ব্লগ সংরক্ষাণাগার

বৃহস্পতিবার, ১১ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

হাদীসের দৃষ্টিতে রাসূল (দ:)-এর কৃপা/অসীলা



-- ওয়াহিদ মনজু 

হাদিস নং - ১

হযরত আবু হুরায়রা (রা:) একবার আরয করেন, "ইয়া রাসূলাল্লাহ (দরুদ), আমি আপনার কাছ থেকে অসংখ্য হাদীস শুনি, কিন্তু তা ভুলে যাই; মনে রাখতে পারিনা। আমি কামনা করি আপনার পবিত্র মুখনিঃসৃত বাণী যেন আর কখনোই না ভুলি।” তখন হুজূর (দ:) বললেন, "তোমার চাদর বিছিয়ে দাও।” অতঃপর হযরত আবু হুরায়রা (রা:) তা বিছিয়ে দিলেন। তখন আকা (দ:) তাঁর হাত মুবারকে শূন্য থেকে কী যেন ওই চাদরের মধ্যে রাখেন, অতঃপর বলেন, "চাদর ভাঁজ করে ফেলো।” তিনি তা ভাঁজ করে নিলেন। হযরত আবু হুরায়রা (রা:) বলেন, ”এরপর আর কোনো দিন কিছু ভুলিনি।” [অধ্যায়: কিতাবুল ইলম, বোখারী শরীফ]

সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ

এখানে হযরত আবু হুরায়রা (রা:)-এর মতো প্রসিদ্ধ সাহাবী, যিনি অধিক হাদিস রেওয়ায়েতকারী এবং আহলে সুফফার একজন আল্লাহ-পাগল রাসূল-প্রেমিক, তিনিও হুজুর নবী করীম (দ:) থেকে ভুলে যাওয়ার ব্যাপারে পরিত্রাণ চাচ্ছেন। তাঁর চাওয়াতে হুজুর পাক (ধ:)-এর কোনো অভিযোগ ছিলনা, মুশরিক-ও আখ্যা দেননি।

হাদিস নং - ২

হযরত উসমান ইবনে হানীফ (রা:) থেকে বর্ণিত আছে, এক অন্ধ ব্যক্তি হুযুর (আলাইহিস সালাম)-এর মহান দরবারে উপস্থিত হয়ে অন্ধত্ব দূর হবার জন্যে তাঁর দোয়াপ্রার্থী হয়েছিলেন। হুযুর (আলাইহিস সালাম) তাঁকে শিখিয়ে দিলেন এ দু’আটি: 

اَلَّهُمَّاِنِّىْ اَسْئَلُك
َ وَاَتَوَ جَّهُ اِلَيْكَ بِمُحَمَّدٍ نَّبِىِّ الرَّحْمَةِ يَا مُحَمَّدُ اِنِّىْ قَدْتَوَجَّهْتُ بِكَ اِلَى رَبِّىْ فِيْ حَاجَتِىْ هذِه لِتَقْضِىَ اَللَّهُمَّ فَشَفِّعْهُ فِىَّ قَالُ اَبُوْا اِسْحقَ هذَا حَدِيْثٌ صَحِيْحٌ

[হে আল্লাহ, আমি অাপনার কাছে সাহায্য প্রার্থনা করছি রহমতের নবী মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) মারফত; আপনার দিকে মনোনিবেশ করছি। হে মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়ামাল্লাম), আমি আপনার মাধ্যমে আপন প্রতিপালকের দিকে আমার এ উদ্দেশ্য (অন্ধত্ব মোচন) পূরণ করার উদ্দেশ্যে মনোনিবেশ করলাম, যাতে আপনি আমার এ উদ্দেশ্য পূরণ করে দেন। হে আল্লাহ, আমার অনুকূলে হুযুর (আলাইহিস সালাম)-এর সুপারিশ কবুল করুন।]

[রেফারেন্স: ইবনে মাজা শরীফের সালাতুল ‘হাজত’ শীর্ষক অধ্যায়]

এ হাদীসটির বিশুদ্ধতা প্রসঙ্গে হযরত আবু ইসহাক (রহ:) বলেন, এ হাদীসটি বিশুদ্ধ (সহীহ)।

লক্ষ করুন,  দু’আটি কিয়ামত পর্যন্ত ধরাপৃষ্ঠে আগমনকারী মুসলমানদের জন্যে শিক্ষার বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়। এখানে হুযুর (আলাইহিস সালাম)-কে আহবান করা হয়েছে এবং তাঁর সাহায্য ও প্রার্থনা করা হয়েছে। এখানে দুটো শব্দ সুষ্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে, "বি মুহাম্মাদিন" ও "বিকা"; এই শব্দ দুটো সুষ্পষ্টভাবেই রাসূল (দ:)-এর অসীলা উল্লেখ করে। তাতে কন্টেক্সট্ ও কনটেক্সট্ দিয়ে ভুল ব্যাখ্যার সুযোগ নেই।

শিক্ষা 

আল্লাহর কাছে অনুগ্রহপ্রাপ্ত ও সম্মানিত কোনো পুণ্যাত্মার অসীলায় কোনো কিছু চাওয়ার ক্ষেত্রে অন্তর্নিহিত আকীদা থাকে, "তিনি যেহেতু আল্লাহর দরবারে সম্মানিত ও অনুগ্রহপ্রাপ্ত, তাই আল্লাহ-প্রদত্ত ক্ষমতাবলে তিনি সাহায্য-সহযোগিতা করতে সক্ষম, বিপদ থেকে উদ্ধার করতেও সমর্থ।" এতে শিরকের গন্ধ যারা খুঁজে, তাদের জ্ঞানের ব্যাপারে আমি সন্দিহান। অস্পষ্ট আয়াত ও যে আয়াত মূর্তিদের ব্যাপারে নাজিল হয়েছে, তার হুকুম নবী (আ:) ও ওলী (রহ:)-দের প্রতি আরোপ করে আমাদের মুসলিম ভাইদের বিভ্রান্ত করা হচ্ছে। মনে খুব-ই কষ্ট হয়।
 

আমার কিছু ভাইয়ের আপত্তি থাকতে পারে: হুজূর (দ:)-এর বেসালের পর চাওয়া শিরক। তাদের বলছি, প্রতি খলিফার আমলে অনেক রেওয়ায়াতে এই আচার প্রমাণিত, যা অতি বিশুদ্ধ। অনেক হাদীস থেকে মাত্র একখানি এখানে পেশ করা হলো:

اصاب الناس قحط في زمان عمرفجاء رجل الئ قبرالنبئ صلي الله عليه وسلم فقال يا رسول الله استسف لامتك فانهم قد هلكوا فاتي الرجل فى المنام فقيل له اءت عمر فاقرأه السلام واخبره انكم مستقيمون

আল মুসান্নাফ, খণ্ড - ১২, নং ১২০৫১
ফাতহুল বারী, শরহে বোখারী, খণ্ড - ২, পৃষ্ঠা - ৪১২, ৪৯৫

উমার (রা:)-এর জমানায় অনাবৃষ্টিতে মুসলমানবৃন্দ আক্রান্ত হলে এক ব্যক্তি (বিলাল বিন হারিস) নবী (দ:)-এর রওযা শরীফে এসে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ (দ:)! আপনি বৃষ্টির জন্যে দোয়া করুন, আপনার উম্মত ধ্বংসপ্রায়। অতঃপর ওই সাহাবী (রা:)-কে স্বপ্নে মহানবী (দ:) জানান, উমর (রা:)-এর কাছে যাও, সালাম জানাও, অতঃপর তাঁকে এই খবর দাও যে নিশ্চয় তোমাদের বৃষ্টি দেয়া হবে।

এই হাদিসটির শুদ্ধতা সম্পর্কে ইমাম ইবনে আবি শাইবা ও আল্লামা ইবনে হাজার আস্কালানি (রা:) বলেন, হাদীসটি সনদে বিশুদ্ধ।

নুক্তা: দেখুন, এখানে কয়েকটি বৈধ বিষয় উল্লেখ্য।

→হুজুর (দ:)-এর বেসালের পর হযরত বিলাল বিন হারিস (রা:)-এর দ্বারা তাঁর রওযায় যাওয়া।
→ইয়া রাসূলাল্লাহ বলে ডাকা।
→সমস্যা সমাধানের ইঙ্গিত পাওয়া হুজুরে পাক (দ:) থেকে।

উপরেল্লেখিত হাদীসসমূহ সুরা আল মায়িদার ৩৫ নং আয়াতের সুষ্পষ্ট ব্যাখ্যা, যাতে ইরশাদ হয়েছে: 


يا ايها الذين امنوا اتقواالله وابتغوا اليه الوسيلة


হে মুমিনগণ, তোমরা খোদা-ভীরুতা অবলম্বন করো এবং আল্লাহর প্রতি (নৈকট্যের জন্যে) অসীলা তালাশ করো (গহণ করো)।

বি:দ্র: এই বিষয়ে এতো সুষ্পষ্ট দলীলসমূহ আছে যে তা কল্পনাতীত। এটি অনেক আলোচনা সাপেক্ষ। আগামীতে ওয়াসীলা ও ইস্তিগাসা নিয়ে কোরান ও সহীহ হাদীসের আলোকে লেখার আশা রইলো, যা’তে ইমাম বোখারী (রহ:)-এর কিতাবের একটি অধ্যায়, বাবু মান ইস্তায়ানা বিদুয়াফায়ে ও সালিহীন (দুর্বল ও ওলী থেকে সাহায্য প্রার্থনা অধ্যায়) অন্তর্ভুক্ত থাকবে, ইনশাআল্লাহ।

পরিশেষে আবেদন করছি, জিয়ারাত ও অসীলা কেউ মানতে না চাইলে মানবেন না। এটাকে ফিকহি মতানৈক্যের মাসয়ালা হিসেবে নিয়ে আপন পথ অনুসরণ যে কেউ করতে পানে। কিন্তু ফাতোয়াবাজী করে মুসলিম মিল্লাতকে বিভাজন করার অধিকার কারো নেই। একটি আশা জাগানো কথা বলে শেষ করছি, সম্প্রতি হেফাজাত নেতৃবৃন্দের পক্ষ থেকে হুজূর পাক (দ:)-এর রওযা মোবারক অন্যত্র সরানোর প্রতিবাদে
পত্রিকায় প্রদত্ত এক ঘোষণায় বলা হয়, ”আমাদের নবী (দ:) হায়াতুন্নবী, জিন্দা নবী (দরুদ)।” এটি প্রমাণের জন্যে আলেমবৃন্দ সারা জীবন কোরআন-হাদীস দিয়ে বুঝিয়েছেন আমাদের। এখন সবাই ঐকমত্য পোষণ করছেন। আল-হামদু লিল্লাহ! ইনশাআল্লাহ অদূর ভবিষ্যতে আরো অনেক বিষয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়ে এক উম্মায় আমরা পরিণত হবো এবং এই বাণীর اعتصموا بحبل الله جميعا প্রতিফলন ঘটবে।

ইনশাআল্লাহ, জাযাকাল্লাহ, সাল্লু আলাল হাবিব।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন