ব্লগ সংরক্ষাণাগার

বৃহস্পতিবার, ২৯ ডিসেম্বর, ২০১৬

ক্ষণজন্মা ব্যক্তিত্ব - এ্যাডভোকেট মোজাম্মেল হোসেন

ভূমিকা

আমাদের এই সুজলা-সুফলা প্রাকৃতিক নিসর্গের বাংলাদেশে যে কয়জন ক্ষণজন্মা বিদ্বান-ব্যক্তির আবির্ভাব ঘটেছে, তাঁদের মধ্যে এ্যাডভোকেট মোজাম্মেল হোসেন ছিলেন অন্যতম। বিশেষ করে দেশের আইন-জগতে তিনি ছিলেন কিংবদন্তি। দেশখ্যাত আইনবিদমণ্ডলী তাঁকে সম্মানের সাথে সম্বোধন করতেন আইনের encyclopedia (বিশ্বকোষ) হিসেবে। এই জ্ঞানের শাখার এমন কোনো দিক ছিল না যা তাঁর দৃষ্টির আড়ালে ছিল। আইনশাস্ত্রের ছাত্র হিসেবে তিনি আইনের প্রতিটি বিষয়কে এমনভাবে আত্মস্থ করেছিলেন যে, কোন্ আইনের প্রয়োগ কোথায়, কীভাবে হবে তা সঠিকভাবে নির্দেশনা দিতে পারতেন। আইনি বিষয়ে তাঁর অসাধারণ জ্ঞান ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ এতোটা স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ ছিল, যা প্রকৃত আইনজীবীর প্রতিচ্ছবি। এ কারণে আইন-জগতের মানুষজন তাঁকে শ্রদ্ধা করতেন।

জন্ম ও বংশ পরিচয়   

বাংলাদেশের দক্ষিণে অবস্থিত বঙ্গোপসাগরবক্ষে দাঁড়িয়ে আছে সন্দ্বীপ। বৈশিষ্ট্যে অন্যান্য দ্বীপের মতো হলেও এই দ্বীপেই জন্মেছেন দেশের প্রথিতযশা আইনবিদ এ্যাডভোকেট জনাব মোজাম্মেল হোসেন এবং আরো অনেক সূর্য-সন্তানপ্রকৃতির কাছে অসহায় ঝড়-ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ এ দ্বীপটির অন্তর্গত অনিন্দ্য সুন্দর একখানি গ্রাম, নাম সন্তোষপুর - যা আপন নামের প্রতি সুবিচারকারী এবং কোনোক্রমেই তার সাথে বৈসাদৃশ্যপূর্ণ নয়। এখানেই ১৯২০ সালের ১লা জানুয়ারী পিতা জনাব মনিরউদ্দীন মুনশী ও মাতা মোহতারামা জোবেদা খাতুনের ঘরকে আলোকিত করে জনাব মোজাম্মেল হোসেনের ধরণীতলে শুভাগমন। বস্তুতঃ সন্দ্বীপের যে কয়টি বিশিষ্ট পরিবার রয়েছে, সেগুলোর মধ্যে মুনশী পরিবারের সুনাম সর্বোচ্চ শিখরে অবস্থিত। বংশীয় ঐতিহ্যগত মান-সম্মান, প্রতিপত্তি, সম্পত্তি ও ধনসম্পদের অধিকারী হওয়ার পাশাপাশি জনাব মনিরউদ্দীন মুনশী ছিলেন আধ্যাত্মিক জগতে বিচরণকারী এক মহান সিদ্ধপুরুষ ও পুণ্যাত্মা। চট্টগ্রামের ফটিকছড়িস্থ মাইজভাণ্ডার দরবার শরীফের আউলিয়াকুল শিরোমণি শায়খ গোলামুর রাহমান আল-হাসানী (রহ:)-এর আধ্যাত্মিক ফয়েযপ্রাপ্ত ছিলেন তিনি। মা মোহতারামা জোবেদা খাতুন-ও ছিলেন এই পথের পথিক। তাই বাবা ও মায়ের আদর্শে লালিত হয়ে জনাব এ্যাডভোকেট মোজাম্মেল হোসেন এই মহৎ নীতি-নৈতিকতা ও আধ্যাত্মিক উৎকর্ষকে নিজের জীবনের একমাত্র আরাধ্য হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। আর এর প্রভাব তাঁর ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে পড়েছিল প্রকটভাবে।

শিক্ষা-দীক্ষা

জনাব মোজাম্মেল হোসেনের শিক্ষা জীবনের শুরু নিজ পরিবারেই। মা মোহতারামা জোবেদা খাতুন এবং বড় ভাই জনাব শামসউদ্দীন আহমদের (চেয়ারম্যান) কাছে তাঁর হাতে খড়ি হয়। এঁরা ছিলেন স্বশিক্ষিত। এঁদেরই জ্ঞানদীপ্ত দিকনির্দেশনায় তিনি ভবিষ্যত শিক্ষা জীবনের পাথেয় খুঁজে পান। বাংলা, ইংরেজি ও অন্যান্য বিদ্যা শেখার আগে তিনি মায়ের কাছ থেকে ইসলাম ধর্মের মৌলিক জ্ঞান আহরণ করেন। বলা বাহুল্য যে, ওই যুগে মক্তবভিত্তিক ইসলামী জ্ঞান এবং আরবী, ফার্সী ভাষা শিক্ষা করা মুসলমান সমাজে প্রচলিত রীতি ছিল, আর জনাব মুনশী মনিরউদ্দীন এসব ক্ষেত্রে ছিলেন বিশিষ্ট জ্ঞান বিশারদ। এ্যাডভোকেট মোজাম্মেল হোসেন সাহেবের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা আরম্ভ হয় নিজ গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। সন্তোষপুর প্রাইমারি স্কুলে ১৯২৬ সালে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হওয়ার পর পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত তিনি সেখানেই পড়ালেখা করেন। এসময় তিনি বৃটিশ শিক্ষা পদ্ধতিতে তৃতীয় ও পঞ্চম শ্রেণিতে জেলা বৃত্তি লাভ করেন। অতঃপর তিনি কাঠগড় হাইস্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হন। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র হিসেবে তিনি বিশেষ করে অঙ্কে ছিলেন তুখোড়। এছাড়াও অন্যান্য বিদ্যাশাস্ত্রে তাঁর অসাধারণ কৃতিত্ব শিক্ষকবৃন্দসহ সবার নজর কাড়ে। আপন বিদ্যা শিক্ষার পাশাপশি পরহিতৈষী এ্যাডভোকেট মোজাম্মেল হোসেন সাহেব গরিব ছাত্রদেরও পাঠদান করতেন। মা ও বড় ভাইয়ের (পরবর্তীকালে সন্তোষপুর ইউনিয়নের আজীবন চেয়ারম্যান শামসউদ্দীন আহমদ সাহেবের) অনুমতি নিয়ে তিনি দরিদ্র ছাত্রদের বই-খাতা কিনে দিতেন। কাঠগড় হাইস্কুল থেকে তিনি স্বেচ্ছায় ট্রান্সফার সার্টিফিকেট নিয়ে কারগিল হাইস্কুলে এসে ভর্তি হন এবং এই বিদ্যালয় হতে কৃতিত্বের সাথে প্রবেশিকা (এনট্রান্স) পাশ করেন।

এ্যাডভোকেট মোজাম্মেল হোসেন সাহেবের কলেজ জীবন শুরু হয় ফেনী কলেজে। তাঁর বাবা বেসালপ্রাপ্ত (পরলোকে আল্লাহর সাথে মিলনপ্রাপ্ত) হওয়ায় বড় ভাই জনাব শামসউদ্দীন আহমদ চেয়ারম্যান সাহেব তাঁর পড়াশুনা চালিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব নিয়েছিলেন, আর তিনি এ ব্যাপারে সর্বাত্মক আর্থিক সাহায্য প্রদান করতে মোটেও কুণ্ঠিত হননি। সত্যি, জনাব মোজাম্মেল হোসেন ও তাঁর দুই বড় ভাইকে যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা এঁদের পারস্পরিক টান ও মিলমিশ, সমঝোতা ও শ্রদ্ধাবোধ দেখে অভিভূত না হয়ে পারেননি। ফেনী কলেজে জনাব মোজাম্মেল হোসেনের মূল বিষয় ছিল অঙ্ক। তবে এখানে তাঁর ফুটবল খেলার প্রতি ঝোঁকও দেখা দেয়। শারীরিকভাবে পাতলা লিকলিকে গড়নের হলে কী হবে, তিনি ছিলেন শক্ত, সামর্থ্য ও দক্ষ ফুটবলার, যিনি নিজ জবানি মোতাবেক ৯০ ডিগ্রী এ্যাঙ্গেলে পেছনে ফিরে আচমকা শটে গোল করতেন। সন্দ্বীপে ফুটবলের উন্নয়নে তিনি অনেক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। কলেজ জীবনেও তিনি গরিব ছাত্রদের বিনামূল্যে পাঠদান করতে থাকেন। আই,এ পাশের পর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্ক বিভাগে বি,এ-তে ভর্তি হন এবং কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন। অতঃপর এম,এ-তে অঙ্ক নিয়ে ভর্তি হন, কিন্তু চূড়ান্ত পরীক্ষার আগে অসুস্থ হয়ে পড়লে পরীক্ষা আর দেয়া হয়নি। এর প্রায় দু বছর পর তিনি সুস্থ হয়ে কোলকাতায় বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হন। ওই সময় বৃটিশ ভারতে দুটি পৃথক রাষ্ট্রের দাবিতে হিন্দু ও মুসলমান জাতি আন্দোলন করছিলেন। এরই ফলশ্রুতিতে ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়, যার পূর্ব অংশ ছিল আমাদের এই পূর্ব বাংলা। এদেশের অধিবাসী হওয়ায় জনাব মোজাম্মেল হোসেন পাকিস্তান রাষ্ট্রের নাগরিক হন এবং তাঁকে আবারো চূড়ান্ত পরীক্ষা না দিয়ে ভারতের অন্তর্গত কোলকাতা হতে চলে আসতে হয়। দেশে ফিরে এসে তিনি পুনরায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হন এবং মাত্র ২১ দিনের পরীক্ষা-প্রস্তুতি নিয়ে সবাইকে বিস্ময়াভিভূত করে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করেন!

কর্মজীবন 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয়ে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে এ্যাডভোকেট মোজাম্মেল হোসেন সাহেব সবাইকে অবাক করে ঢাকায় কর্মজীবনের সূচনার পরিবর্তে চট্টগ্রামেই তা শুরু করেন। তিনি এর কারণ হিসেবে বলেন যে নিজ এলাকা তথা সন্দ্বীপ ও চট্টগ্রামের মানুষকে সেবা দেয়াই তাঁর ব্রত। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মতো বিখ্যাত রাষ্ট্রবিদ ও নেতৃবৃন্দ তাঁকে সরকারি চাকরি গ্রহণ করার পরামর্শ দিলেও তিনি স্বাধীন আইনপেশাকে বেছে নেন। ১৯৪৯ সালে তিনি চট্টগ্রাম জজ আদালতে যোগদান করেন। ১৯৫৪ সালে মাত্র ৩৪ বছর বয়সে তিনি যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে নোয়াখালি জেলা বোর্ডের প্রবীণ রাজনীতিবিদকে হারিয়ে পার্লামেন্ট সদস্য নির্বাচিত হন। এসময় তিনি আইনপেশা ছেড়ে পুরোপুরিভাবে জনগণের সেবায় আত্মনিয়োজিত হন, যা আজকালের রাজনীতিবিদদের মধ্যে কদাচিৎ দেখা যায়। চট্টগ্রামে সন্দ্বীপ এডুকেশন সোসাইটি স্থাপন করে বহু গরিব মেধাবী ছাত্রকে তিনি বৃত্তি প্রদান করেন। এমপি থাকাকালে সন্দ্বীপ থানাকে নোয়াখালি জেলা থেকে আলাদা করে চট্টগ্রাম জেলাধীন থানায় অন্তর্ভুক্ত করেন। কিন্তু জেনারেল আইয়ূব খাঁনের ক্ষমতা দখল ও মার্শাল’ল জারির পর পার্লামেন্ট ভেঙ্গে গেলে তিনি রাজনীতি ছেড়ে দেন এবং আবারো আইনপেশায় মনোনিবেশ করেন।

এ্যাডভোকেট মোজাম্মেল হোসেন সাহেব ব্যক্তিগতভাবে ছিলেন অত্যন্ত সৎ। কর্মস্থলে তাঁর সততার দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় একটি ঘটনায়, যা তাঁর ২৬ বছরের সহকর্মী ও জুনিয়র এ্যাডভোকেট কাজী গোলাম সরওয়ার সাহেবের রচিত ‘আমার শিক্ষককে যেমন দেখেছি’ শিরোনামের প্রবন্ধ হতে জানা যায়। ওই প্রবন্ধে তিনি লেখেন, “সাতকানিয়ার ছিদ্দীক আহমদ সওদাগর নামের এক ব্যক্তি চট্টগ্রাম শিপিং করপোরেশন থেকে ‘বাংলার দূত’ নামক জাহাজ কেনার উদ্দেশ্যে দরপত্র জমা দেয়ার পর তার দরপত্র সর্বনিম্ন হওয়ায় তিনি জাহাজের জন্যে টাকা জমা দেন। ইত্যবসরে অন্য এক ব্যক্তি উক্ত বিক্রির বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করলে তদানীন্তন উপ-রাষ্ট্রপতি বিচারপতি নূরুল ইসলাম সাহেব এ্যাডভোকেট জনাব মোজাম্মেল হোসেনকে শিপিং করপোরেশনের পক্ষে উক্ত মামলা পরিচালনার দায়িত্ব দেন। মামলায় জিতে ছিদ্দীক সওদাগর ৫০,০০০/- (পঞ্চাশ হাজার) টাকা ও কচি ডাব উপঢৌকনস্বরূপ মোজাম্মেল হোসেন সাহেবের বাসায় নিয়ে যান। কচি ডাব বারান্দায় রেখে তিনি বাসায় প্রবেশ করে ৫০,০০০/- টাকা ভর্তি একখানি প্যাকেট এ্যাডভোকেট মোজাম্মেল হোসেন সাহেবের প্রতি বাড়িয়ে দেন এবং তাঁকে বলেন, ‘স্যার, এখানে ৫০,০০০/- টাকা আছে।’ তিনি জিজ্ঞেস করেন, ‘এটা কিসের টাকা?’ ছিদ্দীক সওদাগর উত্তর দেন, ‘আমি মামলায় জিতেছি। তাই টাকা দিচ্ছি।’ এ্যাডভোকেট মোজাম্মেল হোসেন সাহেব বলেন, ‘আমি শিপিং করপোরেশনের উকিল। আপনার কাছ থেকে টাকা নেবো কেন? আপনি টাকা নিয়ে চলে যান।’ এমতাবস্থায় ছিদ্দীক সওদাগর আবারো অনুরোধ করলে তিনি বলেন, ‘টাকাগুলো নিয়ে এখান থেকে চলে যান। নতুবা আমি জোরপূর্বক বের করে দেবো।’ সওদাগর সাহেব হতভম্ব হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে দেখেন, বারান্দায় রাখা কচি ডাবগুলো নিচে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে।

একই বর্ণনাকারী জনাব কাজী গোলাম সরওয়ার এ্যাডভোকেট এমন আরেকটি মামলার কথা উল্লেখ করেন, যেখানে আইনবিদ্যার বিভিন্ন শাখায় এ্যাডভোকেট মোজাম্মেল হোসেন সাহেবের গভীর জ্ঞানের প্রমাণ মেলে। একবার জনৈক মোজাম্মেল হক সাহেবের এক নির্বাচনী আপীল ২য় অতিরিক্ত জেলা জজ আদালতে বিচারাধীন হয়, যার দায়িত্ব নেন এ্যাডভোকেট মোজাম্মেল হোসেন সাহেব। ওই মামলায় আপীলকারী জনাব মোজাম্মেল হক জয়ী হলে মামলায় অপর পক্ষ ঢাকা হাইকোর্টে রিভিশন মামলা দায়ের করেন। ফলে এ্যাডভোকেট মোজাম্মেল হোসেন সাহেব তাঁকে রাত সাড়ে দশটার ট্রেনে চড়ে মামলায় হাজির হওয়ার জন্যে ঢাকায় প্রেরণ করেন। পরদিন সকালে ঢাকায় নিযুক্ত আইনজীবীর চেম্বার থেকে তিনি চট্টগ্রামে মোজাম্মেল হোসেন সাহেবকে টেলিফোনে বলেন, ট্রেনে থাকাকালীন কে বা কারা তাঁর প্রতিপক্ষ নূরুল আমিন সাহেবকে কক্সবাজারে গুলি করে হত্যা করেছে। আর সেই হত্যা মামলায় মোজাম্মেল হক সাহেবকে এক নম্বর আসামি করা হয়েছে। অতঃপর তিনি ঢাকা থেকে ফিরে অন্তর্বর্তীকালীন জামিন নেন। কিন্তু ‘বেইল কনফার্ম’ (জামিন নিশ্চিত) করতে চট্টগ্রাম জেলা ও দায়রা জজ আদালতে শুনানির দিন ধার্য হলে মোজাম্মেল হক সাহেব সেখানে গিয়ে দেখেন, ফৌজদারি মামলা পরিচালনাকারী অনেক নামী-দামী আইনজীবীকে তাঁর প্রতিপক্ষ আগেভাগেই নিযুক্ত করেছেন। এমতাবস্থায় তিনি এ্যাডভোকেট মোজাম্মেল হোসেন সাহেবকে এমর্মে জিজ্ঞেস করেন যে কাকে মামলা পরিচালনার কাজে নিযুক্ত করবেন। এ্যাডভোকেট মোজাম্মেল হোসেন সাহেব বলেন, ‘আমি দীর্ঘ চল্লিশ বছর ফৌজদারি মামলা প্র্যাকটিস (পরিচালনা) করিনি। তাই এ মামলায় যাবো না। আপনি বরঞ্চ মোজাফফর খাঁন সাহেবকে নিযুক্ত করুন।’ কিন্তু মামলার তারিখে মোজাম্মেল হক সাহেবের অনুরোধ উপেক্ষা করতে না পেরে তিনি দায়রা জজ আদালতে অনুষ্ঠিত ওই শুনানিতে উপস্থিত হন। ক্রিমিনাল প্র্যাকটিশনার উকিলবৃন্দ তাঁকে দেখে নানা টিপ্পনি কাটেন। প্রতিপক্ষের যুক্তি পেশ শেষ হলে পরে এ্যাডভোকেট মোজাম্মেল হোসেন সাহেব বিনা প্রস্তুতিতে প্রতিপক্ষ উকিলদের যুক্তি থেকে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে Natural Justice ও Fundamental Right-বিষয়ে যুক্তি উপস্থাপন আরম্ভ করলে আদালতে পিন-পতন নিস্তব্ধতা নেমে আসে। তাঁর অনবদ্য যুক্তিতর্ক পেশের ফলশ্রুতিতেই জামিন নিশ্চিত হয়ে যায়।

আইনশাস্ত্রে জনাব মোজাম্মেল হোসেন এ্যাডভোকেটের পাণ্ডিত্য প্রসঙ্গে এ্যাডভোকেট শামসুদ্দীন আহমদ মীর্জা সাহেব বলেন, মোজাম্মেল হোসেন সাহেব উকিল হিসেবে ড্রাফটিং (মামলা সাজিয়ে লেখা) ও এ্যাডভোকেসি (আদালতে যুক্তিতর্ক পেশ) উভয় ক্ষেত্রেই পারদর্শী ছিলেন। তাঁর হাতের লেখা ছিল অপরূপ। যখন লিখতেন, তখন আস্তে আস্তে লিখতেন। কিছু উকিল ড্রাফটিংয়ে দক্ষ, কিন্তু আদালতে যুক্তি পেশের ক্ষেত্রে অদক্ষ। আবার কিছু উকিল আদালতে যুক্তি পেশের বেলায় দক্ষ, কিন্তু মামলা সাজিয়ে লেখায় অদক্ষ। এই দুটো গুণ একই সঙ্গে খুব কম উকিলেরই থাকে। জনাব মোজাম্মেল হোসেনের মাঝে উভয় গুণের সমাহার ছিল। তিনি যেমন ড্রাফটিংয়ে পারদর্শী ছিলেন, আদালতে নিবেদনের বেলায়ও তেমনি ছিলেন সমান পারদর্শী। তাঁর যুক্তিতর্ক (আর্গুমেন্ট) কখনোই একঘেঁয়ে বা শ্রুতিকটু মনে হতো না। কী বিজ্ঞ হাকিম, কী বিরোধী পক্ষীয় উকিল, কী মক্কেল, তাঁর যুক্তিতর্ক মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনতেন। এটা ছিল তাঁর অনন্য বৈশিষ্ট্য। কিছু কিছু উকিল কিছু বিষয়ে পারদর্শী। কেউ ‘ল্যান্ড ম্যাটার’ বা জমিসংক্রান্ত মামলায়, কেউ নির্বাচনী মামলায়, কেউ বাণিজ্যিক মামলায়, কেউ ব্যাংকিং মামলায়, কেউ চাকরিসম্পর্কিত মামলায়, কেউ বা আবার শ্রমিক মামলায়। কিন্তু সবাই সব বিষয়ে দক্ষ নন। এক্ষেত্রে এ্যাডভোকেট মোজাম্মেল হোসেন সাহেব ছিলেন ব্যতিক্রম। সব মামলাতেই ছিল তাঁর অবাধ বিচরণ। তিনি বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টেও ওকালতি করেন। সেখানেও তিনি অল্প সময়ের মধ্যে আইনজীবী হিসেবে আপন প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন।

চট্টগ্রামে হাইকোর্ট বেঞ্চ প্রতিষ্ঠার পথিকৃৎ

১৯৮২ সালে জেনারেল হোসেন মুহাম্মদ এরশাদ ক্ষমতায় এলে তিনি সিদ্ধান্ত নেন, দেশের প্রতিটি বিভাগে বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের বেঞ্চ প্রতিষ্ঠা করবেন। কিন্তু সরকার তা চট্টগ্রামে না স্থাপন করে কুমিল্লায় প্রতিষ্ঠা করেন। একারণে চট্টগ্রামের আইনজীবীবৃন্দ ও এলাকাবাসী ক্ষুব্ধ হন। ওই সময় চট্টগ্রাম আইনজীবী সমিতির সভাপতি ছিলেন এ্যাডভোকেট মোজাম্মেল হোসেন এবং সাধারণ সম্পাদক ছিলেন আলহাজ্জ্ব আহমদ ছগির। জনাব মোজাম্মেল হোসেন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে নিখুঁত যুক্তি দ্বারা চট্টগ্রামে হাইকোর্ট বেঞ্চ প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব সম্পর্কে বোঝাতে সক্ষম হন। এই প্রক্রিয়া চলাকালীন সময়ে তিনি বহুবার আইনজ্ঞদের প্রতিনিধিদলসহ ঢাকায় আসেন এবং চট্টগ্রামবাসীর কল্যাণে এসব সফরে নিজ অর্থব্যয় করেন। অবশেষে এক্ষেত্রে যুগান্তকারী ভূমিকা রেখে তিনি চট্টগ্রামে হাইকোর্ট বেঞ্চ প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হন। যদিও পরে সুপ্রীম কোর্টের আপীল বিভাগের এক রায়ে হাইকোর্ট বেঞ্চ স্থাপনের লক্ষ্যে সংবিধানের অষ্টম সংশোধনীটি বাতিল করা হয়, তবুও এ ঘটনাটি যুগান্তকারী ছিল। কেননা, এ্যাডভোকেট মোজাম্মেল হোসেন সাহেব পরে চট্টগ্রামভিত্তিক মাসিক আলোকধারা পত্রিকাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে দ্বিমত প্রকাশ করে বলেন যে আপীল বিভাগে তিনজন বিচারকের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চের দুজন বিচারক হাইকোর্ট বিভাগের বিকেন্দ্রীকরণকে সুপ্রীমকোর্টের সার্বভৌমত্ব ক্ষুন্নকারী মনে করে নিষেধাজ্ঞা জারি করলেও প্রকৃতপক্ষে উক্ত ৮ম সংশোধনীতে শুধু হাইকোর্ট বিভাগের বিকেন্দ্রীকরণের কথা-ই বলা হয়েছিল, আপীল বিভাগের বিকেন্দ্রীকরণের কথা বলা হয়নি। তিনি আরো মত প্রকাশ করেন যে এই বিকেন্দ্রীকরণ হলে দেশের সব অঞ্চলের নাগরিকদের ন্যায়বিচার পাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হতো; বিচারব্যবস্থা সবার দোরগোড়ায় পৌঁছে যেতো; পক্ষান্তরে, রাজধানীতে গিয়ে মামলার বিপুল ব্যয়ভার বহন করতে হতো না এবং এতদসংশ্লিষ্ট হয়রানির শিকার-ও আর হতে হতো না।

বিয়ে ও পরিবার

জনাব মোজাম্মেল হোসেনের ছাত্র জীবনেই তাঁর মা মোহতারামা জোবেদা খাতুন এক পাত্রী পছন্দ করে রাখলে তিনি বিয়ে করতে বাধ্য হন। তাঁর স্ত্রী রেজিয়া বেগম নোয়াখালির হাতিয়া থানাধীন জনাব লুৎফুল করীম ও জনাবা নূরুন নাহারের সম্ভ্রান্ত পরিবারে সবার বড় সন্তান। ১৯৪৬ সালে এই বিয়ে সুসম্পন্ন হয়। এ্যাডভোকেট মোজাম্মেল হোসেন সাহেবের সন্তান সাতজন; তাঁরা হলেন রোখসানা বেগম, বোরহানা কবীর, মুহাম্মদ আলী ফারূক, মুহাম্মদ আলী হাসীন, মুহাম্মদ আলী রাহীন, জোবেদা হাসনা ও মুনিরা হোসনা। এঁরা সবাই উচ্চশিক্ষিত ও সুপ্রতিষ্ঠিত। এঁদের সন্তানরাও সমাজে প্রতিষ্ঠিত এবং উচ্চশিক্ষিত।

আধ্যাত্মিক জীবন             

ইতিপূর্বে বলা হয়েছে যে এ্যাডভোকেট মোজাম্মেল হোসেন সাহেব ধর্ম ও আধ্যাত্মিকতার প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন। এই আধ্যাত্ম্য-পিপাসা তাঁকে আপন পীর ও মোর্শেদ চট্টগ্রাম বোয়ালখালিস্থ আহলা দরবার শরীফের আউলিয়াকুল শিরোমণি হযরত মওলানা শাহ সূফী আবূল মোকারেম মুহাম্মদ নূরুল ইসলাম আল-কাদেরী আল-চিশ্তী (রহ:)-এর সান্নিধ্যে টেনে নেয়। এ্যাডভোকেট মোজাম্মেল হোসেন সাহেবের সূফীবাদী ধর্মীয় আদর্শে উদ্বুদ্ধ হন তাঁরই অনেক আত্মীয়স্বজন, সহকর্মী, শুভানুধ্যায়ী ও পরিচিতজন। আজকে ধর্মীয় অঙ্গনে যে উগ্রবাদী প্রভাব বিদ্যমান, তাঁর শান্তিকামী ও কল্যাণকর সূফীবাদী দর্শন-ই তা থেকে একমাত্র পরিত্রাণের পথ।

বেসাল 

মওত বা মৃত্যু একটি সেতু, এক বন্ধুকে অপর বন্ধুর কাছে পৌঁছে (বেসাল) দেয় - পবিত্র হাদীসের এই বাণীতে বিশ্বাসী এ্যাডভোকেট মোজাম্মেল হোসেন সাহেব ২০০৩ সালের ২৭ শে জুলাই তারিখ রোববার সকাল সোয়া দশটায় দুনিয়ার সব বন্ধন ছিন্ন করে মহান প্রভুর সান্নিধ্যে গমন করেন।  
 

  

       

২টি মন্তব্য:

  1. Thank you for the writing! So many details came to our memories. Some details about this unique and great human being brought tears to my eyes! May Allah keep all his families and relatives in His Blessings! May we all his relatives carry his tradition and values to a higher elevation wherever we are around the world!

    উত্তরমুছুন
  2. আমার মাতৃবংশীয় পূর্বপুরুষদেরকে হেয় করে ওই বংশের উত্তরসূরী আমারই জনৈক আত্মীয় ফেইসবুকে গত বছরের মধ্যভাগে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন। সেটা দেখে আমার মনে ক্ষোভ জন্মে। ফলশ্রুতিতে তাঁর বক্তব্যের খণ্ডনমূলক কিছু লেখবো বলে মনস্থ করি। ওই রাতেই ছোট নানাজানকে আমি স্বপ্নে দেখি। তিনি আমায় ‘এই নাও, এটা রাখো’ বলে টাকা সাধেন। আমি উত্তরে বলি, ‘আমার (বড়) নানাজান দিয়েছেন (উত্তরাধিকারস্বরূপ)।’ তখন তিনি আমাকে বলেন, ‘তাহলে জিলাপী খাও।’ তাঁর পবিত্র ডান হাত হতে একটি জিলাপী আমি দু হাত পেতে গ্রহণ করি এবং স্বপ্নের মধ্যেই খেয়ে ফেলি। এরপর আমার স্বপ্ন ভেঙ্গে যায়। এই ঘটনা গত বছরের।

    উত্তরমুছুন