ব্লগ সংরক্ষাণাগার

সোমবার, ২৪ ডিসেম্বর, ২০১৮

মহিলাদের দ্বারা মাযার যেয়ারতের পক্ষে প্রমাণ

মূল: ড: জি, এফ, হাদ্দাদ
অনুবাদ: এডমিন

[Bengali translation of Dr G.F. Haddad's online article "Proofs for visitation of Graves by Women." Translator: Admin]
 “সবচেয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত হলো, মহিলাদের জন্যে মাযার-রওযা যেয়ারতের রুখসাতের তথা (বিধান) প্রয়োগের বিষয়টি দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত।” - ইমাম ইবনে আবেদীন শা’মী [নোট-১: ইবনে আবেদীন কৃত ‘হা’শিয়া’ (১৩৮৬ হিজরী/১৯৬৬ খৃষ্টাব্দ সংস্করণ, ২:২৪২)]

শায়খ সাইয়্যেদ ইঊসুফ হা’শিম আল-রেফাঈ (রহমতুল্লাহে আলাইহে যিনি কুয়েতের সাবেক তেলমন্ত্রী ছিলেন, তিনি) তাঁর প্রণীত ‘আমাদের নজদী উলামা ভাইদের প্রতি নসীহত’ শীর্ষক পুস্তিকায় (ড: হাদ্দাদ কর্তৃক ইংরেজি ভাষান্তরিত) বলেন: “আপনারা মতৈক্যভিত্তিক স্পষ্ট ও মীমাংসাকারী শরঈ দলিল ছাড়াই মহিলাদেরকে পবিত্র বাক্বী’ (কবরস্থান) যেয়ারত করতে নিষেধ করেন!”

নিচের আলোচনায় খোদায়ী বিধিবিধানের মৌলনীতি (উসূল) ও সুন্নাহর দালিলিক প্রমাণ অনুসারে বাক্বী’ কবরস্থান যেয়ারতের অনুমতি প্রদর্শন করা হবে।

মহিলাদের দ্বারা মাযার-রওযা যেয়ারতের প্রতি যারা আপত্তি উত্থাপন করেন, তারা মূলতঃ তিনটি হাদীসকে নিজেদের প্রমাণ হিসেবে পেশ করে থাকেন; এগুলোর মধ্যে দুটি আবার যঈফ (দুর্বল সনদের) হাদীস: (ক) “আল্লাহ সে সমস্ত নারীদের প্রতি লা’নত/অভিসম্পাত দেন যারা মাযার/রওযা যেয়ারত করে” لعن الله زائرات القبور [নোট-২: হযরত আবূ হোরায়রাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে দুর্বল সনদে ইবনে হিব্বান নিজ ‘সহীহ’ ৭:৪৫২ #৩১৭৮ পুস্তকে বর্ণিত; কেননা উমর ইবনে আবী সালামা ইবনে আবদির রাহমান দুর্বল, যেমনটি উল্লেখ করেছেন আল-আরনা’উত ও মা’রূফ ‘তাহরীর আল-তাক্বরীব’ ৩:৭৪ #৪৯১০ গ্রন্থে। আরো এসেছে দুর্বল সনদে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) হতে হযরত হাসান বিন সাবেত (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’এর সূত্রে ইবনে আবী শায়বা (৩:৩১)’তে; কেননা এতে জনৈক বর্ণনাকারী আবদুর রাহমান ইবনে বাহমান হচ্ছেন মাজহূল তথা অপরিচিত। তবে খোদ হাদীসটি গ্রহণযোগ্য, যেহেতু এটা ‘হাসান লি-গায়রিহি’ তথা ‘সাক্ষী ও সমর্থনকারী সনদ এবং বিবরণসমূহের কারণে হাসান পর্যায়ের’, যেমনটি বিবৃত করেন আল-আরনা’উত ‘মুসনাদ’ ৫:১২৮ নং ২ পুস্তকে]; এবং (খ) “আল্লাহ সেসব নারীর প্রতি অভিসম্পাত দেন যারা কবর যেয়ারত করে এবং সেগুলোকে এবাদতের ও প্রদীপ/মোমবাতির স্থান হিসেবে গ্রহণ করে” لعن زائرا القبور، والمتخذين عليها المساجد والسرج [নোট-৩: হযরত ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে ইমাম তিরমিযী (রহ:)-বর্ণিত (হাসান পর্যায়ের) এবং আবূ দাউদ ও আল-নাসাঈ বর্ণিত ‘আল-সুনান’ ও আল-সুনান আল-কুবরা’ গ্রন্থ দুটোতে (১:৬৫৭ #২১৭৪), ইমাম আহমদ, ইবনে আবী শায়বাহ (২:১৫১, ৩:৩০), আল-তাহাবী কৃত ‘শরহু মুশকিল আল-আসা’র’ (১২:১৭৮-১৭৯ #৪৭৪১-৪৭৪২), আল-বাগাবী ‘শরহুস্ সুন্নাহ’ (২:৪১৬-৪১৭ #৫১০), ইবনে হিব্বান (৭:৪৫২-৪৫৪ #৩১৭৯-৩১৮০), অাল-হাকিম (১৯৯০ সংস্করণের ১:৫৩০) যিনি এটার দুর্বলতা ইঙ্গিত করেন, আল-বায়হাক্বী ‘আল-সুনান আল-কুবরা’ (৪:৭৮ #৬৯৯২), ইবনে আল-জা’আদ নিজ ‘মুসনাদ’ গ্রন্থে (২২৪ পৃষ্ঠায়), আল-তাবারানী ‘আল-কবীর’ (১২:১৪৮) পুস্তকে, এবং আল-হায়তামী ‘মাওয়ারিদ আল-যামআন (২০০ পৃষ্ঠায়) - এগুলোর সব একই দুর্বল সনদে বর্ণিত, যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন আবূ সালেহ মওলা উম্মে হানী, যাকে দুর্বল বলেছেন ইবনে হাজর, যেমনটি উদ্ধৃত করেছেন আল-মুনযিরী নিজ ‘আল-তারগীব’ পুস্তকে (১৯৯৭ সংস্করণের ৪:১৯০) এবং অাল-অারনা’উত ‘সহীহ ইবনে হিব্বান’ ও ‘মুসনাদ’ (৫:১২৮ #২৯৮৪) পুস্তকে। তবে হাদীসটি স্বয়ং গ্রহণযোগ্য, কেননা আল-তিরমিযী ও আল-বাগাবী এটাকে ‘হাসান’ পর্যায়ের বলে ঘোষণা করেছেন; অধিকন্তু ইবনে আল-সাকান এটাকে সহীহ হাদীসের অন্তর্ভুক্ত করেন, যেমনটি বিবৃত করেন ইবনে মুলাক্কিন ‘তোহফাতুল মোহতাজ’ (২:৩১) পুস্তকে]; তৃতীয় হাদীসটি - (গ) “অাল্লাহ ওই নারীদের প্রতি অভিসম্পাত দেন যারা ঘনঘন কবর যেয়ারত করে” لعن الله زوارات القبور [নোট-৪: হযরত আবূ হোরায়রাহ রাদ্বিয়াল্লাহু হতে আল-তিরমিযী (হাসান সহীহ), ইবনে মাজাহ ও আহমদ; হযরত ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে আবূ সালিহ’র কারণে দুর্বল সনদে ইবনে মাজাহ; এবং হযরত হাসান বিন সাবিত রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে আবদুর রাহমান ইবনে বাহমানের কারণে দুর্বল সনদে ইবনে মাজাহ ও আহমদ। নোট: ইবনে মাজাহ’র সংস্করণে زوارات উল্লেখিত হয়েছে]।

শায়খ রেফাঈ (রহ:)’র কথানুযায়ী ওপরের বিবরণগুলো ইসলামে মহিলাদের দ্বারা মাযার-রওযা যেয়ারত নিষেধকারী ‘মতৈক্যভিত্তিক স্পষ্ট ও মীমাংসাকারী শরঈ দলিল হিসেবে সাব্যস্ত হয় না।’ সেই অনুযায়ী সংখ্যাগরিষ্ঠ উলামা ঐকমত্য পোষণ করেন যে মহিলাদের দ্বারা মাযার/রওযা যেয়ারত করা জায়েয, যদি প্রলোভন ও পাপের বিপদ বর্তমান না থাকে [নোট-৫: যেমনটি বর্ণিত হয়েছে ইবনে হাজরের ‘ফাতহুল বারী’ (১৯৫৯ সংস্করণের ৩:১৪৮) পুস্তকে, আল-শওকানীর ‘নায়ল আল-আওতার’ (জানায়েয ও কবর সংক্রান্ত ফতোয়া অধ্যায়গুলো), এবং আল-মোবারকপুরীর ‘তোহফাতুল আহওয়াযী (৪:১৩৯)]

উপরোল্লিখিত বক্তব্য নিম্নের প্রামাণ্য দলিল দ্বারা সুপ্রতিষ্ঠিত:

১/ - প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) এরশাদ ফরমান - كنت نهيتكم عن زيارة القبور ألا فزوروها অর্থাৎ, “আমি তোমাদেরকে প্রাথমিক যুগে কবর যেয়ারত করতে নিষেধ করতাম; এখন তোমরা কবর যেয়ারত করো” [নোট-৬: একটি দীর্ঘ হাদীসের অংশ হিসেবে বর্ণনা করেন হযরত বোরায়দা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে ইমাম মুসলিম (রহ:), আল-তিরমিযী حسن صحيح (হাসান সহীহ), আবূ দাউদ, নাসাঈ, আবদুর রাযযাক্ব (৩:৫৬৯) ও অন্যান্যরা; হযরত আবূ সাঈদ আল-খুদরী (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে সহীহ সনদে ইমাম আহমদ (রহ:), যেমনটি বিবৃত করেছেন আল-হায়তামী (৩:৫৮), মালেক (রহ:), আল-হাকিম (১৯৯০ সংস্করণের ১:৫৩১) যিনি ইমাম মুসলিমের মানদণ্ডে এটাকে সহীহ বলেছেন, আল-বায়হাক্বী কৃত ‘আল-সুনান আল-কুবরা’ (৪:৭৭ #৬৯৮৪), এবং সহীহ সনদে আল-বাযযার, যেমনটি উল্লেখ করেছেন আল-হায়তামী (৩:৫৮); হযরত ইবনে মাসউদ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে ইবনে মাজাহ, আদ-দারাক্বুতনী নিজ ‘সুনান’ (৪:২৫৯) পুস্তকে, আবদুর রাযযাক্ব (৩:৫৭২-৫৭৩), ইবনে হিব্বান (৩:২৬১), আল-হাকিম (১৯৯০ সংস্করণের ১:৫৩১) এবং আল-বায়হাক্বী নিজ ‘আল-সুনান আল-কুবরা’ (৪:৭৭ #৬৯৮৩), যা আল-আরনাউতের মতানুসারে (এ সূত্রের) সবগুলোই দুর্বল সনদের; হযরত আনাস (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে ইমাম আহমদ ও আল-বাযযার, যাঁদের এসনাদে রয়েছেন আল-হারিস ইবনে নাবহান যিনি আল-হায়তামী (৪:২৭), আল-হাকিম (১৯৯০ সংস্করণের ১:৫৩১-৫৩২) ও আল-বায়হাক্বী (সুনানে কুবরা ৪:৭৭ #৬৯৮৪)’র দৃষ্টিতে দুর্বল বর্ণনাকারী]। এই নিঃশর্ত অনুমতি স্রেফ পুরুষদের জন্যে খাস তথা সুনির্দিষ্ট করার পক্ষে কোনো প্রামাণ্য দলিল-ই নেই।

২/ - হযরত আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা বলেন: “রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) কবর যেয়ারত নিষেধ করেন; অতঃপর এর অনুমতি দেন। আর আমার মনে হয় তিনি বলেছিলেন, ‘নিশ্চয় কবর যেয়ারত তোমাদেরকে আখেরাতের কথা স্মরণ করিয়ে দেবে’ [নোট-৭: আল-বাযযার কর্তৃক নির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারীদের সহীহ সনদে বর্ণিত, যেমনটি বিবৃত করেন আল-হায়তামী (৩:৫৮); বঙ্গানুবাদকের নোট: মুসলিমে অন্য সূত্রে বর্ণিত আরেকটি হাদীসের এবারতে এসেছে এভাবে - فإنها تذكركم الآخرة]।” হযরত মা আয়েশা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা)’র অনুশীলিত রীতি ও অন্যান্য মন্তব্য নিশ্চিত করেছে যে তিনি প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’র এই আজ্ঞাকে নিঃশর্ত জানতেন।

৩/ - হযরত আয়েশা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা) তাঁর ভাইয়ের ইন্তেক্বালের পরে মক্কা শরীফে এসে জিজ্ঞেস করেন, “আমার ভাইয়ের কবর কোথায় অবস্থিত?” তিনি কবরে গিয়ে সেখানে দুআ পাঠ করেন; আর এই ঘটনাটি তাঁর ভাইয়ের ইন্তেকালের এক মাস পরের [নোট-৮: ইবনে আবী মুলায়কা হতে বর্ণনা করেন আল-বায়হাক্বী নিজ ‘আল-সুনান আল-কুবরা (৪:৪৯) গ্রন্থে]। আরেকটি ভাষ্যে ইবনে আবী মুলায়কা বলেন, “হযরত আয়েশা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা)’র ভাই মক্কা শরীফ হতে ছয় মাইল দূরে ইন্তেক্বাল করেন; তাই আমরা তাঁকে বহন করি যতোক্ষণ না মক্কা শরীফে পৌঁছুই এবং তাঁকে সেখানে দাফন করি। অতঃপর হযরত আয়েশা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) আমাদের কাছে আসেন এবং আমাদেরকে ওরকম করার জন্যে তিরস্কার করেন। এরপর তিনি জিজ্ঞেস করেন, ‘আমার ভাইয়ের কবর কোথায় অবস্থিত?’ আমরা তাঁকে তা প্রদর্শন করলে তিনি তাঁর হাওদা (সওয়ার) থেকে নামেন এবং তাঁর ভাইয়ের কবরে (দাঁড়িয়ে) দুআ করেন” [নোট-৯: আবদুর রাযযাক্ব (৩:৫১৮) ও ইবনে আবদিল বার্র কর্তৃক নিজ ‘আল-তামহীদ’ (৬:২৬১) গ্রন্থে বর্ণিত]

৪/ - আবুদুল্লাহ ইবনে আবী মুলায়কা যখন হযরত আয়েশা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা)’কে তাঁর ভাই আবদুর রাহমানের মাযার যেয়ারত করতে দেখেন, তখন তিনি তাঁকে জিজ্ঞেস করেন: “প্রিয়নবী (দ:) কি এটা (মানে যেয়ারত) নিষেধ করেননি?” তিনি উত্তর দেন: “হ্যাঁ, তিনি নিষেধ করেছিলেন (প্রাথমিক যুগে); অতঃপর সেগুলোর যেয়ারত করতে আদেশ করেন” [নোট-১০: এটা সহীহ সনদে বর্ণনা করেন আবূ এয়ালা (৮:২৮৪), আল-হাকিম (১৯৯০ সংস্করণের ১:৫৩২), আল-বায়হাক্বী নিজ ‘আল-সুনান আল-কুবরা’ (৪:৭৮ #৬৯৯৩), এবং ইবনে আব্দিল বার্র নিজ ‘আল-তামহীদ’ (৩:২৩৪) পুস্তকে]। ইবনে আবদিল বার্র উল্লেখ করেন যে ইমাম আহমদ (রহ:) এই বর্ণনাকে মহিলাদের দ্বারা মাযার যেয়ারতের পক্ষে দলিল হিসেবে সাব্যস্ত করেন [নোট-১১: ইবনে আবদিল বার্র কৃত ‘আল-তামহীদ’ (৩:২৩৪)]

ওপরে উদ্ধৃত রওয়ায়াত/বর্ণনাগুলোতে মহানবী (দ:) ও তাঁর সাহাবা-এ-কেরাম (রা:)’এর ব্যবহৃত বাক্য ও ক্রিয়ার কাল প্রতীয়মান করে যে এসব বিবরণ সুস্পষ্টভাবে নিষেধাজ্ঞা প্রকাশক বর্ণনাগুলোকে রহিত করে দিয়েছে। এটা আল-হাকিম নিশ্চিত করেন, যিনি বর্ণনা করেন নিম্নের হাদীসটি: “আল্লাহ সেসব নারীকে অভিসম্পাত দেন যারা ঘনঘন কবর যেয়ারত করে।” অতঃপর আল-হাকিম বলেন: “মাযার/রওযা যেয়ারত নিষেধকারী এ সমস্ত হাদীস রহিত হয়ে গিয়েছে; আর রহিতকারী হাদীসটি বর্ণনা করেছেন আলক্বামা ইবনে মারতাদ, যিনি তা গ্রহণ করেছেন সুলায়মান ইবনে বোরায়দা হতে, তিনি তাঁর পিতা হতে, তিনি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) হতে, যিনি এরশাদ ফরমান: ‘আমি তোমাদেরকে কবর যেয়ারত করতে নিষেধ করেছিলাম; কিন্তু এখন তোমরা তা যেয়ারত করো’ [নোট-১২: আল-হাকিম (১৯৯০ সংস্করণ ১:৫৩০)]।”

৫/ - (শরীয়তের বিধিবিধান মানার ক্ষেত্রে) হযরত আয়েশা সিদ্দীক্বা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা)’র দৃঢ়তার কারণে এবং হয়তো ইবনে আবী মুলায়কা’র কথার সমর্থনের দরুন তিনি তাঁর ভাই আবদুর রহমানের কবর যেয়ারত করাটা অপছন্দ করতেন, যেমনটি প্রতীয়মান হয় আল-তিরমিযী’তে উদ্ধৃত তাঁর এতদসংক্রান্ত বক্তব্য হতে; তিনি বলেন: “আমি আপনার ইন্তেক্বালের সময় উপস্থিত থাকলে আমি কখনোই (মানে এখন) আপনার কবর যেয়ারত করতাম না” [নোট-১৩: আবদুল্লাহ ইবনে মুলায়কা হতে আল-তিরমিযী বর্ণিত]। অথচ এটা আরেকটা প্রামাণিক দলিল এ মর্মে যে তিনি প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’র ওই (মাযার যেয়ারতের) নিষেধাজ্ঞাকে নিঃশর্ত বলে জানতেন না - তা যদি রহিত না হতো; কেননা তিনি এতদসত্ত্বেও তাঁর ভাইয়ের কবর যেয়ারত করেছিলেন।

৬/ - একবার মহানবী (দ:) জনৈক মহিলার পাশ দিয়ে অতিক্রম করছিলেন, যিনি একটি কবরের পাশে কান্নাকাটি করছিলেন। হুযূর পাক (দ:) তাঁকে বলেন: “আল্লাহকে ভয় করো এবং দৃঢ়/অটল থাকো।” ওই মহিলা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’কে চিনতে না পেরে উত্তর দেন: “আমায় একান্তে থাকতে দিন!” অতঃপর তাঁকে জানানো হয় উনি মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)। মহিলা হুযূরে পাকের (দ:) দর্শনার্থী হতে আসেন এবং দরজায় কাউকে না পেয়ে (সরাসরি প্রবেশ করে) বলেন: “আমি আপনাকে চিনতে পারিনি, (এয়া রাসূলাল্লাহ)!” তিনি উত্তর দেন: “দৃঢ়তা প্রথমবার শোকাহতের সময় হতেই” [নোট-১৪: হযরত আনাস (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে সিহাহ সিত্তা/ছয়টি বিশুদ্ধ হাদীসগ্রন্থে]। মহিলাদের যদি মাযার-রওযা যেয়ারতে নিষেধই করা হতো, তাহলে মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) ওই মহিলাকে প্রথমবারেই তা করা হতে বারণ করতেন।

৭/ - হযরত আয়েশাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা) বলেন: “(বাক্বী কবরস্থানে) আমি কী বলবো, এয়া রাসূলাল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)?” হুযূর পাক (দ:) উত্তর দেন: “বলো: ওহে কবরবাসী ঈমানদার নর-নারী, আপনাদের প্রতি সালাম তথা শান্তি বর্ষিত হোক! আল্লাহ আপনাদের মতো পূর্ববর্তীদের প্রতি এবং আমাদের মতো পরবর্তীদের প্রতি তাঁর অনুগ্রহ মঞ্জুর করুন। নিশ্চয় আল্লাহর ইচ্ছায় আমরা আপনাদের সাথেই মিলিত হবো” [নোট-১৫: মুসলিম ও নাসাঈ বর্ণিত একটি দীর্ঘতর হাদীসের অংশ]

আল-বায়হাক্বী, ইবনে হাজর ও আল-নববী বলেন ওপরের বর্ণনাগুলো পরিদৃষ্ট করে যে, হযরত আয়েশাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা) কর্তৃক তাঁর ভাইয়ের কবর যেয়ারতের সমর্থনে মহিলাদের দ্বারা মাযার-রওযা যেয়ারত অনুমতিপ্রাপ্ত/জায়েয; কেননা মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) ওই শোক প্রকাশকারিনী মহিলাকে কেবল দৃঢ় হতে আদেশ দিয়েছিলেন, কবর যেয়ারত করতে নিষেধ করেননি। আর তিনি হযরত আয়েশা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা)’কে কবর যেয়ারতের সময় কী বলতে হবে, তা-ও শিক্ষা দিয়েছিলেন। [নোট-১৬: আল-বায়হাক্বী, ‘আল-সুনান আল-কুবরা’, (৪:৭৮); ইবনে হাজর, ‘ফাতহুল বারী’, (১৯৫৯ সংস্করণের ৩:১৮৪); আল-নববী, ‘শরহু সহীহ মুসলিম’ (৭:৪১-৪২)]

৮/ - প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) এরশাদ করেন: “আমি তোমাদেরকে কবর যেয়ারত করতে নিষেধ করেছিলাম, কিন্তু মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’কে তাঁর মায়ের কবর যেয়ারত করার অনুমতি দেয়া হয়েছে। অতএব, তোমরা কবর (মাযার/রওযা) যেয়ারত করো, কেননা নিশ্চয় তা তোমাদেরকে আখেরাতের কথা স্মরণ করিয়ে দেবে।” [নোট-১৭: হযরত বুরায়দা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে আল-তিরমিযী বর্ণিত (হাসান সিহীহ হিসেবে)]

৯/ - আরেকটি ভাষ্যে এভাবে এসেছে: “আমি তোমাদেরকে কবর যেয়ারত করতে নিষেধ করতাম; কিন্তু এখন থেকে যেয়ারত করো; কেননা তা আখেরাতের কথা কাউকে স্মরণ করিয়ে দেয়।” [নোট-১৮: হযরত বুরায়দা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে ইমাম আহমদের বর্ণিত একটি দীর্ঘতর হাদীসের অংশ]

১০/ - অপর একটি সংস্করণে বিবৃত হযেছে: “যে কেউ কবর যেয়ারত করতে চাইলে সে তা করতে পারবে; কেননা নিশ্চয় তা আখেরাতের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।” [নোট-১৯: হযরত বুরায়দা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে আল-নাসাঈ বর্ণিত একটি দীর্ঘতর হাদীসের অংশ]

১১/ - আরেকটি এবারতে এসেছে: “আমি তোমাদেরকে কবর যেয়ারত করতে নিষেধ করতাম; কিন্তু এখন থেকে যেয়ারত করো। কেননা তা দুনিয়াকে প্রত্যাখ্যান করতে সহায়তা করে এবং আখেরাতের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।” [নোট-২০: হযরত ইবনে মাসউদ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে ইবনে মাজাহ বর্ণিত হাদীস]

১২/ - অপর এক ভাষ্যে বিবৃত হয়েছে: “আমি তোমাদেরকে কবর যেয়ারত করতে নিষেধ করেছিলাম; অতঃপর আমার কাছে প্রতীয়মান হয়েছে যে তা অন্তরকে নরম করে, চোখে পানি আনে, আর পরকালের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। অতএব, তোমরা কবর যেয়ারত করো, কিন্তু গর্হিত কথাবার্তা (সেখানে) বোলো না!” [নোট-২১: হযরত আনাস (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে ইমাম আহমদ বর্ণিত দীর্ঘতর হাদীসের অংশ বিশেষ]

১৩/ - এই বিষয়টি প্রতিষ্ঠিত যে প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) হযরত উসমান ইবনে মায’উন (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’এর মাযারের ওপর একটি পাথর (ফলক) স্থাপন করে বলেন: “এর দ্বারা আমি আমার (দুধ-) ভাইয়ের কবর চিহ্নিত করবো এবং পরবর্তীকালে আমার আত্মীয়-স্বজনের কেউ ইন্তেক্বাল করলে এখানেই তাকে দাফন করবো।” [নোট-২২: নাম না জানা এক সাহাবী (রা:) হতে ‘হাসান সহীহ’ সনদে বর্ণনা করেছেন আবূ দাউদ ও আল-বায়হাক্বী নিজ ‘আল-কুবরা’ পুস্তকে (৩:৪১২); দেখুন ইবনে হাজর কৃত ‘তালখীস আল-হাবীর’ (২:১৩৪); ইবনে আল-মুলাক্কিন প্রণীত ‘তোহফাতুল মোহতাজ’ (২:২৯); এবং ইবনে আল-কাইয়্যেম জাওযিয়্যার রচিত ‘যাআদ আল-মাআদ’ (১:৫০৬) গ্রন্থের আল-আরনা’উত সংস্করণ। হাদীসটির পুরো বিবরণে ব্যক্ত হয়েছে যে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) জনৈক ব্যক্তিকে হযরত ইবনে মাযউন (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’এর মাযারের ওপর (ফলক চিহ্ন হিসেবে) একটি পাথর স্থাপন করতে বলেন; যখন ওই ব্যক্তি পাথরটি নড়াতে অক্ষম হন, তখন হুযূর পাক (দ:) নিজের জামার আস্তিন গুটিয়ে তাঁকে সাহায্য করেন, আর এমতাবস্থায় তাঁর ধবধবে সাদা হাত দৃশ্যমান হয়। মুহাজির সাহাবাবৃন্দের (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম) মধ্যে হযরত ইবনে মাযউন (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)-ই ছিলেন প্রথম, যাঁকে বাক্বী আল-গারক্বাদে দাফন করা হয়। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’র পুত্র ইবরাহীম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’কে তাঁর পাশে দাফন করা হয়] 

ওপরে উদ্ধৃত পাঁচটি রওয়ায়াত তথা বিবরণে মহিলাদের দ্বারা মাযার/রওযা যেয়ারতের সপক্ষে প্রমাণ পাওয়া যায় এই মর্মে যে, আখেরাতের স্মরণ, কান্নাকাটি ও অন্তর নরম হওয়ার মতো ইতিবাচক প্রভাবগুলো স্রেফ পুরুষদের জন্যেই খাস্ বা সীমাবদ্ধ করা হয়নি, বরং তা মহিলাদের জন্যেও বিস্তৃত করা হয়েছে। অতএব, এসব বিবরণ মহিলাদেরকেও উদ্দেশ্য করেছে, যা সার্বিকভাবে গ্রহণীয়। এটা প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’র কন্যা হযরত মা ফাতিমা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা)’র আচরিত রীতি দ্বারাও সমর্থিত, যেমনটি প্রতীয়মান হয়েছে নিচের দুটো বর্ণনায়:

১৪/ - ইমাম জা’ফর সাদিক্ব (রহমতুল্লাহে আলাইহে) নিজ এসনাদে বর্ণনা করেন ইমাম হাসান ইবনে আলী (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে এই মর্মে যে, হযরত মা ফাতেমা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা) প্রতি জুমুআ-বার [নোট-২৩: জা’ফর ইবনে মুহাম্মদ হতে, তিনি তাঁর বাবা হতে; ইমাম হাসান (রা:)’এর উল্লেখ ছাড়া আবদুর রাযযাক্ব কর্তৃক বর্ণিত (৩:৫৭২) যা মুনক্বাতী’ তথা সনদ কাটা] রাসূলুল্লাহ (দ:)’এর চাচা হযরতে আমীরে হামযা ইবনে আবদিল মুত্তালিব (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’এর মাযার যেয়ারত করতেন; আর তিনি সেখানে দুআ করতেন এবং কাঁদতেনও [নোট-২৪: হাকিম (১৯৯০ সংস্করণের ১:৫৩৩, ৩:৩০) কর্তৃক বর্ণিত, যিনি এটাকে সহীহ বলেছেন; আল-বায়হাক্বী কৃত ‘আল-সুনান আল-কুবরা’ (৪:৭৮), এবং ইবনে আবদ আল-বার্র রচিত ‘আল-তামহীদ’ (৩:২৩৪), যদিও আল-যাহাবী এটাকে তীব্রভাবে নাকচ করেন এবং আল-বায়হাক্বী এটার দুর্বলতার প্রতি ইঙ্গিত করেন]। আরেকটি ভাষ্যে এসেছে যে হযরত ফাতেমা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা) ওই মাযারকে চেনার জন্যে একটি পাথর দ্বারা চিহ্নিত করেন [নোট-২৫: আল-আতরাম ও ইবনে আবদ আল-বার্র এটা বর্ণনা করেন, যেমনটি উল্লেখ করেছেন আল-ক্বুরতুবী নিজ ‘তাফসীর’ গ্রন্থে (১০:৩৮১); একটি দুর্বল সনদে আবদুর রাযযাক্ব-ও (৩:৫৭৪), কেননা বর্ণনাকারী হিসেবে আল-আসবাগ ইবনে নুবাতা প্রত্যাখ্যাত (মাতরূক্ব)]। অপর এক ভাষ্যে বিবৃত হয়েছে যে হযরত মা ফাতেমা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা) ওই মাযার শরীফ রক্ষণাবেক্ষণ করতেন এবং প্রয়োজনে মেরামতও করতেন। [নোট-২৬: আল-হাকিম তিরমিযী, ‘নওয়া’দিরুল উসূল’ (আসল ১৫)]

১৫/ - মহিলাবৃন্দ হযরত রোক্বাইয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা)’র বেসালপ্রাপ্তিতে কান্নাকাটি করছিলেন; এমতাবস্থায় হযরত উমর ফারূক্ব (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) তাঁদেরকে নিষেধ করতে চান। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) তাঁকে বলেন, “অপেক্ষা করো, হে উমর!” অতঃপর তিনি বলেন: “(মহিলারা), শয়তানের কর্কশ আওয়াজ সম্পর্কে সতর্ক হও! যতোক্ষণ এটা (মানে কান্নাকাটি) চোখ ও অন্তর হতে নির্গত হয়, তা (খোদায়ী) রহমত বা করুণা হতে আগত; আর যখন এটা জিহ্বা ও হাত হতে প্রকাশিত হয় [নোট-২৭: অভিসম্পাত এবং আরব খৃষ্টান ও অমুসলমানদের দ্বারা আজো আচরিত শোকজ্ঞাপক গাল-চাপড়ানোর প্রথার প্রতি উদ্দিষ্ট], তা শয়তান হতে আগত।” এমতাবস্থায় হযরত মা ফাতেমা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা) হযরত রোক্বাইয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা)’র কবরে কাঁদতে আরম্ভ করেন এবং হযরত রাসূলে পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) তাঁর পবিত্র মুখমণ্ডল হতে অশ্রু নিজ মোবারক হাত দ্বারা মুছে দেন; অথবা বর্ণনাকারী বলেন, তাঁর মোবারক বাহু দ্বারা মুছে দেন। [নোট-২৮: হযরত ইবনে আব্বাস (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে ইমাম আহমদ বর্ণিত; আল-তায়ালিসী (২:৩৫১) ও আল-বায়হাক্বী কৃত ‘আল-সুনান আল-কুবরা’ (৪:৭০ #৬৯৪৬) যার এসনাদে রয়েছেন আলী ইবনে যায়দ ইবনে জুদান। আল-বায়হাক্বী এই হাদীসটিকে সহীহ বিবেচনা করেন, কেননা এটা সহীহ বিবরণসমূহ দ্বারা নিশ্চিত হয়েছে। একই এসনাদে এটা আংশিকভাবে বর্ণনা করেছেন আল-হাকিম (৩:১৯০; ১৯৯০ সংস্করণের ৩:২১০), যেখানে আল-যাহাবী বলেন: “এই সনদটি সালেহ তথা গৃহীত;’ তবে তাঁর ‘মীযান’ (৩:১২৯) পুস্তকে তিনি দাফনের সময় হযরত ফাতেমা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা)’র উপস্থিতির কারণে এই বর্ণনাকে ‘মুনকার’ তথা প্রত্যাখ্যাত শ্রেণিভুক্ত করেন]

হানাফী মাযহাবে মহিলাদের দ্বারা মাযার/রওযা যেয়ারত ততোক্ষণ পর্যন্ত জায়েয - যতোক্ষণ তাঁরা যথাযথ (শরঈ) পোশাক পরিধান করেন এবং অযথা অ-মাহরাম পুরুষের সংশ্রবে না আসেন; আর তাঁরা অনিয়মতান্ত্রিক আচরণ না করেন, যেমন - বিলাপসহ কান্নাকাটি। এই মাযহাবের মুখ্য রেফারেন্স-মূলক কেতাবগুলোর অন্যতম ‘ফতোয়া-এ-হিন্দীয়া’ (৫:৩৫০) পুস্তকে লিপিবদ্ধ আছে: “মহিলাদের দ্বারা মাযার/রওযা যেয়ারতের ব্যাপারে উলামাবৃন্দের মাঝে মতপার্থক্য বিদ্যমান। আল-সারাখসী বলেন যে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য মত হলো এটা ভ্রান্তি নয়।” আল-মাবসূত পুস্তকে (২৪:১০) আল-সারাখসী বলেন: “আমাদের (হানাফী) মাযহাবে (মাযার যেয়ারতের পক্ষে) সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য মত হলো এই যে, এটা (মানে রুখসাত তথা বিধান প্রয়োগের বিষয়টি) পুরুষ ও নারী উভয়েরই জন্যে প্রযোজ্য; কেননা বর্ণিত আছে যে হযরত মা আয়েশা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা) সব সময়ই মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’র রওযা মোবারক যেয়ারত করতেন, আর হজ্জ্বে গেলে তিনি তাঁর ভাই হযরত আবদুর রাহমানের (রা:) কবর শরীফ যেয়ারত করতেন...।” এই ঘটনার সত্যতা ইবনে নুজাইম তাঁর ‘আল-বাহর আল-রায়ক্ব’ গ্রন্থে নিশ্চিত করেছেন। ইবনে আবেদীন এই পুস্তকের ওপর লেখা তাঁর মহা ব্যাখ্যামূলক ‘মিনহাত আল-খালেক্ব হাশিয়াত আল-বাহর আল-রায়ক্ব’ কিতাবে (২:২১০) উদ্ধৃত করেন আল-রামলী (রহ:)’র কথা, যিনি বলেন: “অনেকের আচরিত প্রথার অনুসরণে মহিলারা নিজেদের দুঃখ-বেদনা পুনরায় জাগিয়ে তুলতে, কিংবা বিলাপসহ কান্নাকাটি করতে মাযার/রওযা যেয়ারতে গেলে তা তাদের জন্যে জায়েয নেই। হুযূরে পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’এর ঘোষিত - ‘আল্লাহতা’লা কবর যেয়ারতকারিনী নারীদের প্রতি অভিসম্পাত দেন’ - মর্মে হাদীস শরীফটিকে এভাবেই বোঝা হয়ে থাকে। আর যদি মহিলাবৃন্দ গভীর ধ্যান, অনুগ্রহ লাভ ও বরকত-আশীর্বাদ অন্বেষণের লক্ষ্যে আউলিয়ার (রহ:) মাযার যেয়ারত করেন, তাহলে বয়স্কা নারী হওয়ার শর্তে তা তাঁদের জন্যে ভ্রান্তি (বলে বিবেচিত) হবে না। তবে তারা যুবতী নারী হলে তা মকরূহ/অপছন্দনীয় হবে (মানে তাদের অংশগ্রহণের দরুন ফিতনার উদ্ভব হতে পারে)। মহিলাদের দ্বারা মাযার/রওযা যেয়ারত অবৈধ না হওয়ার পক্ষে প্রমাণ হিসেবে যে হাদীসটি পাওয়া যায়, তা হযরত আনাস বিন মালেক (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) বর্ণনা করেছেন, যা’তে প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলােইহে ওয়া সাল্লাম) একটি কবরের পাশে উপবিষ্ট ও ক্রন্দনরত জনৈক মহিলাকে অতিক্রম করছিলেন। তিনি তাঁকে বলেন, ‘আল্লাহকে ভয় করো এবং ধৈর্য ধরো’।” ফুক্বাহা তথা ফেক্বাহবিদমণ্ডলী এ থেকে সিদ্ধান্ত নেন যে বিষয়টি জায়েয, কেননা রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) তাঁকে কবর যেয়ারত করতে বারণ করেননি; বিষয়টি যদি অবৈধ হতো, তাহলে প্রিয়নবী (দ:)’র জন্যে ওই মহিলাকে নিষেধ করা বাধ্যতামূলক হতো। [নোট-২৯: এই প্যারাগ্রাফটি সামান্য সম্পাদনাসহ শায়খ ফারাজ রাব্বানী হতে সংগৃহীত]

মহিলাদের দ্বারা মাযার/রওযা যেয়ারতের প্রতি আপত্তিকারীদের প্রামাণ্য দলিলস্বরূপ প্রদর্শিত তিনটি হাদীসের প্রথম দুটো (ক এবং খ)’কে যদি সহীহ হিসেবে আমরা বিবেচনাও করি, যেমনটি করেছিলেন হাতে গোনা কতিপয় আলেম, তবুও সেগুলো নিষেধাজ্ঞার প্রমাণ সাব্যস্ত হবে না নিচের দুটো কারণে: প্রথমতঃ ইসলামের সঠিক মতানুযায়ী সেগুলো রহিত হয়ে গিয়েছে, যেমনটি ওপরে প্রদর্শিত হয়েছে। দ্বিতীয়তঃ সেগুলো একে অপরের স্পষ্ট ব্যাখ্যা দেয় এবং দালিলিক প্রমাণ হিসেবে (বিরোধীদের) পেশকৃত তৃতীয় (গ) হাদীসটিও সেগুলোকে খোলাসা করে এই অর্থে যে, ওই লা’নত/অভিসম্পাত নিঃশর্তভাবে মাযার যেয়ারতকারিনী মহিলাদের সাথে সংশ্লিষ্ট নয়, বরঞ্চ স্রেফ সেসব নারীদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য যারা (১) অতিমাত্রায় যেয়ারত করে এবং (২) যেয়ারতকালে কিছু শরীয়তগর্হিত কাজে লিপ্ত হয়, যেমনটি বিবৃত করেছেন সর্ব-ইমাম তিরমিযী, বাগাবী, তাহাবী, ক্বুরতূবী ও অন্যান্যরা [নোট-৩০: দেখুন - তিরমিযী নিজ ‘সুনান’ পুস্তকে, হযরত আবূ হোরায়রাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে ‘যাওয়ারাত’-সংক্রান্ত হাদীস বর্ণনাশেষে; আল-তাহাবী কৃত ‘শরহে মুশকিল আল-আসার’ (১২:১৭৯-১৮৬); আল-বাগাবী রচিত ‘শরহে আল-সুন্নাহ’ (২:৪১৭, ৫:৪৬৪); এবং আল-ক্বুরতূবী নিজ ‘তাফসীর’গ্রন্থে (২০:১৭০), যেমনটি উদ্ধৃত করেছেন আল-শওকানী তার ‘নায়ল আল-আওতার’ কিতাবে (জানাযা ও কবর যেয়ারত অধ্যায়গুলো দ্রষ্টব্য)]। এই খাস বা সুনির্দিষ্ট নিষেধাজ্ঞা এ বাস্তবতা দ্বারাও সমর্থিত যে, সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য/বিশুদ্ধ/সহীহ নিষেধাজ্ঞাসূচক হাদীসে ঘোষিত হয়েছে: “আল্লাহতা’লা সেসব নারীদের প্রতি অভিসম্পাত দেন, যারা ঘনঘন কবর যেয়ারত করে থাকে।” এর দরুন (বোঝা যায়) নিষেধাজ্ঞাটি স্পষ্টতঃ খাস, মহিলাদের একটি বিশেষ দলের প্রতি উদ্দিষ্ট; তাঁদের সবার প্রতি নয়।

এই খাস নিষেধাজ্ঞা পুরুষদের প্রতিও যে প্রযোজ্য, তার সমর্থন রয়েছে একটি হাদীসে যা’তে বিবৃত হয়েছে: “আল্লাহ ইহুদী ও খৃষ্টানদের প্রতি লা’নত দেন! (কেননা) তারা তাদের পয়গম্বর (আ:)’বৃন্দের মাযার/রওযাকে এবাদতগাহ হিসেবে গ্রহণ করেছিলো” [নোট-৩১: হযরত আয়েশাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা) হতে সর্ব-ইমাম বুখারী ও মুসলিমবর্ণিত]। এই পুরুষদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নিষেধাজ্ঞা আরেকটি হাদীস শরীফে সমর্থিত হযেছে যা’তে ব্যক্ত হয়েছে: “আমি তোমাদেরকে আগে কবর যেয়ারত করতে নিষেধ করেছিলাম; এখন থেকে যেয়ারত করো। কিন্তু তোমাদের প্রভু খোদাতা’লা যেসব কথায় রাগান্বিত হন সেগুলো উচ্চারণ কোরো না!” [নোট-৩২: হযরত আবূ সাঈদ খুদরী (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে আল-বাযযার সহীহ সনদে বর্ণনা করেন, যেমনটি বিবৃত করেন আল-হায়তামী (৩:৫৮); হযরত ইবনে আব্বাস (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে আল-আযদী নিজ ‘মুসনাদ’ পুস্তকে (১৯৪ পৃষ্ঠা); এবং হযরত আনাস (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে ইমাম আহমদ, আবূ এযালা (৬:২৭২) ও ইবনে আবী শায়বা (৩:২৯)]

এই দালিলিক প্রমাণ উপস্থাপনের সারমর্ম এই নয় যে আজকালের মুসলমান মহিলা নির্বিশেষে তাঁদের সবাইকেই মাযার/রওযা যেয়ারতের অনুমতি প্রদান; কেননা প্রলোভন ও পাপ আমাদের যুগে ব্যাপকভাবে বিরাজমান, আর মাযার যেয়ারতের শরঈ বিধিবিধানের প্রতি মাযার/রওযা যেয়ারতকারী পুরুষ ও যেয়ারতকারিনী নারী উভয় শ্রেণি-ই সামান্য আদবশীল নতুবা একেবারেই আদব-কায়দাশূন্য। আল-বায়হাক্বী (রহমতুল্লাহে আলাইহে)’র বক্তব্য তুলে ধরা এখানে অত্যুক্তি হবে না; তিনি বলেন: “মহিলাবৃন্দ যদি নিজেদেরকে জানাযা’র মিছিল থেকে দূরে রাখেন, কবরস্থানে না যান এবং কবর যেয়ারত না করেন, তাহলে তা তাঁদের ধর্মের জন্যে মঙ্গলজনক হবে; আর আল্লাহর তরফ থেকেই আগমন করে সাফল্য” [নোট-৩৩: আল-বায়হাক্বী, ‘আল-সুনান আল-কুবরা’ (৪:৭৮)]। আল-হাকিম আল-তিরমিযী তাঁর রচিত ‘নওয়া’দিরুল উসূল’ পুস্তকের ‘আসল-১৫’তে এই বক্তব্যের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ পেশ করেছেন।

তবু শহর/নগর ও গ্রামের কবরস্থানে সমসাময়িককালের যেয়ারতকারী মুসলমানদের এই নেতিবাচক অবস্থা আল-বাক্বী কবরস্থান যেয়ারতকারিনী মহিলাদের ক্ষেত্রে মোটেই প্রযোজ্য হবে না; (কেননা) সেখানে মদীনা মোনাওয়ারার স্বাভাবিক শিষ্টতার রীতি আবেগের বহিঃপ্রকাশকে বাধা দেয় এবং এই দুইয়ের মাঝে ভারসাম্য রক্ষা করে। এমতাবস্থায় সেখানে মুসলমান পুরুষদের পাশাপাশি তাঁদের অবস্থাকে নিষেধের পরিবর্তে অনুমতি দেয়া উচিত, যেমনটি উলামা-এ-ইসলামের প্রদত্ত ফতোয়া দ্বারা সমর্থিত হয়েছে, যা প্রয়াত আবদুল আযীয বিন বা’য, মুহাম্মদ ইবনে ইবরাহীম ইবনে আবদ আল-লাতীফ, হাম্মা’দ আল-আনসারী ও তার ছাত্রবর্গ বকর আবূ যায়দ, আবূ বকর আল-জাযায়রীর মতো হাতে গোনা কতিপয় ওহাবী বিরোধিতাকারী এবং হারামাইন শরীফাইনের ধর্মীয় পদে সমাসীন অন্যান্যদের দাবির খেলাফ।

মদীনা মোনাওয়ারায় অবস্থিত মসজিদে নববী ও বাক্বী কবরস্থানসহ সর্বত্র নিঃশর্ত নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগের প্রসঙ্গটি, যেটা নিয়ে সৌদি বকর আবূ যায়দ নিজ ‘জুয’ ফী যিয়ারাত আল-নিসা’ লিল-ক্বুবূর’ [নোট-৩৪: লেখকের ‘আল-আজযা’আ আল-হাদীসিয়্যা’ পুস্তকে অন্তর্ভুক্ত] শীর্ষক পত্রে জোরাজুরি করেন, আর তাঁর অদ্ভুত দাবি এই মর্মে  যে (ক) মুর্দার খাটিয়ার সাথে জানাযার মিছিলে মহিলাদের অংশগ্রহণের নিষেধাজ্ঞাসম্বলিত রওয়ায়াত-গুলো মাযার/রওযা যেয়ারতের বেলায়ও প্রযোজ্য হবে এবং (খ) ’যাওয়ারাত’ শব্দটি অশুদ্ধ এবং তা নারী যেয়ারতকারিনীদের অর্থে ‘যুওয়ারাত’ পড়তে হবে, ঘনঘন যেয়ারতের অর্থে গ্রহণ করা যাবে না [নোট-৩৫: এমন কী আল-মু’আল্লেমীও আপন ‘এমারাত আল-ক্বুবূর’ পুস্তকের ১৫৬ পৃষ্ঠায় এটাকে ‘যাওয়ারাত’ পাঠ করেন এবং এর অর্থ করেন ‘যারা ঘনঘন ক্ববর যেয়ারত করে’], সেই প্রসঙ্গটি সম্পর্কে বলবো: এ ধরনের দাবি অযৌক্তিক ও একগুঁয়েভাবে প্রামাণ্য দলিল অস্বীকার করা ছাড়া কিছুই নয়, আর এ আচরণটি আদি গোত্রীয় ও অসঙ্গতির পরিচিত উৎসমূল - ইবনে তাইমিয়া ও ইবনে ক্বাইয়্যেম আল-জাওযিয়্যার অন্ধ অনুসরণ বটে। কিন্তু পরিচিত ব্যক্তিদের অনুসরণের চেয়ে অনুসরণ-অনুকরণের বেশি হক্বদারিত্ব (অধিকার) হচ্ছে সত্যের।

মারওয়ান ইবরাহীম আল-কায়সী’র লিখিত Morals and Manners in Islam: A Guide to Aadaab (লিস্টার, ইংল্যান্ড: দ্য ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ১৯৮৬; পুনর্মুদ্রণ ১৯৮৯ ও ১৯৯১) শীর্ষক পুস্তকে কবরস্থান যেয়ারত ও মাযার/রওযার নির্মাণ (স্থাপত্য-কৌশল) সম্পর্কে নিম্নবর্ণিত ত্রুটি-বিচ্যুতি বিদ্যমান:

১/ - লেখক (৭১ পৃষ্ঠায়) বলেন: “কোনো মুসলমানের কবরস্থান যেয়ারতের উদ্দেশ্য দুটি : ইন্তেক্বালপ্রাপ্তদের জন্যে দুআ করা এবং আখেরাতের কথা নিজেকে স্মরণ করিয়ে দেয়া।” অথচ তৃতীয় একটি উদ্দেশ্য হচ্ছে বরকত আদায়; আর চতুর্থ উদ্দেশ্যটি হচ্ছে প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) ও আসহাবে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহম) এবং আউলিয়া কেরাম (রহমতুল্লাহে আলাইহে)’এর মাযার/রওযার মতো বিশেষ বরকতময় স্থানগুলো যেয়ারত করে সেখানে নিজের প্রয়োজন পূরণের জন্যে আবেদন-নিবেদন ও প্রার্থনা জানানো (মানে তাওয়াসসুল পালন)। ইসলামী উলামামণ্ডলীর মাঝে এজমা’ তথা ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে)’র রওযা মোবারক যেয়ারত করার উদ্দেশ্যে সফর করা পছন্দনীয় এবাদত (ক্বুরবাত), যেমনটি সাব্যস্ত হয়েছে ইমাম ক্বাজী আয়ায (রহমতুল্লাহে আলাইহে)’এর ‘শেফা শরীফ’ গ্রন্থে; আর ইমাম শাফেঈ (রহমতুল্লাহে আলাইহে)’র কাছ থেকে সহীহ বর্ণনায় এসেছে যে তিনি নিজের প্রয়োজন মেটানোর উদ্দেশ্যে ইমাম আবূ হানীফা (রহমতুল্লাহে আলাইহে)’র মাযার যেয়ারত করে তাঁকে অসীলা করতেন। [নোট-৩৬: আল-খতীব কৃত ‘তারীখে বাগদাদ’ (১:১২৩) এবং ইবনে আবী আল-ওয়াফা প্রণীত ‘তাবাক্বাত আল-হানাফিয়্যা’ (৫১৯ পৃষ্ঠা)]

২/ - বইয়ের একই পৃষ্ঠায় ওই লেখক দুর্বল এক মন্তব্য করেন: “কবরস্থানে অবস্থানকালীন ইসলামী শিক্ষা/বিধানের লঙ্ঘন (নিষিদ্ধ)।” নিশ্চয় সেটা কোনো সময়ই বা কোনো স্থানেই অনুমতিপ্রাপ্ত নয়! আর এটাই হলো ফিক্বাহ-শাস্ত্রে বিজ্ঞ ‍ও অভিজ্ঞ উলামাবৃন্দের সতর্কতাপূর্ণ বাক্য-বিন্যাস হতে বিচ্যুতির বিপদ।

৩/ - ওই লেখক একই পৃষ্ঠায় আরো বলেন: “কবরস্থানে ‘ওহে কবরবাসী ঈমানদার নর-নারী, আপনাদের প্রতি সালাম তথা শান্তি বর্ষিত হোক! আল্লাহ আপনাদের মতো পূর্ববর্তীদের প্রতি এবং আমাদের মতো পরবর্তীদের প্রতি তাঁর অনুগ্রহ মঞ্জুর করুন। নিশ্চয় আল্লাহর ইচ্ছায় আমরা আপনাদের সাথেই মিলিত হবো’ - এই কথাটি বলা এবং ইন্তেক্বালপ্রাপ্তদের জন্যে দুআ করা ছাড়া আর কিছুই বলা যাবে না।” বইয়ের ১৭৯ পৃষ্ঠায় লেখক দাবি করেন: “কেউ ইন্তেক্বাল করার পর তাঁর জন্যে তালক্বীন (বিশেষ উপদেশজ্ঞাপক অনুশীলনী) করা একটি বেদআত।” আসলে লেখকের এসব কথাই ভ্রান্তি, কেননা দাফনের পরে ইন্তেক্বালপ্রাপ্তদেরকে তালক্বীন/নির্দেশনা দেয়া মোস্তাহাব (পছন্দনীয়) বা সুন্নাত, এমন কী শায়খ মুহাম্মদ ইবনে আবদিল ওয়াহহাব নজদীর লেখা ‘আহকাম তাম্মানী আল- মওত’ পুস্তকে পরিবেশিত তাঁর মতানুসারেও। এ ব্যাপারে বিস্তারিত দালিলিক প্রমাণ উপস্থাপিত হয়েছে Encyclopedia of Islamic Doctrine ও Reliance of the Traveler (৯২১-৯২৪ পৃষ্ঠা, ৩২.১-২)। কোনো মানুষ বেসালপ্রাপ্ত হওয়ার বাস্তবতা এই নয় যে তিনি (দুনিয়ায়) জীবিতদের শুনতে পান না। তথাকথিত আধুনিকতাবাদীদের এটা একটা মুখ্য বৈশিষ্ট্য যে এলমে গায়ব/অদৃশ্য জ্ঞানের সাথে সম্পৃক্ত অনেক আক্বীদা-বিশ্বাস ও অনুশীলনীকেই তাঁরা অস্বীকার করেন।

৪/ - লেখক বইয়ের ১৭১ পৃষ্ঠায় আরো দাবি করেন: “কোনো মাযার/রওযাকে বরকত লাভের উদ্দেশ্যে স্পর্শ করা নিষিদ্ধ (হারাম)।” এই ধারণাটিও ভুল; সঠিক ফায়সালা হলো এটা মকরূহ [বঙ্গানুবাদকের নোট: সাহাবী হযরত আবূ আইয়ূব আনসারী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর ঘটনার সূত্রে এতে উলামাদের মাঝে মতান্তর বিদ্যমান], যদিও ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহমতুল্লাহে আলাইহে)’এর মতো কিছু উলামার ফতোয়া অনুসারে প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’র রওযা শরীফ স্পর্শ, এমন কী চুম্বন করাতেও কোনো ক্ষতি নেই। আল-যাহাবী এই বিষয়টির অস্বীকারকারীদের এমন কী খারেজীও আখ্যা দিয়েছেন।

৫/ - লেখক ১৮৪ পৃষ্ঠায় দাবি করেন: “কবরের ওপর খাড়াভাবে ফলক স্থাপনও আপনাআপনি নিষিদ্ধ।” খাড়াভাবে স্থাপিত ফলক বলতে যদি বোঝানো হয় কবরের ‘শাহিদান’ তথা সাইনপোস্ট’কে, তাহলে এই দাবি পূর্ব হতে পশ্চিম অঞ্চলজুড়ে যুগ যুগ ধরে অনুশীলিত রীতিসূত্রে পুরোপুরিভাবে প্রত্যাখ্যাত ও অমূলক বলে প্রমাণিত হবে।

৬/ - বইয়ের একই পৃষ্ঠায় লেখক বলেন: “কবরের ওপর কোনো আকৃতির স্থাপনা-ই নির্মাণ করা উচিৎ নয়....কবরগুলোকে জিপসাম (খনিজ পদার্থ) দ্বারা আস্তর করা যাবে না।” সত্যটি হলো, এই বিষয়ে উলামাবৃন্দের মাঝে মতপার্থক্য বিরাজমান; আর মাযার/রওযা নির্মাণ ও জিপসাম দ্বারা সেগুলো আস্তর করা জায়েয হওয়ার পক্ষে দুটি কারণ উল্লেখ করা হয়েছিলো: সাধারণভাবে বলতে গেলে মাযার ভেঙ্গে পড়া থেকে রক্ষা করার লক্ষ্যে, এবং দ্বিতীয়তঃ তা কোনো পীর বা (হক্কানী) আলেম অথবা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’এর বংশের কারো হলে জনগণের মনে শ্রদ্ধাভাব জাগ্রত করার উদ্দেশ্যে, যেমনটি উল্লেখিত হয়েছে ইবনে আবেদীন শামী’র ‘হাশিয়া’ পুস্তকে (১:৬০১)। শায়খ ইসমাঈল হাক্কী তাঁর ‘তাফসীরে রূহুল বয়ান’গ্রন্থে  إِنَّمَا يَعْمُرُ مَسَٰجِدَ ٱللَّهِ مَنْ ءَامَنَ بِٱللَّهِ وَٱلْيَوْمِ ٱلآخِرِ وَأَقَامَ ٱلصَّلَٰوةَ وَءَاتَىٰ ٱلزَّكَٰوةَ وَلَمْ يَخْشَ إِلاَّ ٱللَّهَ فَعَسَىٰ أُوْلَـٰئِكَ أَن يَكُونُواْ مِنَ ٱلْمُهْتَدِينَ (আল্লাহর মসজিদগুলো তারাই আবাদ করে, যারা আল্লাহ ও ক্বেয়ামতের প্রতি ঈমান আনে, নামায ক্বায়েম করে, যাকাত প্রদান করে এবং আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে ভয় করে না; সুতরাং এটাই সন্নিকটে যে এসব মানুষ সৎপথপ্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে - ক্বুরআন মজীদ ৯:১৮, তাফসীরে নূরুল এরফান) - এই আয়াতটির ব্যাখ্যায় বলেন:

“ইমাম আবদুল গনী নাবলুসী (রহ:) নিজ ‘কাশফ আন্ নূর ‘আন্ আসহাবিল ক্বুবূর’ (কবরবাসীদের কাছ থেকে প্রকাশিত জ্যোতি - সানজেরী পাবলিকেশন, বাংলা সংস্করণ দ্রষ্টব্য) শীর্ষক পুস্তিকায় যা বলেছেন, তার সার কথা হলো পবিত্র খোদায়ী বিধানের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের সাথে যে উত্তম নতুন প্রচলন (বেদআতে হাসানা) খাপ খায়, তাকে সুন্নাহ বলে। অতএব, উলামা-এ-হক্কানী/রব্বানী, আউলিয়ায়ে কেরাম ও পুণ্যাত্মাবৃন্দের মাযার/রওযার ওপর গুম্বজ নির্মাণ করা, আর তাঁদের মাযারকে বস্ত্র বা চাদরাবৃত করা জায়েয, যদি সেটার উদ্দেশ্য হয় সাধারণ মানুষের মনে শ্রদ্ধাবোধ জাগ্রত করা, যাতে তাঁরা ওই মাযারের অধিবাসীর (ওলীর) প্রতি ঘৃণা পোষণ না করেন।”

ওপরের বিষয় যদি সঠিক না হয়, অথবা তা যদি সুন্নাহর সাথে সঙ্গতিপূর্ণ না হয়, তাহলে ইমাম আবূ দাউদের ‘সুনান’ গ্রন্থে উদ্ধৃত আমাদের মা আয়েশাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা)’র বক্তব্য সম্পর্কে গভীরভাবে ভাবুন; তিনি বলেন: “(আবিসিনীয়) বাদশাহ নাজ্জাশী যখন বেসালপ্রাপ্ত হন, তখন আমাদেরকে (রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের তরফ থেকে) জানানো হয় যে তাঁর মাযারের ওপর একটি নূর/জ্যোতি নিরন্তর দৃশ্যমান হচ্ছিলো।”

আল্লাহতা’লা আমাদের উপলব্ধি, অন্তর ও আমাদের কবরগুলোকে তাঁর দয়া ও ক্ষমাশীলতা দ্বারা আলোকিত করুন (আমীন)! ওয়া সাল্লাল্লাহু ’আলা সাইয়্যেদিনা মুহাম্মাদিন ওয়া ‘আলা আলিহি ওয়া সাহবিহি ওয়া সাল্লাম। 

                                                    *সমাপ্ত*

বুধবার, ৩১ অক্টোবর, ২০১৮

ইসমাঈল দেহেলভীর প্রতি কুফরের ফতোয়া

Collected fromhttp://salafiaqeedah.blogspot.com/2012/07/fatwa-of-kufr-upon-ismail-dehlavi.html;

বঙ্গানুবাদ: এডমিন

[ভারত উপমহাদেশে ওহাবী/আহলে হাদীস/দেওবন্দী/তাবলীগী জামাআতের পূর্বপুরুষ ইসমাঈল দেহেলভী (মৃত্যু: ১২৪৬ হিজরী/১৮৩১ খৃষ্টাব্দ)] 

ইমাম ফজলে হক্ক খায়রাবাদী চিশ্তী (রহ:) إمكان كذب - এমকানে কিযব (আল্লাহ মিথ্যে বলতে পারেন কি না প্রসঙ্গ), এমতেনা’আ আল-নাযীর ও প্রিয়নবী (দ:)’র শাফাআতের বিষয়গুলোতে মৌলভী ইসমাঈল দেহেলভীর দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি তীব্র আপত্তি উত্থাপন করেন।

(১) ১২৪০ হিজরী সালে ইমাম ফজলে হক্ক খায়রাবাদী চিশ্তী আরো ১৩ (তেরো) জন নেতৃস্থানীয় আলেমকে সাথে নিয়ে ইসমাইল দেহেলভীর প্রতি কুফরের ফতোয়া আরোপ করেন। এঁরা সবাই শাহ আবদুল আযীয মুহাদ্দিসে দেহেলভী (রহ:)’র প্রথম সারির ছাত্র।

এই ফতোয়াটি প্রকাশিত হয়েছিলো ‘তাহক্বীক্ব আল-ফতওয়া’ পুস্তকে যা’তে ওই চৌদ্দ জন আলেম স্বাক্ষর করেছিলেন। দলিলচিত্র:

(২) ১২৪৬ হিজরী/১৮৩১ খৃষ্টাব্দ সালে ইসমাঈল দেহেলভী (বালাকোটে) নিহত হয়।

দেওবন্দী ভাষ্যমতে, “ইমাম ফজলে হক্ক খায়রাবাদী চিশ্তী এই মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেন এবং ইসমাঈল দেহেলভীকে ‘মহান আলেম’ ও উম্মতে মুহাম্মদী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’র ‘হাকিম (ডাক্তার)’ বলে সম্বোধন করেন।”

অনুগ্রহ করে লক্ষ্য করুন যে, এই কাহিনির প্রথম প্রচারকারী ছিলো ফজল হাসান বিহারী নামের এক ব্যক্তি, যার বইয়ের শিরোনাম ছিলো: ‘আল-হায়াত বা’দাল মামা’ত’

(৩) ১২৬৯ হিজরী সালে আলী আহমদ টংকী রামপুরী একটি বই লেখে, যা’তে সে ‘এমকানে কিযব’ ও ‘এমতেনা’আ আল-নাযের’ বিষয়ে ইসমাঈল দেহেলভীর ভ্রান্ত আক্বীদা-বিশ্বাসের পক্ষ সমর্থন করে।

ইমাম ফজলে হক্ক খায়রাবাদী চিশ্তী এই বইটি খণ্ডন করেন এবং আবারো একটি ফতোয়া জারি করেন, যা’তে ওই সময়কার নেতৃস্থানীয় ৩৪ (চৌত্রিশ) জন আলেম সমর্থনসূচক স্বাক্ষর করেন। এটা পারসিক ভাষায় জারি করা হয়েছিলো এবং ‘মাতবা’অা-এ-হেদায়া’ হতে প্রকাশিত হয়েছিলো।

এই ঘটনা প্রমাণ করে যে, এমন কী ইসমাঈল দেহেলভীর মৃত্যুর ২৩ বছর পর ১২৬৯ হিজরী সালেও ইমাম ফজলে হক্ক খায়রাবাদী সাহেবের ঠিক একই দৃষ্টিভঙ্গি ছিলো, যেমনটি ছিলো তাঁর ১২৪০ হিজরী সালে, যখন তিনি ইসমাঈল দেহেলভীর প্রতি কুফরের ফতোয়া জারি করেছিলেন।

এমতাবস্থায় ইমাম ফজলে হক্ক খায়রাবাদী (রহ:) ১২৪৬ হিজরী সালে ইসমাঈল দেহেলভীর প্রশংসা করেছিলেন মর্মে দেওবন্দী (বানোয়াট) কাহিনীর জন্যে আর কোনো দরজা খোলা আছে কি?

(৪) ১২৭০ হিজরী সালে ইমাম ফজলে হক্ক খায়রাবাদী চিশ্তী তাঁর পারসিক ভাষায় লিখিত মহাকীর্তি সুসম্পন্ন করেন এবং ওর নাম দেন ‘এমতেনা’আ আল-নাযীর’।

দলিলচিত্র:



এই বইটিতে ‘আল্লাহ চাইলে সহস্র সহস্র রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম সৃষ্টি করতে পারেন’ মর্মে ইসমাঈল দেহেলভীর বক্তব্যকে তিনি আবারো কুফর হিসেবে প্রমাণ করেন। মহান এই আলেম ওই বক্তব্য ও ধারণার সকল সম্ভাব্য ব্যাখ্যারও খণ্ডন করেন।

অতএব, আমরা দেখতে পাই এমন কী ১২৭০ হিজরী সালেও ইমাম ফজলে হক্ক খায়রাবাদী (রহ:) তাঁর সেই ফতোয়ার ওপর অটল ছিলেন, যা তিনি ১২৪০ হিজরী সালে ইসমাঈল দেহেলভীর প্রতি জারি করেছিলেন। এমতাবস্থায় ১২৪৬ হিজরী সালে ইসমাঈল দেহেলভীর গুণকীর্তন করার সম্ভাব্যতা তথা অবকাশ কোথায়?

১২৭০ হিজরীর ওই একই বছর মওলানা ফজলে রাসূল বদায়ূনী সাহেব ‘আল-মুতাক্বাদ’ শীর্ষক পুস্তকটি রচনা করেন, যার মধ্যে ‘এমকান আল-কিযব’‘এমতেনা’আ আল-নাযীর’ বিষয়গুলোতে তিনি শুধু ইসমাঈল দেহেলভীকে খণ্ডন-ই করেননি, বরঞ্চ ওহাবীদের অন্যান্য ভ্রান্ত ধারণাকেও রদ করেছেন।

ইমাম ফজলে হক্ক খায়রাবাদী চিশ্তী (রহ:) উক্ত বইটির ওপর তাক্বরিয লেখেন এবং তা (বইটির) অনুমোদন করেন এ কথা বলে:

“এই বইটি বিশুদ্ধ আক্বীদা-বিশ্বাস বর্ণনা করেছে এবং গোমরাহ দলগুলোকেও খণ্ডন করেছে...”

ইমাম ফজলে হক্ব খায়রাবাদী চিশ্তী (রহ:) যদি ১২৪৬ হিজরী সালে ইসমাঈল দেহেলভীর মৃত্যুতে সত্যি শোক প্রকাশ করতেন এবং তাকে মহান আলেম বলতেন, তাহলে কেন তিনি ১২৭০ হিজরী সালে ইসমাঈল দেহেলভীর প্রতি আরোপিত কুফরের ফতোয়ার সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেন?

আনুমানিক ১২৭০ হিজরী/১৮৫৩ খৃষ্টাব্দ সালের দিকে হায়দার আলী টংকি একটি দ্বি-চরণে ইসমাঈল দেহেলভীর প্রশংসা করে; তাতে বলা হয়:

اتهجو عالماً بر اً تقياً وعند الله فى ذاك انتقام

“তোমরা কি খোদাভীরু আলেমের প্রতি করছো বিদ্রূপ,
খোদা এ জন্যে তোমাদের প্রতি করবেন প্রতিবিধান আরোপ।” [ভাবানুবাদ]

ইমাম ফজলে হক্ব খায়রাবাদী চিশ্তী ছিলেন ‘ফীল-বাদি শা’য়্যার’। কাব্যে তাঁর মহা পাণ্ডিত্য ছিলো এবং আরবী ভাষায়ও ছিলো গভীর দখল। তিনি জবাবে লেখেন:

اتمدح جاهلاَ شر اَ شقياً       تدار كم من الله انتقام
و انكر جا حداً غياَ وجحلاً     شفا عة من يلو ذ به الانام
و حرم ان يؤم بشد رحل ل    مزار دونه البيت الحرام
وجوز ان يقول الله كذباً       وقول الكذب منقصة وذام
فجوز ان يكون نظاءرفى      الكمال لمن له الفضل العظام

“তোমরা কি এক অজ্ঞ ও মন্দ লোকের প্রশংসামুখর, যাকে আল্লাহ দিয়েছেন শাস্তি,
একগুঁয়েমির কারণে যার ঘটেছিলো বিচ্যুতি, 
আর ওই আশীর্বাদধন্য সত্তার (দ:) সুপারিশের প্রতি যে জানিয়েছিলো অস্বীকৃতি,
সেই পবিত্র সত্তা (দ:) - যাঁকে ছাড়া সমগ্র সৃষ্টির নেই ইহ ও পরকালীন মুক্তি,
আর ওই বদমাইশ লোকটি দিয়েছিলো রওযা আকদস যেয়ারত না করার ফিরিস্তি,
যে পুণ্যস্থানটির রয়েছে এমন কী বায়তুল হারামের চেয়েও অধিক আশীর্বাদ ও স্বস্তি,      
অধিকন্তু সে বলেছিলো, আল্লাহ চাইলে করতে সক্ষম মিথ্যে উক্তি,
অথচ তা মহা পবিত্র আল্লাহর জন্যে নিশ্চয় এক দোষ ও ঘাটতি,
উপরন্তু নিখুঁত ও অনুপমের (দ:) অনুরূপ সত্তার সম্ভাব্যতা তার ভ্রান্তমতে সত্যি।”
[ভাবানুবাদ]

এই সকল দ্বি-চরণ ‘এমকান আল-কিযব’, ‘এমতেনা’আ আল-নাযীর’ ও ‘শাফা’আত’ বিষয়ে ইসমাঈল দেহেলভীকে রদ করে। ইমাম খায়রাবাদী (রহ:) আরো ৩৫ (পঁয়ত্রিশ)-টি দ্বি-চরণমূলক কাব্যে ইসমাঈল দেহেলভীর (বদ) আক্বীদার বিরুদ্ধে লিখেছিলেন।

এতে বোঝা যায়, ১২৭০ হিজরী সালেও ইমাম ফজলে হক্ক খায়রাবাদী সাহেব তাঁর ১২৪০ হিজরী সালে ব্যক্ত দৃষ্টিভঙ্গির ওপর অটল ছিলেন।

অতএব, ‘ইসমাঈল দেহেলভীর মৃত্যুতে ইমাম খায়রাবাদী শোক প্রকাশ করেন, এমন কী তার প্রশংসাও করেন’ মর্মে ওই দেওবন্দীর ফাঁদা কাহিনিটি একটি আষাঢ়ে গল্প ছাড়া কিছু নয়।

পাঠকমণ্ডলী নিশ্চয় দেখতে পাচ্ছেন যে দেওবন্দীটি এই কাহিনি ধার করেছে আরেক দেওবন্দী হতে, যে ইন্টারনেটে মিথ্যে প্রচারে কুখ্যাত।

এই দেওবন্দী লেখক সত্যান্বেষী নয়। যদি সে তা-ই হতো, তাহলে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’আতের মহান আলেম-উলামার সমালোচনা করার আগে দলিলপত্র গবেষণা ও অধ্যয়ন করতো।

দেখুন কীভাবে এই দেওবন্দী লেখক শায়খ ড: জি, এফ, হাদ্দাদকে আক্রমণ করছে।

দেওবন্দী লিখেছে:

“ড: জিবরীল ফুয়াদ হাদ্দাদ কিছু বছর আগে (ইসমাঈল দেহেলভীর) ‘তাকভিয়াতুল ঈমান’ পুস্তকের ইংরেজি অনুবাদের ওপর ভিত্তি করে একটি সমালোচনা লিখেছিলেন, যেটা তাঁর পক্ষপাত, অসততা, অজ্ঞতা ও অনুবাদের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতার ফলশ্রুতিতে অতিরঞ্জিত ও ভুল তথ্যে পূর্ণ ছিলো।”

কিন্তু পাঠকমণ্ডলী স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন কে আসলে পক্ষপাতদুষ্ট, অসৎ ও অজ্ঞ!!

ওই দেওবন্দী আরো লিখেছে:

“ড: হাদ্দাদের কথার তথ্যসূত্র হলো দেওবন্দীদের বিরুদ্ধে লেখা একটি ইন্টারনেট-ভিত্তিক প্রবন্ধ।”

প্রকৃতপক্ষে শায়খ জিবরীল হাদ্দাদ সাহেব যা কিছুর উদ্ধৃতি দিয়েছেন, তা স্রেফ ক্বুরআন মজীদ, সুন্নাহ ও নির্ভরযোগ্য ইতিহাস পুস্তক হতেই; পক্ষান্তরে এই দেওবন্দী সব কিছুই ইন্টারনেট বা অনুবাদকর্ম থেকে গ্রহণ করেছে! সে এমন কী মূল ‘তাক্বভিয়াতুল ঈমান’ বইটির উদ্ধৃতিও দেয়নি, বরঞ্চ ইংরেজি ও আরবী অনুবাদের শরণাপন্ন হয়েছে।

ওই দেওবন্দী লেখক মৌলভী ইসমাঈল দেহেলভীর গুণকীর্তন করার অপচেষ্টারত, যে বলেছিলো:

“সালাত তথা নামাযে তোমার স্ত্রীর সাথে সহবাসের চিন্তা কিংবা অবৈধ যৌনাচারের কুপ্রলোভন-ও শ্রেয়তর; আর কোনো শায়খ বা পুণ্যাত্মা সম্পর্কে, এমন কী মহানবী (দ:) সম্পর্কে চিন্তা করাও তোমার নিজের গাধা বা বৃষের চিন্তার চেয়ে নিকৃষ্টতর।” [সিরা’ত-এ-মুসতাক্বীম, পারসিক কিতাব, ৮৬ পৃষ্ঠা] নাউযুবিল্লাহ মিন যালেক!

বি:দ্র: স্ক্যানকৃত পৃষ্ঠাগুলোর লিঙ্কhttp://aakhirikhtilaafkyun.blogspot.com/

এবার আমরা দেখবো আশরাফ আলী থানভী কী বলেছেন:

প্রশ্ন: (এটা উত্থাপন করেন আবদুল মজীদ দরিয়াবাদী, থানভী সাহেবের শিষ্য ও খলীফা)
সালাতে মনোযোগ রাখার জন্যে আপনাকে স্মরণ করা কি আমার জন্যে জায়েয হবে?

উত্তর: (আশরাফ আলী থানভী প্রদত্ত)
এটা সঠিক/বৈধ যতোক্ষণ পর্যন্ত তুমি অন্যান্যদের কাছে তা প্রকাশ না করছো।” [হাকিমুল উম্মত, ৫৪ পৃষ্ঠা]

দেওবন্দী ফের্কার গোপন প্রকৃতি এই বর্ণনায় পরিদৃষ্ট হয়। তারা তাদের গোপন শিক্ষাগুলো নিজেদের মাঝেই সীমাবদ্ধ রাখে এবং অন্যদেরকে তা জানতে দিতেও চায় না!

আর তারা ইসমাঈল দেহেলভীকে খুব ভালোবাসে! কেননা كل شي يرجع الى اصله - সকল বস্তু-ই তার মূলের দিকে প্রত্যাবর্তন করে।

- আবদুল্লাহ সাবরী চিশ্তী
১৫ রমাদান আল-মোবারক, ১৪৩২ হিজরী
১৬ আগস্ট, ২০১১ খৃষ্টাব্দ।

ইসমাঈল দেহেলভীর প্রতি ফতোয়ার স্ক্যানকৃত কপি:




মওলানা আবূল কালা’ম আযাদ সাহেব লেখেন:

“মওলানা মুহাম্মদ ইসমাঈল শহীদ (মাক্বতূল) ছিলেন মওলানা মুনাওওয়ারুদ্দীন সাহেবের সহপাঠী। শাহ আবদুল আযীয দেহেলভী সাহেবের বেসালের পরে তিনি (ইসমাঈল) যখন ‘তাক্বভিয়াতুল ঈমান’ ও ‘জিলাউল ‘আয়নাইন’ বইগুলো রচনা করেন এবং তার ফের্কাহ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে, তখন সমস্ত আলেম-উলামা এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। এসব বইয়ের খণ্ডনে যিনি সবচেয়ে বেশি বই লিখেছেন, তিনি হলেন মওলানা মুনাওওয়ারুদ্দীন সাহেব; তিনি বেশ কয়েকটি কিতাব লেখেন এবং ১২৪০ হিজরী সালে দিল্লীর জামে মসজিদে বিখ্যাত বাহাস/বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়। ভারত উপমহাদেশের সকল আলেমের কাছ থেকে একটি (সম্মিলিত) ফতোয়া জারির আহ্বান জানানো হয় এবং হারামাইন শরীফাইন হতেও একটি ফতোয়ার জন্যে আবেদন করা হয়।

“মওলানা মুনাওওয়ারুদ্দীন সাহেবের লেখনী থেকে স্পষ্ট হয় যে তিনি প্রাথমিক পর্যায়ে মওলানা ইসমাঈল ও তার মেয়ের জামাই মওলানা আব্দুল হাই এবং তাদের সাথীদেরকে বোঝাতে সর্বাত্মক চেষ্টা করেন। তবে তাঁর ওই চেষ্টা বিফল হলে তিনি তাদের সাথে মোনাযেরা ও তাদেরকে রদ করতে বাধ্য হন। ফলশ্রুতিতে দিল্লীর জামে মসজিদে ওই প্রসিদ্ধ বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়; বিতর্কে এক পক্ষে ছিলেন মওলানা ইসমাঈল ও মওলানা আবদুল হাই, আর অপর পক্ষে মওলানা মুনাওওয়ারুদ্দীন ও দিল্লীর সমস্ত আলেম-উলামা।” [রেফারেন্স: আযাদ কি কাহানি, ৪৮ পৃষ্ঠা; মাকতাবা’ খলীল, উর্দূ বাজার, লাহোর; মওলানা আবদুল রাযযাক্ব মালীহ-আবাদী]

মওলানা মাখসূসউল্লাহ বিন শাহ রফিউদ্দীন দেহেলভী, মওলানা মুহাম্মদ মূসা বিন শাহ রফিউদ্দীন দেহেলভী, মওলানা ফজলে হক্ব খায়রাবাদী (শাহ আবদুল আযীয মুহাদ্দিসে দেহেলভীর ছাত্র), মুফতী সদরউদ্দীন আযুরদাহ (শাহ আবদুল আযীয মুহা্দ্দিসে দেহেলভীর ছাত্র), মওলানা মুহাম্মদ ফজলে রাসূল উসমানী বদায়ূনী, মওলানা আহমদ সাঈদ নক্বশবন্দী দেহেলভী, মওলানা রশীদউদ্দীন দেহেলভী, মওলানা খায়রউদ্দীন দেহেলভী, হাকীম সাদিক্ব আলী খাঁন দেহেলভী (মাসীহুল মুলক্ হাকীম আজমল খাঁনের দাদা), মওলানা সাইয়্যেদ আশরাফ আলী গুলশান-আবাদী, মওলানা মুখলিসুর রহমান চাটগামী (চট্টগ্রামের আলেম), মওলানা ক্বালান্দার আলী যুবায়রী পানিপথী এবং আরো অনেক সুন্নী আলেম তাঁদের ভাষণ ও লেখনীর দ্বারা ইসমাঈল দেহেলভীর প্রবর্তিত ভ্রান্ত ও বেদআতী ধ্যান-ধারণার খণ্ডন করেন। তাঁরা নিজেদের জ্ঞান ও কর্ম দিয়ে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’আতকে রক্ষা করার মহৎ উদ্দেশ্যে এই পবিত্র জ্বেহাদে অংশগ্রহণ করেন।

হযরত শাহ মাখসূসউল্লাহ বিন শাহ রফিউদ্দীন বিন শাহ ওলীউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহেলভী’কে আল্লামা ফজলে রাসূল উসমানী বদায়ূনী সাহেব ‘তাক্বভিয়াতুল ঈমান’ পুস্তকটি সম্পর্কে সাতটি প্রশ্ন করেন।

এসব প্রশ্ন ও উত্তর ‘তাহক্বীক্ব আল-হাক্বীক্বত’ শিরোনামের একটি বইতে বোম্বে হতে ১২৬৭ হিজরী সালে প্রকাশিত হয়

এর মধ্যে তিনটি উত্তর এখানে পেশ করা হলো:

হযরত মাখসূসউল্লাহ দেহেলভী লেখেন:

প্রথম প্রশ্নটির উত্তর যা ‘তাক্বভিয়াতুল ঈমান’ সংক্রান্ত - আর আমি এটাকে ‘তাফউইয়াতুল ঈমান’ (আরবী تفويت الإيمان যা ‘ঈমানহারা’ বোঝায়) অভিহিত করেছি - তার খণ্ডনে আমি ‘মু’ঈদুল ঈমান’ শীর্ষক একটি একক পুস্তক রচনা করেছি।

ইসমাঈলের বই শুধু আমাদের পারিবারিক ঐতিহ্যেরই বিরোধী নয়, বরঞ্চ তা সকল নবী-রাসূল (আলাইহিমুস সালাম)’বৃন্দের তওহীদেরও বিরোধী! কেননা তাঁদেরকে প্রেরণ করা হয়েছে মানুষদেরকে শিক্ষা দানের উদ্দেশ্যে এবং তওহীদের পথে চলার লক্ষ্যে।

তবে এই বইটিতে তওহীদের কিংবা আম্বিয়া (আ:)’মণ্ডলীর সুন্নাহের কোনো লেশচিহ্নমাত্র-ও নেই।

বইটিতে যেসব বিষয়কে শির্ক ও বেদআত বলে দাবি করা হয়েছে এবং মানুষকে শিক্ষা দেয়া হয়েছে, সেগুলো পয়গম্বর (আ:)’বৃন্দের মধ্যে কেউই সে মোতাবেক চিহ্নিত করেননি, কিংবা তাঁদের অনুসারীবৃন্দও তা করেননি। এর পরিপন্থী কোনো প্রমাণ থাকলে ইসমাইলের অনুসারীদের বলুন তা আমাদেরকে প্রদর্শন করতে। 

চতুর্থ প্রশ্নের উত্তর হলো (ইবনে আবদিল ওয়াহহাব নজদীর) ওহাবী বইটি ছিলো মূল, আর এটা যেনো তারই ব্যাখ্যামূলক পুস্তক।

পঞ্চম প্রশ্নের উত্তর হলো শাহ আবদুল আযীয (বৃদ্ধ বয়সে) ক্ষীণ দৃষ্টিশক্তি দ্বারা আক্রান্ত ছিলেন। এই বইটি সম্পর্কে শোনার পরে তিনি বলেছিলেন অসুস্থ না হলে ‘তোহফা-এ-এসনা আশারিয়্যা’ গ্রন্থের মতো একটি রদ-সূচক বই তিনি প্রণয়ন করতেন

আল্লাহতা’লার অনুগ্রহে আমি (মওলানা মাখসূসউল্লাহ) এই ব্যাখ্যামূলক বই (তাকভীয়াতুল ঈমান)’টির একটি রদ লিখেছি এবং এই সূত্রে মূল কিতাবেরও (কিতাবুত-তওহীদ) খণ্ডন করা হয়েছে।

আমার পিতা শাহ রফিউদ্দীন এই বইটি দেখেননি, কিন্তু যখন শাহ আবদুল আযীয দেহেলভী এটা দেখতে পান এবং তাঁর অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেন, তখন আমি এর রদ লেখায় প্রবৃত্ত হই।

(রেফারেন্স: আনওয়ার-এ-আফতাব-এ-সাদাক্বাত, ৬১৭-৬২০ পৃষ্ঠা; করীম প্রেস, লাহোর - মুহাম্মদ ক্বাজী ফজলে আহমদ লুধীয়ানী)

ইমাম ফজলে হক্ব খায়রাবাদী (রহ:) প্রণয়ন করেন ‘তাহক্বীক্ব অাল-ফাতওয়া ফী ইবতাল আল-তাগওয়া’ শীর্ষক গ্রন্থ, যা’তে তিনি ইসমাঈল দেহেলভীর বিভিন্ন ইসলামবিরোধী ধারণার খণ্ডন করেন।

মৌলভী ইসমাঈল দেহেলভী ও তার লিখিত ‘তাক্বভিয়াতুল ঈমান’ পুস্তকের প্রতি কুফরের ফতোয়া জারি করা হয়:

‘তাহক্বীক্ব আল-ফাতওয়া ফী ইবতাল আল-তাগওয়া’র মধ্যে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’আতের ১৭ (সতেরো) জন নেতৃস্থানীয় আলেম স্বাক্ষর করেছিলেন।

ইমাম আহমদ রেযা খাঁন (রহ:)’এর জারিকৃত ইসমাঈল দেহেলভীর প্রতি ফতোয়া? 

ইমাম আহমদ রেযা খাঁন সাহেবের (রহ:) সময়কালের বহু বছর আগেই ইসমাঈল দেহেলভী মারা যায়। তাই ইমাম সাহেব যদিও ইসমাঈল দেহেলভীর লেখনীর খণ্ডনে নিজের বইতে লিখেছিলেন যে দেহেলভীর কিছু কিছু লেখা কুফর, তথাপিও তিনি ইসমাঈলের প্রতি কুফরের ফতোয়া জারি করেননি; কেননা সে তখন মৃত এবং নিশ্চয় আত্মপক্ষ সমর্থন করে কোনো কিছু লেখায়ও ছিলো অপারগ।

ইমাম সাহেবের (রহ:) আগে অনেকেই দেওবন্দের উলামা’বর্গের (ওই মসলকের পূর্বসূরীদের) বিরুদ্ধে লিখেছিলেন; যেমন - 

ইমাম ফজলে হক্ব খায়রাবাদী (রহ:): ‘তাহক্বীক্বুল ফাতাওয়া।’
আল্লামা ফজলে রাসূল বদায়ূনী (রহ:): ‘সাইফুল জব্বার’
এছাড়াও অন্যান্য সুন্নী আলেম-উলামা।

বস্তুতঃ এগুলো যখন লেখা হয়, তখন ইমাম আহমদ রেযা (রহ:)’র জন্মও হয়নি!

ইমাম ফজলে হক্ব খায়রাবাদী (রহ:) রচনা করেন ‘তাহক্বীক্ব আল-ফাতাওয়া ফী ইবতাল আল-তাগওয়া’

ইমাম আহমদ রেযা খান (রহ:) জন্মগ্রহণ করেন ১২৭২ হিজরী সালের ১০ই শাওয়াল/১৪ই জুন, ১৮৫৬ খৃষ্টাব্দ

ইসমাঈল দেহেলভী মারা যায় ১২৪৬ হিজরী/১৮৩১ খৃষ্টাব্দ।

                                               *সমাপ্ত* 


    






   







    
 


রবিবার, ২ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

ডাক্তার জাকির নায়েকের গোমরাহীর ওপেন-হার্ট সার্জারী

[Open-heart surgery of Dr Zakir Naik's heresies - written by the Admin]

ভূমিকা

এই লেখার প্রারম্ভে বলা প্রয়োজন যে টেলি-প্রচারক ডাক্তার জাকির নায়েক সাহেব পেশায় একজন ডাক্তার এবং তিনি ধর্মবিষয়ের স্রেফ কমপ্যারেটিভ রিলিজিয়নে তথা বিভিন্ন ধর্মের পারস্পরিক তুলনামূলক বিচার-বিশ্লেষণ সম্পর্কে পড়াশুনা করেছেন। তাঁর নেই কোনো আরবী ভাষাজ্ঞান, নেই কালাম, ফেক্বাহ, হাদীস, তাসাউফ ইত্যাদি ইসলামী শাস্ত্রে কোনো দক্ষতা। তিনি নিজেই তা স্বীকার করেছেন। অতএব, তাঁর উচিত ছিলো কেবল তাঁর জানা কমপ্যারেটিভ রিলিজিয়ন বিষয়ে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখা এবং ওপরে উল্লেখিত ইসলামী বিদ্যাশাস্ত্রগুলোতে নাক না গলানো; ঠিক যেমনটি করেছিলেন তাঁর শিক্ষাগুরু ও সুন্নীপন্থী প্রচারক মরহূম আহমদ দীদাত সাহেব (দক্ষিণ আফ্রিকা)। কিন্তু তিনি তা না করে তাঁর অ-বিশেষজ্ঞ মতামত ওই সব বিষয়ে প্রদান করেছেন। ফলশ্রুতিতে মুসলিম দুনিয়ার বিভিন্ন ধর্মীয় সংস্থা ও আলেম-উলামা তাঁর গোমরাহী/পথভ্রষ্টতার ব্যাপারে হয়েছেন সোচ্চার। আমরা তাঁর ওই সব গোমরাহী আমাদের এই লেখাতে তুলে ধরবো এবং সেগুলোর ওপেন-হার্ট সার্জারী সুসম্পন্ন করবো, ইনশা’আল্লাহ।

ডাক্তার সাহেবের বিভ্রান্তিগুলো নানা ধরনের; মৌলিক আক্বীদা-বিশ্বাস থেকে শুরু করে ফিক্বহী সিদ্ধান্ত দিতে গিয়েও তিনি অনেক ভুল করেছেন। আল্লাহতা’লার গুণগত বৈশিষ্ট্য, শানে রেসালাত, শানে বেলায়াত - এমন কোনো দিক বাকি নেই যা’তে তিনি গোমরাহী প্রচার করেননি। বিপুল পরিমাণ টাকা ব্যয়ে তাঁর পরিচালিত ‘পীস টিভি’র সম্প্রচার দ্বারা তিনি শুধু নিজেই এসব অনৈসলামী মতবাদ প্রচার করেননি, বরঞ্চ কতিপয় অধার্মিক ও অর্থলোভী আলেম-উলামাকেও এই কাজে শরীক করেছেন। বলা বাহুল্য যে, ডাক্তার ও তাঁর সহযোগীবর্গ উগ্র ‘সালাফী’ মতবাদে বিশ্বাসী। এই বিভ্রান্তিকর দর্শন প্রথম পরিবেশন করেন মধ্যযুগে ইবনে তাইমিয়া নামের এক মুফতী। কিন্তু ওই সময় সুন্নীপন্থী উলামা-এ-হক্কানীবৃন্দ তা রদ বা রহিত করেন। এর প্রায় সাড়ে চার শ বছর পরে আরবের নজদ অঞ্চলের আরেক বিভ্রান্ত আলেম মুহাম্মদ ইবনে আবদিল ওয়াহহাব ওই গোমরাহ দর্শন পুনরায় পরিবেশন করেন। অতঃপর সৌদি আরবীয় রাজা-বাদশাহবর্গ তাঁর সেই ভ্রান্ত মতবাদ রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সারা বিশ্বে সম্প্রসারণ করেন। সেই ধারাবাহিকতায় ডাক্তার জাকির নায়েক সৌদি সমর্থন নিয়ে ‘সালাফী’ মতবাদের ডিজিটাল সম্প্রচার আরম্ভ করেন। সৌদিদের সাথে তাঁর সখ্যতা ছিলো সর্বজনবিদিত [তবে বর্তমান যুবরাজ সালমান ’সালাফী’ দর্শনের বিরোধী বলে মনে হচ্ছে]। এমতাবস্থায় এ ব্যাপারে অনবধান মুসলিম তরুণ প্রজন্ম ডাক্তার জাকির নায়েকের প্রদত্ত এনেসথেটিকস্ দ্বারা বে-শোধ হয়ে তাঁকে সত্যিকার ইসলামী পণ্ডিত মনে করছে। আমরা এ রকম এক ক্রান্তিকালে সঠিক তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরার মহান লক্ষ্য সামনে নিয়ে লেখাটি আরম্ভ করছি। এতে অন্তর্ভুক্ত থাকবে ডাক্তারের গোমরাহীপূর্ণ দর্শনের পাশাপাশি তাঁর বিরুদ্ধে আলেম-উলামাবৃন্দের ফতোয়া এবং আমাদেরও খণ্ডনমূলক দলিলাদি। তরুণ প্রজন্ম যারা সত্য জানতে উন্মুখ, তাদের জন্যে এই লেখাটি সত্যের আলোকবর্তিকা হবে বলে আমরা আশাবাদ ব্যক্ত করি।

আক্বীদা-বিশ্বাসগত বিভ্রান্তি

আমরা সর্বপ্রথমে ডাক্তার জাকির নায়েকের আক্বীদা-বিশ্বাসগত বিভ্রান্তি ও বিচ্যুতি (গোমরাহী) সম্পর্কে আলোকপাত করবো। এক্ষেত্রে বিভিন্ন মাসলাকের উলামাদের ফতোয়া তুলে ধরাই উত্তম হবে। এসব মাসলাকের কিছু কিছুর সাথে প্রকৃত সুন্নী জামাআতের আক্বীদা-বিশ্বাসগত মিল না থাকলেও ডাক্তারের ব্যাপারে এঁরা সবাই একমত। সেন্ট্রাল মসক্-ডট-কম শিরোনামের একটি ওয়েবসাইটে ভারতীয় দারুল উলূম দেওবন্দ হতে একটি ফতোয়া উপস্থাপন করা হয়েছে, যার অনুবাদ নিচে দেয়া হলো:

দারুল উলূম দেওবন্দ

প্রশ্ন: সম্মানিত মুফতীবৃন্দ, সালাম নেবেন। আমি আপনাদের জিজ্ঞেস করছি যে ডাক্তার জাকির নায়েক সম্পর্কে আপনাদের দৃষ্টিভঙ্গি কী? তাঁর আক্বীদা-বিশ্বাস কি আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ? হাদীস ও তাফসীর-সংক্রান্ত তাঁর মতামত নির্ভরযোগ্য কি না? ফেক্বাহ’র ক্ষেত্রে তাঁর পথ ও মত কী? তিনি কোন্ ইমামের অনুসরণ করেন? আমরা কি তাঁর (টেলি-সম্প্রচারিত) আলোচনা শুনতে পারবো এবং সেই অনুযায়ী অনুশীলন করতে পারবো? অনুগ্রহ করে একটি সন্তোষজনক উত্তর দেবেন। আরজ গুজার - রিয়্যাদ আহমদ খাঁন, আতিয়্যা প্রিন্টার্স, উত্তর সু’ইয়া, এলাহাবাদ, ভারত।

উত্তর: ডাক্তার জাকির নায়েক সম্পর্কে অনেক প্রশ্ন ওঠেছে, এটা সেগুলোরই একটা। তাঁর আক্বীদা-বিশ্বাস, ফিক্বহী মাযহাব ও ক্বুরআন-হাদীস সংক্রান্ত ব্যাখ্যাবলীর ওপরে একটি বিস্তারিত জবাব চাওয়া হয়েছে। অতএব, তাঁরই প্রভাষণ ও বক্তব্যের আলোকে একটি বিশদ জবাব এখানে দেয়া হলো।

حامدا ومصليا ومسلما ، الجواب وبالله التوفيق والعصمة      

ডাক্তার জাকির নায়েকের প্রভাষণগুলোতে পাওয়া যায় ইসলামের মৌলিক আক্বীদা-বিশ্বাস হতে বিচ্যুতি; আল-ক্বুরআনের তাফসীর তথা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে (বিকৃতিমূলক) সংযোজন ও বানোয়াট দৃষ্টিভঙ্গি পরিবেশন; বৈজ্ঞানিক গবেষণার প্রতি বিস্ময়ভাব; ইসলাম ধর্মের বিরোধিতায় পশ্চিমা চিন্তাভাবনার সাথে ঐক্য; এবং পূর্ববর্তী পুণ্যাত্মাবৃন্দ হতে মুখ ফিরিয়ে ফিক্বহী সিদ্ধান্তে সংখ্যাগরিষ্ঠ উম্মতের পথ ও মত হতে বিচ্যুতি। অধিকন্তু, তিনি অপতৎপর মুসলিম উম্মাহ’কে মুজতাহিদ ইমামমণ্ডলীর অনুসরণ হতে ফেরাতে; মানুষদেরকে দিয়ে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো পরিত্যাগে; আর আলেম-উলামার প্রতি মানুষকে বীতশ্রদ্ধ করতে। এ ধরনের কিছু বিচ্যুতি নিচে পেশ করা হলো:

/- ডাক্তার জাকিরের আক্বীদা-বিশ্বাসগত কতিপয় বিষয় (বিশ্বাস অত্যন্ত সূক্ষ্ম; একটুখানি নড়ে গেলেও কখনো কখনো ঈমানের জন্যে বিপজ্জনক হয়ে ওঠে)।

(ক) “আল্লাহতা’লাকে বিষ্ণু ও ব্রক্ষ্মা নামে ডাকা জায়েয বা বৈধ/অনুমতিপ্রাপ্ত।”

ডাক্তার জাকির একটি অনুষ্ঠানে বলেন, “আল্লাহতা’লাকে হিন্দু দেবতা বিষ্ণু মানে প্রভু ও ব্রক্ষ্মা মানে স্রষ্টা নামগুলো ধরে ডাকা জায়েয।এটা এ শর্তে যে কেউ বিষ্ণু সম্পর্কে বিশ্বাস করবেন না যে তাঁর চারটি হাত আছে এবং তিনি পাখির ওপরে চড়েন।” [ডাক্তার জাকির নায়েক প্রণীত ‘Islaam and Universal Brotherhood' (ইসলাম ধর্ম ও সর্বজনীন ভ্রাতৃত্ব), ৩৩ পৃষ্ঠা]

আল্লাহতা’লাকে আরবী নয় এমন শব্দ দ্বারা আহ্বান করার কোনো অনুমতি-ই নেই। সে সব নাম ধরে তাঁকে ডাকা জায়েয নেই, যেগুলো তাঁর জন্যে সুনির্দিষ্ট নয়। আল্লাহতা’লাকে বিষ্ণু ও ব্রক্ষ্মা নামে কীভাবে ডাকা যায়, যেখানে এগুলো হিন্দু ধর্মের স্পষ্ট প্রতীক?

(খ) “আল্লাহর কথা কী? এটাকে পরীক্ষা করার জন্যে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির পথ গ্রহণ করা প্রয়োজন।”

ডাক্তার জাকির একটি অনুষ্ঠানে বলেন, “প্রত্যেকেই বোঝেন যে তাঁর সম্মানিত কেতাব-ই কেবল আল্লাহর বাণী হতে পারে। আপনারা যদি জানতে চান কোন্ কেতাবটি নিশ্চিতভাবে আল্লাহর বাণী, তাহলে চূড়ান্ত পরীক্ষা হচ্ছে আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির পথ গ্রহণ করা। তা অাধুনিক বিজ্ঞানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হলেই বুঝবেন সেটা নিশ্চিতভাবে আল্লাহর বাণী।”

الجواب على ثلاثين جوابا على أن ذاكر الهندي وأصحاب فكره منحرفون ضلالا للشيخ يحى الحجورى   

এখানে আমরা জানতে পারি ডাক্তার জাকির নায়েকের গোমরাহীর ঔদ্ধত্য সম্পর্কে; আল্লাহর কেতাব হতে ‍মুখ ফিরিযে নেয়ার ব্যাপারে; তাঁর বিভ্রান্তিকর চিন্তাধারা ও আধুনিক বিজ্ঞানের প্রতি তাঁর বিস্ময় ভাব সম্পর্কেও - যা বিপজ্জনক মাত্রায় পৌঁছেছে। এটা এমনই এক পর্যায়ের যে তিনি প্রতিটি মুহূর্তে পরিবর্তনশীল বৈজ্ঞানিক গবেষণাকে ঐশী গ্রন্থাবলীর, বিশেষ করে পবিত্র আল-ক্বুরআনের বিচারের মাপকাঠি বা মানদণ্ড নির্ধারণ করেছেন। এটার সবচেয়ে বড় প্রমাণ আল্লাহর কালাম তথা বাণী হচ্ছে এর ‘এ’জা-য’ (অসহায় বানিয়ে দেয়া)। এর মাধ্যমে অাল্লাহ (ক্বুরঅানের) বিভিন্ন স্থানে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছেন।

(গ) “প্রত্যেক ব্যক্তিরই অধিকার রয়েছে ফতোয়া প্রদানের।”

ডাক্তার জাকির নায়েক নিজের রচিত ‘Islaam and Universal Brotherhood' (ইসলাম ধর্ম ও সর্বজনীন ভ্রাতৃত্ব) শীর্ষক পুস্তকের এক জায়গায় বলেন, “যে কারো ফতোয়া দেয়াটা জায়েয/অনুমতিপ্রাপ্ত; কেননা ফতোয়ার অর্থ হলো কারো মতামত ব্যক্ত করা।” [প্রাগুক্ত]

এই বক্তব্যে ডাক্তার জাকির নায়েক সাহেব ফতোয়া দেয়ার মতো এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজকে ‘মতামত প্রদানের’ মতো হাল্কা ভাষায় প্রকাশ করেছেন। হাফেয ইবনে কাইয়্যেম আল-জাওযিয়্যার মতানুসারে, (ধর্মীয় পদবীধারী) মুফতী হচ্ছেন শরীয়ত তথা ঐশী বিধানের ব্যাখ্যায় আল্লাহতা’লারই (বাণীর) একজন অনুবাদক; আর তিনি খোদার পক্ষে সই-স্বাক্ষর করার দায়িত্বপ্রাপ্তও।

لم تصلح مرتبة التبليغ بالرواية والفتيا إلا لمن اتصف بالعلم والصدق...وإذا كان منصب التوقيع عن الملوك بالمحل الذي لا ينكر فضله ولا يجهل قدره...فكيف بمنصب التوقيع عن رب الأرض والسماوات ، فحقيق بمن أقيم في هذا المنصب أن بعد له عدته ويتأهب له أهبته وأن يعلم فدر المقام الذي أقيم فيه . إعلام الموقعين ٩١/١

এই বিষয়টির বৈধতা ডাক্তার জাকির শুধু নিজের জন্যেই রাখেননি, বরং প্রত্যেকের জন্যেও এর অনুমতি দিয়েছেন। তিনি নিম্নবর্ণিত ক্বুরআনের আয়াত ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের হাদীস শরীফকে সম্পূর্ণভাবে অবজ্ঞা করেছেন -

 فاسألوا اهل الذكر إن كنتم لا تعلمون 

”তোমরা না জানলে জ্ঞানীদের কাছে জিজ্ঞেস করে শেখো।” [আল-আয়াত]

من أفتى بغير علم كان إثمه على من أفتاه . أخرجه أبو داؤد في سننه ٣٥٩ رقم ٣٦٥٩٣، باب تفسير القرآن عن رسول الله صلى الله عليه وسلم

”যে ব্যক্তি জ্ঞান না থাকা সত্ত্বেও ফতোয়া দেয়, সে ওই ফতোয়ার পাপের দায় বহন করবে।” [সুনানে আবূ দাউদ, রাসূল (দ:) হতে ক্বুরআন তাফসীর অধ্যায়]

/- ক্বুরআন মজীদের তাফসীর সংক্রান্ত ডাক্তারের নিজস্ব ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ উপস্থাপন তথা অর্থের বিকৃতি সাধন খুবই সূক্ষ্ম। একজন মুফাসসির বা ব্যাখ্যাকারী আয়াতে করীমায় ব্যক্ত আল্লাহতা’লার উদ্দেশ্য নির্ধারণ করেন এই মর্মে যে আল্লাহ এ কথা বলতে চেয়েছেন। অতএব, কোনো অযোগ্য লোকের জন্যে এই শাস্ত্রে নাক গলানো ভীষণ বিপজ্জনক একটি ব্যাপার। কেননা একটি হাদীস শরীফে প্রিয়নবী (দ:) এরশাদ ফরমান - 

من قال في القرآن برأيه فأصاب فقد أخطأ. أخرجه الترمذى رقم٢٧٧٦
 

“যে ব্যক্তি নিজের (মনগড়া) সিদ্ধান্ত অনুসারে আল-ক্বুরআনের তাফসীর/ব্যাখ্যা করে, সে সঠিক অর্থ পেলেও ভুল করেছে বলে বিবেচিত হবে।” [তিরমিযী]

অপর একটি বর্ণনায় এসেছে - 

من قال في القرآن برأيه فليتبوأ مقعده من النار . أخرجه الترمذى ١٩٩/٥ رقم ٢٩٥١
 

“যে ব্যক্তি নিজের (মনগড়া) সিদ্ধান্ত অনুসারে আল-ক্বুরআনের ব্যাখ্যা করে, সে জাহান্নামকে নিজের আবাসস্থল বানিয়ে নেয়।” [তিরমিযী]

এই কারণেই মুফাসসির হওয়ার জন্যে অনেকগুলো শর্ত রয়েছে। যেমন - তাঁকে ক্বুরআন মজীদের আয়াতগুলো সম্পর্কে সম্যক অবগত হতে হবে; হুযূরের (দ:) আহাদীস সম্পর্কেও গভীর জ্ঞান থাকতে হবে; আরবী ভাষা ও ব্যাকরণ, বাক্যরীতি, ভাষার রূপতত্ত্ব, বাগ্মিতা ও স্বচ্ছতা ইত্যাদি সম্পর্কেও তাঁকে জানতে হবে [বঙ্গানুবাদকের নোট: বিশেষ করে রূহানী তথা আধ্যাত্মিক জ্ঞান থাকতে হবে, যাতে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (দ:) কী বলেছেন তা তিনি বুঝতে পারেন]। ডাক্তার জাকিরের ক্ষেত্রে এসব শর্তের কোনোটাই প্রয়োজনীয় মাত্রায় পূরণ হয়নি; তিনি আরবী ব্যাকরণ জানেন না যা তাঁর জানা উচিত ছিলো; আর আহাদীস কিংবা আরবী ভাষায় বাগ্মিতা ও স্বচ্ছতা
সম্পর্কেও তিনি গভীর জ্ঞান রাখেন না [এগুলোর সবই পরবর্তী পর্যায়ে উদাহরণ সহকারে স্পষ্ট করা হবে]। পক্ষান্তরে, গোমরাহীর অতল গহ্বরে পতিত হওয়ার সকল কারণ ডাক্তার জাকিরের মাঝে পুরো মাত্রায় পরিদৃষ্ট হয়েছে; যথা - রাসূলুল্লাহ (দ:), সাহাবা কেরাম (রা:) ও তাবেঈন (রহ:)-বৃন্দ হতে বর্ণিত তাফসীর হতে মুখ ফিরিয়ে নেয়া, যুগের চিন্তা-চেতনার প্রতি ঝোঁক এবং আল-ক্বুরআনের বিষয়বস্তুকে ভুল বোঝা ইত্যাদি। এমতাবস্থায় তিনি অনেকগুলো আয়াতে করীমাকে তাঁর ওই অজ্ঞতাপ্রসূত বিরোধিতা করার উপলক্ষ হিসেবে গ্রহণ করেছেন। এগুলোর কিছু উদাহরণ নিচে দেয়া হবে।



(ক) ডাক্তার জাকির নায়েক الرجال قوامون على النساء - আয়াতটির তাফসীর প্রসঙ্গে বলেন, “লোকে বলে (আয়াতোক্ত) ‘ক্বাওওয়াম’ শব্দটি এক স্তর উঁচু হওয়ার অবস্থাকে উদ্দেশ্য করে। তবে বাস্তবে ‘ক্বাওওয়াম’ শব্দটি উৎপন্ন হয়েছে ‘এক্বা’মাহ’ হতে। এক্বা’মাহ অর্থ উঠে দাঁড়ানো। অতএব, এক্বা’মাহ শব্দটির মানে হলো দায়িত্বের ক্ষেত্রে এক স্তর উঁচুতে অবস্থান, কিন্তু তা গুণগত বৈশিষ্ট্যের ক্ষেত্রে নয়।” [জাকির নায়েকের প্রভাষণসমূহ, ২৯৫ পৃষ্ঠা, ফরীদ বুক ডিপো]

ডাক্তার জাকির নায়েক নারী-পুরুষের সাম্যবিষয়ক পশ্চিমা দৃষ্টিভঙ্গির সমর্থনে তাঁর নিজস্ব (মনগড়া) তাফসীর তৈরি করেছেন এবং এরই ফলশ্রুতিতে পুরুষদের গুণগত বৈশিষ্ট্যের পর্যায়কে তিনি নাকচ করে দিয়েছেন। প্রসঙ্গতঃ ইবনে কাসীর ওপরোক্ত আয়াতের তাফসীরে লেখেন - 

أى الرجل قيم على المرأة أى هو رئيسها وكبيرها والحاكم عليها ، مؤدبها إذا اعوجت 
  
অর্থ: স্ত্রীর সামনে তার স্বামীর মর্যাদা হচ্ছে একজন নেতা ও (শ্রদ্ধেয়) শাসকের মতো; প্রয়োজনের সময় স্বামী তার স্ত্রীকে যথাযথ পন্থায় শ্রদ্ধাশীলতার আদব-কায়দা শিক্ষা দেন। ইবনে কাসীর وللرجال عليهن درجة - এর তাফসীরে লেখেন - 

وللرجال عليهن درجة أى في الفضيلة في الخلق والمنزلة وطاعة الأمر والإنفاق والقيام بالمصالح والفضل في الدنيا والآخرة . ٦١٠/١

অর্থাৎ, “গুণগত বৈশিষ্ট্য, মর্যাদা, (খোদার) আনুগত্য ইত্যাদি ক্ষেত্রে স্বামী তার স্ত্রীর চেয়ে উঁচ্চস্তরের।

ডাক্তার জাকির নায়েকের (মনগড়া) তাফসীর হাদীস শরীফেরও খেলাফ। মহানবী (দ:) এরশাদ করেন:

لو كنت آمرا أحدا أن يسجد لأحد ، لأمرت النساء أن يسجدن لأزواجهن. أخرجه أبو داؤد 

অর্থ: আল্লাহ ভিন্ন কাউকে সেজদা করার অনুমতি থাকলে আমি নারীদের প্রতি তাদের স্বামীদেরকে সেজদা করতে আদেশ করতাম। [আবূ দাউদ]

স্বামীদের যদি তাদের স্ত্রীদের ওপরে মর্যাদা না থাকতো, তাহলে কেন রাসূলে পাক (দ:) নারীদেরকে তাদের স্বামীদের প্রতি সর্বোচ্চ সম্মানের চিহ্নস্বরূপ সেজদার আদেশ করতে চেয়েছিলেন?

(খ) ডাক্তার জাকির নায়েকের প্রতি একটি প্রশ্ন করা হয়: “ক্বুরআন মজীদে বিবৃত হয়েছে যে মায়ের গর্ভে সন্তানটি ছেলে না মেয়ে তা একমাত্র আল্লাহতা’লাই জানেন। কিন্তু বিজ্ঞানের অনেক উন্নতি হয়েছে এবং আমরা বর্তমানে আলট্রা-সনোগ্রাফির মাধ্যমে সহজে এটা নির্দিষ্ট করতে পারি। এমতাবস্থায় অালোচ্য আয়াতটি চিকিৎসা বিজ্ঞানের সাথে সাংঘর্ষিক নয় কি?”

ডাক্তার জাকির উত্তর দেন, “এটা ঠিক যে এই আয়াতখানির বিভিন্ন অনুবাদ ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে উল্লেখ করা হয়েছে একমাত্র আল্লাহ-ই জানেন মায়ের গর্ভে শিশুটি ছেলে না-কি মেয়ে। তবে আরবী আয়াতটি অধ্যয়ন করুন এবং এতে আপনারা দেখতে পাবেন যে ছেলে না মেয়ে অভিব্যক্তিটি আরবী শব্দে ব্যবহৃত হয়নি। বাস্তবতা হলো, ক্বুরআন মজীদে (স্রেফ) বলা হয়েছে মাতৃগর্ভে কী আছে। এই জ্ঞানটি শুধু আল্লাহর কাছে নিহিত। বহু মোফাস্সেরীন (তাফসীরবিদ) এটা ভুল বুঝেছেন এবং এর অর্থ করেছেন মায়ের গর্ভে শিশুটি ছেলে না মেয়ে, সে সম্পর্কে স্রেফ আল্লাহ-ই (ভালো) জানেন। এটা ভুল ব্যাখ্যা। এই আয়াতটি গর্ভস্থ ভ্রূণ ছেলে না মেয়ে, সে সম্পর্কে ইঙ্গিত করে না, বরঞ্চ শিশুটির প্রকৃতি সম্পর্কে ইশারা করে এ মর্মে, সে তার পিতামাতার জন্যে (খোদায়ী) রহমত/করুণা হবে, না শাস্তি?” [ডাক্তার জাকির নায়েক কৃত ইসলামের প্রতি ৪০টি আপত্তি, ১৩০ পৃষ্ঠা, আরীব পাবলিকেশন্স, দিল্লী]

ডাক্তার জাকির নায়েক তাঁর প্রদত্ত এই উত্তরে বৈজ্ঞানিক গবেষণার প্রতি বিস্ময় ভাবাচ্ছন্ন এবং স্পষ্ট অভিযোগটি হতে নিজের গা বাঁচানোর জন্যে সাহাবা-এ-কেরাম (রা:) ও তাবেঈন (রহ:)’বৃন্দের তাফসীরকে পাশ কাটিয়ে সর্বজনজ্ঞাত অর্থকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি সমালোচনা করেছেন এই বলে যে বহু মুফাস্সেরীন ভুল করেছেন। ডাক্তার জাকিরের ব্যাখ্যাকৃত অর্থটি হচ্ছে ‘মা’ মওসূল’। অনেক মোফাস্সেরীন এটাকে প্রথম অর্থের আওতাধীন সম্ভাবনা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তবে দ্বিতীয় অর্থটিকে প্রত্যাখ্যান করাটা সঠিক নয়। ডাক্তার জাকির নায়েক যে গভীর ভাবনায় নিমগ্ন হন না এবং সাহাবা-এ-কেরাম (রা:) ও তাবেঈন (রহ:)’বৃন্দের বক্তব্য হতে মুখ ফিরিয়ে নেন, এ ঘটনায় তা স্পষ্ট প্রমাণিত। এটা এ কারণে যে ডাক্তার জাকির যে অর্থকে নাকচ করেছেন, সূরা রা’আদের ৮ম আয়াতটি তার দিকে ইঙ্গিত করেছে। এরশাদ হয়েছে - 

الله يعلم ما تحمل كل انثى وما تغيض الأرحام وما تزداد. الرعد ٨

অর্থ: আল্লাহ জানেন যা কিছু কোনো স্ত্রী প্রজাতির (মানে নারীর) গর্ভে থাকে এবং তাতে যা কিছু কমে বা বাড়ে। [আল-আয়াত]

বিখ্যাত তাবেঈ ও মুফাস্সির ইমাম ক্বাতাদা (রহ:)-ও একই অর্থ বর্ণনা করেন: 

فلا يعلم ما في الأرحام أذكر أم أنثى الخ

অর্থ: একমাত্র আল্লাহরই প্রকৃত জ্ঞান রয়েছে গর্ভস্থ সন্তানটি ছেলে না মেয়ে।

একইভাবে ইবনে কাসীর এটা উল্লেখ করেছেন নিজের তাফসীরগ্রন্থের ৬ষ্ঠ খণ্ড, ৩৫৫ পৃষ্ঠায়; আল্লামা নাসাফী তাঁর ‘তাফসীরে মাদারেক’, ৩য় খণ্ড, ১১৬ পৃষ্ঠায়; এবং শওকানী নিজ ফাতহুল ক্বাদীর পুস্তকের ৫ম খণ্ড, ৪৯৮ পৃষ্ঠায়। কিন্তু ডাক্তার জাকির নায়েক এই মহান মুফাস্সির-মণ্ডলীর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে উল্লেখিত অর্থকে ভ্রান্ত শ্রেণিভুক্ত করেছেন। তিনি নিজের কৃত অর্থকে তর্কাতীত হিসেবে গ্রহণ করেছেন এবং এটাকে একগুঁয়েভাবে সমর্থন করছেন।

সঠিক উত্তর:  
এই আয়াতের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো আল্লাহতা’লার অদৃশ্য জ্ঞানকে (এলম-এ-গায়েব) সপ্রমাণ করা; আর এলমে গায়ব বাস্তবে সেই নিশ্চিত জ্ঞানকে বোঝায়, যা কোনো প্রকাশ্য/স্পষ্ট কারণ বা অসীলা অথবা হাতিয়ার ছাড়া লাভ হয়। ডাক্তারদের দ্বারা হাতিয়ার/যন্ত্রপাতির সাহায্যে লব্ধ জ্ঞান সুনিশ্চিত জ্ঞান নয়; আর তা বিনা যন্ত্রপাতিতেও অর্জন করা হয় না। এটা যন্নি (অস্পষ্ট) এবং যন্ত্রপাতির সাহায্যেই কেবল অর্জিত হয়। অতএব, আল্ট্রা-সনোগ্রাফি’র সহায়তায় যে যন্নি জ্ঞান লাভ হয়, তা ক্বুরআনী আয়াতটির প্রতি আপত্তি উত্থাপন করে না।

(গ) يا ايها النبى إذا جائك المؤمنت يبايعنك على ان لا يشركن بالله شيئا. الممتحنة ١٢ ডাক্তার জাকির নায়েক এই আয়াতটি সম্পর্কে বলেন: “এখানে ‘বাই’য়াত’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। বাই’য়াত শব্দটি আমাদের সময়কার নির্বাচনের অন্তর্নিহিত অর্থ বহন করে। এটা এ কারণে যে মহানবী (দ:) আল্লাহতা’লারই প্রেরিত পয়গম্বর এবং সরকারপ্রধান। ‘বাই’য়াত’ মানে হলো তাঁকে সরকারের প্রধান হিসেবে গ্রহণ করা। ইসলাম ধর্ম ওই সময় নারীকে ভোট দেয়ার অধিকার দেয়।” [ইসলামে নারী অধিকার (The rights of women in Islaam), ৫০ পৃষ্ঠা, প্রণেতা - ডাক্তার জাকির নায়েক]

এখানেও ডাক্তার জাকির নায়েক ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী হয়েছেন। তিনি নারীর ভোটাধিকার প্রমাণের মানসে বিবৃত করেছেন যে রাসূলে খোদা (দ:)’র কাছে মহিলাদের বাই’য়াত (আনুগত্যের শপথ) গ্রহণটি ছিলো বর্তমানকালের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাচনেরই প্রাচীন একটি পদ্ধতি। গণতন্ত্রের বাস্তবতা (মানে সংখ্যাগরিষ্ঠের জয়) সম্পর্কে যাঁরা জানেন, তাঁরা স্পষ্ট বোঝেন যে ডাক্তার জাকিরের এ ব্যাখ্যাটি আসল ঘটনার একেবারেই পরিপন্থী এবং ক্বুরআন তাফসীরশাস্ত্রে তাঁরই বুদ্ধির স্রেফ অপচয় ছাড়া কিছু নয়। কেননা আধুনিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা অনুসারে প্রত্যেকেরই রাষ্ট্রপতি (বা প্রধানমন্ত্রী) নির্বাচন করার ভোটাধিকার আছে। কেউ সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোট অর্জন করতে না পারলে রাষ্ট্রপতি/প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না। বাই’য়াত গ্রহণ যদি প্রকৃতপ্রস্তাবে ভোট পাওয়ার ব্যাপার হতো, তাহলে সাহাবা-এ-কেরাম (রা:)’এর পক্ষে কি রাসূলুল্লাহ (দ:)’এর নেতৃত্বকে প্রত্যাখ্যান করার সুযোগ ছিলো? 

(ঘ) يا أخت هارون ما كان أبوك امرأ سوء وما كانت أمك بغيا . مريم ٢٨ - সূরা মরিয়মের ২৮ আয়াত (হে হারূনের বোন! তোমার পিতা মন্দ লোক ছিলো না এবং না তোমার মাতা ব্যভিচারিনী) সম্পর্কে ভুল বুঝে যে সর্বজনবিদিত আপত্তি উত্থাপিত হয়ে থাকে এ মর্মে, হযরত মরিয়ম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা পয়গম্বর হারূন আলাইহিস্ সালামের বোন নন এবং তাঁদের মধ্যে এক সহস্র বছরের ব্যবধান বিদ্যমান, সে সম্পর্কে ডাক্তার জাকির নায়েক বলেন, “খৃষ্টান মিশনারীবৃন্দ দাবি করেন যে রাসূলে পাক (দ:) পয়গম্বর ঈসা (আ:)’র মাতা মরিয়ম (রা:) ও পয়গম্বর হারূন (আ:)’এর বোন মরিয়মের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করতে পারেননি; অথচ ‘উখতু’ আরবী শব্দটির অর্থ সন্তানও হয়। এই কারণেই মানুষেরা মরিয়ম (রা:)’কে বলেছিলেন ‘ওহে হারূনের সন্তানেরা।’ বাস্তবিকপক্ষে এটা পয়গম্বর হারূন (রা:)’এর সন্তানদেরকে উদ্দেশ্য করেছে।” [ডাক্তার জাকির রচিত ‘ইসলামের প্রতি ৪০টি আপত্তি’ (Forty objections on Islaam)]

এটা আহাদীস (হাদীসশাস্ত্র) ও আভিধানিক ক্ষেত্রে ডাক্তার জাকিরের অজ্ঞতারই বহিঃপ্রকাশ। এর খণ্ডনে মুসলিম শরীফের হাদীসটি-ই যথেষ্ট। আরবী এবারত:

عن المغيرة بن شعبة قال : لما قدمت نجران سألونى ، فقالوا : إنكم تقرأون يا أخت هارون وموسى قبل عيسى بكذا وكذا ، فلما قدمت على رسول الله صلى الله عليه وسلم سألته عمن ذلك فقال : إنهم كان يسمون بأنبيائهم والصالحين قبلهم . مسلم ١٧١/٦ دار الجيل بيروت رقم ٥٧٢١  

প্রিয়নবী (দ:) ১৪০০ বছর আগেই এই আয়াতটি সম্পর্কে স্পষ্ট ব্যাখ্যা দিয়েছেন। হাদীসটির সংক্ষিপ্ত বিবরণ হলো এই যে, পয়গম্বর ঈসা (আ:)’র মাতা মরিয়ম (রা:) পয়গম্বর মূসা (আ:)’র ভাই পয়গম্বর হারূন (আ:)’এর বোন ছিলেন না, বরঞ্চ পয়গম্বর ঈসা (আ:)’র মা মরিয়ম (রা:)’র ভাইয়ের নামও ছিলো হারূন; বিশেষতঃ এসব মানুষ নিজেদের নাম রাখতেন আম্বিয়া (আ::) ও পুণ্যবান ব্যক্তিত্বদের নামের অনুসরণে। এ থেকে আমরা জানতে পারি এটা কোনো নতুন উত্থাপিত আপত্তি নয়; আর এর উত্তর দেয়ার জন্যে কোনো মিথ্যে বানিয়ে নেয়ারও কোনো দরকার নেই (যা ডাক্তার জাকির নায়েক করেছেন)।

আহাদীস তথা হাদীসশাস্ত্র সম্পর্কে ডাক্তার জাকির নায়েক এতোখানি অজ্ঞ যে তিনি আহাদীস ও তাফসীরের বাস্তবতা তথা মর্মবাণী অনুধাবনের চেষ্টা করার পরিবর্তে মিথ্যে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ বানিয়ে নিয়েছেন।

(ঙ) وَٱلأَرْضَ بَعْدَ ذَلِكَ دَحَاهَا (এবং এরপর জমিনকে প্রসারিত করেছেন; আল-ক্বুরআন ৭৯:৩০) - এই আয়াতটি সম্পর্কে ডাক্তার জাকির বলেন, “এখানে ডিমের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত আরবী শব্দটি হচ্ছে ‘দাহাহা’। এটা উট পাখির ডিমকে উদ্দেশ্য করেছে। উট পাখির ডিমের আকৃতি পৃথিবীর মতোই গোলাকৃতি। অতএব, আল-ক্বুরআন নির্ভুলভাবে পৃথিবীর আকৃতি ব্যক্ত করেছে। (কেননা) ক্বুরআন যখন অবতীর্ণ হয়েছিলো, তখন ভ্রান্ত ধারণা প্রচলিত ছিলো যে দুনিয়া সমতল/চেপ্টা।” [জাকির নায়েকের প্রভাষণসমূহ, ক্বুরআন ও আধুনিক বিজ্ঞান, ৭৩-৪ পৃষ্ঠা]

এখানেও ডাক্তার জাকির নায়েক বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি একদম বিস্ময়াভিভূত। দুনিয়ার আকৃতি সম্পর্কে গবেষণা করতে গিয়ে তিনি ভ্রান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে আয়াতে করীমাটির ব্যাপারে নিজের মনগড়া ব্যাখ্যা পেশ করেছেন। আল-ক্বুরআনের বিষয়বস্তু (যা’তে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে তওহীদ ও রেসা’লাত এবং এতদসংশ্লিষ্ট সকল বিষয়), তা উপলব্ধি না করার দরুন-ই এটা হয়েছে। অতএব, (আয়াতোল্লিখিত) ‘দাহাহা’ শব্দটি আরবী ভাষায় বোঝায় প্রসারিত হওয়া। এই অর্থানুযায়ী ‘দাহাহা’ শব্দের অনুবাদ ও তাফসীর হলো, পৃথিবী ও এতে অবস্থিত যাবতীয় সৃষ্টির প্রসার [দেখুন তাফসীরে ইবনে কাসীর]। এই শব্দটি ও এর ধাতু ডিমের অর্থ বোঝায় না।

/- আহাদীস সম্পর্কে অজ্ঞতা

আহাদীসের রত্নভাণ্ডার সম্পর্কে মূর্খতার দরুন ডাক্তার জাকির এমন কিছু (মনগড়া) ফতোয়ার উদ্ধৃতি দিয়েছেন যা সহীহ হাদীসেরই পরিপন্থী। অধিকন্তু, অনেক ক্ষেত্রে বেশ কিছু সংখ্যক হাদীসের অস্তিত্ব থাকলেও ডাক্তার নায়েক বলেন যে সেগুলোর কোনো প্রমাণ-ই নেই (মানে তিনি দলিল অস্বীকার করেছেন)। নিচে ডাক্তার নায়েকের মূর্খতা অথবা ইচ্ছাকৃতভাবে আহাদীস অস্বীকারের উদাহরণ পেশ করা হলো:

(ক) হায়য/ঋতুস্রাব অবস্থায় নারীদের ক্বুরআন তেলাওয়াতের অনুমতি:

একটি অনুষ্ঠানে (সম্ভবতঃ পীস টিভিতে) ডাক্তার জাকির হায়য-সম্পন্ন নারীদের সম্পর্কে বলেন, “আল-ক্বুরআন ও হাদীস শরীফে নামায/সালাত সম্পর্কে নিষেধ করা হয়েছে বটে, তবে এ কথা কোথাও মানা করা হয়নি যে মহিলারা ক্বুরআন তেলাওয়াত করতে পারবেন না।”

অথচ তিরমিযী শরীফে একটি স্পষ্ট হাদীসে এ ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা এসেছে - لا تقرأ الحائض ولا الجنب شيئا من القرآن 
অর্থাৎ, “হায়য ও জনাবাত/নাপাকী অবস্থায় কোনো নারীর ক্বুরআন তেলাওয়াত করা নিষেধ।”

অতএব, স্পষ্ট সহীহ হাদীসের উপস্থিতি সত্ত্বেও ডাক্তার জাকির নায়েক নিজের ভ্রান্ত দাবি উত্থাপন করেছেন এবং দলিল প্রত্যাখ্যান করেছেন।

(খ) অাহনা’ফ (পূর্ববর্তী মুজতাহিদ ইমাম)-বৃন্দের কাছে এ মর্মে কোনো প্রমাণ নেই যে (শরীরের) রক্ত প্রবাহের দরুন অযূ ভেঙ্গে যায়।

রক্ত প্রবাহের কারণে অযূ ভাঙ্গে কী ভাঙ্গে না, এই বিষয়ে একটি প্রভাষণে আলোচনাকালে ডাক্তার জাকির নায়েক বলেন, “কতিপয় ‘উলামা’, বিশেষ করে হানাফী ফেক্বাহবিদবৃন্দ, অভিমত ব্যক্ত করেন যে শরীরের রক্ত প্রবাহের দরুন অযূ ভেঙ্গে যায়। কিন্তু সালাত/নামাযে রত অবস্থায় কারো রক্ত ঝরলে তিনি কী করবেন? এই প্রশ্নের উত্তর দেয়া হয়েছে (আহনা’ফ-বৃন্দের) একটি বিস্তারিত ফতোয়ায়। তবে তাতে এই দৃষ্টিভঙ্গির পক্ষে কোনো প্রামাণ্য দলিল নেই।” [জাকির নায়েকের বাস্তবতা, ২১৪ পৃষ্ঠা, মাকতাবাহ মদীনা, দেওবন্দ]

এখানে ডাক্তার নায়েক হানাফী ফেক্বাহ’র বিষয়ে ‘উলামা’বৃন্দের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করেছেন যে তাঁরা রক্ত প্রবাহের কারণে অযূ ভেঙ্গে যায় মর্মে (মনগড়া) ফতোয়া দিয়েছেন। অথচ এ বিষয়ে অনেক আহাদীস (হাদীসসমূহ) বিদ্যমান। অধিকন্তু, হযরতে সাহাবায়ে কেরাম (রা:)’এরও এই অনুযায়ী অনুশীলন ছিলো। নিচের বর্ণনাগুলো অধ্যয়ন করুন:

أخرج البخاري عن عائشة رضي الله عنها قالت : جائت فاطمة بنت أبي حبيش إلى النبي صلى الله عليه وسلم فقالت : يا رسول الله! إني امرأة أستحاض فلا أطهر ، أفأدع الصلاة؟ قال : لا ، إنما ذلك عرق وليست بالحيضة ، فإذا أقبلت الحيضة فدعى الصلاة وإذا أدبرت فاغسلي عنك الدم قال هشام : قال أبي ثم توضئي لكل صلاة حتى يجيئ ذلك الوقت. إذا رعف أحدكم في صلاتة فلينصرف فليغسل عنه الدم ثم ليعد وضوءه ويستقبل صلاته أخرجه الدار قطني.

সারমর্ম: নামায আদায়কালে কারো নাকে রক্তক্ষরণ হলে তাঁকে রক্ত ধুয়ে ফেলতে হবে এবং তারপর পুনরায় অযূ করতে হবে। [দা’রু ক্বুতনী]

عن زيد بن ثابت رضي الله عنه الوضوء من كل دم سائل . أخرجه ابن عدي في الكامل (نصب الراية للإمام الزيلعي ٣٧⁄١

সারমর্ম: রক্তক্ষরণের দরুন অযূ বাধ্যতামূলক হয়। 

এই রওয়ায়াতগুলো এবং অন্যান্য বর্ণনা থাকা সত্ত্বেও ডাক্তার নায়েক নিজের অজ্ঞতা স্বীকার করে নেননি, বরং এজতেহাদ দাবি করেছেন এ কথা বলে যে রক্তক্ষরণ দ্বারা অযূ ভেঙ্গে যায় মর্মে কোনো দালিলিক প্রমাণ-ই নেই। 

(গ) পুরুষ ও নারীর নামায পড়ার পদ্ধতির মাঝে পার্থক্যকরণ অনুমতিপ্রাপ্ত নয়

(উক্ত বইয়ের) আরেক স্থানে ডাক্তার জাকির পুরুষ ও নারীর মধ্যকার সালাতের পার্থক্যের প্রসঙ্গে বলেন, “পুরুষদের থেকে পৃথক কোনো পদ্ধতিতে নারীদের নামায আদায়ের আদেশসম্বলিত কোনো সহীহ ও প্রতিষ্ঠিত হাদীস বিদ্যমান নেই। উল্টো সহীহ বুখারীতে এমন একটি রওয়ায়াত/বর্ণনা এসেছে, যা’তে হযরতে উম্মে দারদা (রা:) বিবৃত করেছেন যে (নামাযের) ‘আত-তাহিয়্যাত’-কালীন বৈঠকে পুরুষদের মতোই নারীদের বসার পক্ষে একটি আদেশ বিদ্যমান।”

এখানে ডাক্তার জাকির দুটো সম্পূর্ণ ভ্রান্ত অভিমত ব্যক্ত করেছেন:

১. পুরুষ ও নারীর সালাত আদায় পদ্ধতির মাঝে কোনো পার্থক্য নেই; এবং
২. রাসূলুল্লাহ (দ:) আদেশ করেছেন নারীরা যেনো পুরুষদের মতোই (উক্ত বৈঠকে) বসেন।

প্রথম বক্তব্যটি পেশ করে ডাক্তার জাকির পুরুষ ও নারীর মধ্যকার সালাত পদ্ধতির পার্থক্যের ব্যাখ্যাসম্বলিত সমস্ত আহাদীস-ই অস্বীকার করেছেন। (পক্ষান্তরে) কিছু এতদসংক্রান্ত রওয়ায়াত নিচে প্রদান করা হলো:

أخرج البخاري عن النبي عليه السلام أنه قال يا أيها الناس! ما لكم حين نابكم شيئ في الصلاة ، أخذتم في التصفيق ، إنما التصفيق للنساء. ١٧٤⁄١ رقم ٦٨٤
عن وائل بن حجر قال لي رسول الله صلى الله عليه وسلم يا وائل بن حجر! إذا صليت فاجعل يديك حذاء أذنيك والمرأة تجعل يديها حذاء ثدييها. المعجم الكبير للطبراني
عن يزيد بن أبي حبيب أن رسول الله صلى الله عليه وسلم مر على امرأتين تصليان فقال : إذا سجدتما فضما بعض اللحم إلى الأرض ، فإن المرأة ليست في ذلك كالرجل . أخرجه أبو داؤد مرسلا والبيهقي موصولا
سئل ابن عمر كيف كن النساء يصلين على عهد رسول الله صلى الله عليه وسلم قال : كن يتربعن ثم أمرن أن يتحفزن . جامع المسانيد والسنن      

সারমর্ম: এ সকল হাদীস ও বর্ণনায় পুরুষ ও নারীদের সালাত-পদ্ধতির মধ্যকার পার্থক্য (স্পষ্ট) বিবৃত হয়েছে। এগুলো ছাড়াও আরো আহাদীস বিরাজমান। এই বিষয়ে বিশদ ব্যাখ্যাসম্বলিত বইপত্র অধ্যয়ন করা যেতে পারে। ডাক্তার নায়েকের (ভ্রান্ত) দ্বিতীয় অভিমত অনুযায়ী, বুখারী শরীফে রাসূল (দ:)’এর এ মর্মে একটি আজ্ঞা বিদ্যমান যে নারীকুল পুরুষদের মতোই সালাতে বসতে পারবেন। বস্তুতঃ এটা একটা অপব্যাখ্যা ছাড়া কিছু নয়। কেননা ডাক্তার নায়েক হযরতে উম্মে দারদা (রা:)’র যে বর্ণনাটির উদ্ধৃতি দিয়েছেন, তা নিম্নরূপ:

وكانت ام الدرداء تجلس في صلاتها جلسة الرجل وكانت فقيهة . بخاري ١١٤⁄١

সারমর্ম: এতে রাসূলুল্লাহ (দ:)’এর বাণীর কোনো উল্লেখ নেই, বরং ওই মহিলা সাহাবী’র আমল/কর্ম সম্পর্কে বর্ণনা রয়েছে। বর্ণনাকারী ইমাম বুখারী (রহ:) ওই মহিলা সাহাবী’কে ‘ফক্বীহ’ বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি নিজ এজতেহাদ অনুসারেই এ রকম আমল করতেন। উপরন্তু, ইমাম বুখারী (রহ:) এটার উল্লেখ ‘তা’লীক্বান’-এ করেন, যা’তে এসনাদ তথা বর্ণনাকারীদের কোনো পরম্পরার উল্লেখ-ই নেই।

/- মুজতাহিদ ইমামবৃন্দের অনুসরণ হতে পলায়মান এবং ফিক্বহী সিদ্ধান্তে সংখ্যাগরিষ্ঠের পথ হতে মুখ ফিরিয়ে নেয়া

ডাক্তার জাকিরের ভাষণ ও প্রভাষণ হতে প্রতীয়মান হয় যে তিনি কোনো (মুজতাহিদ) ইমামের অনুসারী নন। বস্তুতঃ তিনি গায়রে মুক্বাল্লিদ ও লা-মাযহাবী হয়ে (সমস্ত কিছুকে) জায়েয ফতোয়াবাজির ফাঁদে আটকা পড়েছেন এবং রয়েছেন নিত্যনতুন বিষয়াদির প্রেমাসক্ত। তিনি নিজে নির্দিষ্ট কোনো ইমামের অনুসরণ-ই শুধু পরিহার করেননি, বরঞ্চ সর্বসাধারণকেও তাক্বলীদ পরিত্যাগ করার শিক্ষা দিচ্ছেন। কোনো ইমামের হোক, কিংবা হোক কোনো দৃষ্টিভঙ্গির বা সিদ্ধান্তের, ডাক্তার নায়েক যেসব ফতোয়া ব্যাখ্যা করেন, তা তিনি নিজের সাথে (সর্বদা) সংযুক্ত করেন। কখনো কখনো তিনি মুজতাহিদের প্রকৃতি ধারণ করেন এবং ফতোয়াসমূহের ব্যাখ্যা করেন; অথচ ফতোয়া বর্ণনা করার সময় ওই ফতোয়া-দাতা ইমামের নাম তাঁর উল্লেখ করা উচিৎ, যাতে শ্রোতামণ্ডলী ফতোয়াটি স্রেফ ক্বুরআন ও সুন্নাহ হতে প্রমাণিত বলে ভুল বোঝাবুঝির মুখোমুখি না হন। তাছাড়া মানুষেরা অন্যান্য বিষয়েরও অনুশীলন করেন, চাই তা প্রমাণিত হোক ক্বুরআন-হাদীস থেকে বা কোনো মুজতাহিদের দৃষ্টিভঙ্গি হতে, যেগুলো প্রকৃতপক্ষে সঠিক নয়। নিচের উদাহরণ থেকে বিষয়টি বোধগম্য হবে:

(ক) বিনা অযূ’তে ক্বুরআন মজীদ স্পর্শ করা জায়েয/অনুমতিপ্রাপ্ত।

(উক্ত বইয়ের) এক স্থানে ডাক্তার নায়েক বলেন, “বিনা অযূ’তে ক্বুরআন মজীদ স্পর্শ করা জায়েয হওয়া উচিত।”

ডাক্তার জাকির নায়েকের এই বক্তব্য لاَّ يَمَسُّهُ إِلاَّ ٱلْمُطَهَّرُونَ (অযূ-সম্পন্ন ব্যক্তিবর্গ ব্যতিরেকে যেনো ক্বুরআন স্পর্শ না করে; সূরা ওয়া’ক্বি’আহ, ৭৯) - আয়াতটির খেলাফ এবং মুজতাহিদীন ইমামবৃন্দের ফতোয়ারও পরিপন্থী।

(খ) জুমুআ’র নামাযের খুতবাহ আরবী ভাষায় হওয়া উচিত নয়; বরং তা স্থানীয় ভাষায় হওয়া উচিত। 

(বইয়ের) আরেক জায়গায় জুমুআ’র নামাযের খুতবাহ প্রসঙ্গে ডাক্তার জাকির নায়েক বলেন, “আমি উপলব্ধি করি আমাদের দেশে জুমুআ’র খুতবাহ স্থানীয় ও মাতৃভাষাগুলোতে প্রদানের ওপর গুরুত্বারোপ করা উচিৎ।”

অথচ বাস্তবতা হলো, রাসূলুল্লাহ (দ:)’এর যুগ হতে অদ্যাবধি, প্রজন্ম হতে প্রজন্মান্তরে, জুমুআ’র নামাযের খুতবাহ আরবীতেই দেয়া হচ্ছে। বর্তমানে ডাক্তার জাকির দাবি করছেন যে ওই খুতবাহ স্থানীয় ভাষায় দেয়া উচিৎ, যাতে মানুষেরা বুঝতে পারেন। কিন্তু এই উপযোগী কৌশল (আরবীভাষী নন এমন ব্যক্তিদের বোঝার সুবিধা) প্রিয়নবী (দ:)’র যুগেও বর্তমান ছিলো। তথাপি তিনি আরবীতেই খুতবাহ দিতেন। তা অন্য কোনো ভাষায় প্রদানের আদেশ তিনি যেমন দেননি, তেমনি পরবর্তী সময়ে ভাষান্তরেরও হুকুম তিনি জারি করেননি। অনুরূপভাবে, সাহাবায়ে কেরাম (রা:), তাবেঈন (রহ:), তাবে’ তাবেঈন (রহ:) এবং তাঁদের পরবর্তীকালের পুণ্যাত্মাবৃন্দ (রহ:) আরবভূমি হতে দূর-দূরান্তে বসতি স্থাপন করেন। তাঁরা পূর্ব ও পশ্চিমে ইসলাম ধর্ম প্রচার করেন, কিন্তু তাঁরা সদাসর্বদা-ই খুতবাহ আরবী ভাষায় দেন। অথচ দ্বীন-ইসলাম প্রচারে তাঁদের তাকিদ আজকের দিনের মানুষের তাকিদের চেয়েও বেশি ছিলো। কিছু সাহাবা (রা:) ও তাবেঈন (রহ:) বিদেশি ভাষা ভালোই জানতেন, তবু তাঁরা খুৎবাহ আরবী ভাষাতেই দিতেন। মোদ্দা কথা হলো, খুলাফায়ে রাশেদীন (রা:) ও তাবেঈন (রহ:)’এর অনুশীলিত এ রীতি ও এটার ওপর তাঁদের অটল থাকা এবং সমগ্র উম্মত কর্তৃক এর অবিরত চর্চা করাই স্পষ্ট প্রমাণ করে যে খুতবাহ আরবী ভাষায় দেয়াটা অপরিহার্য। এটা এমনই এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যে ইমাম মালেক (রহ:) বলেন, জুমুআ’র নামায সঠিক হবার জন্যে খুৎবাহ আরবীতে প্রদান করা জরুরি; এমন কী যদি পুরো জামা’আত বিদেশি/অনারব এবং আরবীতে অদক্ষ জনগোষ্ঠীও হয়, তা-ও তা করা বাঞ্ছনীয়। জামাআতের মধ্যে কেউই (ইমামসহ) আরবী বলতে না জানলে তাদের জন্যে যোহরের নামায পড়া তখন বাধ্যতামূলক হবে, আর জুমুআ’র নামায বাতিল হয়ে যাবে।

ولو كان الجماعة عجما لا يعرفون العربية ، فلو كان ليس فيهم من يحسن الإتيان بالخطبة عربية لم يلزمهم جمعة . حاشية الدسوقي على الشرح الكبير ٣٧٨⁄١ نقلا عن المقالات الفقهية     

শাহ ওলীউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহেলভী বলেন, “(জুমুআ’র) খুৎবাহ আরবী ভাষায় দেয়া জরুরি, কেননা এটা পূর্ব ও পশ্চিমদেশীয় সকল মুসলমানের নিরন্তর আচরিত প্রথা/রীতি ছিলো।” [মুসাফফা শরহে মুওয়াত্তা, ১৫২ পৃষ্ঠা, ফারূক্ব-দিল্লী]

(গ) তিন তালাক্বের স্থলে এক তালাক্ব-ই কার্যকর হওয়া উচিৎ।

ডাক্তার জাকির নায়েক বলেন, “তিন তালাক্বের জন্যে বহু শর্ত রয়েছে। এগুলোর সবই (পূরণ অবস্থায়) পাওয়া অসম্ভব ব্যাপার। সৌদি আরব হতে ৩০০টি ফতোয়া বিদ্যমান। অতএব, তালাক্ব একটা-ই; আধুনিক পরিস্থিতিতে তালাক্ব একটা-ই হওয়া উচিৎ।” [জাকির নায়েকের প্রভাষণ, জাকির নায়েকের বাস্তবতা হতে সংকলিত; ৩৩১ পৃষ্ঠা]

অথচ সমস্ত সাহাবায়ে কেরাম (রা:), তাবেঈন (রহ:), চারজন মুজতাহিদ ইমাম, সংখ্যাগরিষ্ঠ উম্মত এবং সৌদির বর্তমান সব নামী-দামী ‘উলামা’ এ কথা বলেছেন যে, তিন তালাক্ব তখন-ই কার্যকর হবে যখন কেউ এক বসায় তিন তালাক্ব উচ্চারণ করবে; একবার বল্লে তা কার্যকর হবে না। এই সিদ্ধান্তে নির্ভরযোগ্য কোনো আলেম-ই দ্বিমত পোষণ করেননি; ব্যতিক্রম শুধু ইবনে তাইমিয়া ও তার ছাত্র ইবনে কাইয়্যেম আল-জাওযিয়্যা। কিন্তু সমগ্র উম্মত, যাঁদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত মহান তাবেঈন (রহ:) ও চার মাযহাবের ইমাম - সর্ব-হযরত আবূ হানীফা (রহ:), মালেক (রহ:), শাফেঈ (রহ:) ও আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ:), তাঁদের সিদ্ধান্তের মোকাবেলায় ওই দু জনকে কখনোই অনুসরণ করা যায় না। এ ধরনের একটি সর্বসম্মত সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে ডাক্তার নায়েক উম্মাহ’কে বিভ্রান্ত করেছেন। তিন তালাক্বের ‘৩’ উচ্চারণ দ্বারা তা বলবৎ হওয়ার সিদ্ধান্তটি স্পষ্টভাবে ক্বুরআনের আয়াত, অগণিত আহাদীস ও সাহাবায়ে কেরাম (রা:)’এর আচরিত রীতিসমর্থিত। নিম্নের কিছু আহাদীস অধ্যয়ন করুন:


وقال الليث عن نافع كان ابن عمر إذا سئل عمن طلق ثلاثا قال لو طلقت مرة أو مرتين (لكان لك الرجعة) فإن النبي صلى الله عليه وسلم أمرني بهذا (أى بالمراجعة) فإن طلقها ثلاثا حرمت حتى تنكح زوجا غيره . بخاري ٧٩٢⁄٢ و ٨٠٣⁄٢
(বিখ্যাত তাবেঈ) ইমাম নাফেঈ (রহ:) বর্ণনা করেন, একবার সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ বিন উমর (রা:)’এর কাছে জনৈক ব্যক্তি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়, যে তিনটি তালাক্ব দিয়েছিলো। হযরত ইবনে উমর (রা:) উত্তরে বলেন, “তুমি যদি এক বা দুই তালাক্ব দিতে (তাহলে ফিরিয়ে নিতে পারতে); কেননা রাসূলুল্লাহ (দ:) আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন (ওইভাবে) ফিরিয়ে নিতে। কিন্তু তুমি তিন তালাক্ব দিয়ে থাকলে ওই নারী হারাম হয়ে যাচ্ছে, যতোক্ষণ না সে অন্য কাউকে বিয়ে করছে।” [আল-বুখারী]
عن مالك بلغه : أن رجلا جاء إلى عبد الله ابن مسعود فقال : إني طلقت امرأتي ثمانى تطليقات ، قال ابن مسعود ، فماذا قيل لك؟ قال : قيل لي : إنها قد بانت مني ، فقال ابن مسعود صدقوا . الحديث . الموطا للإمام مالك ١٩٩
ইমাম মালেক (রহ:) হতে বর্ণিত হয়েছে যে জনৈক ব্যক্তি হযরত আবদুল্লাহ বিন মাসউদ (রা:)’এর কাছে আসেন এবং বলেন, “আমি আমার স্ত্রীকে ৮টি তালাক্ব দিয়েছি।” হযরত ইবনে মাসউদ (রা:) জিজ্ঞেস করেন, মানুষেরা তোমার সাথে কী (আচরণ) করেছে? ওই ব্যক্তি উত্তর দেন, “আমার স্ত্রীর সাথে আমার বিবাহ-বিচ্ছেদ ঘটানো হয়েছে।” অতঃপর হযরত ইবনে মাসউদ (রা:) বলেন, “তারা (মানুষ) সত্য বলেছে (মানে তিন তালাক্ব কার্যকর হয়েছে)।” [ইমাম মালেক, ‘মুওয়াত্তা’]
حدثنا على بن محمد بن عبيد الحافظ نا محمد بن شاذان الحوهرى نا معلى بن منصور نا شعيب بن رزيق أن عطاء الخراسانى حدثهم عن الحسن قال نا عبد الله بن عمر أنه طلق امرأته تطليقة وهى حائض ثم أراد أن يتبعها بتطليقتين أخريين عند القرأين فبلغ ذلك رشول الله صلى الله عليه وسلم فقال يا ابن عمر ما هكذا أمرك الله إنك قد أخطأت السنة . والسنة أن تستقبل الطهر فيطلق لكل قرء قال فأمرنى رسول الله صلى الله عليه وسلم فراجعتها ثم قال إذا هى طهرت فطلق عند ذلك أو أمسك فقلت يا رسول الله أرأيت لو أنى طلقتها ثلثا أكان يحل لي أن أراجعها قال لا ، كانت تبين منك وتكون معصية. سنن الدار قطنى ٤٣٨/٢ زاد المعاد ٢٥٧/٢ مصنف ابن أبي شيبة بحواله عينى شرح كنز ١٤١ سنن الدار قطنى ٣١/٤ مطبوعه قاهرة
ইমাম হাসান (রা:) বর্ণনা করেন, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা:) আমাদের জানিয়েছেন যে তিনি তাঁর স্ত্রীকে হায়য তথা ঋতুস্রাবকালে একটি তালাক্ব দেন। অতঃপর তিনি ইচ্ছা করেন বাকি দুই তালাক্ব স্ত্রী পবিত্র হলে দেবেন। মহানবী (দ:)’কে এ ব্যাপারে জানানো হয় এবং তিনি তাঁকে বলেন, “ওহে ইবনে উমর! আল্লাহ তোমাকে এ রকম করার নির্দেশ দেননি; তুমি (হায়য অবস্থায় তোমার স্ত্রীকে তালাক্ব দিয়ে) সুন্নাহ হতে বিচ্যুত হয়েছো। সুন্নাত হলো, তুমি তার পবিত্রতার সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করবে; আর প্রতিটি পবিত্র সময়কালে একটি তালাক্ব দেয়া উচিৎ।” হযরত ইবনে উমর বলেন, এরপর রাসূলে খোদা (দ:) আমাকে (তালাক্ব) ফিরিয়ে নেয়ার আদেশ করেন। আমি তা-ই করি। অতঃপর তিনি আমায় বলেন, “তোমার স্ত্রী পবিত্র হলে দুটি হতে যে কোনো একটি পন্থা তোমাকে বেছে নিতে হবে: হয় তাকে তালাক্ব দেবে, না হয় তাকে (স্ত্রী হিসেবে) রেখে দেবে।” হযরত ইবনে উমর (রা:) বলেন, আমি হুযূর পূর নূর (দ:)’কে জিজ্ঞেস করি, এয়া রাসূলাল্লাহ (দ:)! আমি যদি তিন তালাক্ব দিতাম, তাহলে কি তা ফিরিয়ে নেয়া আমার জন্যে হালাল বা বৈধ হতো? রাসূলে খোদা (দ:) উত্তর দেন, “না, সে ক্ষেত্রে তোমার স্ত্রীর সাথে তোমার বিবাহ-বিচ্ছেদ ঘটতো এবং তোমার ওই কাজটি (তিন তালাক্ব) একটি পাপ হতো।” [সুনানে দারু ক্বুতনী]     
অতএব, আপনারা দেখতে পেলেন যে ওপরে উল্লেখিত আহাদীসে তিন তালাক্বে তিনটির পক্ষে ফতোয়া কার্যকর হওয়ার কথা-ই বলা হয়েছে। এ রকম বহু আহাদীস বর্তমান রয়েছে, যেখানে তিন তালাক্ব তিনটিকে বুঝিয়েছে, একটিকে নয়। 

জরুরি নোট: ডাক্তার জাকির তাঁর প্রভাষণে ৩০০ জন সৌদি আলেমের রেফারেন্স টেনেছেন। এরপর তিনি নিজের মনগড়া মতামত পেশ করেছেন। কিন্তু সৌদি আরবের নামী-দামী মুফতীবৃন্দ নিজেদের গবেষণায় তিন তালাক্বকে তিনটি বল্লেও তাঁদের মধ্যে কারা কারা ডাক্তার জাকিরের ওই রেফারেন্সের আওতায় পড়েছেন, তাঁদের নাম কিন্তু ডাক্তার জাকির নায়েক উল্লেখ করেননি। সৌদি উলামাদের দেয়া তিন তালাক্বের পক্ষে ফতোয়াটি নিচে দেখুন: 

بعد الاطلاع على البحث المقدم من الأمانة العامة لهيئة كبار العلماء والمعد من قبل لحنة الدائمة للبحوث والإفتاء في موضوع "الطلاق الثلاث بلفظ واحد" وبعد دراسة المسئلة وتداول الرأي واستعراض الأقوال التى قيلت فيها ومناقشة ما على كل قول من إيراد توصل المجلس بأكثريته إلى اختيار القول بوقوع الطلاق الثلاث بلفظ ثلاثا...الخ (مجلة التحوث الإسلامية المجلد الأول ، العدد الثالث سنة ١٣٩٧    
    
-যাইনুল ইসলাম ক্বাসেমী এলাহাবাদী
সহকারী মুফতী, দারুল ইফতা 
দারুল উলূম দেওবন্দ
২০/০৩/১৪৩২ হিজরী মোতাবেক ২৪/০২/২০১১ খৃষ্টাব্দ।

[দারুল উলূম দেওবন্দের ফতোয়া’র অনুবাদ এখানে সমাপ্ত]

ডাক্তার জাকির নায়েকের বিভ্রান্তি সম্পর্কে দেওবন্দী ফতোয়াটি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ফিক্বাহ-বিষয়ক হওয়ায় তাঁর আক্বীদা-বিশ্বাসগত বিভ্রান্তি ও বিচ্যুতির ব্যাপারে আমি আরো কিছু লেখার কথা মনস্থ করেছি। তবে পাঠকমণ্ডলীকে এ ব্যাপারে অবশ্যই নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করতে হবে। কেউ অন্তরে পক্ষপাত নিয়ে এই আলোচনায় প্রবেশ করলে সত্যে পৌঁছুতে পারবেন বলে মনে হয় না। দ্বিতীয়তঃ আমি ডাক্তারের এবং সুন্নী উলামাবৃন্দের কিছু ভিডিও ক্লিপ প্রামাণ্য দলিল হিসেবে উপস্থাপন করবো। সেগুলো ইংরেজি ও উর্দূ ভাষায় ইউটিউবে বিদ্যমান। এমতাবস্থায় কেউ সেগুলো না বুঝে পক্ষপাতিত্বমূলক মনোভাব গ্রহণ করবেন না। 

১/ - মহানবী (দ:)’র শানে গোস্তাখি    
       
ডাক্তার জাকির তাঁর একটি ভিডিও’তে আল্লাহ’র সান্নিধ্য লাভের জন্যে অসীলা/মাধ্যম তালাশের ব্যাপারে মন্তব্য করতে গিয়ে বেসাল তথা পরলোকে আল্লাহর সাথে মিলনপ্রাপ্ত আম্বিয়া (আ:) ও আউলিয়া (রহ:)’র আধ্যাত্মিক মধ্যস্থতা বা তাঁদের রূহানী সাহায্য প্রার্থনার ব্যাপারে বলেন, “শাফায়াত/সুপারিশ প্রার্থনা ও অসীলা গ্রহণ ২৫টি আয়াতে নিষিদ্ধ করা হয়েছে; স্রেফ আল্লাহ যাঁদেরকে অনুমতি দেবেন, তাঁরাই আখেরাতে সুপারিশ করতে পারবেন। আজকের তারিখে আমি ‘মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলেইহে ওয়া সাল্লামের কাছেও (সাহায্য) চাইতে পারবো না। অন্যান্য ’বাবা’দের কথা ছাড়ুন, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম’কেও মান্য করা আমার জন্যে হারাম! যে ব্যক্তি ‘মারা’ গেছেন, (যদিও) তাঁকে আমি ইজ্জত করি, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম’কে আমি ভালোবাসি!” ভিডিও লিঙ্ক: https://www.youtube.com/watch?v=x4e6mJk00y8; [নাউযুবিল্লাহ মিন যালেক] উর্দূতে তিনি শেষবার বলেছেন, “মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম’কো ভি মান্না হামারে লিয়ে হারাম হ্যায়।” পরে অবশ্য সমালোচনার মুখে তিনি মাফ চেয়ে বলেছেন এটা ‘স্লিপ অফ টাং’ বা মুখ ফসকে বেরিয়ে গিয়েছিলো; তিনি নাকি বলতে চেয়েছিলেন ‘মাঙনা’ যার অর্থ চাওয়া বা যাচ্ঞা করা। আমার বক্তব্য হলো, তাঁর কথার ধারাবাহিকতায় কিন্তু বেয়াদবি-ই প্রকাশ পেয়েছে এবং এ ধরনের কথা মুখ ফসকে কেউ বলেন না। কেননা তাঁর কথার মধ্যে ‘মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম কো ভি (রাসূল-কেও মান্য করা হারাম)’ শব্দটি বলে দিচ্ছে তিনি যা বলেছিলেন আসলে তা-ই বুঝিয়েছিলেন। ওই কথার সাথে ‘মাঙনা’ (চাওয়া) শব্দটি ব্যাকরণগতভাবে মিলে না; বরঞ্চ ‘মান্না’ (মান্য করা) শব্দটি-ই মিলে। তিনি এ কথা বলতে না চাইলে তাঁকে বলতে হতো ‘মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম’সে মাঙনা হামারে লিয়ে হারাম হ্যায়’, মানে ‘মহানবী (দ:)’র কাছে চাওয়া আমার জন্যে হারাম।’ মোদ্দা কথা হলো, রাসূল (দ:)’এর প্রতি মনের মধ্যে হিংসা-বিদ্বেষ যাদের, কেবল তারাই এই ধরনের কথা বলতে পারে। ডাক্তার জাকির বলেন ‘জো শাখস্ মার চুকা হ্যায়, হাম উনসে ইজ্জত করতে হ্যায়, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম’সে মহব্বত করতে হ্যায়...” মানে যে ব্যক্তি মারা গেছেন, আমি তাঁকে ইজ্জত করি, রাসূলুল্লাহ (দ:)’কে মহব্বত করি।” দেখুন কীভাবে ডাক্তার নায়েক কথার মারপ্যাঁচে প্রিয়নবী (দ:)’কে ‘মৃত’ বলেছেন! অথচ ইসলামী আক্বীদা-বিশ্বাস হলো তিনি হায়াতুন্নবী (দ:) তথা রূহানীভাবে জীবিত। এই বিষয়ে আমরা ক্বুরআন-হাদীস ও বিজ্ঞ সুন্নী আলেম-উলামার উদ্ধৃতি দেবো, ইনশা’আল্লাহ।

আল্লাহতা’লা তাঁর পাক কালামে ঘোষণা করেন:

وَلاَ تَقُولُواْ لِمَنْ يُقْتَلُ فِي سَبيلِ ٱللَّهِ أَمْوَاتٌ بَلْ أَحْيَاءٌ وَلَكِن لاَّ تَشْعُرُونَ

অর্থ: আর যারা আল্লাহর পথে ক্বুরবানী হয়, তাদেরকে মৃত বোলো না, বরঞ্চ তারা জীবিত; তোমরা (এ ব্যাপারে) জানো না। [আল-ক্বুরআন, ২:১৫৪]

এই আয়াতটি জ্বেহাদে শহীদানের ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়েছে। তাঁদের সম্পর্কে ’মৃত’ শব্দটি উচ্চারণ করতেও নিষেধ করা হয়েছে এতে। লক্ষ্য করুন, ‘নেহি’ তথা নিষেধসূচক ক্রিয়ায় এ কথা বলা হয়েছে। আল্লাহতা’লার যাবতীয় আদেশ-নিষেধ যেভাবে জারি হয়েছে, ঠিক সেভাবেই এই আজ্ঞা প্রদান করা হয়েছে। অতঃপর বলা হয়েছে ‘বরঞ্চ তারা জীবিত, তোমরা তা জানো না; তথা অবহিত না।’ এই আয়াতটি ডাক্তার জাকিরের মূর্খতাপ্রসূত বক্তব্যের মূলোৎপাটন করে এবং প্রমাণ করে যে ধর্মীয় সাধনায় জীবন উৎসর্গকারী পুণ্যাত্মাবৃন্দকে ‘মৃত’ বলে সম্বোধন করা ও তাতে বিশ্বাস করা আল্লাহতা’লার সরাসরি আদেশের বিরুদ্ধাচরণ। জেনে রাখুন, শহীদানের মর্তবা-মর্যাদা পুণ্যাত্মাদের মধ্যে তৃতীয় সারির। প্রথমে আছেন আম্বিয়া (আলাইহিমুস্ সালাম)। দ্বিতীয়তঃ সিদ্দীকীন তথা সত্যনিষ্ঠ বুযূর্গানে দ্বীন/আউলিয়া কেরাম (রহ:)। শহীদানের পরে চতুর্থ স্তরে আছেন সালেহীন তথা নেককার বান্দা-মণ্ডলী। এটা আল্ ক্বুরআনেই বর্ণিত হয়েছে। এক্ষণে প্রশ্ন জাগে, আম্বিয়াকুল শিরোমণি হযরতে রাসূলে খোদা (দ:)’কে কীভাবে ‘মৃত’ বলা যায়? স্মরণে রাখা দরকার যে, তিনি একটি জ্বেহাদ-শেষে ফিরে এসে হাদীসে এরশাদ করেন: 


رجعنا من الجهاد الأصغر إلى الجهاد الأكبر

অর্থ: আমরা ছোট জ্বেহাদ থেকে প্রত্যাবর্তন করলাম বৃহৎ জ্বেহাদের দিকে (البيهقي ইমাম বায়হাক্বী)। আধ্যাত্মিক জ্ঞানে সমৃদ্ধ হক্কানী আলেম-উলামা এই ‘বৃহৎ জ্বেহাদ’ বলতে নিজের নফস্ তথা একগুঁয়ে জীব-সত্তার বিরুদ্ধে সংগ্রামকেই বুঝেছেন। এর মোকাবেলায় ময়দানের জ্বেহাদ-ও ক্ষুদ্রকায়। আম্বিয়া (আ:) ও আউলিয়া (রহ:) নফস তথা আত্ম-দমনের এ সাধনায় সারা জীবন উৎসর্গ করেন বিধায় তাঁরাও উপরোক্ত আয়াতে করীমার উদ্দিষ্ট পুণ্যাত্মাবৃন্দ। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, ডাক্তার জাকির নায়েকের ’সালাফী’ সহযোগীরা এই হাদীসটিকে ‘যয়ীফ’ বা দুর্বল বলে প্রমাণের অপচেষ্টা করে থাকেন। কিন্তু প্রাথমিক যুগের আলেম-উলামা এটাকে রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করেছেন। অতএব, পাঠককুল তাদের ধোকায় পড়বেন না! এ ব্যাপারে আমাদের শেষ কথা হলো, আল্লাহর প্রিয় পুণ্যবান বান্দাদেরকে ’মৃত’ বলে সম্বোধন করা নিষেধ। আল্লাহতা’লা তাঁর পাক কালামে ‘বরঞ্চ তারা জীবিত’ বলে তাকিদ দেয়ায় বোঝা যায় তাঁরা রূহানী/আধ্যাত্মিকভাবে জীবিত। ইমাম জালালউদ্দীন সৈয়ূতী (রহ:)’র রচিত তাফসীরে জালালাইন শরীফে ওই আয়াতে করীমার ব্যাখ্যায় একটি হাদীসের উদ্ধৃতি দেয়া হয়েছে, যেখানে বর্ণিত হয়েছে যে তাঁদের রূহগুলো সবুজ পাখির আকৃতিতে আছেন এবং তাঁরা বেহেশতের সর্বত্র উড়ে বেড়াচ্ছেন।

সুন্নী উলামাবৃন্দ সূরা বাক্বারা’র উল্লেখিত ১৫৪ নং আয়াতটির ব্যাখ্যায় আরো ব্যক্ত করেন যে সেটা শহীদানের জিন্দা হওয়ার বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আলোকপাত করলেও ওই বৈশিষ্ট্য একমাত্র শহীদানের জন্যেই খাস তথা নির্দিষ্ট নয়। আহাদীসে পাকে আম্বিয়া (আ:) ও আউলিয়া (রহ:)’র ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য বলে সাব্যস্ত হয়েছে। এ কারণেই আল্লাহর বেসালপ্রাপ্ত প্রিয় বান্দা-মণ্ডলীর তাওয়াসসুল, তাশাফফু ও এস্তেগাসাহ করা হয়ে থাকে। এই প্রসঙ্গে ইমাম ইঊসুফ নাবহানী (রহ:) প্রণীত ‘শওয়াহিদুল হক্ব’ গ্রন্থের উদ্ধৃতি অনুযায়ী ইমাম শেহাবউদ্দীন রামলী (রহ:) বলেন, “আম্বিয়া (আ:) ও আউলিয়া (রহ:)’কে তাঁদের বেসালপ্রাপ্তির পরও অসীলা/মধ্যস্থতাকারী স্থাপন করা যায়। আম্বিয়া (আ:)’র মো’জেযাত/অলৌকিকত্ব ও আউলিয়া (রহ:)’র কারামত/অলৌকিকত্ব তাঁদের বেসালপ্রাপ্তির পর শেষ হয়ে যায় না। হাদীস শরীফ ঘোষণা করে যে আম্বিয়া (আ:) (রূহানীভাবে) জীবিত এবং তাঁরা তাঁদের মাযার-রওযায় সলাত আদায় করেন এবং হজ্জ্বও সমাপন করেন। আরো জ্ঞাত হয়েছে যে শহীদান-বৃন্দও জীবিত এবং তাঁরা যোদ্ধাদেরকে সাহায্য করে থাকেন।” ডাক্তার জাকির পীস টিভিতে বহুবার মাযারস্থ আম্বিয়া (আ:) ও আউলিয়া (রহ:) সাহায্য করতে পারেন না মর্মে দাবি করেছেন। তিনি এ কথাও বলেছেন যে মাযারস্থ পুণ্যাত্মাবৃন্দের জন্যে দুআ করতে হবে; তাঁদের সুপারিশ চাওয়া যাবে না। এটা তাঁর মুরব্বি শায়খ নজদীর বক্তব্যেরই ভাঙ্গা রেকর্ড। যেহেতু শায়খ নজদীর খণ্ডনে সুন্নী উলামা-মণ্ডলীর বইপত্র বর্তমানে প্রচুর ভাষান্তরিত হয়েছে এবং হচ্ছে, সেহেতু এখানে এর বিশদ ব্যাখ্যায় যাবো না। আমি ডাক্তার নায়েকের বক্তব্যের খণ্ডনে কেবল একটি ইংরেজি ভিডিও ক্লিপ পেশ করছি, যা’তে সিরীয় শায়খ নিনোউয়ী সাহেবসহ অন্যান্য সুন্নী উলামা প্রামাণ্য দলিল উপস্থাপন করেছেন: https://www.youtube.com/watch?v=296piV1_pgw [তরুণ সুন্নী এ্যাকটিভিস্টদের প্রতি আমার অনুরোধ, সম্ভব হলে এতে বাংলা সাব-টাইটেল যুক্ত করবেন। অনেকে তাহলে বিষয়টি সম্পর্কে জানতে পারবেন। ধন্যবাদ]

২/ - অসীলা সম্পর্কে ২৫টি আয়াতের ভুয়া দাবি

আগেই বলেছি, ডাক্তার নায়েক অসীলা গ্রহণের বিপক্ষে ক্বুরআন মজীদে ন্যূনতম ২৫টি আয়াতে করীমা রয়েছে বলে দাবি করে থাকেন। তাঁর সেই দাবিটি শ্রীলঙ্কায় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছিলো কিছু বছর আগে। তিনি ওই সময় সে দেশ সফর করছিলেন। সফরশেষে এয়ারপোর্টে শ্রীলঙ্কার আহলে সুন্নাত সংস্থার নেতৃবৃন্দ তাঁকে পাকড়াও করেন। সুন্নী বীর হাফেয এহসান ক্বাদেরী সাহেব তাঁকে প্রশ্ন করেন, “আপনি দাবি করে থাকেন যে আল-ক্বুরআনে অসীলা গ্রহণের বিপক্ষে ২৫টি আয়াত বিদ্যমান। আপনি কি সেগুলোর মধ্যে স্রেফ একটি আয়াতের উদ্ধৃতি দেবেন?” ডাক্তার জাকির নায়েক উত্তরে বলেন, “আখেরাতে (শেষ বিচার দিবসে) শাফাঅাত/সুপারিশের বর্ণনা কেবল দু’বার এসেছে পবিত্র ঐশীগ্রন্থে।” হাফেয এহসান ক্বাদেরী সাহেব পাল্টা আঘাত হানেন, “সেটা তো শাফাআত/সুপারিশ প্রসঙ্গ। আমরা অসীলা/মধ্যস্থতা সম্পর্কে কথা বলছি।” এমতাবস্থায় ডাক্তার জাকির নায়েক গা বাঁচাতে বলেন তাঁর সংস্থায় ই-মেইলে করে প্রশ্নটি উপস্থাপন করতে। হাফেয এহসান ক্বাদেরী সাহেব তখন বলেন তাঁরা কয়েক বছর যাবৎ এ ব্যাপারে জানতে চেয়ে ই-মেইল করেও জবাব পাননি। ডাক্তার জাকির শ্রীলঙ্কায় ধরা খেয়ে ফেরার পরে তাঁরা আবারো ই-মেইল প্রেরণ করেন, কিন্তু ডাক্তারের পক্ষ থেকে কোনো সদুত্তর অদ্যাবধি মেলেনি, মিলবেও না কোনো দিন। এর ভিডিও ক্লিপ দেখুন: https://www.youtube.com/watch?v=z4v7NEA5DTs [এই ভিডিও’র বাংলা সাব-টাইটেলও জরুরি]। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, ডাক্তার নায়েক শাফাআত ও অসীলা‘র মধ্যকার পার্থক্যও জানেন না। তিনি আবার নিজেকে দাঈ (প্রচারক) বলে দাবি করেন! তাঁর পীস টিভি’তে কখনোই সুন্নী উলামাবৃন্দের মোকাবেলা তিনি ও তাঁর পক্ষীয় মৌ-লোভীরা করেননি! তা করলে অবশ্যঅবশ্য শ্রীলঙ্কায় ধরা খাওয়ার মতো অবস্থা হতো! বস্তুতঃ পীস টিভির অনুষ্ঠান এক সাজানো নাটক ছাড়া কিছু নয়। সুন্নী মুসলিম প্রচারক ও কমপ্যারেটিভ রিলিজিয়ন বিদ্যাশাস্ত্রের মাস্টার জনাব আহমদ দীদাত যে রকম সরাসরি বাইরে অডিটরিয়ামে মিশনারী পাদ্রীদেরকে বাহাস/বিতর্কে মোকাবেলা করতেন, ঠিক সেভাবে পীস টিভি’র কোনো অনুষ্ঠানে ডাক্তারের কৃত বাহাসের সরাসরি সম্প্রচার কখনোই দেখানো হয়নি। ডাক্তারের এই কর্মকাণ্ড ম্যাচ-ফিক্সিংয়ের মতোই ব্যাপার। আমরা সন্দেহ করি, মার্কিন পাদ্রী ক্যাম্পবেলের সাথে প্রথম বাহাসটিও এই রকম সাজানো নাটক ছিলো। জাকিরভক্ত কিছু তরুণ সব সময়ই দাবি করে থাকে যে ডাক্তার নায়েক অনেক খৃষ্টানকে মুসলমান বানিয়েছেন। কতোটা ফাঁকা এই দাবি! যদি তিনি সত্যিসত্যি তাদেরকে ’মুসলমান’ ধর্মান্তরিত করেও থাকেন, তবু প্রশ্ন জাগে কোন্ আক্বীদা-বিশ্বাসে দীক্ষা দিয়েছেন? হাদীসে এসেছে মুসলমানদের ৭৩টি দল হবে; বাহাত্তরটি হবে জাহান্নামী, একটি কেবল নাজাতপ্রাপ্ত [তিরমিযী]। এমতাবস্থায় ডাক্তারের ভ্রান্ত ‘সালাফী’ আক্বীদায় দীক্ষা নেয়া নও-মুসলিম লোকগুলো আরো বিভ্রান্তি-ই ছড়াবে। এসব যৌক্তিক প্রশ্ন কি মস্তিষ্ক-ধোলাইকৃত তরুণদের মাথায় আসে কখনো? প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে অসীলা-বিষয়ে হাফেয এহসান ক্বাদেরী সাহেব উর্দূতে একটি লেকচার দিয়েছেন যার ভিডিও ক্লিপ নিচে দেয়া হলো: https://www.youtube.com/watch?v=yg5eeHu74os।  

৩/ - এয়াযীদ-বন্দনা    

সবশেষে ডাক্তার জাকির নায়েক কর্তৃক পাপিষ্ঠ এয়াযীদের গুণকীর্তন সম্পর্কে সংক্ষেপে কিছু বলে এই লেখাটি শেষ করবো। তিনি ২০০৭ সালের ডিসেম্বর মাসে (মহর্রম চাঁদে) এয়াযীদকে ‘রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু’ (আল্লাহ তার প্রতি সন্তুষ্ট হোন) অভিহিত করেন। তিনি এক সমাবেশে ভাষণ দানকালে আরো বলেন, কারবালা’র ঘটনা রাজনৈতিক (মানে ধর্মীয় কোনো সংশ্লিষ্টতা এতে নেই)। ডাক্তারের এহেন দায়িত্বহীন ও খামখেয়ালিপূর্ণ বক্তব্য ওই সময় মুসলমান সমাজে উত্তেজনা সৃষ্টি করে। তখনকার সৌদি-ভিত্তিক আরব নিউজ নিম্নের খবরটি পরিবেশন করে: http://www.arabnews.com/node/307208। এয়াযীদের কুকীর্তি সম্পর্কে সবচেয়ে বিস্তারিত তথ্য-উপাত্ত রয়েছে পাকিস্তানভিত্তিক ‘আহলুস্ সুন্নাহ-ডট-কম’ ওয়েবসাইটে পেশকৃত লেখাটিতে, যার বঙ্গানুবাদ নিচে দেয়া হলো। লিঙ্ক: https://kazisaifuddinhossain.blogspot.com/2017/12/blog-post.html। আশা করি পাঠকমণ্ডলী আমার প্রদত্ত লিঙ্কগুলোর সদ্ব্যবহার করে সত্য উদঘাটনে সক্ষম হবেন। আল্লাহতা’লা আমাদেরকে বাতিলপন্থীদের ধোকা থেকে সুরক্ষিত রাখুন, আমীন। বে-হুরমাতে সাইয়্যেদিল মুরসালীন সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম।

                                      =সমাপ্ত=  
              

   




  

https://scroll.in/article/811508/muslim-clerics-in-india-unite-against-superstar-televangelist-zakir-naik;  http://www.dnaindia.com/india/report-storm-over-fatwa-against-scholar-zakir-naik-1204534;  https://www.correctislamicfaith.com/drzakirnaik.htm