডিত) যাঁরা অধিক অবহিত, তাঁরা এ শিরোনামের গুজবে সম্মত নই।

পরবর্তী চারটি পুস্তক ‘হিজরত/যাত্রাপুস্তক,’ ‘লেবীয়,’ ‘শুমারি/গণনাপুস্তক’ ও ‘দ্বিতীয় বিবরণ’ - কে সেগুলোর রচয়িতা? উত্তর: “সাধারণতঃ মোশির প্রতি আরোপ করা হয়।” এটাও ‘আদিপুস্তকের’ মতো একই শ্রেণিভুক্ত উত্তর।  

ইউসা/শিহোশূয়’ পুস্তকটির লেখক কে? উত্তর: “অধিকাংশই উইসার প্রতি আরোপিত।” 

কাজী/বিচারকবৃন্দ’ পুস্তক-প্রণেতা কে? উত্তর: “সম্ভবতঃ শামূয়েল।”

‘রূত’ পুস্তকটি লিখেছেন কে? উত্তর: “নিশ্চিত জ্ঞাত নয়।”

আর নিম্নের পুস্তকগুলোর প্রণেতা কে?

১ শমূয়েল -- উত্তর: লেখক - “অজ্ঞাত।”
২ শমূয়েল -- উত্তর: লেখক - “অজ্ঞাত।”
১ বাদশাহনামা/রাজাবলী - উত্তর: লেখক - “অজ্ঞাত।”
২ বাদশাহনামা -- উত্তর: লেখক - “অজ্ঞাত।” 
১ খান্দাননামা/বংশাবলী - উত্তর: লেখক - “অজ্ঞাত, সম্ভবতঃ...
২ খান্দাননামা -- উত্তর: লেখক - “সম্ভবতঃ উযায়ের/ইয্রা কর্তৃক সংগৃহীত।”

আর এভাবেই এই কাহিনির বিস্তার। এসব বেনামী পুস্তকের লেখকবর্গ হয় ‘অজ্ঞাত,’ নয়তো ‘সম্ভবতঃ,’ নতুবা ‘সন্দেহজনক’ উৎস থেকে নিঃসৃত। এই কার্যবিপত্তির জন্যে খোদার প্রতি দোষারোপ কেন? অতিসহিষ্ণু ও পরম করুণাময় আল্লাহতা’লা বাইবেল পণ্ডিতদের দ্বারা আমাদেরকে এ কথা বলবার জন্যে দুই হাজার বছর অপেক্ষা করেননি যে তিনি ইহুদীদের দোষত্রুটি, দম্ভ, পক্ষপাত, কাম, ঝগড়াঝাটি, হিংসাবিদ্বেষ ও মস্ত অপরাধের স্রষ্টা নন। তিনি প্রকাশ্যে তাদের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে ঘোষণা দান করেন:

فَوَيْلٌ لِّلَّذِينَ 

সুতরাং দুর্ভোগ তাদের জন্যেই,

يَكْتُبُونَ ٱلْكِتَابَ بِأَيْدِيهِمْ

যারা কিতাব নিজেদের হাতে রচনা করে,

ثُمَّ يَقُولُونَ

অতঃপর বলে বেড়ায়,

هَـٰذَا مِنْ عِنْدِ ٱللَّهِ

‘এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে;’

لِيَشْتَرُواْ بِهِ ثَمَناً قَلِيلاً

এ উদ্দেশ্যে যে, এর বিনিময়ে তারা স্বল্পমূল্য অর্জন করবে।

فَوَيْلٌ لَّهُمْ مِّمَّا كَتَبَتْ أَيْدِيهِمْ

সুতরাং দুর্ভোগ তাদের জন্যে, তাদের আপন হাতে (কিতাব) রচনার কারণে।

وَوَيْلٌ لَّهُمْ مِّمَّا يَكْسِبُونَ

আর দুর্ভোগ তাদের জন্যে, তাদের এ (অবৈধ) উপার্জনের দরুন। [আল-ক্বুরআন, ২:৭৯; নূরুল এরফান] {নোট: ‘পবিত্র বাইবেল’ - বিশ্বের সেরা কাটতিপূর্ণ পুস্তক! RSV-এর প্রকাশকবর্গ প্রথম সংস্করণেই দেড় কোটি ডলারের নেট মুনাফা করেছিলেন। পরকালের ঐশ্বর্যের তুলনায় এটা কতোই না নগণ্য মূল্য!}

আমরা উপরোক্ত ক্বুরআনী আয়াতটি দ্বারা এই গবেষণামূলক পুস্তিকাটি লেখা আরম্ভ করে আবার এই আয়াত দ্বারাই তা সমাপ্ত করতে পারতাম আমাদের মনে এ প্রশান্তি নিয়ে যে, স্বয়ং আল্লাহতা’লা ‘বাইবেল কি খোদার বাণী?’ - বিষয়টি সম্পর্কে তাঁর চূড়ান্ত রায় দিয়েছেন; কিন্তু আমরা চাই যেনো আমাদের খ্রীষ্টান ভাইয়েরাও তাঁদের অভিলাষ (পঞ্চম অধ্যায়ে লিপিবদ্ধ ড: স্ক্রগীর আরজ দ্রষ্টব্য) অনুযায়ী বিষয়টিকে পক্ষপাতহীনভাবে অধ্যয়ন করার সুযোগ পান, যাতে বিশ্বাসী খ্রীষ্টানবৃন্দ ও Born Again (B.A.) খ্রীষ্টান সম্প্রদায়গুলো তাঁদের নিজেদের বাইবেলের সাক্ষ্যকে আপন আপন ‘বিবেকের কষ্টিপাথরে’ যাচাই করতে পারেন।

পবিত্র ক্বুরআনের ব্যাপারে কী ফায়সালা? এটা কি খোদার বাণী? এই প্রশ্নটির উত্তর প্রদানের খাতিরে এ পুস্তিকার লেখক আমি অধম বিজ্ঞানসম্মত পন্থায় চেষ্টা করেছি আমারই 'Al-Qur'an: The Ultimate Miracle' শিরোনামের পুস্তিকায়।

পরিশিষ্ট

খোলা মনের পাঠকের এতোক্ষণে নিশ্চয় দৃঢ় প্রত্যয় জন্মেছে যে, বাইবেল সম্পর্কে খ্রীষ্টবাদের সমর্থকবৃন্দ যা দাবি করে থাকেন তা মোটেও সঠিক নয়।

গত প্রায় চার দশক যাবৎ মানুষেরা এ মর্মে আমাকে জিজ্ঞেস করেছেন, কীভাবে আমি খ্রীষ্টধর্ম ও বাইবেল সম্পর্কে এতোখানি ‘গভীর’ জ্ঞান অর্জন করতে পেরেছি। সরলভাবে বল্লে, ইহুদী ও খ্রীষ্টধর্ম-বিষয়ক একজন মুসলিম ‘বিশেষজ্ঞ’ হিসেবে আমার বর্তমান অবস্থাটি মোটেও আমার নিজস্ব পছন্দ ছিলো না। আমাকে এ অবস্থায় জোরপূর্বক ঠেলে দেয়া হয়েছিলো।

প্রাথমিক প্ররোচনা

এর সূচনাকাল ছিলো ১৯৩৯ খ্রীষ্টাব্দে, যখন আমি এডামস্ মিশন নামের এলাকায় এক দোকান-সহকারী হিসেবে কর্মরত ছিলাম; ওই দোকানটি এডামস্ মিশন নামের একটি খ্রীষ্টান সেমিনারী তথা পাদ্রীদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের কাছে অবস্থিত ছিলো। সেই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রেই গড়ে তোলা হতো উচ্চাভিলাষী তরুণ পাদ্রী ও পুরোহিতদেরকে, যাঁদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হতাম আমি ও আমার মুসলিম সহকর্মীবৃন্দ। এমন কোনো দিন অতিক্রান্ত হয়নি, যখন এসব তরুণ খ্রীষ্টান প্রচারক আমাকে ও আমার দ্বীনী ভাইদেরকে হযরত রাসূলে করীম (صلى اللّٰه عليه وسلم), দ্বীন-ইসলাম ও আল-ক্বুর’আন প্রসঙ্গে অপমানজনক কথা বলে আঘাত করেননি।

বিশ বছর বয়সী এক অনুভূতিশীল যুবক হিসেবে আমি আমার প্রাণপ্রিয় রাসূলুল্লাহ (صلى اللّٰه عليه وسلم), যিনি ‘রাহমাতুল্-লিল্-আলামীন’ (জগতসমূহের জন্যে আল্লাহর বিশেষ করুণা), তাঁকে খ্রীষ্টান মিশনারীদের মোকাবিলায় সমর্থন করতে না পারায় নিদ্রাহীন রজনীসমূহ অশ্রুসজল চোখে কাটিয়েছি। অতঃপর আমি ক্বুরআন মজীদ, বাইবেল ও অন্যান্য ধর্মীয় বই পড়ার সিদ্ধান্ত নেই। ‘এযহারুল হক্ব’ শিরোনামের গ্রন্থটির সন্ধান লাভ-ই আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। এর কিছু কাল পরে আমি এডামস্ মিশন কলেজের পাদ্রী-পুরোহিতবর্গকে দাওয়াত করে এনে তাঁদের শার্টের কলারে ঘাম ঝরাতে সক্ষম হই - যতোক্ষণ পর্যন্ত না তাঁদের মাঝে প্রিয়নবী (صلى اللّٰه عليه وسلم) ও ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে শ্রদ্ধাভাব জাগ্রত হয়।

আমি ভাবছি, আজকে কতো অগণিত অসতর্ক মুসলমান যে খ্রীষ্টান পাদ্রী-পুরোহিতদের দ্বারা অবিরত আক্রমণের শিকার হচ্ছেন; যেসব পাদ্রী প্রত্যেক দরজায় দরজায় হানা দিচ্ছেন এবং অতিথিপরায়ণ হিসেবে সুখ্যাত মুসলিমবৃন্দ কর্তৃক আপ্যায়িত হওয়ার পর কতোটা নির্দয়ভাবে মুসলিম বিশ্বাসের পরিপন্থী কটূক্তি করে মুসলমানদেরকে ‘সমুচার’ মতো খেয়ে ফেলছেন, আর তাঁদের অন্তরে চরম অশান্তি সৃষ্টি করছেন।

মুসলমানবৃন্দকে ওই সব টাটকা সুসমাচার প্রচারক ও খ্রীষ্টবাদের ফেরিওয়ালা এবং রাসূলুল্লাহ (صلى اللّٰه عليه وسلم) ও ইসলাম ধর্মের প্রতি বেহায়া আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দানের উদ্দেশ্যে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে আমি কিছু প্রভাষণ প্রদানের দায়িত্ব নিয়েছিলাম মুসলিম সাধারণকে এটা দেখাতে যে, খ্রীষ্টান মিশনারীদের আক্রমণ হতে তাঁদের কোনো ভয়ই নেই। আমার প্রভাষণগুলো খ্রীষ্টান সম্প্রদায়কেও দাওয়াত করেছে ইসলাম ধর্মের সত্যতা এবং পয়গাম্বর ঈসা মসীহ (আ:)’এর সত্য, সঠিক শিক্ষাসমূহে মিথ্যের অনুপ্রবেশ সম্পর্কে সাক্ষ্য ও স্বীকৃতি দিতে।

আক্রমণ নতুন নয়

বিগত কয়েক শতাব্দী কী আরো কিছু বেশি সময়কাল যাবৎ খ্রীষ্টান মিশনারীবর্গ বহু বিষয়ে মুসলমানদেরকে চ্যালেঞ্জ করে আসছেন এবং এ রকম বহু চ্যালেঞ্জ আমার জানা মোতাবেক পুরোপুরি বা আংশিকভাবে প্রত্যুত্তরপ্রাপ্ত হয়েছে। হয়তো আল্লাহর ইচ্ছাক্রমে এ ক্ষেত্রে আমার অবদানটিও ইসলাম-অবমাননাকারীদের চ্যালেঞ্জের পুরো বা আংশিক জবাব হতে পারে। এটা অত্যন্ত জরুরি যে আমরা এ প্রক্রিয়ায় যেনো কোনো রকম ঢিলে না দেই; অলসতা না করি।

এই ধরনের চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে ‘খ্রীষ্টের দিকে মুসলিমবৃন্দকে পরিচালনার উপায়’ (How to Lead Muslims to Christ) শীর্ষক পুস্তকের লেখক জিও জি, হ্যারিস সাহেবের চ্যালেঞ্জটি বিশেষভাবে মনে পড়ে। এ মিশনারী যিনি চীনের মুসলমানবৃন্দকে ধর্মান্তরের চেষ্টা করেছিলেন, তিনি তাঁর বইয়ের ১৯ পৃষ্ঠায় ‘বিকৃতির ধারণা বা অভিযোগটি’ (The Theory or Charge of Corruption) শিরোনামযুক্ত অধ্যায়ে পশ্চিমাদের দম্ভপূর্ণ ও ঘৃণ্য স্বভাবসহ বলেন: 

"এবার আমরা মুসলিম দুনিয়া কর্তৃক আমাদের খ্রীষ্টান ধর্মগ্রন্থের (বাইবেলের) বিরুদ্ধে উত্থাপিত সবচেয়ে গুরুতর অভিযোগটি সম্পর্কে আলোকপাত করবো। এই অভিযোগের তিনটি দিক বিদ্যমান:

১/ খ্রীষ্টান শাস্ত্রলিপিগুলো এমনই পরিবর্তন করা হয়েছে যে এগুলো আল-ক্বরআনে প্রশংসিত ইনজীলের সাথে সামান্য সামঞ্জস্য-ই বহন করছে, যদি আদৌ করে থাকে। এ অভিযোগটিকে নিম্নের প্রশ্নগুলোর যে কোনো একটির দ্বারা খণ্ডন করা যায়: ধর্মপুস্তকগুলোর কোথায় এ সব পরিবর্তন সাধন করা হয়েছে? আপনি কি ইনজীলের একটি মূল কপি জোগাড় করতে পারবেন, যাতে আমি সেটার সাথে আমার বাইবেলটি মিলিয়ে দেখতে পারি? ইতিহাসের কোন্ সময় ওই মূল ও নির্ভুল ইনজীলটি প্রচলিত ছিলো?

২/ আমাদের সুসমাচারগুলো নাকি বিকৃত করা হয়েছে। পরবর্তী পাঁচটি প্রশ্ন এ ক্ষেত্রে যথাযথ এবং এগুলো জিজ্ঞেস করার পূর্ণ অধিকার আমরা সংরক্ষণ করি:
(ক) ওই বিকৃতি বা পরিবর্তন ইচ্ছাকৃত ছিলো কি?
(খ) ওই ধরনের বিকৃত কোনো উদ্ধৃতি আপনি আমার বাইবেল থেকে দেখাতে পারবেন কি?
(গ) উদ্ধৃতিটি মৌলিক অবস্থায় কী রকম ছিলো?
(ঘ) কখন, কার দ্বারা, কীভাবে বা কেনো এটা বিকৃত অথবা পরিবর্তিত হয়েছিলো?
(ঙ) সেই বিকৃতি কি মূল লিপিতে, না ভাবার্থে?

৩/ আমাদের সুসমাচারগুলো নাকি মূল ইনজীলের ‘জাল।’ অথবা এগুলো নাকি যীশুর প্রতি অবতীর্ণ মহান ইনজীল নয়, বরং মানুষের হাতের কারসাজি। সামান্য একটু জিজ্ঞাসাবাদ-ই এই প্রকৃত ঘটনাকে পরিস্ফুট করবে, যে মুসলমান অভিযোগটি উত্থাপন করছেন তিনি প্রাচীনকালে ও বর্তমানে বিরাজমান বাইবেল বা ‘নতুন নিয়ম’ সম্পর্কে সন্তাপজনকভাবে অজ্ঞ।

এই আলোচনার বাকি অংশে যাবার আগে একটি বিষয় স্মরণ করিয়ে দেয়া জরুরি যে, যখন-ই আপত্তি উত্থাপনকারী তাঁর ওই ধরনের অভিযোগের ভিত্তিহীনতা সম্পর্কে অনুভব করতে ইচ্ছুক হবেন, তৎক্ষণাৎ আমাদেরকে আমাদের পুস্তকগুলো থেকে কিছু শিক্ষা প্রচার করতে হবে, যাতে আমাদের চেষ্টা ইতিবাচক হয়, নেতিবাচক না হয়।” [জিও জি, হ্যারিস]

মুসলমানবৃন্দের কাছে এর জবাব আছে কি?

আমাদের মুসলমানদের কি এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর-ই নেই? সহৃদয় পাঠক, আপনি এ পুস্তিকাটি পুরোটুকু পড়ে থাকলে নিশ্চয় স্বীকার করবেন যে জিও জি, হ্যারিস সাহেবের পায়ের নিচে দাঁড়াবার মতো আর মাটি নেই। তাঁর দাবিগুলো ভ্রান্ত প্রমাণ করতে যেয়ে আমি বাইবেল থেকে বাস্তবিক উদ্ধৃতিসমূহ প্রদর্শন করতে সক্ষম হয়েছি।

চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি মুসলিম সমাজ

মুসলমানদেরকে কোণঠাসা করার জন্যে জিও জি, হ্যারিস সাহেব নিজ পুস্তকে তাঁরই সহকর্মীদেরকে একটি মৌলিক মিশনারী রীতি শিক্ষা দিচ্ছেন: 

“এই অধ্যায়ে এটা ধরে নেয়া হয়েছে যে আমাদের পুস্তকগুলোর প্রামাণিকতা ও অকৃত্রিমতার প্রতি মুসলিম সমাজ অভিযোগ উত্থাপন করেছেন। এ-ই যখন অবস্থা, তখন আমরা আত্মপক্ষ সমর্থনের চেষ্টা করার আগে একটি বুনিয়াদি নিয়ম স্মরণে রাখবো। প্রমাণ করার দায়িত্বটি মুসলমানদের কাঁধে ন্যস্ত।” [আল-হামদু লিল্লাহ! পাঠক অবশ্যই একমত হবেন, এ পুস্তিকায় এবং আমার অন্যান্য পুস্তিকায় আমরা মুসলিম সমাজ সদাসর্বদা এ খ্রীষ্টান চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করছি।] 

আল্লাহতা’লার প্রতি সমস্ত প্রশংসা এ কারণে যে, খ্রীষ্টান মিশনারীদের দুঃসাহসিক চাহিদানুযায়ী বাইবেলের প্রামাণিকতাকে ভ্রান্ত প্রমাণ করার প্রক্রিয়ায় উৎসর্গিত আমার চল্লিশ বছরে আমি বিজয়মাল্য ছিনিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছি। মনে রাখবেন, আমরা মুসলিম সমাজ মানুষের দরজায় দরজায় যেয়ে আমাদের ধর্মকে ফেরি করি না। পক্ষান্তরে, বিভিন্ন ডিনোমিনেশানের খ্রীষ্টান মিশনারীবর্গ আমাদের আতিথ্যের সুযোগ নিয়ে অসতর্ক মুসলমানদের হেনস্তা করার অসৎ উদ্দেশ্যে আমাদেরই ব্যক্তিগত ধর্মবিশ্বাসের প্রতি আঘাত হেনে থাকেন এবং আমাদের শান্তিপূর্ণ জীবন যাপনে ব্যাঘাত সৃষ্টি করেন। 

মুসলমান যাঁরা খ্রীষ্টান মিশনারীদের দ্বারা কোণঠাসা হওয়ার পরও সত্য উপস্থাপনে ভীতসন্ত্রস্ত - যে মিশনারীবর্গ এমন কী আমাদের প্রিয়নবী (صلى اللّٰه عليه وسلم)-কেও হেয় প্রতিপন্ন করতে কুণ্ঠিত হন না - তাঁদের নিজ নিজ ঈমান পুনঃপরীক্ষা করা উচিৎ।

এই প্রভাষণগুলো আমি সেসব পিচ্ছিল মিশনারীর স্বরূপ উন্মোচনের উদ্দেশ্যে দিয়ে থাকি, যাঁরা নিজের কাজে ব্যস্ত অসতর্ক মুসলমানদের ঘরবাড়ি আক্রমণ করতে অভ্যস্ত। 

এসব প্রভাষণের আরেকটি লক্ষ্য হলো, মুসলমানবৃন্দের ভূলুণ্ঠিত গৌরব পুনরুদ্ধার করা, যা খ্রীষ্টবাদের ফেরিওয়ালার নির্মম আক্রমণের শিকার হয়েছে। চ্যাটস্-ওয়ার্থ, হ্যানোভার পার্ক অথবা বিভারলী’র গরিব মুসলমানদের জিজ্ঞেস করুন কীভাবে নির্দিষ্ট কয়েকজন মিশনারী তাঁদেরকে হেনস্তা করে থাকেন। [নোট: উক্ত টাউনগুলো সেসব টাউনের কয়েকটি, যেখানে দক্ষিণ আফ্রিকী Group Areas Act-এর অধীনে গরিব মুসলমানদের বসবাস করতে বাধ্য করানো হয়।]

আমার এই সামান্য অবদান ‘বাইবেল কি খোদার বাণী?’ পুস্তিকাটি যদি খ্রীষ্টান আতঙ্কের বিরুদ্ধে প্রতিটি মুসলিম পরিবারে রক্ষাকবচ হিসেবে স্থান পায়, তাহলে আমার এ প্রয়াস পর্যাপ্ত পুরস্কার লাভ করবে। 

আরো বড় একটি পুরস্কার পাওয়া যাবে যদি পয়গাম্বর ঈসা মসীহ (যীশু খ্রীষ্ট)’এর কোনো আন্তরিক/একনিষ্ঠ অনুসারী অন্ততঃপক্ষে সত্যের দিকে পরিচালিত হন এবং ভ্রান্তি ও মিথ্যের বেড়াজাল ছিন্ন করতে পারেন।

তবে সবচেয়ে বড় পুরস্কারটি আমার আল্লাহতা’লার কাছে নিহিত, যাঁর দরবারে আমি হেদায়াত ও অনুগ্রহ প্রার্থনা করি এবং পরম বিনয় সহকারে কামনা করি যেনো তিনি আমার এ প্রয়াসকে ক্ববূল/গ্রহণ করে নেন, আমীন।

*সমাপ্ত*