ব্লগ সংরক্ষাণাগার

শুক্রবার, ২২ জুলাই, ২০২২

গাদীরে খুম ২০২২-২৩ উপলক্ষে রচনাসম্ভার

 -এডমিন


*ঈদে গাদীর সম্পর্কে সুন্নী দৃষ্টিভঙ্গি* (১)

>প্রশ্ন: মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোতে জাতীয়ভাবে ঈদে গাদীর পালিত হয় কি?

>উত্তর: না, হয় না।

>প্রশ্ন: কোন্ দেশে তা পালিত হয়?

>উত্তর: ইরানে (রাফেযী শিয়াপন্থী)।

>প্রশ্ন: তাহলে কারা ঈদে গাদীরের পক্ষে ওকালতি করছে?

>উত্তর: রাফেযী শিয়াদের চামচা দল।

>প্রশ্ন: হাদীসে কি বলা হয়নি জামা’আতকে অনুসরণ করো?

>উত্তর: হ্যাঁ, কোনো ক্ষুদ্র গোষ্ঠীস্বার্থ চরিতার্থ না করে বৃহত্তর মুসলিম জামা’আতকে অনুসরণ করার জন্যে বলা হয়েছে। যেমন, আদেশ দেয়া হয়েছে - يَدُ اللهِ مَعَ الْجَمَاعَةِ - “আল্লাহর সমর্থন জামা’আতের প্রতি” (সুনান আত্ তিরমিযী, ২১৬৬, হাদীসের মান - সহীহ)। ইরান ছাড়া অন্য কোনো মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে জাতীয় পর্যায়ে ঈদে গাদীর পালন করা হয় না। অথচ উপরে উল্লেখিত হাদীসটিতে জামা’আতকে আঁকড়ে ধরতে এবং তা থেকে বিচ্যুত না হবার জন্য নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে।

>প্রশ্ন: আমরা জানি বর্তমান ইরান শিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ, যদিও ইতিপূর্বে এটা সুন্নীপ্রধান ছিলো; রাফেযী শিয়াপন্থী তুর্কমেন জাতিগোষ্ঠী পাহাড় থেকে নেমে এসে সুন্নী আলেম-উলামা, বুদ্ধিজীবী ও জ্ঞানীগুণীজনকে হত্যাকাণ্ড চালিয়ে নির্মূল করেছে এবং দেশটি জবরদখল করেছে। এই ঈদে গাদীর পালনের পেছনে রাফেযী শিয়াদের উদ্দেশ্য কী?

>উত্তর: রাফেযী শিয়াপন্থীদের মতানুযায়ী, গাদীরে খুমের ভাষণে প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)-কে খেলাফত/ইমামতের গুরুদায়িত্ব অর্পণ করেন। কিন্তু তাঁর বেসাল শরীফের পরে প্রথম তিন খলীফা সর্ব-হযরত আবূ বকর সিদ্দীক্ব, উমর ফারূক্ব ও উসমান যিন্নূরাইন (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম) ষড়যন্ত্র করে খেলাফতের ভারগ্রহণ হতে হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)-কে বঞ্চিত করেন। তাই শিয়াপন্থী গোষ্ঠী ঈদে গাদীর পালনের অন্তরালে উক্ত তিন খলীফা (রা.)-কে অবৈধ ও অনৈসলামী হিসেবে প্রচার-প্রতিষ্ঠা করার গোপন এজেন্ডা বাস্তবায়নে অপতৎপর। এছাড়া, তারা একই তারিখে খলীফা উসমান (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’এর শাহাদাত উপলক্ষে উল্লাস প্রকাশে মত্ত। এসব কাজ ইসলামের মূলোৎপাটনের দুরভিসন্ধি নিয়ে করা হচ্ছে। বস্তুতঃ খলীফা উসমান (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’এর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারী আবদুল্লাহ ইবনে সাবা’ ও তার সাবাইয়্যা গোষ্ঠীর পদাঙ্ক অনুসরণকারী হলো আজকের রাফেযী শিয়াচক্র। তারা দাবি করে যে শাহাদাতে উসমান (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’এরও ২৪ বছর আগেকার এই গাদীরে খুমের ঘটনা। কিন্তু আমাদের প্রশ্ন হলো, ওই ২৪ বছরে তো কারো দ্বারা কোনো ঈদে গাদীর পালনের নজির নেই!

অতএব, হক্বপন্থী সুন্নী মুসলমানবৃন্দের এ বিষয়ে অত্যন্ত সতর্ক হতে হবে। কেননা পারস্যদেশীয় রাফেযী গোষ্ঠীর অঢেল সম্পদ তারা নিজেদের ভ্রান্ত মত আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রচারে ব্যয় করছে। আমাদের দেশে ইতোমধ্যে অনেক অর্থলোভী আলেম ও দরবারি আওলাদকে কেনা গোলামে তারা পরিণত করেছে! এই সেবাদাসগুলো বর্তমানে ঘটা করে ঈদে গাদীর পালনের অপচেষ্টারত। মুসলমান সমাজকে এ থেকে পরহেজ করতে হবে, ঠিক যেমনিভাবে পরহেজ করেছিলেন আমাদের পূর্ববর্তী সুন্নী আকাবের/বুযূর্গানে দ্বীন-মণ্ডলী।

*সমাপ্ত*


*গাদীরে খুমে হযরত আলী (ক.)-কে প্রদত্ত ‘মওলা’ উপাধি সম্পর্কে রাফেযী ব্যাখ্যা কী?* (২)

ইদানীং আমাদের দেশে অনলাইনে সক্রিয় রাফেযী শিয়া সদস্যবর্গ গাদীরে খুমে প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কর্তৃক হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)-কে প্রদত্ত ‘মওলা’ উপাধিটির ব্যাখ্যা নিয়ে সাধারণ মুসলমানদেরকে ধোঁকা দিচ্ছে। তারা ইনিয়ে বিনিয়ে অনেক কথা বলছে, কিন্তু ‘মওলা’ বলতে প্রকৃত অর্থে তারা কী বোঝাতে চাচ্ছে তা স্পষ্ট করে বলছে না। আমরা মুসলমান সর্বসাধারণের বোধগম্য হবার জন্য বিষয়টিকে সহজ করে দিচ্ছি। কেননা এই বিষয়টি চৌদ্দ শ বছর আগেই আহলে বাইত (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-মণ্ডলীর একজন সম্মানিত সদস্য সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করেছেন; ওই সময় তিনি জনৈক রাফেযী শিয়ার অন্তরের গভীরে লালিত শিয়াপন্থীদের ভ্রান্ত ধারণাপ্রসূত বক্তব্যের জবাব দিচ্ছিলেন। চলুন, তিনি যে প্রত্যুত্তর দিয়েছিলেন তা জানা যাক।
জনৈক ব্যক্তি হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’এর নাতী হযরত ইমাম হাসান আল-মুসান্না (রহমতুল্লাহি আলাইহি)-কে জানায় যে প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) গাদীরে খুমে হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)-কে ‘মওলা’ ঘোষণা করে আপন উত্তরাধিকারী খলীফা হিসেবে নিযুক্ত করেছিলেন (এ বিবরণ তারীখুল দিমাশক গ্রন্থ হতে প্রাপ্ত)। অতঃপর হযরত ইমাম হাসান মুসান্না (রহমতুল্লাহি আলাইহি) লোকটিকে বলেন:

أما والله إن رسول الله صلى الله عليه وسلم إن كان يعني بذلك الإمرة والسلطان والقيام على الناس بعده لأفصح لهم بذلك كما أفصح لهم بالصلاة والزكاة وصيام رمضان وحج البيت ولقال لهم إن هذا ولي أمركم من بعدي فاسمعوا له وأطيعوا فما كان من رواء هذا شيء فإن أنصح الناس كان للمسلمين رسول الله صلى الله عليه وسلم ولو كان الأمر كما تقولون إن الله ورسوله اختارا عليا لهذا الأمر والقيام بعد النبي عليه السلام إن كان لأعظم الناس في ذلك خطأة وجرما إذ ترك ما أمره به رسول الله صلى الله عليه وسلم أن يقوم فيه ، كما أمره أو يعذر فيه إلى الناس.

অর্থ: আল্লাহর কসম! যদি এই বক্তব্যের মাধ্যমে প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হযরত আলী (রাদিয়াল্লাহু আনহু)-এর প্রতি খেলাফতের নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বের একটি পদ প্রদানের ইচ্ছা করতেন, তাহলে তিনি স্পষ্টভাবে তা প্রকাশ করতেন; ঠিক যেমনটি তিনি স্পষ্টভাবে (শরঈ আদেশ) সালাত, যাকাত, রমজানের রোজা এবং হজ ইত্যাদি জারি করেছিলেন। তিনি বলতেন, ‘হে লোক সকল! এই ব্যক্তি (হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহুকে উল্লেখ করে) আমার পরে তোমাদের আমির তথা নেতা, সুতরাং তার কথা শোনো এবং তার আনুগত্য করো।’ এর পরে আর কোনো বিভেদ থাকতো না, কারণ প্রকৃতপক্ষে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন মুসলমানদের প্রতি সবচেয়ে সৌহার্দ্যপূর্ণ এবং বিবেচনাশীল ব্যক্তিত্ব। যদি তোমার (মানে শিয়া লোকটির) মত হয় এই যে, নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর পরে হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)-কে এ ঘোষণার দ্বারা খলীফা মনোনীত করা হয়েছিলো, তাহলে তিনি (মানে হযরত আলী-ক.) সমস্ত লোকের মধ্যে সবচেয়ে ত্রুটিযুক্ত হতেন; কেননা তিনি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)’এর এ আদেশ পালন করেননি। [তাবাকাত ইবনে সা'দ, ৭/৩১৪-৩১৫; তারীখু ইবনু আসাকির, ৪/১৬৬; আল-বায়হাকী রচিত ’আল-ই’তিকাদ, ৪৯৯ পৃষ্ঠা, সহীহ সনদ-সহ; মুহাম্মদ ইবনে আসিম আল-আসবাহানী তাঁর জুয-এ, # ১২৬]

অতএব, আমরা দেখতে পেলাম যে আহলে বাইত (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-বৃন্দের সম্মানিত একজন সদস্য চৌদ্দ শ বছর আগেই শিয়াদের বক্র অন্তরে লালিত চিন্তার সমুচিত জবাব দিয়ে গিয়েছেন। তাঁর এ দিকনির্দেশনার আলোকে আমাদের (মানে সুন্নীদের) পথ চলতে হবে। তাঁর কথার প্রতি বিন্দুমাত্র সন্দেহ পোষণ করা আমাদের উচিত হবে না। কেননা তিনি ভেড়ার লোমের আড়ালে লুকোনো নেকড়ের থাবা আমাদের চেয়ে ঢের ভালো দেখতে পেয়েছিলেন (যা বর্তমানে নির্বোধ কিছু মুসলমান দেখতে পাচ্ছে না)। বস্তুতঃ আহলে বাইত ও আসহাব (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম আজমাঈন)-মণ্ডলীকে মান্য করতে আমরা আদিষ্ট হয়েছি। তাই হযরত হাসান মুসান্না (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)-এর এই দিকনির্দেশনাকে আমাদের মোটেও অবহেলা করা উচিত হবে না।

*সমাপ্ত*


*খেলাফত ও বেলায়াত* (৩)
আল্লাহতায়ালা তাঁর পবিত্র গ্রন্থে ঘোষণা করেন:

وَإِذْ قَالَ رَبُّكَ لِلْمَلَٰئِكَةِ إِنِّي جَاعِلٌ فِي ٱلأَرْضِ خَلِيفَةً قَالُواْ أَتَجْعَلُ فِيهَا مَن يُفْسِدُ فِيهَا وَيَسْفِكُ ٱلدِّمَآءَ وَنَحْنُ نُسَبِّحُ بِحَمْدِكَ وَنُقَدِّسُ لَكَ قَالَ إِنِّيۤ أَعْلَمُ مَا لاَ تَعْلَمُونَ.

অর্থ: এবং স্মরণ করুন (হে রাসূল), যখন আপনার রব ফেরেশতাদেরকে বল্লেন, ‘আমি পৃথিবীতে আপন খলীফা/প্রতিনিধি সৃষ্টিকারী।’ (তারা) বল্লো, ‘আপনি কি এমন কোনো সৃষ্টিকে খলীফা/প্রতিনিধি করবেন, যে তাতে ফ্যাসাদ ছড়াবে ও রক্তপাত ঘটাবে? আর আমরা আপনার প্রশংসাপূর্বক আপনার তাসবীহ (স্তুতিগান) করি এবং আপনার পবিত্রতা ঘোষণা করি।’ তিনি বল্লেন, ‘আমার জানা আছে যা তোমরা জানো না।’ [আল-ক্বুর’আন, ২:৩০; নূরুল ইরফান]

ওপরের আয়াতে উল্লেখিত খলীফা প্রেরণের প্রক্রিয়াটি আরম্ভ হয় পয়গাম্বর আদম (আলাইহিস্ সালাম) দ্বারা এবং এর চূড়ান্ত পরিসমাপ্তি ঘটে আমাদের প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে দিয়ে। কেননা তিনি একটি হাদীসে ঘোষণা করেন:

وَأَنَا خَاتَمُ النَّبِيين لَا نَبِيَّ بِعْدِي.

অর্থ: এবং নিশ্চয় আমিই সর্বশেষ পয়গাম্বর, আমার পরে কোনো নবী আসবেন না। [আবূ দাউদ ৪২৫২, তিরমিযী ২২০২, ইবনে মাজাহ ৩৯৫২, মুসনাদে আহমদ ১৬৯৫৬, আল-বুখারী ৭১, মুসলিম ১৭৬ - (১৯২৪), ইবনে হিব্বান ৬৮৩৬, নাসাঈ ৮৭১২]

এই নুবূয়্যতের ক্রমধারা সুসম্পন্ন হওয়ার পরে বেলায়াত (ওলীত্ব)-এর ক্রমধারা আরম্ভ হয়েছে এবং জারি রয়েছে; আর তা জারি থাকবে ক্বিয়ামত পর্যন্ত। তবে তা খুলাফায়ে রাশেদীন তথা সঠিক পথপ্রাপ্ত চার খলীফা (রা.)-কে দিয়েই সূচিত হয়। যেমন, প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঘোষণা করেন:

فَعَلَيْكُمْ بِسُنَّتِي وَسُنَّةِ الْخُلَفَاءِ الرَّاشِدِينَ الْمَهْدِيينَ.

অর্থ: অতঃপর তোমাদের প্রতি বিধেয়/পরিপালনীয় হলো আমার সুন্নাত (রীতি/পদ্ধতি) ও হেদায়াতের পথপ্রাপ্ত খলীফাবৃন্দের সুন্নাত। [আবূ দাউদ ৪৬০৭; তিরমিযী ২৬৬; ইমাম নববী (রহ.)’এর চল্লিশ হাদীস পুস্তকে ২৮ নং হাদীস; হাদীসের মান - হাসান সহীহ]
এখানে লক্ষণীয় যে, হেদায়াতের পথপ্রাপ্ত খলীফাবৃন্দ শব্দটি বহুবচনে ব্যবহৃত হয়েছে। এটা তাঁদের মধ্যে কোনো বিশেষ একজনকে উদ্দেশ্য করেনি। আর সুন্নাত শব্দটি ফিক্বহী অর্থে তাঁদের নিজ নিজ মাযহাবকে ও তাসাউফের অর্থে নিজ নিজ তরীক্বতকে বুঝিয়েছে।
বিশিষ্ট ইসলামী আলেম শাহ ওলীউল্লাহ মুহাদ্দীসে দেহেলভী (রহ.) নিজের লেখা ‘ইযালা’তুল খাফা’ পুস্তকে লেখেন:

“রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর হেদায়াত দানের কাজটি ছিলো তিনটি অংশে বিভক্ত। প্রথমটি আল্লাহর আদেশ-নিষেধ ক্ষমতা প্রয়োগ করে বলবৎ করার দায়িত্ব। এর নাম ‘সালতানাত।’ দ্বিতীয় দায়িত্ব ছিলো আল্লাহর আদেশ-নিষেধ মুসলমানদের মাঝে শিক্ষাদান (ফিক্বাহ)। তৃতীয় কাজটি যার নাম ‘ইহসান,’ তা ছিলো অন্তরসমূহকে পরিশুদ্ধ করার দায়িত্ব। খুলাফায়ে রাশেদীন এই তিনটি দায়িত্ব (সুচারুরূপে) পালন করেন। (রাজ্য শাসনে) তাঁদের উত্তরসূরীবৃন্দ শুধু সালতানাতের দায়িত্বই পালন করতে সক্ষম হন। শরীয়তের (ফিক্বাহ) শিক্ষাদানের দায়িত্ব মাযহাবের ইমামবৃন্দের কাঁধে ন্যস্ত হয় এবং ‘ইহসানের’ দায়িত্বভার অর্পিত হয় তাসাউফ/তরীক্বতের মহান মাশায়েখ-মণ্ডলীর প্রতি।” [ইযালা’তুল খাফা আন্ খিলাফাতিল খুলাফা, ৩৪২ পৃষ্ঠা; এ উদ্ধৃতিটি আল্লামা হুসাইন হিলমী তুর্কী (রহ.)-এর ‘ইসলামে ধর্ম সংস্কারক’ বইটি থেকে নেয়া; মূল আরবী বই পাওয়া গেলে ইবারত পেশ করা হবে, ইন-শা-আল্লাহ!]

শাহ ওলীউল্লাহ সাহেবের আলোচনার আলোকে আমরা জানতে পারি যে, চার খলীফা (রা.)-এর খেলাফত ছিলো রাজ্য শাসন, শরঈ জ্ঞান শিক্ষাদান ও বেলায়াত তথা তাসাউফ-তরীক্বতের দীক্ষাদানের সমষ্টি। এর সূচনা হয় হযরতে সিদ্দীক্বে আকবর সৈয়্যদুনা আবূ বকর (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’এর খেলাফত দ্বারা। সে সময় সমস্ত আহলে বাইত (রা.) ও আসহাব (রা.) তাঁর খেলাফত তথা বেলায়াতের আনুগত্য স্বীকার করেন। এরপর হযরতে ফারূক্বে আজম সৈয়্যদুনা উমর (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)-এর খেলাফতের প্রতি সবাই আনুগত্য স্বীকার করেন। অতঃপর হযরতে যিন্নূরাইন সৈয়্যদুনা উসমান ইবনে আফফান (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)-এর খেলাফত এবং সবশেষে হযরতে সৈয়্যদুনা মওলা আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)-এর খেলাফত সবার প্রতি জারি হয়। এ সকল খলীফা (রা.) তাঁদের নিজ নিজ সময়কালে রূহানী ফয়েয বিচ্ছুরণ করে সবার অন্তরকে পরিশুদ্ধ ও আলোকিত করেন।

খলীফা (রা.)-বৃন্দের ফয়েযপ্রাপ্ত হয়ে অন্যান্য সাহাবা (রা.)-ও আপন আপন মাযহাব ও তরীক্বত প্রচার-প্রসারের কাজে আত্মনিয়োজিত হন। কিন্তু সময়ের পরিক্রমণে তাঁদের ফিক্বাহ’র মাযহাব ও তাসাউফ-তরীক্বত বিস্মৃত হয়। হয়তো কারো কারো তরীক্বত পৃথিবীর আনাচে-কানাচে কোথাও না কোথাও আজো জারি আছে, তবে হযরতে ইমামে আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)-এর সূত্রে অধিকাংশ তরীক্বতের সিলসিলা বর্তমান জগতে জারি হয়েছে। খলীফা আবূ বকর (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)-এর সূত্রেও কিছু সিলসিলা এখনো আছে, আরো আছে হযরতে ওয়াইস ক্বরণী (রহমতুল্লাহ আলাইহি)’এর সূত্রে তরীক্বতের সিলসিলা। শেষ কথা হলো, সমস্ত সিলসিলা সম্পর্কে আমরা নিশ্চিত জানি না। অতএব, এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রচুর গবেষণার অবকাশ রয়েছে।
*সমাপ্ত*


*ইসলামী খলীফা (রা.)-বৃন্দের সবাই কি বাতেনী পূর্ণতাপ্রাপ্ত নন?* (৪)

এদেশের সুন্নী সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের মধ্যে কিছু ভুল ধারণা বদ্ধমূল। নিশ্চয় এটা বহু বছরের শিয়া অপচেষ্টার ফসল এ মর্মে যে তারা নিজেদের বইপত্রে, বিশেষ করে তাসাউফ-তরীক্বতবিষয়ক বইপত্রে চার খলীফার মধ্যে প্রথম তিনজনকে স্রেফ রাজ্য-শাসক হিসেবে উপস্থাপন করেছে; এ যেনো তাঁরা আধ্যাত্মিকতার কোনো দীক্ষাই প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হতে পাননি। এর চেয়ে বেশি অসত্য আর কোনো কিছু হতে পারে না! কেননা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঘোষণা করেছেন:

فَعَلَيْكُمْ بِسُنَّتِي وَسُنَّةِ الْخُلَفَاءِ الرَّاشِدِينَ الْمَهْدِيينَ.

অর্থ: অতঃপর তোমাদের প্রতি বিধেয়/পরিপালনীয় হলো আমার সুন্নাত (রীতি/পদ্ধতি) ও হেদায়াতের পথপ্রাপ্ত খলীফাবৃন্দের সুন্নাত। [আবূ দাউদ ৪৬০৭; তিরমিযী ২৬৬; ইমাম নববী (রহ.)’এর চল্লিশ হাদীস পুস্তকে ২৮ নং হাদীস; হাদীসের মান - হাসান সহীহ]
এখানে লক্ষণীয় যে, হেদায়াতের পথপ্রাপ্ত খলীফাবৃন্দ শব্দটি বহুবচনে ব্যবহৃত হয়েছে। এটা তাঁদের মধ্যে কোনো বিশেষ একজনকে উদ্দেশ্য করেনি। আর সুন্নাত শব্দটি ফিক্বহী অর্থে তাঁদের নিজ নিজ মাযহাবকে ও তাসাউফের অর্থে নিজ নিজ তরীক্বতকে বুঝিয়েছে। আরো লক্ষণীয় যে, খলীফা (রা.)-বৃন্দ হলেন - الرَّاشِدِينَ الْمَهْدِيينَ - হেদায়াতের পথপ্রাপ্ত। আমাদের প্রশ্ন: ইসলামের যাহেরী/প্রকাশ্য বিধিবিধানগত শিক্ষা ও বাতেনী/আধ্যাত্মিক জ্ঞানে দীক্ষা ছাড়া কি হেদায়াতের পথ বিরাজমান থাকতে পারে? তাও আবার পুরো মুসলিম জনগোষ্ঠীকে তা দ্বারা নেতৃত্ব দেয়ার বেলায়? আফসোস, এসব ব্যাপারে আজকের মুসলমান সমাজ প্রায় বে-খবর। দুনিয়া অন্বেষণের সময় সমস্ত গবেষণা করা গেলেও আখেরাতের প্রশ্নে চরম অজ্ঞতাই এখন সার!
সবার জ্ঞাতার্থে আমরা খলীফা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-বৃন্দের কিছু কারামতের বর্ণনা এখানে সংক্ষিপ্তভাবে উল্লেখ করবো। এগুলো বিভিন্ন ইসলামী বইপত্রে লিপিবদ্ধ আছে:
১/ - খলীফা হযরত আবূ বকর (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) বেসাল হওয়ার আগে অসীয়ত/উইল করেন যে হযরত আয়েশাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা) তাঁর সন্তানদেরকে লালন-পালন করবেন। তিনি তাঁকে বলেন, “আমার পুত্র ও দুই কন্যাকে তোমার কাছে রেখে গেলাম।” অথচ তখন কন্যাদের মধ্যে কেবল হযরত আসমা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা)-ই রয়েছেন। মা আয়েশাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা) খলীফা (রা.)-কে জিজ্ঞেস করেন, “আমার শুধু একজন বোন, অপরজন কে?” খলীফা (রা.) উত্তর দেন, ”আমার স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা। মনে হয় বাচ্চাটি মেয়ে হবে।” ঠিকই তাঁর বেসালপ্রাপ্তির পরে এক কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করেন। [শওয়াহিদুন্ নুবূওয়া গ্রন্থ]

২/ - মুসলমান সেনাবাহিনি হযরত সারিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’এর অধিনায়কত্বে পারসিকদের মুখোমুখি হন খলীফা উমর ফারূক্ব (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)-এর খেলাফত আমলে। পারসিক বাহিনি ছিলো বিশাল। তাদের সাথে মুসলমানবৃন্দ এঁটে উঠছিলেন না। ঠিক সেই সময় খলীফা (রা.) মদীনায় মসজিদে নববীর মিম্বরে উঠে জুমুআ’র খুতবা পাঠ করছিলেন। কাশফ/দিব্যদৃষ্টিতে মুসলমান বাহিনির নাজুক অবস্থা দেখতে পেয়ে তিনি উচ্চস্বরে বলেন, “হে সারিয়া! (পেছনের) পাহাড়! পাহাড়টি দখল করো!” উপস্থিত জামা’আত খুতবার মাঝখানে এ কথাটির মর্ম বুঝতে না পারলেও হযরত সারিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) ও তাঁর সেনাদল ঠিকই শুনতে পান। তাঁরা পেছনের পাহাড়টি দখল করার পরে শত্রুর দুর্বল স্থানগুলো ওপর থেকে দেখে তাতে আঘাত হানেন। ফলশ্রুতিতে বিশাল পারসিক বাহিনি যুদ্ধে পরাজয় বরণ করে।
৩/ - খলীফা উসমান (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) যেদিন সকালে শহীদ হন, তার আগের রাতে প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে স্বপ্নে দেখেন, যিনি তাঁকে বলেন, “হে উসমান! (আজ) রোযা রাখো যাতে সন্ধ্যায় তুমি আমাদের সাথে ইফতার করতে পারো।” সেই দিনটিতে তিনি মোনাফিক্বদের দ্বারা শহীদ হন। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’এর সাথে তাঁর আধ্যাত্মিক যোগাযোগ না থাকলে এটা হতো না।
৪/ - খলীফা আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু) বেসালপ্রাপ্তির সময় পুত্র ইমাম হুসাইন (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)-কে ডেকে বলেন, “আমার খাটিয়াকে আরনাঈন নামের একটি জায়গায় নিয়ে যাবে। সেখানে তুমি একটা সাদা ঝকঝকে পাথর দেখবে। সেখানেই আমাকে দাফন করবে।” তাঁর অসীয়ত অনুযায়ী তাঁরা সেখানে যেয়ে ঠিকই ঝকঝকে সাদা পাথর দেখতে পান এবং তাঁকে দাফন করেন।

শেষ কথা: ইসলাম হলো আদবশীলতার ধর্ম। বেয়াদবের জন্য খোদা নেই। আমাদের এমন কোনো কথা বলা উচিত নয়, যা দ্বারা বুযূর্গানে দ্বীনের মান-মর্যাদা খাটো হয়। হাকীকত না জেনে খলীফা (রা.)-মণ্ডলীর কাউকে অন্যান্যদের চেয়ে বড় করে প্রদর্শন করার চেষ্টা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’এর দরবারে প্রত্যাখ্যাত হবে। সুন্নী জামা’আতের আক্বীদা-বিশ্বাস হলো আম্বিয়া (আলাইহিমুস্ সালাম)-এর পরে আহলে বাইত (রা.) ও সাহাবায়ে কেরাম (রা.) উম্মতের মাঝে সেরা, আর চার খলীফা (রা.) সেই সেরাদের সেরা! অতএব, তাঁদের চারজনের ব্যাপারে কথা বলার সময় আমাদের সতর্ক হতে হবে।

*সমাপ্ত*


*রাফেযী শিয়াচক্রের একটি ভুয়া দাবি* (৫)

রাফেযী গোষ্ঠী আরেকটি ভুয়া দাবি উত্থাপন করে যে প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কর্তৃক গাদীরে খুমে প্রদত্ত ভাষণ শেষ হলে নিম্নোক্ত আয়াতে করীমাটি অবতীর্ণ হয়:

ٱلْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ ٱلإِسْلٰمَ دِيناً.

অর্থ: আজ আমি (আল্লাহ) তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণ করে দিলাম এবং তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করলাম, আর তোমাদের জন্য ইসলামকে দ্বীন মনোনীত করলাম। [আল-ক্বুর’আন, ৫/৩; নূরুল ইরফান]

শিয়াচক্র দাবি করে যে, গাদীরে খুমে হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)-কে খেলাফতের উত্তরাধিকারী মনোনীত করে দ্বীনকে পূর্ণতাদানের খাতিরে এই আয়াতটি নাযেল হয়েছিলো। অথচ আরাফাতের পাহাড়ে প্রদত্ত বিদায়ী হজ্জ্বের ভাষণশেষে এই আয়াতটি অবতীর্ণ হয়। যেমন -

حَدَّثَنَا الْحَسَنُ بْنُ الصَّبَّاحِ، سَمِعَ جَعْفَرَ بْنَ عَوْنٍ، حَدَّثَنَا أَبُو الْعُمَيْسِ، أَخْبَرَنَا قَيْسُ بْنُ مُسْلِمٍ، عَنْ طَارِقِ بْنِ شِهَابٍ، عَنْ عُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ، أَنَّ رَجُلاً، مِنَ الْيَهُودِ قَالَ لَهُ يَا أَمِيرَ الْمُؤْمِنِينَ، آيَةٌ فِي كِتَابِكُمْ تَقْرَءُونَهَا لَوْ عَلَيْنَا مَعْشَرَ الْيَهُودِ نَزَلَتْ لاَتَّخَذْنَا ذَلِكَ الْيَوْمَ عِيدًا‏.‏ قَالَ أَىُّ آيَةٍ قَالَ ‏(‏الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ الإِسْلاَمَ دِينًا‏)‏‏.‏ قَالَ عُمَرُ قَدْ عَرَفْنَا ذَلِكَ الْيَوْمَ وَالْمَكَانَ الَّذِي نَزَلَتْ فِيهِ عَلَى النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم وَهُوَ قَائِمٌ بِعَرَفَةَ يَوْمَ جُمُعَةٍ.

অর্থ: হাসান ইবনুুস সাব্বাহ্ (রহ.) ... ’উমর ইবনুল খাত্তাব (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণনা করেন, এক ইয়াহূদী তাঁকে বললেন, হে আমীরুল মু’মিনীন! আপনাদের কিতাবে একটি আয়াত আছে যা আপনারা পাঠ করে থাকেন, তা যদি আমাদের ইয়াহূদী জাতির প্রতি নাযিল হতো, তাহলে অবশ্যই আমরা সে দিনটিকে ঈদ হিসেবে পালন করতাম। তিনি (খলীফা) বললেন, কোন্ আয়াতটি? ইহুদী উত্তর দিলেন -
الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ الإِسْلاَمَ دِينًا.

“আজ আমি (আল্লাহ) তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণ করে দিলাম এবং তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করলাম, আর তোমাদের জন্য ইসলামকে দ্বীন মনোনীত করলাম” (আল-ক্বুর’আন, ৫/৩)। খলীফা ’উমর (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) বললেন, এটি যে দিন এবং যে স্থানে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি নাযিল/অবতীর্ণ হয়েছিলো তা আমরা জানি; তিনি সেদিন ’আরাফায় দাঁড়িয়েছিলেন এবং তা ছিল জুম’আর দিন। [আল-বুখারী-৪৫, মুসলিম শরীফ ও অন্যান্য গ্রন্থ; এই হাদীসের মান - সহীহ]

অতএব, স্পষ্ট প্রমাণিত হলো যে রাফেযী-চক্র ধর্ম নিয়ে তামাশায় মেতেছে। মিথ্যের বেসাতি-ই তাদের একমাত্র সম্বল।
সৌজন্যে: www.mahajjah.com

*সমাপ্ত*


*গাদীরে খুমে খেলাফত/ইমামত মঞ্জুর হয়নি মর্মে হযরত আলী (ক.)’এর সমর্থনসূচক ভাষ্য* (৬)

প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বিদায়ী হজ্জ থেকে মদীনা মোনাওয়ারায় ফেরার পথে গাদীরে খুম স্থানটিতে হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)-কে ‘মওলা’ উপাধি দান করেন। এর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ আমরা ’সুন্নী দৃষ্টিকোণ হতে গাদীরে খুম-সংক্রান্ত হাদীসের বিশ্লেষণ’ শীর্ষক বইটিতে পেশ করেছি (২০১৯ সালে প্রকাশিত)। ভ্রান্ত শিয়াপন্থী গোষ্ঠী এটা নিয়ে বড্ড বাড়াবাড়ি করে; তারা দাবি করে এ ঘটনায় হযরতে আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)-কেই সর্বপ্রথম খলীফা বা ইমামের দায়িত্বভার অর্পণ করা হয়েছিলো। কিন্তু এ ব্যাপারে হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’এর ভাষ্য কী? তিনি অথবা অন্যান্য সাহাবা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-মণ্ডলী এ বিষয়ে কী বলেন, চলুন তা জানতে চেষ্টা করি।

ইমাম বুখারী (রহমতুল্লাহি আলাইহি) তাঁর ‘সহীহ’ গ্রন্থে আল-যুহরী হতে ইসনাদের সূত্রে বর্ণনা করেন:
حَدَّثَنِي إِسْحَاقُ، أَخْبَرَنَا بِشْرُ بْنُ شُعَيْبِ بْنِ أَبِي حَمْزَةَ، قَالَ حَدَّثَنِي أَبِي، عَنِ الزُّهْرِيِّ، قَالَ أَخْبَرَنِي عَبْدُ اللهِ بْنُ كَعْبِ بْنِ مَالِكٍ الأَنْصَارِيُّ ـ وَكَانَ كَعْبُ بْنُ مَالِكٍ أَحَدَ الثَّلاَثَةِ الَّذِينَ تِيبَ عَلَيْهِمْ أَنَّ عَبْدَ اللهِ بْنَ عَبَّاسٍ أَخْبَرَهُ أَنَّ عَلِيَّ بْنَ أَبِي طَالِبٍ ـ رضى الله عنه ـ خَرَجَ مِنْ عِنْدِ رَسُولِ اللهِ صلى الله عليه وسلم فِي وَجَعِهِ الَّذِي تُوُفِّيَ فِيهِ، فَقَالَ النَّاسُ يَا أَبَا حَسَنٍ، كَيْفَ أَصْبَحَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ أَصْبَحَ بِحَمْدِ اللهِ بَارِئًا، فَأَخَذَ بِيَدِهِ عَبَّاسُ بْنُ عَبْدِ الْمُطَّلِبِ، فَقَالَ لَهُ أَنْتَ وَاللهِ بَعْدَ ثَلاَثٍ عَبْدُ الْعَصَا، وَإِنِّي وَاللهِ لأُرَى رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم سَوْفَ يُتَوَفَّى مِنْ وَجَعِهِ هَذَا، إِنِّي لأَعْرِفُ وُجُوهَ بَنِي عَبْدِ الْمُطَّلِبِ عِنْدَ الْمَوْتِ، اذْهَبْ بِنَا إِلَى رَسُولِ اللهِ صلى الله عليه وسلم فَلْنَسْأَلْهُ فِيمَنْ هَذَا الأَمْرُ، إِنْ كَانَ فِينَا عَلِمْنَا ذَلِكَ، وَإِنْ كَانَ فِي غَيْرِنَا عَلِمْنَاهُ فَأَوْصَى بِنَا‏.‏ فَقَالَ عَلِيٌّ إِنَّا وَاللهِ لَئِنْ سَأَلْنَاهَا رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم فَمَنَعَنَاهَا لاَ يُعْطِينَاهَا النَّاسُ بَعْدَهُ، وَإِنِّي وَاللهِ لاَ أَسْأَلُهَا رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم‏.‏

অর্থ: ইসহাক (রহ.) ... আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত যে, আলী ইবনু আবূ তালীব (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু) হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কাছ হতে বের হয়ে আসেন যখন তিনি শেষ অসুখে আক্রান্ত ছিলেন। তখন সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম) তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, হে আবূল হাসান (ক.), রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আজ কেমন আছেন? তিনি বললেন, আল্-হামদুলিল্লাহ্, তিনি কিছুটা সুস্থ। তখন হযরত আব্বাস ইবনু আবদুল মুত্তালিব (রাঃ) তাঁর হাত ধরে তাঁকে বললেন, আল্লাহর কসম, তুমি তিন দিন পরে অন্যের দ্বারা পরিচালিত হবে। আল্লাহর শপথ, আমি মনে করি যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই রোগে অচিরেই বেসাল (আল্লাহর সাথে পরলোকে মিলন)-প্রাপ্ত হবেন। কেননা আমি আবদুল মুত্তালিবের বংশের অনেকের মৃত্যুকালীন চেহারার অবস্থা লক্ষ্য করেছি। চলো যাই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কাছে এবং তাঁকে জিজ্ঞাসা করি যে, তিনি (খিলাফতের) দায়িত্ব কার উপর ন্যস্ত করে যাচ্ছেন। যদি আমাদের মধ্যে থাকে তো তা আমরা জানবো। আর যদি আমাদের ছাড়া অন্যদের উপর ন্যস্ত করে যান, তাহলে তাও আমরা জানতে পারবো এবং তিনি এ ব্যাপারে আমাদের তখন অসীয়ত করে যাবেন। তখন হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু) বললেন, আল্লাহর কসম, যদি এ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে আমরা জিজ্ঞাসা করি আর তিনি আমাদের নিষেধ করে দেন (মানে খেলাফত মঞ্জুর না করেন), তাহলে এরপর লোকেরা আর আমাদের তা প্রদান করবেন না। আল্লাহর কসম, এজন্য আমি কখনোই এ সম্পর্কে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে জিজ্ঞাসা করবো না। [সহীহ বুখারী, ৪৪৪৭]

আমাদের (সুন্নীদের) প্রশ্ন: হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু) যদি গাদীরে খুম্মে স্পষ্টভাবে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক মনোনীত হয়ে থাকেন, তাহলে কেনো হযরত আব্বাস (রাদিয়াল্লাহু আনহু) খিলাফত সম্পর্কে নবী পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে জিজ্ঞেস করার কথা নিয়ে ভাবতে যাবেন? কেননা হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুকে তো তাঁর (খেলাফতের) উত্তরাধিকারের নির্দেশ (গাদীরে খুমে) দেওয়াই হয়েছিলো বলে শিয়াদের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়! অধিকন্তু, কেনোই বা হযরত ‘আলী (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু) হযরত ‘আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুকে সংশোধন করে দেননি এ কথা স্বীকার করে যে তিনিই গাদীরে খুমে খলীফা নিযুক্ত হয়েছেন? আর কেনোই বা হযরত আলী (রাদিয়াল্লাহু আনহু) নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কর্তৃক তাঁর প্রতি খিলাফত মঞ্জুর না করার ব্যাপারে শঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন, যদি তিনি ইতিমধ্যেই খলীফা নিযুক্ত হয়ে গিয়ে থাকেন? হযরত আলী (রাদিয়াল্লাহু আনহু)-এর প্রতিক্রিয়া স্পষ্টভাবে ইঙ্গিত করে যে, তিনি স্বয়ং কখনো প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’এর কোনো সুস্পষ্ট নির্দেশ দ্বারা খলীফা নিযুক্ত হওয়ার বিষয়টিকে বিবেচনায়ই নেন নি। {সৌজন্যে: www.mahajjah.com}

*সমাপ্ত*


*ফিরে দেখা এবারের গাদীরে খুম দিবস* (৭)

একজন ফেইসবুক বন্ধু গত বছরের গাদীরে খুম উপলক্ষে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “গাদীরে খুম দিবসটিকে স্বাভাবিকভাবে স্মরণ করা সুন্নী ইমামদের দ্বারা প্রমাণিত কি-না?” আমি বিগত কয়েকদিন যাবৎ এ বিষয়ে ফেইসবুকে অনেক লিখেছি। পাশাপাশি দলিলসমৃদ্ধ বইয়ের অনুবাদটিও শেয়ার করেছি। তাই সংক্ষেপে বলবো, এই দিবসটির গুরুত্ব ও তাৎপর্য এরই পটভূমিতে নিহিত। হযরতে ইমামে আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)’এর প্রতি মুসলমানদের কেউ কেউ কোনো একটি বিশেষ কারণে বিরূপ সমালোচনা করলে প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁদের প্রতি এ রকম না করার জন্য সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছিলেন। এটা কেইস-স্পেসিফিক তথা সুনির্দিষ্ট বিষয়সংশ্লিষ্ট, যা এখন অতীত। এ থেকে আমাদের জন্য একমাত্র শিক্ষণীয় হলো, তাঁর সাথে শত্রুতা ও বেয়াদবি করা চলবে না, বরং বন্ধুত্ব বজায় রাখতে হবে। এটাই এ ঘটনার গুরুত্ব ও তাৎপর্য। সুন্নী মুসলমান সমাজের এ ব্যাপারে ফোকাস তথা সঠিক পয়েন্টে দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখা জরুরি। কেননা মহাভ্রান্ত রাফেযী শিয়া গোষ্ঠী এ দিবসটিকে অজুহাত হিসেবে দেখিয়ে এটাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করে মুসলমানদের ধোঁকা দিতে অপতৎপর এবং ইসলামের বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত, যা নিয়ে আমি এই কয়দিন লেখালেখি করেছি। আল-হামদু লিল্লাহ, সুন্নী মুসলমান সমাজ এখন অনেক বেশি সচেতন ও সতর্ক। তবে শিয়া চক্র যেহেতু এমন ঘাড় ত্যাড়া আইনুদ্দী যাদের কাছে নিজেদের মনগড়া কথাই (শরঈ) আইন, আর যেহেতু তারা বকলম-বাহাদুর হওয়া সত্ত্বেও এতদসংক্রান্ত সেমিনার-সিম্পোজিয়াম অনুষ্ঠানের আয়োজনে একগুঁয়ে, সেহেতু আমাদেরও ১৮ যিলহজ্জ্ব তারিখে ৩য় খলীফা হযরতে উসমান (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)-এর শাহাদাত বার্ষিকী বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজনের মাধ্যমে পালন করা উচিত। দ্বিতীয়তঃ আমাদের আহলে বাইত (রা.)-বৃন্দের অন্যতম সদস্য ইমাম হাসান মুসান্না (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’এর এতদসংক্রান্ত বক্তব্যই পুণ্যবান ইমামবৃন্দের পক্ষে চূড়ান্ত রায় বলে আমি মনে করি।

*সমাপ্ত*


*গাদীরে খুমে মওলা আলী (ক.)-এর বেলায়াতের অভিষেক হয়নি, হয়েছে কুর’আনের মক্কী সূরায়*

শিয়াচক্র বেহুদা তর্কাতর্কি করতে পছন্দ করে। গাদীরে খুমে ঘোষিত হাদীসটির চুলচেরা বিশ্লেষণ পেশ করার পরও তারা তা মানতে নারাজ। এই লেখাটির শেষে আবারো আমার অনূদিত বইটির পিডিএফ ও ওয়ার্ড ডক লিঙ্কগুলো যুক্ত করা হলো। আমি যা লিখেছি শরঈ দলিলভিত্তিক, আর তা পূর্ববর্তী ভুল ধারণার মূলোৎপাটনকারীও। সম্ভব হলে কুর’আন ও হাদীসের দলিলকে খণ্ডন করুন! তাই আসুন, আমার এতদসংক্রান্ত লেখাটি আবারো শেয়ার করা যাক। এবার কলেবর বৃদ্ধি পেয়েছে কিছু প্রাসঙ্গিক কথা যোগ করার কারণে। সবাইকে মনোযোগ সহকারে পড়ার অনুরোধ জানাই।

মহাভ্রান্ত শিয়াচক্র দাবি করে যে গাদীরে খুমে ‘মওলার (বেলায়াতের) অভিষেক’ হয়েছে। অথচ হাদীসে উক্ত মওলা শব্দটি একজন প্রিয়ভাজন বন্ধুকে বুঝিয়েছে, মুসলিম সাধারণের (বেলায়াতের) অভিভাবক বোঝায় নি। যদি তাই হতো, তাহলে জ্যেষ্ঠ সাহাবা (রা.)-বৃন্দ, বিশেষ করে প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর আহলে বাইত-সদস্য ও শ্রদ্ধেয় চাচাজান দু জন সর্ব-হযরত আমীরে হামযা ও আব্বাস (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা) প্রমুখ ইমামে আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)-এর অভিভাবকত্বের অধীন হতেন। এটা স্রেফ এক জঘন্য বেয়াদবি! শিয়াদের পথভ্রষ্ট মতবাদে এ বেয়াদবি থাকলেও আমাদের সুন্নী মতাদর্শে এর কোনো স্থান নেই। হযরতে আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু) হযরত আব্বাস (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)-এর হস্তপদ মোবারক চুম্বন করতেন (ইমাম বুখারী কৃত ‘আদাবুল মুফরাদ’)।

*গাদীরে খুমে মওলা আলী (ক.)-এর বেলায়াতের অভিষেক হয়নি, হয়েছে কুর’আনের মক্কী সূরায়*

সূরাহ ইঊনুস, ৬২ আয়াতে আল্লাহ বলেন - أَلاۤ إِنَّ أَوْلِيَآءَ ٱللَّهِ لاَ خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلاَ هُمْ يَحْزَنُونَ - “নিশ্চয় আল্লাহর আউলিয়াবৃন্দের কোনো ভয় নেই এবং তাঁরা সন্তাপগ্রস্তও হবেন না” [সরাসরি অনুবাদ]। আউলিয়া শব্দটি বহুবচন। আর কুর‘আনের এই আয়াত যখন নাযিল হয় (মক্কী সূরাহ, ড: তাহিরুল কাদরী কৃত ইরফানুল কুর’আন, বাংলা সংস্করণ), তখন সাহাবা (রা.)-বৃন্দের প্রজন্মকেই এতে প্রথমতঃ উদ্দেশ্য করা হয়েছিলো। গাদীরে খুমের ঘটনা প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নুবূয়্যতের মিশনের শেষ দিকে সংঘটিত হয় (বিদায়ী হজ্জ্বশেষে মদীনা ফেরার পথে)। অতএব, বেলায়াত তথা ওলীত্ব ইতিমধ্যে আল্লাহতায়ালা দান করেছেন সাহাবা (রা.)-বৃন্দের অনেককেই, যাঁদের মধ্যে হযরতে ইমামে আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু)-ও রয়েছেন। পার্থক্য কেবল এতোটুকু যে, অনেক সাহাবা (রা.)-এর তরীকতের সিলসিলা পরবর্তীকালে জারি থাকেনি, ঠিক যেমনিভাবে তাঁদের মাযহাবও জারি থাকেনি। মাযহাবের ক্ষেত্রে চার ইমামের (রহ.)-গুলোই জারি হয়েছে। একইভাবে সিলসিলার ক্ষেত্রেও হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু) হতে বেশির ভাগ তরীকাহ আবির্ভূত হয়েছে। তবে তরীকার ইমাম (রহ.)-বৃন্দের স্ব স্ব নামে তা জারি রয়েছে।

*সমাপ্ত*





কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন