-এডমিন
প্রশ্ন
”আমার আকীদার সাথে মিল থাকলে হাদীস মানি, আর মিল না থাকলে মানি না। কেননা হাদীসের সত্যতা প্রমাণ করা ৭ সমুদ্র ১৩ নদীর পানি সেঁচে মুক্তা আহরণের চেয়েও কঠিন। তাই আমার হাতে সুযোগ আছে। মানিনা অর্থ অস্বীকার করা নয়, সে হাদীসগুলো আমার মতে জাল ও ক্ষেত্রে বিশেষে জইফ। আর হ্যাঁ, হাদীস অবশ্যই কুর’আনের সমমর্যাদার না“ - এ কথাগুলো কি ইসলামের দৃষ্টিতে সঠিক? নাকি ভুল?
উত্তর
আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে উপরের কথাগুলো ইসলামের দৃষ্টিতে সিদ্ধ নয়। কেননা স্ববিরোধী দাবি উত্থাপন করা হয়েছে এ মর্মে যে, ’হাদীস মানি না, (আবার) অস্বীকারও করি না।’ হাদীস হিসেবে স্বীকার করলে অবশ্যই তা মানতে হবে, যেহেতু তা রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর বাণী। আমি নিজস্ব মত এখানে দেবো না, বরং ইসলামের হাদীসশাস্ত্র বিশারদ ইমামবৃন্দের (রহ.) ভাষ্য এখানে উপস্থাপন করবো। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিখ্যাত লেবাননী বংশোদ্ভূত মার্কিন শাইখ মুহাম্মদ হিশাম কাব্বানী (রহমতুল্লাহি আলাইহি) তাঁর ‘ইন্টারনেটে মহা-বিতর্ক’ শিরোনামের গবেষণাপত্রে লিখেছেন:
‘এলম আল-হাদীস’ শাস্ত্রে আমরা হাদীসের বিভিন্ন শ্রেণীবিন্যাস পাই। এগুলোর একটি হলো ‘সহীহ’, যার অর্থ করা হয়েছে, ‘ভুলের বিপরীত।’ এই ‘সহীহ’ শব্দটির ব্যাখ্যা করতে একটি গোটা গ্রন্থ লেখার প্রয়োজন হবে। ‘হাদীসে হাসান’ শব্দটির ব্যাখ্যা করতেও আরেকটি পুরো বই লেখতে হবে।
আহাদীসের শ্রেণীবিন্যাস
এই শ্রেণীবিন্যাসের পরবর্তী ধাপ/পর্যায় হলো ’হাদীস যয়ীফ’। এরপর ক্রমানুসারে ‘হাদীস মারফু’, ’হাদীস মুসনাদ’, ‘হাদীস মুত্তাসিল’, ‘হাদীস মওকুফ’, ’হাদীস মাকতু’, ‘হাদীস মুনকাতী’, ’হাদীস মু’আদল’, ’হাদীস মুরসাল’, ’হাদীস মু’আলাক’, ‘হাদীস মুসালসাল’, ‘হাদীস গরীব’, ‘হাদীস আযীয’, ‘হাদীস মাশহুর’, ‘হাদীস মুতাওয়াতের’, ‘হাদীস মু’আনা’আন’, ‘হাদীস মুবহাম’, ‘হাদীস মুদাল্লাস্’, ‘হাদীস আশ্ শায়ায’, ‘হাদীস মাহফূয’, ‘হাদীস মুনকার’, ‘হাদীস মা’রুফ’, ‘হাদীস আলিই ওয়ান-নাযিল’, হাদীস মুদার্রাজ’, ’হাদীস মুদ্দাবাজ’, ‘হাদীস মুত্তাফফাক’, ‘হাদীস মুফতারাক’, ‘হাদীস মু’তালিফ’, ‘হাদীস মুখতালিফ’, ‘হাদীস মাকলুব’, ‘হাদীস মুদতারিব’, ‘হাদীস মু’আল্লাল’, ‘হাদীস মাতরুক’, এবং সবশেষে ‘হাদীস মাওযু’।
অতএব, আমরা পেলাম হাদীসের ৩৫টি সুনির্দিষ্ট শ্রেণীবিন্যাস, যা উলামাবৃন্দ হাদীস অধ্যয়নের সময় ব্যবহার করেন এবং যা দ্বারা তাঁরা হাদীসের শ্রেণীবিন্যাস করেন। এভাবেই ইসলামী পণ্ডিতমণ্ডলী জানতে পারেন কোন্ হাদীস গ্রহণযোগ্য, আর কোনটি গ্রহণযোগ্য নয়। এখানে একটি যৌক্তিক প্রশ্নের উদ্ভব হতে পারে আর তা হলো, “কুরআন বা সুন্নাহ’তে আক্ষরিকভাবে কোথায় এই শব্দগুলো পাওয়া যায়?” আর এরই ধারাবাহিকতায় আরও একটি যৌক্তিক প্রশ্ন উঠতে পারে যে এই জ্ঞানের বা বিদ্যার শাখা সৃষ্টির এবং এই শ্রেণীকরণ ও শব্দগুলো প্রবর্তনের অনুমতি কখন এলো? কেননা, এ তো মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) করেননি।
বস্তুতঃ এসব শ্রেণীবিন্যাস অস্তিত্ব পেয়েছে ইমাম বুখারী (রহমতুল্লাহি আলাইহি) ও তাঁর মতো মুহাদ্দেসীনবৃন্দের আগমনের পর, যাঁরা ‘এলমুল হাদীস’-এর উসূল তথা মূলনীতি প্রণয়ন ও সেগুলোর শ্রেণীকরণ করেন; আর এগুলোর কোনোটি-ই রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর জমানায় ছিল না। আরেক কথায়, হাদীসের এই শ্রেণীবিন্যাস কুরআন মজীদ বা সুন্নাহ’তে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখিত হয়নি; কিংবা সাহাবা-এ-কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-দের যুগেও এগুলোর অস্তিত্ব ছিল না; বরং এগুলোকে পরবর্তীকালে উলামাবৃন্দই সংজ্ঞায়িত ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন। [শাইখ হিশাম কাব্বানী রহমতুল্লাহি আলাইহির লেখাটির লিঙ্ক মন্তব্য সেকশনে প্রদত্ত]
অতএব, বোঝা গেলো যে হাদীসশাস্ত্র আমাদের মুহাদ্দিস ইমামবৃন্দই (রহ.) নিয়মবদ্ধ করেছেন এবং আমাদের মতো বকলম-বাহাদুরদের কোনো সুযোগ রাখেন নি এ বিষয়ে কথা বলার। আমাদের একমাত্র করণীয় হলো তাঁদের আঁকা ছকের অনুসরণ করা, আর আলবানী, ইবনে বা’য গংয়ের মতো গণ্ডমূর্খদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে পণ্ডিতি জাহির না করা! কেননা নির্ভুল হাদীসশাস্ত্রের খাতিরে মুহাদ্দিস ইমামবৃন্দ (রহ.) ৭ সমুদ্র ১৩ নদীর পানি সেঁচে সত্যিকার মুক্তাই উদ্ধার করেছেন! তাঁরা বর্তমান যুগের পণ্ডিতি জাহিরকারী লোকদের কোনো কথা বলার অবকাশই রাখেন নি! এ শাস্ত্রে ‘আমার মত/অভিমত’ বলতে কিছু নেই। তাই কোনো হাদীস সম্পর্কে মনে সন্দেহ জাগলে অবশ্যঅবশ্য মুহাদ্দিস ইমামবৃন্দের (রহ.) এতদসংক্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গি জানতে হবে। জানতে হবে হাদীসটি আসলে কোন্ শ্রেণিভুক্ত। এর জন্যে ব্যাপক অধ্যয়ন প্রয়োজন।
উপরের প্রশ্নটিতে উল্লেখিত শেষ আপত্তিটি সম্পর্কে কিছু বলে শেষ করতে চাই। কুর’আনের সাথে হাদীসের এ রকম তুলনা দেয়াটা ইসলামের শত্রুদের শেখানো বুলি। এতে আমাদের ধর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভের ভিত নাড়িয়ে দেবার ষড়যন্ত্র নিহিত। এতে লুকিয়ে আছে প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর বাণীর প্রতি অনাস্থা জ্ঞাপনের এক গভীর দুরভিসন্ধি। অথচ আল্লাহতায়ালা ফরমান - وَمَا يَنطِقُ عَنِ ٱلْهَوَىٰ، إِنْ هُوَ إِلاَّ وَحْيٌ يُوحَىٰ - এবং নবী পাক কোনো কথা নিজ প্রবৃত্তি থেকে বলেন না; তা তো ওহী-ই, যা তাঁর প্রতি (নাজিল) করা হয় [কুর’আন, ৫৩/৩-৪; নূরুল ইরফান]। এ লেখাটি দীর্ঘ হয়ে যাবে বলে ওহী মাতলূ (وَحِى مَتْلْو) এবং গায়রে মাতলূ (وَحِى غَيْر مَتْلْو) শব্দগুলোর এ.আই. রেফারেন্স লিঙ্ক আমি মন্তব্য সেকশনে দিলাম। মোদ্দা কথা হলো, রাসূলুল্লাল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সমস্ত বাণী-ই ওহী, কেননা তিনি নিজ হতে কোনো কথা বলেন না (উক্ত আয়াতে করীমা অনুসারে)। সুতরাং হাদীসকে খাটো করে কথা বলার কোনো রকম সুযোগই নেই!
*সমাপ্ত*
**শাইখ হিশাম কাব্বানী (রহ.)-এর লেখাটির লিঙ্ক: https://sunnah.org/2024/11/11/%e0%a6%87%e0%a6%a8%e0%a7%8d%e0%a6%9f%e0%a6%be%e0%a6%b0%e0%a6%a8%e0%a7%87%e0%a6%9f%e0%a7%87-%e0%a6%ae%e0%a6%b9%e0%a6%be-%e0%a6%ac%e0%a6%bf%e0%a6%a4%e0%a6%b0%e0%a7%8d%e0%a6%95/?fbclid=IwY2xjawNOH8VleHRuA2FlbQIxMABicmlkETFWdGlrWG9wQnZuNlVIOEpoAR4F1i2ypF_zcjsY5femq7gGVD8G6tdiQLURE5i5lttCUwrbj34m-X500kyHAA_aem_r1SR3yPRvkl1S2PFdZRcNQ
জরুরি জ্ঞাতব্য
ওহাবী/সালাফীচক্র নিম্নের হাদীসটিকে বিকৃত করে থাকে - “আমার রওযাকে ঈদ হিসেবে গ্রহণ কোরো না” [মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বাহ, ৭৫৪২, আন্তর্জাতিক - لَا تَتَّخِذُوا قَبْرِي عِيدًا]। আল-মাকদেসী (রহ.)-এর মতে হাদীসটি সহীহ। ওহাবী ভ্রান্তরা দাবি করে যে এর অর্থ, ঈদের মতো দিন ধার্য করে বাৎসরিক উরসের মেলা বসিও না। অথচ সুন্নী ইমামদের এ ব্যাপারে ভিন্নতর ব্যাখ্যা রয়েছে। ইমাম ইঊসুফ নাবহানী (রহমতুল্লাহি আলাইহি) তাঁর বিখ্যাত ‘শওয়াহিদুল হক্ক’ পুস্তকের ৮০ পৃষ্ঠায় (৩য় সংস্করণ, কায়রো, ১৯৬৫) মুহাদ্দিস ইমামবৃন্দের উদ্ধৃতি দিয়ে এর ব্যাখ্যা করেছেন - “ঈদের মতো বছরে একদিন যিয়ারত করতে এসো না, বরং ঘনঘন যিয়ারত কোরো।” এসব ব্যাখ্যা না জেনে ঘাড়ত্যাড়া আঈনউদ্দীনের মতো হাদীস অস্বীকার করলে সুন্নীদের মুখ দুনিয়াতে থাকবে কি? নাকি আখেরাতে প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সামনে দাঁড়াতে পারবে? বস্তুতঃ এভাবেই হাদীসের অপব্যাখ্যা করে থাকে পথভ্রষ্ট ওহাবী/সালাফী গোষ্ঠী। ইমাম নাবহানী (রহ.)-এর বইয়ের আরবী ইবারত - وقيل المراد لا تزوروه في العام مرة فقط بل أكثروا الزيارة له كما مر - شواهد الحق في الاستغاثة بسيد الخلق (ص) - الشيخ يوسف بن اسماعيل النبهاني - الصفحة ١٨٦
ইমাম ইঊসুফ নাবহানী (রহ.)-এর শওয়াহিদুল হক গ্রন্থের পিডিএফ লিঙ্ক: https://archive.org/details/ShawahidUlHaqByImamNabhani
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন