[পারসিক বাদশাহ নাদির শাহের দরবারে প্রায় ৩০০ বছর আগে শীয়া-সুন্নী এক বাহাস অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তাতে বাগদাদের প্রধান মুফতী শায়খ আবদুল্লাহ সুওয়াইদীকে ইরানী বাদশাহ দাওয়াত করে আনেন। তিনি ওই বিতর্কে শীয়াদের মুখ বন্ধ করে দিলে বাদশাহ তাঁর পক্ষে শাহী ফরমান জারি করেন। এই ঘটনার একটি বিস্তারিত বিবরণ শায়খ সুওয়াইদী নিজের লেখা ‘হুজাজে ক্বাতেয়া’ পুস্তকে রেকর্ড করেছেন। শিরোনামের হাদীসটি ওই বিতর্কে শীয়ারা উত্থাপন করলে তিনি তাদেরকে যে জবাব দিয়েছিলেন, এখানে তারই অনুবাদ পেশ করা হলো - অনুবাদক]
শায়খ আবদুল্লাহ সুওয়াইদী বলেন:
“অতঃপর আমি যার মওলা, আলী-ও তার মওলা”, এই বিবৃতিটি যদি (সহীহ) হাদীস হয়েও থাকে, তথাপিও তা হযরত আলী (ক:)-কে (প্রথম) ইমাম (মানে খলীফা) হিসেবে নির্দেশ করে না। কেননা ‘মওলা’ শব্দটি বিভিন্ন অর্থ জ্ঞাপক। এ ধরনের বিশটি অর্থ ’ক্বামূস’ শীর্ষক (আরবী অভিধান) পুস্তকে লিপিবদ্ধ আছে। (কোনো নির্দিষ্ট লিপিতে) এ রকম শব্দের ব্যবহার কোন্ অর্থে করা হয়েছে, তা কোনো বিশেষ চিহ্ন, সঙ্কেত বা গূঢ়ার্থ-জ্ঞাপক অতিরিক্ত দ্যোতনা দ্বারা প্রদান করতে হয়। ওই ধরনের সঙ্কেত ছাড়া তা ব্যাখ্যা করা ভুল হবে। (আলোচ্য হাদীসের ক্ষেত্রে) সেটার সবগুলো অর্থ, না কিছু অর্থ আরোপ করা সঠিক হবে, তা কিন্তু নিশ্চিত নয়; অধিকাংশ (উলামা)-ই বলেছেন যে এটা (মানে ওই হাদীস এভাবে ব্যাখ্যা করা) ভুল হবে। এক্ষণে তর্কের খাতিরে ব্যাখ্যা করা সঠিক হবে বলে আমরা ধরে নিলাম এবং ’মওলা’ শব্দটির প্রতি ‘আশেক্ব’/প্রেমিক’ ও ‘সাহায্যকারী’ অর্থ আরোপের বিষয়ে আমরা আপনাদের সাথে একমত হলাম। কিন্তু অন্যান্য অর্থারোপ তো এতে যথাযথ হবে না। এসব ক্ষেত্রে (উলামাদের) এজমা’ তথা ঐকমত্য অনুযায়ী অর্থারোপ করাই শ্রেয়তর হবে। এ কারণেই আবদুল গাফির বিন ইসমাঈল ফারিস [৪৫১-৫২৯ হিজরী/১১৩৫ খৃষ্টাব্দ; নিশাপুর] তাঁর ‘মজমাউল গারাইব’ গ্রন্থে ‘ওলী’ শব্দটির ব্যাখ্যাকালে উদ্ধৃত করেন নিম্নের হাদীস শরীফ - “কেউ আমাকে ভালোবাসলে এবং আমাকে তার সাহায্যকারী হিসেবে জানলে তার (এটাও) জানা উচিত যে আলী-ও তার সাহায্যকারী।” এই বিষয়টি সযত্নে চিন্তা করলে দেখা যাবে যে উক্ত হাদীসটি খেলাফতের জন্যে অধিকতর যোগ্যতা কিংবা কোনো প্রকারের শ্রেষ্ঠত্ব-ই নির্দেশ করে না। কেননা, অাভিধানিকভাবে অথবা ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে ‘ওলী’ শব্দটিকে ‘আওলা’ শব্দ হিসেবে ব্যাখ্যা করা মোটেও সঠিক হবে না। এটা যে ইসলামী রীতি নয় তা একেবারেই স্পষ্ট। আর আরবী ভাষার আভিধানিক দিক থেকে ‘মাফ’আল ক্যাটেগরি/শ্রেণিভুক্ত শব্দগুলোকে কখনোই ‘আফ’আল’ ক্যাটেগরি/শ্রেণিতে ব্যবহার করা হয়নি।
এই পর্যায়ে ইরানী প্রধান মোল্লা বলেন:
অভিধানবিদ আবূ যায়দ বিবৃত করেন যে এসব শব্দের ব্যবহার আবূ উবায়দা’র তাফসীরেও করা হয়েছে। আর তিনি (আবূ উবায়দা) ‘(আলী) তোমাদের মওলা’, এই অভিব্যক্তিকে ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে - ‘(আলী) তোমাদের জন্যে অধিকতর উপযুক্ত।’
শায়খ সুওয়াইদী জবাবে বলেন:
আবূ যায়দের বক্তব্য দলিল হতে পারে না। কেননা আরবী ভাষার পণ্ডিতদের কেউই তার এই বক্তব্যকে অনুমোদন করেননি। যদি এগুলো সমার্থক শব্দ হতো, তাহলে ‘অমুক তোমাদের জন্যে আওলা (শ্রেষ্ঠতর, অধিকতর উপযুক্ত)’, এ কথার চেয়ে ‘অমুক তোমাদের জন্যে মওলা (সাহায্যকারী, আশেক্ব) বলাটাই বেশি সঠিক হতো। কিন্তু অভিধান বিশারদবৃন্দ বলেন যে এটা কখনোই সঠিক হবে না। আবূ উবায়দার বক্তব্য অন্যান্যদের দ্বারাও রদ করা হয়েছে। আমরা দেখেছি যে ‘মওলা’ শব্দটির পরিবর্তে ‘আওলা’ শব্দটি ব্যবহার করা যায় না। তবে ধরুন আমরা বল্লাম এটা ব্যবহার করা সম্ভব, তবুও এটাকে ‘অধিকারী’, ‘ব্যবহারের উপযুক্ত’ অর্থে প্রয়োগ করা যাবে না। সম্ভবতঃ ‘আওলা’ শব্দটির অর্থ ‘সম্মান ও ভালোবাসার জন্যে অধিকতর উপযুক্ত।’ যদি এ কথা ধরেও নেয়া হতো যে এর মানে ‘ব্যবহার’, তাহলেও এটা আয়াতে করীমার অর্থের উপযোগী হতো না। “নিশ্চয় সমস্ত লোকের মধ্যে ইবরাহীমের অধিকতর হকদার (আওলা) তারাই ছিলো” - সূরা আলে ইমরানের ৬৮ নং আয়াতে বর্ণিত ‘আওলা’ শব্দটি কি ‘(ইবরাহীম আলাইহিস্ সালামকে) ব্যবহার করা’ বোঝাতে বলা হয়েছে? ’এ প্রসঙ্গে ‘আওলা’ শব্দটি বড় জোর বোঝায় ‘তাঁর (পয়গম্বর ইবরাহীম আলাইহিস সালামের) প্রতি ভালোবাসা অধিকতর উপযুক্ত।’
অধিকন্তু, হাদীস শরীফের শেষাংশে ব্যবহৃত ‘ওলী’ শব্দটির অর্থ মহব্বত করা। যদি রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর সাথে সম্বন্ধের ক্ষেত্রে এর মানে হতো ‘ব্যবহারের জন্যে অধিকতর উপযুক্ত’, তাহলে তিনি বলতেন ‘ব্যবহারের জন্যে অধিকতর উপযুক্ত যে কেউ।’ যেহেতু তিনি তা বলেননি, সেহেতু (হাদীস শরীফের অভিব্যক্তি অনুযায়ী) এর অর্থ হবে ‘হযরত আলী (ক:)-কে ভালোবাসা এবং তাঁর প্রতি শত্রুতা পরিহার করা’; এতে কোনোক্রমেই ‘ব্যবহার করার জন্যে উপযুক্ত’ বোঝাবে না। বস্তুতঃ ইমাম আবূ নু’য়াইম আহমদ বিন আব্দিল্লাহ রাহিমাহুল্লাহু-তা’লা (বেসালপ্রাপ্তি: ৪৩০ হিজরী, ইসপাহান) বর্ণনা করেন ইমাম হাসান (রা:)-এর পুত্র হযরত হাসান (রহ:) হতে: হযরত হাসান (রা:)-কে মানুষেরা জিজ্ঞেস করেছিলেন, (আমি যার মওলা, আলী-ও তার মওলা) এই হাদীসটি কি এ কথা প্রতীয়মান করে যে হযরত আলী (ক:) (প্রথম) খলীফা হবেন? হযরত হাসান (রা:) উত্তর দেন, “রাসূলুল্লাহ (দ:) যদি এই হাদীসটি দ্বারা বোঝাতেন যে হযরত আলী (ক:)-ই হবেন প্রথম খলীফা, তাহলে তিনি বলতেন, ‘ওহে মানবকুল! এই ব্যক্তি আমার (ঐশী মিশনের) কর্তব্য-কর্মের ওলী (আস্থাভাজন প্রতিনিধি)। সে-ই হবে আমার পরে (ইসলামী) খলীফা। এ কথা শোনো এবং মান্য করো!’ আমি আল্লাহর নামে কসম করে বলছি, আল্লাহতা’লা ও তাঁর রাসূল (দ:) যদি হযরত আলী (ক:)-কে (প্রথম) খলীফা করার ইচ্ছা পোষণ করতেন, তাহলে এক্ষেত্রে আল্লাহতা’লার আদেশ বাস্তবায়ন করার চেষ্টা না করে হযরত আলী (ক:) আল্লাহকে অমান্য করতেন, যার পরিণতিতে তাঁর মহাপাপ হতো।” হযরত হাসান (রা:)-এর এ কথা শুনে কেউ একজন বলেন, “কেন, আমাদের রাসূল (দ:) কি বলেননি - ‘আমি যার মওলা, আলী-ও তার মওলা’?” হযরত হাসান (রা:) উত্তরে বলেন, “না, ওয়াল্লাহি! রাসূলুল্লাহ (দ:) যদি হযরত আলী (ক:)-কে (প্রথম) খলীফা করতে চাইতেন, তাহলে তিনি সেভাবে এর আদেশ দিতেন যেমনি স্পষ্টভাবে তিনি (মুসলমানদেরকে) নামায-রোযা করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন।” আহলে বায়তের অন্যতম সদস্য ও হযরত আলী (ক:)-এর নাতি হযরত হাসান (রা:)-এর এই কথাগুলো প্রমাণ করে যে আপনাদের (শীয়াদের) এতদসংক্রান্ত বক্তব্য ভ্রান্ত ও দূষণীয়।
পুনশ্চ:
আমার পূর্ববর্তী শীয়া মতবাদ খণ্ডনকারী লেখাটি ’হুজাজে ক্বাতেয়া’ শীর্ষক একটি বইয়ের অংশ, যা’তে খলীফা হযরত আলী (ক:)-এর শান-মানও বর্ণিত হয়েছে। এই ফলো-আপে আমি যা বলতে চাই তা হলো, ইমাম-এ-আলী (ক:) ইসলামী চার খলীফার একজন। আর মহানবী (দ:)-এর করম নজরে তিনি বেলায়াতের রাজ্যের শাহেনশাহ-ও বটেন। বস্তুতঃ তাঁর আওলাদ-এ-পাকদের দ্বারাই তাসাউফ-তরীক্বতের ব্যাপক প্রচার-প্রসার হয়েছে। এটা অন্য কোনো সাহাবীর বংশে সেভাবে হয়নি। এর দ্বারা-ই বাস্তব রূপ লাভ করেছে মহানবী (দ:)-এর হাদীস: “আমি জ্ঞানের শহর, আলী তার দরজা।” কিন্তু মূল প্রতিপাদ্য সেটা নয়। মনে রাখবেন, হযরত আলী (ক:)-এর পূর্ববর্তী তিনজন খলীফা যখন একে একে খেলাফতের দায়িত্ব পান, তখন তাঁরা একই সাথে তিনটি দায়িত্ব পালন করেন: ১/ শরীয়তের হুকুম-আহকাম তথা ইসলামের বিধি-বিধান সর্বসাধারণের মাঝে প্রচার করা (অর্থাৎ, তাঁরা ফক্বীহ); ২/ ইসলামের বাতেনী শিক্ষাসমূহ বিশিষ্ট উম্মতদের মাঝে প্রচার করা (অর্থাৎ, তাঁরা মাশায়েখ); এবং ৩/ ইসলামী রাষ্ট্র পরিচালনা তথা শাসন করা (অর্থাৎ, তাঁরা রাষ্ট্রনায়ক) [শাহ ওলীউল্লাহ দেহেলভী কৃত ‘এযালাতুল খাফা’ ’আন খিলাফাতিল খুলাফা’]। তাঁরা যখন ওই দায়িত্ব গ্রহণ করেন, তখন সব জীবিত সাহাবা-ই তাঁদের কাছে আনুগত্যের বাইয়া‘ত নিয়েছিলেন। হযরত আলী (ক:)-ও সাহাবীদের থেকে ব্যতিক্রম নন। শেষ কথা হলো, ’আমি যার মওলা, আলীও তার মওলা’, এই হাদীসে মহানবী (দ:) যেভাবে বুঝিয়েছেন, সেভাবে বুঝতে হবে; তিনি আরবী ব্যাকরণের সূক্ষ্ম কারুকাজগুলো তাতে যুক্ত করেছেন, যা শায়খ সুওয়াইদী তাঁর ‘হুজাজে ক্বাতেয়া’ বইটিতে খোলাসা করেছেন। এগুলো বুঝতে হলে আলেম হতে হবে, উল্টো ব্যাখ্যা করা চলবে না। আমি ওই বই অনুবাদের আশা রাখি, মওলার মর্জি হোক। আমীন!
শায়খ আবদুল্লাহ সুওয়াইদী বলেন:
“অতঃপর আমি যার মওলা, আলী-ও তার মওলা”, এই বিবৃতিটি যদি (সহীহ) হাদীস হয়েও থাকে, তথাপিও তা হযরত আলী (ক:)-কে (প্রথম) ইমাম (মানে খলীফা) হিসেবে নির্দেশ করে না। কেননা ‘মওলা’ শব্দটি বিভিন্ন অর্থ জ্ঞাপক। এ ধরনের বিশটি অর্থ ’ক্বামূস’ শীর্ষক (আরবী অভিধান) পুস্তকে লিপিবদ্ধ আছে। (কোনো নির্দিষ্ট লিপিতে) এ রকম শব্দের ব্যবহার কোন্ অর্থে করা হয়েছে, তা কোনো বিশেষ চিহ্ন, সঙ্কেত বা গূঢ়ার্থ-জ্ঞাপক অতিরিক্ত দ্যোতনা দ্বারা প্রদান করতে হয়। ওই ধরনের সঙ্কেত ছাড়া তা ব্যাখ্যা করা ভুল হবে। (আলোচ্য হাদীসের ক্ষেত্রে) সেটার সবগুলো অর্থ, না কিছু অর্থ আরোপ করা সঠিক হবে, তা কিন্তু নিশ্চিত নয়; অধিকাংশ (উলামা)-ই বলেছেন যে এটা (মানে ওই হাদীস এভাবে ব্যাখ্যা করা) ভুল হবে। এক্ষণে তর্কের খাতিরে ব্যাখ্যা করা সঠিক হবে বলে আমরা ধরে নিলাম এবং ’মওলা’ শব্দটির প্রতি ‘আশেক্ব’/প্রেমিক’ ও ‘সাহায্যকারী’ অর্থ আরোপের বিষয়ে আমরা আপনাদের সাথে একমত হলাম। কিন্তু অন্যান্য অর্থারোপ তো এতে যথাযথ হবে না। এসব ক্ষেত্রে (উলামাদের) এজমা’ তথা ঐকমত্য অনুযায়ী অর্থারোপ করাই শ্রেয়তর হবে। এ কারণেই আবদুল গাফির বিন ইসমাঈল ফারিস [৪৫১-৫২৯ হিজরী/১১৩৫ খৃষ্টাব্দ; নিশাপুর] তাঁর ‘মজমাউল গারাইব’ গ্রন্থে ‘ওলী’ শব্দটির ব্যাখ্যাকালে উদ্ধৃত করেন নিম্নের হাদীস শরীফ - “কেউ আমাকে ভালোবাসলে এবং আমাকে তার সাহায্যকারী হিসেবে জানলে তার (এটাও) জানা উচিত যে আলী-ও তার সাহায্যকারী।” এই বিষয়টি সযত্নে চিন্তা করলে দেখা যাবে যে উক্ত হাদীসটি খেলাফতের জন্যে অধিকতর যোগ্যতা কিংবা কোনো প্রকারের শ্রেষ্ঠত্ব-ই নির্দেশ করে না। কেননা, অাভিধানিকভাবে অথবা ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে ‘ওলী’ শব্দটিকে ‘আওলা’ শব্দ হিসেবে ব্যাখ্যা করা মোটেও সঠিক হবে না। এটা যে ইসলামী রীতি নয় তা একেবারেই স্পষ্ট। আর আরবী ভাষার আভিধানিক দিক থেকে ‘মাফ’আল ক্যাটেগরি/শ্রেণিভুক্ত শব্দগুলোকে কখনোই ‘আফ’আল’ ক্যাটেগরি/শ্রেণিতে ব্যবহার করা হয়নি।
এই পর্যায়ে ইরানী প্রধান মোল্লা বলেন:
অভিধানবিদ আবূ যায়দ বিবৃত করেন যে এসব শব্দের ব্যবহার আবূ উবায়দা’র তাফসীরেও করা হয়েছে। আর তিনি (আবূ উবায়দা) ‘(আলী) তোমাদের মওলা’, এই অভিব্যক্তিকে ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে - ‘(আলী) তোমাদের জন্যে অধিকতর উপযুক্ত।’
শায়খ সুওয়াইদী জবাবে বলেন:
আবূ যায়দের বক্তব্য দলিল হতে পারে না। কেননা আরবী ভাষার পণ্ডিতদের কেউই তার এই বক্তব্যকে অনুমোদন করেননি। যদি এগুলো সমার্থক শব্দ হতো, তাহলে ‘অমুক তোমাদের জন্যে আওলা (শ্রেষ্ঠতর, অধিকতর উপযুক্ত)’, এ কথার চেয়ে ‘অমুক তোমাদের জন্যে মওলা (সাহায্যকারী, আশেক্ব) বলাটাই বেশি সঠিক হতো। কিন্তু অভিধান বিশারদবৃন্দ বলেন যে এটা কখনোই সঠিক হবে না। আবূ উবায়দার বক্তব্য অন্যান্যদের দ্বারাও রদ করা হয়েছে। আমরা দেখেছি যে ‘মওলা’ শব্দটির পরিবর্তে ‘আওলা’ শব্দটি ব্যবহার করা যায় না। তবে ধরুন আমরা বল্লাম এটা ব্যবহার করা সম্ভব, তবুও এটাকে ‘অধিকারী’, ‘ব্যবহারের উপযুক্ত’ অর্থে প্রয়োগ করা যাবে না। সম্ভবতঃ ‘আওলা’ শব্দটির অর্থ ‘সম্মান ও ভালোবাসার জন্যে অধিকতর উপযুক্ত।’ যদি এ কথা ধরেও নেয়া হতো যে এর মানে ‘ব্যবহার’, তাহলেও এটা আয়াতে করীমার অর্থের উপযোগী হতো না। “নিশ্চয় সমস্ত লোকের মধ্যে ইবরাহীমের অধিকতর হকদার (আওলা) তারাই ছিলো” - সূরা আলে ইমরানের ৬৮ নং আয়াতে বর্ণিত ‘আওলা’ শব্দটি কি ‘(ইবরাহীম আলাইহিস্ সালামকে) ব্যবহার করা’ বোঝাতে বলা হয়েছে? ’এ প্রসঙ্গে ‘আওলা’ শব্দটি বড় জোর বোঝায় ‘তাঁর (পয়গম্বর ইবরাহীম আলাইহিস সালামের) প্রতি ভালোবাসা অধিকতর উপযুক্ত।’
অধিকন্তু, হাদীস শরীফের শেষাংশে ব্যবহৃত ‘ওলী’ শব্দটির অর্থ মহব্বত করা। যদি রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর সাথে সম্বন্ধের ক্ষেত্রে এর মানে হতো ‘ব্যবহারের জন্যে অধিকতর উপযুক্ত’, তাহলে তিনি বলতেন ‘ব্যবহারের জন্যে অধিকতর উপযুক্ত যে কেউ।’ যেহেতু তিনি তা বলেননি, সেহেতু (হাদীস শরীফের অভিব্যক্তি অনুযায়ী) এর অর্থ হবে ‘হযরত আলী (ক:)-কে ভালোবাসা এবং তাঁর প্রতি শত্রুতা পরিহার করা’; এতে কোনোক্রমেই ‘ব্যবহার করার জন্যে উপযুক্ত’ বোঝাবে না। বস্তুতঃ ইমাম আবূ নু’য়াইম আহমদ বিন আব্দিল্লাহ রাহিমাহুল্লাহু-তা’লা (বেসালপ্রাপ্তি: ৪৩০ হিজরী, ইসপাহান) বর্ণনা করেন ইমাম হাসান (রা:)-এর পুত্র হযরত হাসান (রহ:) হতে: হযরত হাসান (রা:)-কে মানুষেরা জিজ্ঞেস করেছিলেন, (আমি যার মওলা, আলী-ও তার মওলা) এই হাদীসটি কি এ কথা প্রতীয়মান করে যে হযরত আলী (ক:) (প্রথম) খলীফা হবেন? হযরত হাসান (রা:) উত্তর দেন, “রাসূলুল্লাহ (দ:) যদি এই হাদীসটি দ্বারা বোঝাতেন যে হযরত আলী (ক:)-ই হবেন প্রথম খলীফা, তাহলে তিনি বলতেন, ‘ওহে মানবকুল! এই ব্যক্তি আমার (ঐশী মিশনের) কর্তব্য-কর্মের ওলী (আস্থাভাজন প্রতিনিধি)। সে-ই হবে আমার পরে (ইসলামী) খলীফা। এ কথা শোনো এবং মান্য করো!’ আমি আল্লাহর নামে কসম করে বলছি, আল্লাহতা’লা ও তাঁর রাসূল (দ:) যদি হযরত আলী (ক:)-কে (প্রথম) খলীফা করার ইচ্ছা পোষণ করতেন, তাহলে এক্ষেত্রে আল্লাহতা’লার আদেশ বাস্তবায়ন করার চেষ্টা না করে হযরত আলী (ক:) আল্লাহকে অমান্য করতেন, যার পরিণতিতে তাঁর মহাপাপ হতো।” হযরত হাসান (রা:)-এর এ কথা শুনে কেউ একজন বলেন, “কেন, আমাদের রাসূল (দ:) কি বলেননি - ‘আমি যার মওলা, আলী-ও তার মওলা’?” হযরত হাসান (রা:) উত্তরে বলেন, “না, ওয়াল্লাহি! রাসূলুল্লাহ (দ:) যদি হযরত আলী (ক:)-কে (প্রথম) খলীফা করতে চাইতেন, তাহলে তিনি সেভাবে এর আদেশ দিতেন যেমনি স্পষ্টভাবে তিনি (মুসলমানদেরকে) নামায-রোযা করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন।” আহলে বায়তের অন্যতম সদস্য ও হযরত আলী (ক:)-এর নাতি হযরত হাসান (রা:)-এর এই কথাগুলো প্রমাণ করে যে আপনাদের (শীয়াদের) এতদসংক্রান্ত বক্তব্য ভ্রান্ত ও দূষণীয়।
পুনশ্চ:
আমার পূর্ববর্তী শীয়া মতবাদ খণ্ডনকারী লেখাটি ’হুজাজে ক্বাতেয়া’ শীর্ষক একটি বইয়ের অংশ, যা’তে খলীফা হযরত আলী (ক:)-এর শান-মানও বর্ণিত হয়েছে। এই ফলো-আপে আমি যা বলতে চাই তা হলো, ইমাম-এ-আলী (ক:) ইসলামী চার খলীফার একজন। আর মহানবী (দ:)-এর করম নজরে তিনি বেলায়াতের রাজ্যের শাহেনশাহ-ও বটেন। বস্তুতঃ তাঁর আওলাদ-এ-পাকদের দ্বারাই তাসাউফ-তরীক্বতের ব্যাপক প্রচার-প্রসার হয়েছে। এটা অন্য কোনো সাহাবীর বংশে সেভাবে হয়নি। এর দ্বারা-ই বাস্তব রূপ লাভ করেছে মহানবী (দ:)-এর হাদীস: “আমি জ্ঞানের শহর, আলী তার দরজা।” কিন্তু মূল প্রতিপাদ্য সেটা নয়। মনে রাখবেন, হযরত আলী (ক:)-এর পূর্ববর্তী তিনজন খলীফা যখন একে একে খেলাফতের দায়িত্ব পান, তখন তাঁরা একই সাথে তিনটি দায়িত্ব পালন করেন: ১/ শরীয়তের হুকুম-আহকাম তথা ইসলামের বিধি-বিধান সর্বসাধারণের মাঝে প্রচার করা (অর্থাৎ, তাঁরা ফক্বীহ); ২/ ইসলামের বাতেনী শিক্ষাসমূহ বিশিষ্ট উম্মতদের মাঝে প্রচার করা (অর্থাৎ, তাঁরা মাশায়েখ); এবং ৩/ ইসলামী রাষ্ট্র পরিচালনা তথা শাসন করা (অর্থাৎ, তাঁরা রাষ্ট্রনায়ক) [শাহ ওলীউল্লাহ দেহেলভী কৃত ‘এযালাতুল খাফা’ ’আন খিলাফাতিল খুলাফা’]। তাঁরা যখন ওই দায়িত্ব গ্রহণ করেন, তখন সব জীবিত সাহাবা-ই তাঁদের কাছে আনুগত্যের বাইয়া‘ত নিয়েছিলেন। হযরত আলী (ক:)-ও সাহাবীদের থেকে ব্যতিক্রম নন। শেষ কথা হলো, ’আমি যার মওলা, আলীও তার মওলা’, এই হাদীসে মহানবী (দ:) যেভাবে বুঝিয়েছেন, সেভাবে বুঝতে হবে; তিনি আরবী ব্যাকরণের সূক্ষ্ম কারুকাজগুলো তাতে যুক্ত করেছেন, যা শায়খ সুওয়াইদী তাঁর ‘হুজাজে ক্বাতেয়া’ বইটিতে খোলাসা করেছেন। এগুলো বুঝতে হলে আলেম হতে হবে, উল্টো ব্যাখ্যা করা চলবে না। আমি ওই বই অনুবাদের আশা রাখি, মওলার মর্জি হোক। আমীন!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন