ব্লগ সংরক্ষাণাগার

মঙ্গলবার, ১৬ মার্চ, ২০২১

’নবী পাক (দ:)’ সম্বোধন নিয়ে আপত্তি ও প্রাসঙ্গিক আলোচনা

- এডমিন 

সম্প্রতি প্রিয়নবী (দ:)’কে ‘নবী পাক’ ডাকা নিয়ে কতিপয় গণ্ডমূর্খ মৌ-লোভী অনলাইনে আপত্তি উত্থাপন করেছেন। এরই সূত্র ধরে সালাফী-ওহাবীদের একটি মাহফিলে জনৈক না’ত-গায়ককে ‘নবী পাক (দ:)’এর প্রশংসাসূচক না’ত পরিবেশন করা হতে থামিয়ে দেয়া হয়েছে। এ ভাইরাল ভিডিও নিয়ে সচেতন সুন্নী মুসলমান সমাজে তীব্র সমালোচনার ঝড় বইছে। ইত্যবসরে জনৈক ‘আজহারী’ আলেম প্রিয়নবী (দ:)’কে ‘পুতঃপবিত্র’ প্রমাণের পক্ষে ক্বুরআন-হাদীসভিত্তিক দলিল দেয়ার সময় হযরতে আহলে বায়ত (রা:)’বৃন্দেরও পুতঃপবিত্রতার পক্ষে দলিল দিয়েছেন। সেটা তাত্ত্বিক আলোচনা, যা আমার এই পোষ্টের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় নয়। কেননা, আহলে বায়ত (রা:) ও আসহাব (রা:)’বৃন্দের আপন আপন শান-মান তথা মর্যাদা নিয়ে আমাদের সুন্নীদের মনে কোনো ধরনের দ্বিধা-দ্বন্দ্বই নেই। এখানে গণ্ডগোল বেধেছে ‘আজহারী’ সাহেবের আন্তর্জাতিক, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যীয় রাজনীতিবিষয়ক বক্তব্যটি নিয়ে। তিনি বলেছেন, সৌদি নজদী সরকার ‘এজিদের খেলাফত সঠিক’ প্রমাণার্থে আহলে বায়ত (রা:)’এর মান-মর্যাদাকে যে কোনোভাবে খাটো করতে অপতৎপর। ইরান যেহেতু আহলে বায়ত (রা:)’কে বড় করে দেখায়, সেহেতু সৌদি ওহাবীরা ইরানী শিয়াদেরকে কোনো সুযোগ দিতে রাজি নয়। এই হলো তাঁর কথার সারসংক্ষেপ।
আমরা জানি, উক্ত দুটো দেশ বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যে এবং দুনিয়ার তাবৎ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে ক্ষমতার বলয় সৃষ্টি নিয়ে দ্বন্দ্বে লিপ্ত। আমার মতে দুই বলদ শিং উঁচিয়ে লড়াইয়ে নেমেছে আর নেকড়েরূপী শত্রুরা অপেক্ষা করছে কখন ঘাড় মটকানো যায়! আমাদের দেশের মৌ-লোভীবর্গ ও বিভিন্ন দরবার-খানেকাহ’র অনেক কর্তা ব্যক্তি দেশ দুটোর আর্থিক আনুকূল্যে (তথা পেট্রো-ডলারের মদদে) তাদের সিপাহিতে (foot soldier) হয়েছেন পরিণত। শিয়াপন্থী ইরানীদের পেট্রো-ডলার (মানে পারসিক উটের দুধ ও দুম্বার গোস্ত) যে অনেকেই ভোগ করছেন, তা আর আমাদের অজানা বিষয় নয়। সৌদি নজদী/ওহাবীদের ছিটানো দুম্বার গোস্তের চালান তো বহু আগেই আসা আরম্ভ করেছিলো (১৯৭০/৮০-এর দশকে)। আর এখন আসছে পারসিক উটের দুধ, দুম্বার গোস্ত ও মরিয়ম খেজুরের চালান! তবে আশ্চর্যের বিষয়, ‘আজহারী’ মৌলভীর মতো আলেমবর্গ পারসিক শিয়াদের ব্যাপারে একদম নীরব। শিয়াদের বলয় সৃষ্টির হুমকির ব্যাপারে যে সব সুন্নী লেবাস-পরিহিত মৌ-লোভী নীরব থাকবেন, তাঁদের সম্পর্কে সুন্নী মুসলমানদের সতর্ক হওয়া অতীব প্রয়োজন। এ ব্যাপারে আমার উদাত্ত আহ্বান, আপনারা সত্যিকার সুন্নী হলে পারসিক উটের দুধ ও দুম্বার গোস্ত সরবরাহকারী ও তাদের মদদপুষ্ট সিপাহিদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হোন (সৎসাহস থাকলে অবশ্য)। কয়েক বছর আগে আমি আমার একটি লেখায় দলিল প্রদর্শন করে দেখিয়েছিলাম যে, হযরত আলী (ক:)’এর বিষয়ে বাড়াবাড়ি করে মুসলমানদের মধ্যে দুটো দল ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে। এক দল করবে তাঁর সাথে শত্রুতা, আরেক দল অতি ভক্তি দেখিয়ে অতল গহ্বরে তলিয়ে যাবে। রাসূলুল্লাহ (দ:) ইমামে আলী (ক:)’এর এই ব্যাপারটিকে পয়গাম্বর ঈসা (আ:)’এর সাথে তুলনা করেছেন। ইহুদীরা তাঁকে (পয়গাম্বরকে) ঘৃণা করে পথভ্রষ্ট হয়েছেন, অপর দিকে ঈসায়ীবর্গ তাঁর প্রতি ভক্তিস্বরূপ তাঁকে ‘খোদা’ বানিয়ে বিচ্যুত হয়েছেন। আগ্রহী পাঠকদের জন্যে আমার ওই লেখাটির লিঙ্ক এখানে দেয়া হলো: https://kazisaifuddinhossain.blogspot.com/.../blog-post.html; আমরা উক্ত রওয়ায়াত/বিবরণের আলোকে দেখতে পাচ্ছি যে, খারেজী গোমরাহর দল ও তাদের উত্তরসূরী নজদী-ওহাবীচক্র হযরতে ইমামে আলী (ক:) ও তাঁর পরিবার-সদস্যদের (আহলে বায়ত-রা:) হেয় করতে অপতৎপর; অপর দিকে, শিয়াপন্থী পারস্যদেশীয় পথভ্রষ্ট গোষ্ঠী তাঁর প্রতি অতি ভক্তি প্রদর্শনের অপচেষ্টারত।
শেষ কথা
আমি তাত্ত্বিক আলোচনা করবো না বল্লেও প্রাসঙ্গিক একটি কথা বলে এই পোষ্টের ইতি টানবো। নজদী ওহাবী/মওদূদী/সালাফীচক্র বা পারসিক শিয়াপন্থী গোষ্ঠী যে মানদণ্ড দ্বারাই বিচার-বিবেচনা করুক না কেন, আল্লাহতা’লা কিন্তু তাঁর নিজস্ব মানদণ্ড নির্ধারণ করে দিয়েছেন পাক কালামে। সুবিবেচনাশীল সুন্নী মুসলমান সমাজকে আমি এ বিষয়টি নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করার উদাত্ত আহ্বান জানাই। আল্লাহতা’লা এরশাদ ফরমান:
وَمَن يُطِعِ ٱللَّهَ وَٱلرَّسُولَ فَأُوْلَـٰئِكَ مَعَ ٱلَّذِينَ أَنْعَمَ ٱللَّهُ عَلَيْهِم مِّنَ ٱلنَّبِيِّينَ وَٱلصِّدِّيقِينَ وَٱلشُّهَدَآءِ وَٱلصَّالِحِينَ وَحَسُنَ أُولَـٰئِكَ رَفِيقاً
অর্থ: এবং যে ব্যক্তি আল্লাহ ও রাসূল (দ:)’এর হুকুম মানে, তবে সে তাঁদেরই সঙ্গ লাভ করবে যাঁদের প্রতি আল্লাহ অনুগ্রহ করেছেন - অর্থাৎ পয়গাম্বরবৃন্দ, সিদ্দীক্ব (সত্যনিষ্ঠ)-মণ্ডলী, শহীদান ও সৎকর্মপরায়ণ (সালেহীন)-বৃন্দ [সূরা নিসা, ৬৯ আয়াত; নূরুল এরফান]। আম্বিয়া (আ:)’বৃন্দের সম-মর্যাদা কোনো উম্মতেরই হবে না। দ্বিতীয় শ্রেণিতে আছেন সিদ্দীক্বীন, যাঁদের প্রথম জন হলেন খলীফা হযরতে আবূ বকর (রা:); দ্বিতীয় জন খলীফা হযরতে উমর ফারূক্ব (রা:); তৃতীয় জন খলীফা হযরতে উসমান যিন্নূরাইন (রা:); এবং চতুর্থ জন খলীফা হযরতে ইমামে আলী (ক:)। খলীফা বলতে গোমরাহ’দের ওই দুটো দল মনে করে তাঁরা বুঝি কেবলই রাজ্যের শাসক। তবে তাসাউফপন্থী সুন্নী মুসলমান সম্প্রদায়ের আক্বীদা-বিশ্বাস হলো, তাঁরা তিনটি দায়িত্ব পালন করেছিলেন: ১/ শরীয়তের যাহেরী (ফিক্বহ’র) জ্ঞান বিতরণ/বণ্টন (মুফতীর কাজ); ২/ মা’রেফতের গূঢ় রহস্যপূর্ণ জ্ঞান বিতরণ (পীরের কাজ); এবং ৩/ রাজ্য শাসন [শাহ ওলীউল্লাহ দেহেলভী কৃত ‘ইযালাতুল খাফা’]। অতএব, সঠিক পথপ্রাপ্ত চার জন খলীফার মাক্বাম/স্তর এক্ষণে গবেষণার দাবি রাখে। আজকের দিনের বিক্রি হয়ে যাওয়া মৌ-লোভীদের চামচামির মুখাপেক্ষী এ বিষয়টি মোটেও নয়! [বি:দ্র: মন্তব্য ফোরামে ভদ্রতা কাম্য। ধন্যবাদ]
*সমাপ্ত*

’নবী পাক (দ:)’ সম্বোধন নিয়ে আপত্তি ও প্রাসঙ্গিক আলোচনা: ফলো-আপ*
দ্বীনী ভাই ও বোনেরা, ওপরের শিরোনামে আমার ২ দিন আগের পোষ্টের কথা আপনাদের নিশ্চয় স্মরণে অছে। এবার ফলো-আপের পালা। কেননা, ওই পোষ্টে বিষয়টির একটি গুরুত্বপূর্ণ দিকের কথা তুলে ধরা হয়নি। আজ তা আলোচনা করবো। আমি শাহ ওলীউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহেলভী সাহেবের ‘ইযালাতুল খাফা’ বইটির বরাত দিয়েছিলাম, যেখানে তিনি বলেছেন: “খুলাফায়ে রাশেদীন তিনটি দায়িত্ব পালন করেছিলেন: ১/ শরীয়তের যাহেরী (ফিক্বহ’র) জ্ঞান বিতরণ/বণ্টন (মুফতীর কাজ); ২/ মা’রেফতের গূঢ় রহস্যপূর্ণ জ্ঞান বিতরণ (পীরের কাজ); এবং ৩/ রাজ্য শাসন।” আমাদের ফোকাস তথা মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু হলো দ্বিতীয় পয়েন্টটি।
তাসাউফ-তরীক্বত ও মা’রেফতের জ্ঞান যাঁদের যাঁদের পছন্দ তাঁদের ক্বলব তথা অন্তরে (সীনায়) বিতরণের দায়িত্ব চারজন সঠিক পথপ্রাপ্ত খলীফা বহন করেছিলেন। অর্থাৎ, তাঁরা রূহানী এলম শিক্ষাদাতা মাশায়েখ-এ-কেরাম (রা:)। প্রথম খলীফা হযরতে আবূ বকর (রা:) যখন খলীফা তথা রাসূলুল্লাহ (দ:)’এর প্রতিনিধিত্বের দায়িত্ব গ্রহণ করেন, তখন সকল সাহাবী (রা:)-ই তাঁর কাছে বাইয়া’ত হন। এই আনুগত্য স্বীকার স্রেফ রাজ্য শাসনের বেলায় নয়, বরং তাঁর বেলায়াতের (ওলীত্বের) রূহানী ফয়েয বা আধ্যাত্মিক জ্ঞান গ্রহণের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য; ঠিক যেমনটি কোনো কামেল-মোকাম্মেল পীরের কাছে বাইয়া’ত গ্রহণ করে আধ্যাত্মিকতার রাস্তায় তালিম নেয়া হয়ে থাকে।
সুন্নীয়তভিত্তিক সূফী দর্শনের এই সূক্ষ্ম দিকটি আমাদের সুন্নী আলেম-উলামা খুব একটা আলোকপাত করেন না। অথচ নজদী-ওহাবী ও পারসিক শিয়া গোষ্ঠী দুটো হরদম মিথ্যে অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। আমাদের তরুণ প্রজন্মকে সত্য ও সঠিক তথ্য জানানো অবশ্য কর্তব্য। সেই লক্ষ্যেই আমি খুলাফায়ে রাশেদীনের এ বিষয়টির প্রতি অলোকপাত করলাম। বস্তুতঃ সূফী-দরবেশবৃন্দের রীতিনীতি ওই খেলাফতেরই ধারাবাহিকতায় এসেছে। ব্যতিক্রম শুধু এই যে, তরীক্বতের মাশায়েখবৃন্দ রাষ্ট্রব্যবস্থার সাথে সম্পৃক্ত না হয়ে আধ্যাত্মিকতার তালিম দানে নিজেদের প্রবৃত্ত করেছেন। এটা বিশেষায়িত জ্ঞানের শাখা।
*সমাপ্ত*

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন