[ইউনেস্কো কর্তৃক প্রকাশিত ইতিহাসবিদ ইবনে জারীর তাবারী’র ৪০ খণ্ডে রচিত ‘তারীখ’ গ্রন্থের ১৮তম খণ্ডের ২২৩-২২৫ পৃষ্ঠায় লিপিবদ্ধ হযরতে খলীফা মুআবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’র অসীয়তনামা; অনলাইন সংস্করণ]
অনুবাদ: এডমিন
৬০ হিজরীর ঘটনাবলী
হযরত মুআবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’র এই অসীয়তটি হিশাম বিন মুহাম্মদ বর্ণনা করেন আবূ মিখনাফ হতে, তিনি আবদুল মালিক বিন নওফল বিন মুসা’হিক্ব বিন আবদীল্লাহ বিন মাখরামাহ হতে এই মর্মে যে, খলীফা মুআবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) যখন অসুস্থতার দরুন জীবন সায়াহ্নে পৌঁছেন, তখন তিনি তাঁর পুত্র এয়াযীদকে তলব করে অসীয়ত করেন:
হে আমার পুত্র, আমি তোমার জন্যে (পথ) সহজসাধ্য করেছি, তোমারই খাতিরে শত্রুদের পরাস্ত করেছি এবং আরবদের গর্দান শাসনাধীন করেছি, আর তোমারই জন্যে ঐক্য গড়েছি। আমি স্রেফ শঙ্কিত এ মর্মে যে, যা কিছু তোমার জন্যে প্রতিষ্ঠা করেছি, চারজন ক্বুরাইশ সেসব বিষয়ে তোমাকে চ্যালেঞ্জ করতে পারেন - এঁরা হলেন (সর্ব-হযরত) হুসাইন ইবনে আলী (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু), আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু), আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়র (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) ও আবদুর রাহমান বিন আবী বকর (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)। (হযরত) আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’র ব্যাপারে বলবো, তিনি একজন অতিশয় পুণ্যবান/ধার্মিক ব্যক্তি; আর কেউ যদি না-ও থাকেন, তবু তিনি তোমাকে স্বীকৃতি দেবেন। হযরত হুসাইন ইবনে আলী (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’র ব্যাপারে বলবো, ইরাক্বের লোকেরা তাঁকে পীড়াপীড়ি করবে, যতোক্ষণ না তিনি তাদের পীড়াপীড়িতে বাধ্য হন বিদ্রোহ করতে। তিনি তোমার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলে তাঁকে তোমার পরাস্ত করা উচিৎ; অতঃপর ক্ষমা করা উচিৎ, কেননা তাঁর রয়েছে ঘনিষ্ঠ আত্মীয়তা এবং এক মহা অধিকার (আমাদের ওপর)। আর ইবনে আবী বকর (রা:) হলেন এমনই এক ব্যক্তি যিনি তাঁর সাথীদের কিছু করতে দেখলে তিনিও ওই একই রকম করেন। তিনি কেবল নারী ও ফুর্তিতে মজে আছেন। কিন্তু যিনি তোমার জন্যে সিংহের মতো ঘাপটি মেরে থাকেন এবং ধূর্ত শেয়ালের মতো তোমাকে ধোকা দেন, আর সুযোগ পেলে যিনি তোমার ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়বেন, তিনি হলেন ইবনে আল-যুবায়র (রা:)। তোমার প্রতি তিনি তা করলে আর তুমি তাঁকে পরাভূত করতে পারলে তাঁর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ টুকরো টুকরো করে ফেলবে।
হিশাম - আওয়ানাহ হতে বর্ণনা করেন: আমরা আরেকটি বিবরণে শুনেছি যে, এই বছর (৬০ হিজরী সালে) হযরত মুআবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) জীবন সায়াহ্নে উপনীত হলে এয়াযীদ অনুপস্থিত ছিলো। হযরত খলীফা (রহ:) পুলিশ-প্রধান দাহহাক বিন ক্বায়স আল-ফিহরী এবং মুসলিম বিন উক্ববাহ আল-মুর্রী’কে তলব করেন এবং তাদেরকে পরামর্শ (উপদেশ) দেন এই বলে:
আমার এ অসীয়তনামা এয়াযীদকে পৌঁছে দেবে: হিজাযের জনগণের প্রতি মনোযোগ দেবে (মানে যত্নবান হবে); কেননা তাঁরা হলেন তোমার শেকড়। তাঁদের যে কেউ তোমার কাছে এলে সম্মান প্রদর্শন কোরো; আর (তাঁদের) অনুপস্থিতদের সেবাযত্ন নেবে। ইরাক্বী জনগণের প্রতি সেবাযত্ন কোরো; আর তারা যদি তাদের কর্মকর্তাদের কাউকে প্রতিদিন-ই বরখাস্ত করতে বলে তাও কোরো। কেননা আমার কাছে একজন প্রাদেশিক শাসনকর্তার অব্যাহতি তোমার বিরুদ্ধে হাজার হাজার কোষমুক্ত তরবারির চেয়েও বেশি কাম্য। সিরিয়ার জনগণের প্রতিও যত্নবান হয়ো, কারণ তাঁরা তোমার সাথী ও তোমারই চামড়ার ঝুলি। তোমার শত্রুদের তরফ থেকে তোমার প্রতি কোনো আঘাত এলে তাদের বিরুদ্ধে বিজয়ী হয়ো। একবার তুমি তাতে সাফল্যমণ্ডিত হলে সিরিয়াবাসীকে তাঁদের ভূমিতে ফিরে যেতে দেবে। কেননা যদি তাঁরা নিজেদের ছাড়া অন্য কোনো ভূমিতে থাকেন, তাহলে তাঁদের আপন বৈশিষ্ট্য ভিন্ন অপরাপর বৈশিষ্ট্য তাঁরা গ্রহণ করবেন। আমি ক্বুরাইশ বংশীয় তিনজনকে ভয় পাই - (সর্ব-হযরত) হুসাইন বিন আলী, আবদুল্লাহ ইবনে উমর ও আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়র (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)। ইবনে উমর (রা:)’এর বেলায় বলবো, তিনি অতিশয় ধার্মিক ব্যক্তি, তাই তিনি তোমার কাছে কিছুই দাবি করবেন না। (ইমাম) হুসাইন বিন আলী (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’র ব্যাপারটি হলো, তিনি একজন তাৎপর্যহীন ব্যক্তি; আর আমি আশা করি, তাঁর পিতাকে যারা হত্যা করেছিলো এবং তাঁর ভাইকে যারা ছেড়ে পালিয়েছিলো (মানে ইরাক্বী গাদ্দার), তাদের সূত্রে আল্লাহতা’লা তোমাকে রক্ষা করবেন। তাঁর (হযরত ইমামের) রয়েছে ঘনিষ্ঠ আত্মীয়তা, এক মহা অধিকার (আমাদের ওপর), আর তিনি রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’এর আত্মীয়। আমি মনে করি না ইরাক্বী লোকেরা তাঁকে পীড়াপীড়ি হতে মুক্তি দেবে - যতোক্ষণ না তিনি বিদ্রোহী হন। তুমি যদি তাঁকে পরাভূত করতে সক্ষম হও, তাহলে তাঁকে ক্ষমা কোরো; কেননা আমি তাঁর ইমাম হলে তাঁকে ক্ষমা করতাম। কিন্তু ইবনে আল-যুবায়র হলেন এক বিষধর সাপ। অতএব, তিনি তোমাকে আক্রমণ করলে তাঁকে সামাল দেবে - যতোক্ষণ না তিনি তোমার সাথে শান্তি স্থাপনের আবেদন করেন। তিনি তা করলে তা গ্রহণ কোরো এবং তোমার মানুষদের রক্তপাত যথাসম্ভব এড়িয়ে চলো।
*সমা্প্ত*
লিঙ্ক: https://archive.org/stream/TabariEnglish/Tabari_Volume_18#page/n221/mode/2up
অনুবাদকের ব্যাখ্যা
ফেইসবুকে অনেকে এই অসীয়তনামার ব্যাপারে সংশয় প্রকাশ করেছেন এ মর্মে যে, এটা সুন্নী না শীয়া লিপি? আসলে এটা একটা ঐতিহাসিক দলিল, যাকে গোষ্ঠীগত দিক থেকে বিচার করা উচিৎ নয়। এতে খলীফা হযরত মুআবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’র আশঙ্কা ব্যক্ত হয়েছে মাত্র। তিনি এতে হযরত ইমাম হুসাইন (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’র বিরুদ্ধে আগ্রাসনমূলক যুদ্ধ করার লাইসেন্স এয়াযীদকে দেননি। তিনি আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন কুফার মোনাফেক্ববর্গ হযরত ইমামকে পীড়াপীড়ি করে যুদ্ধে বাধ্য করতে পারে। ইতিপূর্বে তারা ইমাম হাসান (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’র সাথেও গাদ্দারি করেছিলো; এমন কী ছুরিকাঘাত পর্যন্ত করেছিলো, যার দরুন তিনি হযরত মুআবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’র সাথে শান্তিচুক্তি করেন এবং খেলাফতের ক্ষমতা তাঁর বরাবর সমর্পণ করেন। এই শান্তিচুক্তির শর্তাবলীর ব্যাপারে ইতিহাসবিদদের মধ্যে মতপার্থক্য বিদ্যমান। সবচেয়ে প্রাথমিক যুগের ইতিহাসবিদ আল-এয়াকূবী ও আল-মাসউদী ওই সব শর্তের কোনো উল্লেখই করেননি। অন্যদের বিবরণও পরস্পরবিরোধী। দেখুন লিঙ্কে Treaty শিরোনাম: (ইউকিপেডিয়া https://en.wikipedia.org/wiki/Hasan%E2%80%93Muawiya_treaty)।
অধিকন্তু, ইবনে জারীর তাবারী তাঁর ইতিহাসে লিখেছেন, ইমাম হাসান (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) নিজের লোক (ইরাক্বী)-দের প্রতি তিক্তবিরক্ত হয়ে হযরত মুআবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’র কাছে আনুগত্যের শর্তসমূহ দিয়ে একটি পত্র প্রেরণ করেন এবং বলেন, “এসব শর্ত পূরণ সাপেক্ষে আপনি এটা মঞ্জুর করলে আমি আনুগত্য প্রকাশ করবো।” এই চিঠি হযরত মুআবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’র কাছে পৌঁছোয়। তিনি ইত্যবসরে একটি সাদা কাগজের তলদেশে স্রেফ নিজের সই-সীল দিয়ে হযরত ইমামের (রা:) কাছে পাঠান এই বলে, “আমার সই-সীলকৃত এ কাগজে আপনি যা যা শর্ত বসাতে চান, তা তা লিখুন; সেগুলো মঞ্জুর হবে।” এই চিঠি হযরত ইমাম (রা:) পাওয়ার পর তিনি ইতিপূর্বে যেসব শর্ত দিয়েছিলেন, তার চেয়ে দিগুণ শর্ত তাতে জুড়ে দেন এবং পত্রটি নিজের হেফাযতে রাখেন। ওদিকে, হযরত মুআবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)-ও ইতিপূর্বে হযরত ইমামের (রা:)’এর দেয়া শর্তের পত্রটি নিজের কাছে সংরক্ষণ করেন। অতঃপর যখন এই দু জনের সাক্ষাৎ হয়, ইমাম হাসান (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) তখন সাদা কাগজের তলদেশে সই-সীলকৃত পত্রটিতে লেখা শর্তাবলী পূরণের জন্যে তাকিদ দেন। কিন্তু হযরত মুআবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) তা অস্বীকার করে বলেন, “আমি শুধু আপনার প্রেরিত (ইতিপূর্বেকার) মূল পত্রে প্রদত্ত শর্তগুলোই পূরণ করবো; কেননা আমি আপনার চিঠি পেয়ে ইতোমধ্যেই তা মঞ্জুর করেছি।” ইমাম হাসান (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) উত্তরে বলেন, ”কিন্তু আপনার পত্র পাওয়ার সময় আমার যে আরো শর্ত ছিলো, আর আপনি তা পূরণে রাজি হয়েছিলেন।” যেহেতু তাঁরা এ বিষয়ে বিতর্কে লিপ্ত হন, সেহেতু ইমাম হাসান (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’র কোনো শর্ত-ই পূরণ হয়নি। [https://archive.org/stream/TabariEnglish/Tabari_Volume_18#page/n21/mode/2up]
এই দীর্ঘ বিবরণ দেয়ার কারণ হলো, খেলাফত হস্তান্তরের সময়ে কী কী শর্ত গৃহীত হয়েছিলো তা স্পষ্ট নয়। এর ইতিহাস লেখা হয়েছে মূলতঃ আব্বাসীয় শাসনামলের ইতিহাসবিদদের দ্বারা। অতএব, তাঁরা উমাইয়া আমলকে মন্দ হিসেবে প্রদর্শন করতেই ছিলেন তৎপর। হযরত মুআবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)‘র পরে খেলাফতের দাবি শূরা’র মাধ্যমে মীমাংসা হবার শর্তটি পূরণ করতেই তিনি জ্যেষ্ঠ সাহাবা (রা:)’বৃন্দের মতামত গ্রহণ করেন - [লিঙ্ক: https://kazisaifuddinhossain.blogspot.com/2018/06/blog-post_19.html]। অতঃপর জীবন সায়াহ্নে তিনি এয়াযীদকে এই অসীয়ত করেন।
সর্বোপরি, আমীরে মুআবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’র অসীয়তটি ভালোভাবে অধ্যয়ন করলে দেখা যাবে, তিনি সুশাসনের প্রতি তাকিদ দিয়েছেন। ধৈর্য ধরে নরম পন্থা অবলম্বন করার কথা বলেছেন। কেউ রাষ্ট্রে বিদ্রোহ করলেই কেবল তাঁকে পরাভূত করার প্রশ্ন এসেছে। আর এটা তো একটা বাস্তবতা যে ইরাক্বের কুফাবাসী গাদ্দারগুলো ইমাম হুসাইন (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’কে পীড়াপীড়ি করে দাওয়াত দিয়ে কারবালায় নিয়ে গিয়েছিলো। আমরা অবাক হই যখন দেখি, হযরত মুআবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’র সমালোচকবর্গ কখনোই কুফাবাসীদের ওই বিশ্বাসঘাতকতার প্রতি সেভাবে আলোকপাত করেন না, যেভাবে ইতিহাসের নিরিখে করা উচিৎ। তাঁরা এ ঘটনাকে ধামাচাপা দিতে এবং শুধু এয়াযীদকে দোষারোপ করে তার নিয়োগকর্তা হযরত মুআবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’কে ইতিহাসের খলনায়ক হিসেবে দাঁড় করাতে অপচেষ্টারত। অথচ এখানে দেয়া তাঁর কোনো উপদেশই এয়াযীদ গ্রহণ করেনি বলে ইতিহাসের আলোকে সাব্যস্ত হয়।
[পুনশ্চ: ফেইসবুকে কিছু বিরোধিতাকারী লোক বিরূপ লেখালেখি করায় তাদের উদ্দেশ্যে প্রদত্ত জবাব এখানে সংযুক্ত করা হলো]
ফেইসবুক বন্ধুরা,
আপনারা জানেন, ২ দিন আগে আমি একটি পোস্ট দিয়েছিলাম ইতিহাসবিদ ইবনে জারীর তাবারী’র ‘তারীখ’ (ইতিহাস) পুস্তক থেকে, যার মধ্যে হযরত মুআবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’র ‘অসীয়তনামা’ বঙ্গানুবাদ করা হয়েছিলো। কিন্তু এর প্রতি ফেইসবুকে কিছু ব্যক্তির বিরূপ প্রতিক্রিয়া আমি লক্ষ্য করেছি। তাই এই পোস্টে আমার বক্তব্য তুলে ধরছি।
ইবনে জারীর তাবারী সহস্রাধিক বছর আগের একজন মুসলিম ইতিহাসবিদ। তিনি এই ইতিহাস বইটি লেখার পর তদানীন্তন মুসলিম সমাজে এর বিরুদ্ধে উচ্চবাচ্য হয়েছিলো বলে জানা যায় না। ওই অসীয়তটি ইবনে জাওযী নামে আরেকজন ইতিহাসবিদের বইতেও পাওয়া যায়। কিন্তু তখনকার বিদ্বান সমাজে কেউই এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেননি।
১৯৭১ সালে এহসান এয়ারশাতের নামে এক মধ্যপ্রাচ্যের পণ্ডিত ইতিহাস বইটির ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশের জন্যে ইউনেস্কো’র কাছে আবেদন করেন। ফলশ্রুতিতে বইটির জন্যে একটি বিশাল প্রকল্প ওই বছরই হাতে নেয়া হয় এবং দীর্ঘ সময়শেষে ১৯৮৭ সালে বইটি প্রকাশিত হয়। এর সম্পাদনা বিভাগে ছিলেন জর্দানী আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এহসান আব্বাস, কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এহসান এয়ারশাতের (সাধারণ সম্পাদক) ও সাঈদ আমির আরজুমান্দ (সম্পাদক)-সহ ইয়েইল, ওয়েইন ও ম্যানচেষ্টার (যুক্তরাজ্য) বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকমণ্ডলী। এটা ইরানীদের একক কিছু নয়। ইউনেস্কো সবাইকে জড়িত করেছিলো। এতো বড় একটা প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হলো এবং এতোগুলো বছর (৩২) অতিক্রান্ত হলো, কেউই কি এটা দেখে হৈচৈ বাধালেন না?
আসলে প্রতিবাদ না করার কারণ হলো, ইতিহাস সাবজেক্ট তথা বিষয়টি কখনোই ধর্মতত্ত্ব বা ধর্মীয় বিধান নয়। দুটো আলাদা আলাদা সাবজেক্ট। মুসলিম বিদ্বানদের স্বর্ণযুগে জিনিসটিকে এভাবেই দেখা হতো। আর বিগত এই ৩২ বছরেও এভাবেই দেখা হয়েছে। আফসোস আমাদের দেশের পণ্ডিতদের জন্যে! বড় বড় বিদেশী ডক্টরেট, এমফিল করা ব্যক্তিরা এই সামান্য তাফরীক্ব/পার্থক্য করতেও হয়েছেন ব্যর্থ! ইতিহাসবিদের লেখনী যুগের হাওয়া অনুযায়ী হয়ে থাকে। আব্বাসীয় যুগের ইতিহাসবিদবৃন্দ উমাইয়া শাসনকে মন্দ হিসেবে তুলে ধরেছেন [ইসলামের ইতিহাস সর্বপ্রথম আব্বাসীয় আমল থেকে লেখা আরম্ভ হয়]। আমাদের সময়কেই ধরুন, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি’র মধ্যে স্বাধীনতার ঘোষক নিয়ে কী রকম বিরোধ চলছে! ঠিক তেমনি মুসলিম ইতিহাসবিদদের লেখনীতেও বিরোধ থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু সেটা কখনোই ধর্মীয় বিধান মানে শরীয়তের হুকুম-আহকাম হতে পারে না।
শেষ কথা হলো, আমি একজন অনুবাদক। শুধু ধর্মীয় বইপত্র অনুবাদে সীমাবদ্ধ নই। ইতিহাস, ভ্রমণ ইত্যাদি বিষয়ও আমাকে আকর্ষণ করে। আমার ২ দিন আগের পোস্টে প্রথমেই উল্লেখিত হয়েছিলো সেটা ইতিহাসবিদ ইবনে জারীর তাবারীর ইতিহাসগ্রন্থ থেকে করা অনুবাদ। এটাকে নিয়ে ফেইসবুকে যারা অপপ্রচার চালিয়েছেন, তাদের জ্ঞানের বহর দেখে আমি সত্যি হতভম্ব! হায় বিদ্যা, এভাবে উধাও হয়ে গেলো! সত্যি আফসোস!
অনুবাদ: এডমিন
৬০ হিজরীর ঘটনাবলী
হযরত মুআবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’র এই অসীয়তটি হিশাম বিন মুহাম্মদ বর্ণনা করেন আবূ মিখনাফ হতে, তিনি আবদুল মালিক বিন নওফল বিন মুসা’হিক্ব বিন আবদীল্লাহ বিন মাখরামাহ হতে এই মর্মে যে, খলীফা মুআবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) যখন অসুস্থতার দরুন জীবন সায়াহ্নে পৌঁছেন, তখন তিনি তাঁর পুত্র এয়াযীদকে তলব করে অসীয়ত করেন:
হে আমার পুত্র, আমি তোমার জন্যে (পথ) সহজসাধ্য করেছি, তোমারই খাতিরে শত্রুদের পরাস্ত করেছি এবং আরবদের গর্দান শাসনাধীন করেছি, আর তোমারই জন্যে ঐক্য গড়েছি। আমি স্রেফ শঙ্কিত এ মর্মে যে, যা কিছু তোমার জন্যে প্রতিষ্ঠা করেছি, চারজন ক্বুরাইশ সেসব বিষয়ে তোমাকে চ্যালেঞ্জ করতে পারেন - এঁরা হলেন (সর্ব-হযরত) হুসাইন ইবনে আলী (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু), আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু), আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়র (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) ও আবদুর রাহমান বিন আবী বকর (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)। (হযরত) আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’র ব্যাপারে বলবো, তিনি একজন অতিশয় পুণ্যবান/ধার্মিক ব্যক্তি; আর কেউ যদি না-ও থাকেন, তবু তিনি তোমাকে স্বীকৃতি দেবেন। হযরত হুসাইন ইবনে আলী (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’র ব্যাপারে বলবো, ইরাক্বের লোকেরা তাঁকে পীড়াপীড়ি করবে, যতোক্ষণ না তিনি তাদের পীড়াপীড়িতে বাধ্য হন বিদ্রোহ করতে। তিনি তোমার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলে তাঁকে তোমার পরাস্ত করা উচিৎ; অতঃপর ক্ষমা করা উচিৎ, কেননা তাঁর রয়েছে ঘনিষ্ঠ আত্মীয়তা এবং এক মহা অধিকার (আমাদের ওপর)। আর ইবনে আবী বকর (রা:) হলেন এমনই এক ব্যক্তি যিনি তাঁর সাথীদের কিছু করতে দেখলে তিনিও ওই একই রকম করেন। তিনি কেবল নারী ও ফুর্তিতে মজে আছেন। কিন্তু যিনি তোমার জন্যে সিংহের মতো ঘাপটি মেরে থাকেন এবং ধূর্ত শেয়ালের মতো তোমাকে ধোকা দেন, আর সুযোগ পেলে যিনি তোমার ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়বেন, তিনি হলেন ইবনে আল-যুবায়র (রা:)। তোমার প্রতি তিনি তা করলে আর তুমি তাঁকে পরাভূত করতে পারলে তাঁর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ টুকরো টুকরো করে ফেলবে।
হিশাম - আওয়ানাহ হতে বর্ণনা করেন: আমরা আরেকটি বিবরণে শুনেছি যে, এই বছর (৬০ হিজরী সালে) হযরত মুআবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) জীবন সায়াহ্নে উপনীত হলে এয়াযীদ অনুপস্থিত ছিলো। হযরত খলীফা (রহ:) পুলিশ-প্রধান দাহহাক বিন ক্বায়স আল-ফিহরী এবং মুসলিম বিন উক্ববাহ আল-মুর্রী’কে তলব করেন এবং তাদেরকে পরামর্শ (উপদেশ) দেন এই বলে:
আমার এ অসীয়তনামা এয়াযীদকে পৌঁছে দেবে: হিজাযের জনগণের প্রতি মনোযোগ দেবে (মানে যত্নবান হবে); কেননা তাঁরা হলেন তোমার শেকড়। তাঁদের যে কেউ তোমার কাছে এলে সম্মান প্রদর্শন কোরো; আর (তাঁদের) অনুপস্থিতদের সেবাযত্ন নেবে। ইরাক্বী জনগণের প্রতি সেবাযত্ন কোরো; আর তারা যদি তাদের কর্মকর্তাদের কাউকে প্রতিদিন-ই বরখাস্ত করতে বলে তাও কোরো। কেননা আমার কাছে একজন প্রাদেশিক শাসনকর্তার অব্যাহতি তোমার বিরুদ্ধে হাজার হাজার কোষমুক্ত তরবারির চেয়েও বেশি কাম্য। সিরিয়ার জনগণের প্রতিও যত্নবান হয়ো, কারণ তাঁরা তোমার সাথী ও তোমারই চামড়ার ঝুলি। তোমার শত্রুদের তরফ থেকে তোমার প্রতি কোনো আঘাত এলে তাদের বিরুদ্ধে বিজয়ী হয়ো। একবার তুমি তাতে সাফল্যমণ্ডিত হলে সিরিয়াবাসীকে তাঁদের ভূমিতে ফিরে যেতে দেবে। কেননা যদি তাঁরা নিজেদের ছাড়া অন্য কোনো ভূমিতে থাকেন, তাহলে তাঁদের আপন বৈশিষ্ট্য ভিন্ন অপরাপর বৈশিষ্ট্য তাঁরা গ্রহণ করবেন। আমি ক্বুরাইশ বংশীয় তিনজনকে ভয় পাই - (সর্ব-হযরত) হুসাইন বিন আলী, আবদুল্লাহ ইবনে উমর ও আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়র (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)। ইবনে উমর (রা:)’এর বেলায় বলবো, তিনি অতিশয় ধার্মিক ব্যক্তি, তাই তিনি তোমার কাছে কিছুই দাবি করবেন না। (ইমাম) হুসাইন বিন আলী (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’র ব্যাপারটি হলো, তিনি একজন তাৎপর্যহীন ব্যক্তি; আর আমি আশা করি, তাঁর পিতাকে যারা হত্যা করেছিলো এবং তাঁর ভাইকে যারা ছেড়ে পালিয়েছিলো (মানে ইরাক্বী গাদ্দার), তাদের সূত্রে আল্লাহতা’লা তোমাকে রক্ষা করবেন। তাঁর (হযরত ইমামের) রয়েছে ঘনিষ্ঠ আত্মীয়তা, এক মহা অধিকার (আমাদের ওপর), আর তিনি রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)’এর আত্মীয়। আমি মনে করি না ইরাক্বী লোকেরা তাঁকে পীড়াপীড়ি হতে মুক্তি দেবে - যতোক্ষণ না তিনি বিদ্রোহী হন। তুমি যদি তাঁকে পরাভূত করতে সক্ষম হও, তাহলে তাঁকে ক্ষমা কোরো; কেননা আমি তাঁর ইমাম হলে তাঁকে ক্ষমা করতাম। কিন্তু ইবনে আল-যুবায়র হলেন এক বিষধর সাপ। অতএব, তিনি তোমাকে আক্রমণ করলে তাঁকে সামাল দেবে - যতোক্ষণ না তিনি তোমার সাথে শান্তি স্থাপনের আবেদন করেন। তিনি তা করলে তা গ্রহণ কোরো এবং তোমার মানুষদের রক্তপাত যথাসম্ভব এড়িয়ে চলো।
*সমা্প্ত*
লিঙ্ক: https://archive.org/stream/TabariEnglish/Tabari_Volume_18#page/n221/mode/2up
অনুবাদকের ব্যাখ্যা
ফেইসবুকে অনেকে এই অসীয়তনামার ব্যাপারে সংশয় প্রকাশ করেছেন এ মর্মে যে, এটা সুন্নী না শীয়া লিপি? আসলে এটা একটা ঐতিহাসিক দলিল, যাকে গোষ্ঠীগত দিক থেকে বিচার করা উচিৎ নয়। এতে খলীফা হযরত মুআবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’র আশঙ্কা ব্যক্ত হয়েছে মাত্র। তিনি এতে হযরত ইমাম হুসাইন (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’র বিরুদ্ধে আগ্রাসনমূলক যুদ্ধ করার লাইসেন্স এয়াযীদকে দেননি। তিনি আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন কুফার মোনাফেক্ববর্গ হযরত ইমামকে পীড়াপীড়ি করে যুদ্ধে বাধ্য করতে পারে। ইতিপূর্বে তারা ইমাম হাসান (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’র সাথেও গাদ্দারি করেছিলো; এমন কী ছুরিকাঘাত পর্যন্ত করেছিলো, যার দরুন তিনি হযরত মুআবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’র সাথে শান্তিচুক্তি করেন এবং খেলাফতের ক্ষমতা তাঁর বরাবর সমর্পণ করেন। এই শান্তিচুক্তির শর্তাবলীর ব্যাপারে ইতিহাসবিদদের মধ্যে মতপার্থক্য বিদ্যমান। সবচেয়ে প্রাথমিক যুগের ইতিহাসবিদ আল-এয়াকূবী ও আল-মাসউদী ওই সব শর্তের কোনো উল্লেখই করেননি। অন্যদের বিবরণও পরস্পরবিরোধী। দেখুন লিঙ্কে Treaty শিরোনাম: (ইউকিপেডিয়া https://en.wikipedia.org/wiki/Hasan%E2%80%93Muawiya_treaty)।
অধিকন্তু, ইবনে জারীর তাবারী তাঁর ইতিহাসে লিখেছেন, ইমাম হাসান (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) নিজের লোক (ইরাক্বী)-দের প্রতি তিক্তবিরক্ত হয়ে হযরত মুআবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’র কাছে আনুগত্যের শর্তসমূহ দিয়ে একটি পত্র প্রেরণ করেন এবং বলেন, “এসব শর্ত পূরণ সাপেক্ষে আপনি এটা মঞ্জুর করলে আমি আনুগত্য প্রকাশ করবো।” এই চিঠি হযরত মুআবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’র কাছে পৌঁছোয়। তিনি ইত্যবসরে একটি সাদা কাগজের তলদেশে স্রেফ নিজের সই-সীল দিয়ে হযরত ইমামের (রা:) কাছে পাঠান এই বলে, “আমার সই-সীলকৃত এ কাগজে আপনি যা যা শর্ত বসাতে চান, তা তা লিখুন; সেগুলো মঞ্জুর হবে।” এই চিঠি হযরত ইমাম (রা:) পাওয়ার পর তিনি ইতিপূর্বে যেসব শর্ত দিয়েছিলেন, তার চেয়ে দিগুণ শর্ত তাতে জুড়ে দেন এবং পত্রটি নিজের হেফাযতে রাখেন। ওদিকে, হযরত মুআবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)-ও ইতিপূর্বে হযরত ইমামের (রা:)’এর দেয়া শর্তের পত্রটি নিজের কাছে সংরক্ষণ করেন। অতঃপর যখন এই দু জনের সাক্ষাৎ হয়, ইমাম হাসান (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) তখন সাদা কাগজের তলদেশে সই-সীলকৃত পত্রটিতে লেখা শর্তাবলী পূরণের জন্যে তাকিদ দেন। কিন্তু হযরত মুআবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) তা অস্বীকার করে বলেন, “আমি শুধু আপনার প্রেরিত (ইতিপূর্বেকার) মূল পত্রে প্রদত্ত শর্তগুলোই পূরণ করবো; কেননা আমি আপনার চিঠি পেয়ে ইতোমধ্যেই তা মঞ্জুর করেছি।” ইমাম হাসান (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) উত্তরে বলেন, ”কিন্তু আপনার পত্র পাওয়ার সময় আমার যে আরো শর্ত ছিলো, আর আপনি তা পূরণে রাজি হয়েছিলেন।” যেহেতু তাঁরা এ বিষয়ে বিতর্কে লিপ্ত হন, সেহেতু ইমাম হাসান (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’র কোনো শর্ত-ই পূরণ হয়নি। [https://archive.org/stream/TabariEnglish/Tabari_Volume_18#page/n21/mode/2up]
এই দীর্ঘ বিবরণ দেয়ার কারণ হলো, খেলাফত হস্তান্তরের সময়ে কী কী শর্ত গৃহীত হয়েছিলো তা স্পষ্ট নয়। এর ইতিহাস লেখা হয়েছে মূলতঃ আব্বাসীয় শাসনামলের ইতিহাসবিদদের দ্বারা। অতএব, তাঁরা উমাইয়া আমলকে মন্দ হিসেবে প্রদর্শন করতেই ছিলেন তৎপর। হযরত মুআবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)‘র পরে খেলাফতের দাবি শূরা’র মাধ্যমে মীমাংসা হবার শর্তটি পূরণ করতেই তিনি জ্যেষ্ঠ সাহাবা (রা:)’বৃন্দের মতামত গ্রহণ করেন - [লিঙ্ক: https://kazisaifuddinhossain.blogspot.com/2018/06/blog-post_19.html]। অতঃপর জীবন সায়াহ্নে তিনি এয়াযীদকে এই অসীয়ত করেন।
সর্বোপরি, আমীরে মুআবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’র অসীয়তটি ভালোভাবে অধ্যয়ন করলে দেখা যাবে, তিনি সুশাসনের প্রতি তাকিদ দিয়েছেন। ধৈর্য ধরে নরম পন্থা অবলম্বন করার কথা বলেছেন। কেউ রাষ্ট্রে বিদ্রোহ করলেই কেবল তাঁকে পরাভূত করার প্রশ্ন এসেছে। আর এটা তো একটা বাস্তবতা যে ইরাক্বের কুফাবাসী গাদ্দারগুলো ইমাম হুসাইন (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’কে পীড়াপীড়ি করে দাওয়াত দিয়ে কারবালায় নিয়ে গিয়েছিলো। আমরা অবাক হই যখন দেখি, হযরত মুআবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’র সমালোচকবর্গ কখনোই কুফাবাসীদের ওই বিশ্বাসঘাতকতার প্রতি সেভাবে আলোকপাত করেন না, যেভাবে ইতিহাসের নিরিখে করা উচিৎ। তাঁরা এ ঘটনাকে ধামাচাপা দিতে এবং শুধু এয়াযীদকে দোষারোপ করে তার নিয়োগকর্তা হযরত মুআবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’কে ইতিহাসের খলনায়ক হিসেবে দাঁড় করাতে অপচেষ্টারত। অথচ এখানে দেয়া তাঁর কোনো উপদেশই এয়াযীদ গ্রহণ করেনি বলে ইতিহাসের আলোকে সাব্যস্ত হয়।
[পুনশ্চ: ফেইসবুকে কিছু বিরোধিতাকারী লোক বিরূপ লেখালেখি করায় তাদের উদ্দেশ্যে প্রদত্ত জবাব এখানে সংযুক্ত করা হলো]
ফেইসবুক বন্ধুরা,
আপনারা জানেন, ২ দিন আগে আমি একটি পোস্ট দিয়েছিলাম ইতিহাসবিদ ইবনে জারীর তাবারী’র ‘তারীখ’ (ইতিহাস) পুস্তক থেকে, যার মধ্যে হযরত মুআবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’র ‘অসীয়তনামা’ বঙ্গানুবাদ করা হয়েছিলো। কিন্তু এর প্রতি ফেইসবুকে কিছু ব্যক্তির বিরূপ প্রতিক্রিয়া আমি লক্ষ্য করেছি। তাই এই পোস্টে আমার বক্তব্য তুলে ধরছি।
ইবনে জারীর তাবারী সহস্রাধিক বছর আগের একজন মুসলিম ইতিহাসবিদ। তিনি এই ইতিহাস বইটি লেখার পর তদানীন্তন মুসলিম সমাজে এর বিরুদ্ধে উচ্চবাচ্য হয়েছিলো বলে জানা যায় না। ওই অসীয়তটি ইবনে জাওযী নামে আরেকজন ইতিহাসবিদের বইতেও পাওয়া যায়। কিন্তু তখনকার বিদ্বান সমাজে কেউই এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেননি।
১৯৭১ সালে এহসান এয়ারশাতের নামে এক মধ্যপ্রাচ্যের পণ্ডিত ইতিহাস বইটির ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশের জন্যে ইউনেস্কো’র কাছে আবেদন করেন। ফলশ্রুতিতে বইটির জন্যে একটি বিশাল প্রকল্প ওই বছরই হাতে নেয়া হয় এবং দীর্ঘ সময়শেষে ১৯৮৭ সালে বইটি প্রকাশিত হয়। এর সম্পাদনা বিভাগে ছিলেন জর্দানী আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এহসান আব্বাস, কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এহসান এয়ারশাতের (সাধারণ সম্পাদক) ও সাঈদ আমির আরজুমান্দ (সম্পাদক)-সহ ইয়েইল, ওয়েইন ও ম্যানচেষ্টার (যুক্তরাজ্য) বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকমণ্ডলী। এটা ইরানীদের একক কিছু নয়। ইউনেস্কো সবাইকে জড়িত করেছিলো। এতো বড় একটা প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হলো এবং এতোগুলো বছর (৩২) অতিক্রান্ত হলো, কেউই কি এটা দেখে হৈচৈ বাধালেন না?
আসলে প্রতিবাদ না করার কারণ হলো, ইতিহাস সাবজেক্ট তথা বিষয়টি কখনোই ধর্মতত্ত্ব বা ধর্মীয় বিধান নয়। দুটো আলাদা আলাদা সাবজেক্ট। মুসলিম বিদ্বানদের স্বর্ণযুগে জিনিসটিকে এভাবেই দেখা হতো। আর বিগত এই ৩২ বছরেও এভাবেই দেখা হয়েছে। আফসোস আমাদের দেশের পণ্ডিতদের জন্যে! বড় বড় বিদেশী ডক্টরেট, এমফিল করা ব্যক্তিরা এই সামান্য তাফরীক্ব/পার্থক্য করতেও হয়েছেন ব্যর্থ! ইতিহাসবিদের লেখনী যুগের হাওয়া অনুযায়ী হয়ে থাকে। আব্বাসীয় যুগের ইতিহাসবিদবৃন্দ উমাইয়া শাসনকে মন্দ হিসেবে তুলে ধরেছেন [ইসলামের ইতিহাস সর্বপ্রথম আব্বাসীয় আমল থেকে লেখা আরম্ভ হয়]। আমাদের সময়কেই ধরুন, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি’র মধ্যে স্বাধীনতার ঘোষক নিয়ে কী রকম বিরোধ চলছে! ঠিক তেমনি মুসলিম ইতিহাসবিদদের লেখনীতেও বিরোধ থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু সেটা কখনোই ধর্মীয় বিধান মানে শরীয়তের হুকুম-আহকাম হতে পারে না।
শেষ কথা হলো, আমি একজন অনুবাদক। শুধু ধর্মীয় বইপত্র অনুবাদে সীমাবদ্ধ নই। ইতিহাস, ভ্রমণ ইত্যাদি বিষয়ও আমাকে আকর্ষণ করে। আমার ২ দিন আগের পোস্টে প্রথমেই উল্লেখিত হয়েছিলো সেটা ইতিহাসবিদ ইবনে জারীর তাবারীর ইতিহাসগ্রন্থ থেকে করা অনুবাদ। এটাকে নিয়ে ফেইসবুকে যারা অপপ্রচার চালিয়েছেন, তাদের জ্ঞানের বহর দেখে আমি সত্যি হতভম্ব! হায় বিদ্যা, এভাবে উধাও হয়ে গেলো! সত্যি আফসোস!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন