ব্লগ সংরক্ষাণাগার

মঙ্গলবার, ২৬ এপ্রিল, ২০১৬

চার মাযহাব অমান্যকারীদের খণ্ডন

الرد على من اتبع غير المذاهب الأربعة

মূল: ইমাম ইবনে রাজাব হাম্বলী
অনুবাদ: কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন

[Bengali translation of Ibn Rajab's booklet  "Refutation of those who do not follow the four schools" (English translation by Musa Furber, Abu Dhabi)]

উৎসর্গ: পীর ও মোর্শেদ হযরতুল আল্লামা শাহ সূফী সৈয়দ এ, জেড, এম, সেহাবউদ্দীন খালেদ আল-কাদেরী আল-চিশ্তী (রহ:)-এর পুণ্যস্মৃতিতে - বঙ্গানুবাদক

সূচিপত্র

১/ অনুবাদক মূসা ফার্বারের মুখবন্ধ
২/ ইবনে রাজাবের খণ্ডন
৩/ সংক্ষিপ্ত জীবনী
৪/ অনুবাদক পরিচিতি

অনুবাদক মূসা ফার্বারের মুখবন্ধ


বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম

বিগত ২০০১ হতে ২০০৪ সাল পর্যন্ত আমি বেশ কিছু ফলদায়ক অনুবাদকর্ম সম্পন্ন করেছিলাম। ওই সময় আমি অনুবাদ করি ইমাম নববী (রহ:)-এর রচিত আল-কুরআনের আদববিষয়ক গ্রন্থ, আবূ শুজা’র প্রণীত ’চূড়ান্ত সারসংক্ষেপ’ শিরোনামের পুস্তক, ইমাম জুওয়াইনী কৃত ‘আল-ওয়ারাকাত’ বইটি যার সাথে যুক্ত ছিল আল-মাহাল্লী’র ব্যাখ্যামূলক গ্রন্থ, আল-বুহূতী’র ’যাদ আল-মুস্তাক্কনী’ এবং অন্যান্য বইপত্র, যা’তে অন্তর্ভুক্ত ছিল ইমাম ইবনে রাজাব হাম্বলীর রচিত ‘আল-রাদ্দ আ’লা মান ইত্তাবা’ গায়র আল-মাযাহিব আল-আরবা’আ’ (চার মযহাব অমান্যকারীদের খণ্ডন) শিরোনামের পুস্তিকা।


লেখক পরিচিতি

ইবনে রাজাবের মূল নাম আবূ আল-ফারাজ আবদ্ আর-রাহমান ইবনে আহমদ। তিনি হাম্বলী মযহাবের ফকীহ ও হাদীসশাস্ত্র বিশারদ। হিজরী ৭৩৬ মোতাবেক ১৩৩৫ খৃষ্টাব্দে বাগদাদ নগরীতে জন্মগ্রহণ করে পাঁচ বছর বয়সেই তিনি দামেশকে এবং তারপর জেরুসালেমে গমন করেন। তিনি সেখানে এবং মক্কা মোয়াযযমা ও মিসরে পড়ালেখা করেন। অবশেষে তিনি দামেশকে প্রত্যাবর্তন করেন, যেখানে তিনি তাঁর ছাত্রদের পাঠদান করতেন। তাঁর শায়েখদের মধ্যে রয়েছেন ইমাম আস্ সুবকী (রহ:), আল-ইরাকী ও ইবনে কাইয়্যেম আল-জাওযিয়্যা। হাদীসশাস্ত্রে অবদানের ক্ষেত্রে তিনি সবচেয়ে বেশি প্রসিদ্ধ, বিশেষ করে ইমাম নববী (রহ:)-এর ‘হাদীসে আরবাঈন’ গ্রন্থের শরাহ (ব্যাখ্যামূলক পুস্তক) লেখার জন্যে। ‘ফাতহুল বারী’ শিরোনামে সহীহ বুখারীর ব্যাখ্যামূলক গ্রন্থ লেখা আরম্ভ করলেও তিনি তা শেষ করে যেতে পারেননি। ইবনে রাজাবের সম্মানে ইমাম ইবনে হাজর (রহ:) তাঁর নিজস্ব শরাহকে ওই শিরোনামে উৎসর্গ করেন। হাম্বলী মযহাব অনুযায়ী বের করা নিয়ম-কানুন হতে ফেকাহ-শাস্ত্রীয় বিদ্যায় তাঁর পাণ্ডিত্য দৃশ্যমান হয়।

ইবনে রাজাব হিজরী ৭৯৫ মোতাবেক ১৩৯৩ খৃষ্টাব্দে ইন্তেকাল করেন। আল্লাহ পাক তাঁর প্রতি আপন করুণা বর্ষণ করুন।

পুস্তিকা পরিচিতি

ইবনে রাজাবের ‘চার মযহাব অমান্যকারীদের খণ্ডন’ পুস্তিকাটি ইসলামী উলামা-এ-কেরাম, বিশেষ করে মুজতাহিদ ইমামবৃন্দের অনুসরণের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তার প্রতি তাকিদ দেয়। এর প্রথমাংশ ইসলামী ইতিহাসে এজতেহাদের ক্রমবিবর্তন এবং মুসলমান সমাজ কীভাবে মুজতাহিদবৃন্দকে ইসলামী জ্ঞানের কর্তৃত্ব হিসেবে স্বীকৃতি দেন, সে বিষয় নিয়ে ব্যাপৃত। দ্বিতীয়াংশটিতে শিক্ষার্থীদের, বিশেষ করে হাম্বলী মযহাবের অনুসারী শিক্ষার্থীদের প্রতি ধর্মীয় জ্ঞান সম্পর্কে উপদেশ বিধৃত।

এই পুস্তিকার পাঠকবৃন্দ লক্ষ্য করবেন যে ইবনে রাজাব ওইসব লোকদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য রেখেছেন, যারা কোনো বিশেষ মযহাবের অনুসারী বলে দাবি করে, কিন্তু নিজেদেরকে পূর্ববর্তী উলামাদের প্রজন্মগুলোর সমকক্ষ বা তার চেয়েও শ্রেষ্ঠ মনে করে, আর প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও দক্ষতার অধিকারী না হওয়া সত্ত্বেও পূর্ববর্তীদের সিদ্ধান্তগুলোকে ছুঁড়ে ফেলে। যদিও এই পুস্তিকা ৭০০ বছর আগেকার, তবু এটা আজকের একবিংশ খৃষ্টাব্দের ধর্ম সংস্কারকদের কথা মাথায় রেখেই যেন রচিত হয়েছে।

এতে অনেক সাহাবী, তাঁদের উত্তরসূরী ও নেককার পূর্ববর্তী হক্কানী উলামার নাম উল্লেখিত হয়েছে (এঁদের সবার প্রতি আল্লাহর করুণা বর্ষিত হোক)। এঁদের সংক্ষিপ্ত পরিচিতিও সংযোজনীতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

এই অনুবাদ অসংখ্যবার সংস্কৃত ও রূপান্তরিত হয়েছে। আমি যখন এটা অনুবাদ করি, তখন অনভিজ্ঞ ছিলাম, যা স্পষ্ট প্রতীয়মান। আমি আজকে যা করে থাকি, সে অনুযায়ী মূলের কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করেছি। একটি দিক ঘাটতি থেকে গিয়েছে, যেমন আল-কুরআনের তেলাওয়াত-সংক্রান্ত অক্ষর-পদ্ধতি ও পঠন-রীতি (যথাক্রমে হুরূফ কেরআত)। ইনশা’আল্লাহ এগুলো কুরআন মজীদ-বিষয়ক জ্ঞানের ওপর প্রকাশিতব্য একখানা গ্রন্থে আরো ভালোভাবে ব্যাখ্যা করা হবে।

আল্লাহতা’লা ইবনে রাজাবকে পুরস্কৃত করুন। এই পুস্তিকার পাঠকদের প্রতিও তিনি তাঁর করুণা বর্ষণ করুন, আর এর থেকে ফায়দা লাভকারীদের মধ্যে আমাদেরকে অন্তর্ভুক্ত করুন। আমি যেখানে সফল হয়েছি, তা একমাত্র আল্লাহ পাকের অনুগ্রহেই; আর যেখানে ব্যর্থ হয়েছি, তা আমার নিজস্ব ঘাটতির কারণেই।

মূসা ফার্বার
আবূধাবি
জুন ৩০, ২০১৫ খৃষ্টাব্দ।

ইমাম ইবনে রাজাব কর্তৃক চার মাযহাব অমান্যকারীদের খণ্ডন  

মহান আল্লাহ পাকের নামে আরম্ভ, যিনি করুণাশীল ও দয়াবান। তাঁর কাছেই আমরা সাহায্য চাই।

সমস্ত প্রশংসা আল্লাহতা’লার প্রতি, যিনি বিশ্বজগতের মহাপ্রভু; এই সুপ্রশংসা বারংবার তাঁরই প্রতি পেশকৃত, আমাদের মহাপ্রভু যেমনটি পছন্দ করেন এবং যা’তে তিনি রাজি (সন্তুষ্ট) থাকেন। তিনি আশীর্বাদধন্য করুন তাঁর প্রিয় হাবীব ও পয়গম্বর হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামকে, যিনি উম্মী নবী, আম্বিয়া (আ:)-মণ্ডলীর সীলমোহার এবং খোদাভীরুদের ইমাম; যিনি সত্য, সঠিক ধর্ম ও চিরস্থায়ী, ঐশী সমর্থিত এবং সুরক্ষিত (হেফাযতপ্রাপ্ত) খোদায়ী বিধান প্রচারের সুমহান দায়িত্বপ্রাপ্ত। এটা এমনই এক ঐশী বিধি-বিধান যা মহানবী (দ:)-এর উম্মতের একটি অংশ বা দল এ সত্যের অনুসরণে সদাসর্বদা বিজয় লাভ করবেন; তাঁরা মহাপ্রলয় দিবস অবধি এ সত্যের প্রত্যাখ্যানকারীদের দ্বারা পরাভূত বা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না। [হুযূর পূর নূর (দ:) ঘোষণা করেছেন - لاَ تَزَالُ طَائِفَةٌ مِنْ أُمَّتِي ظَاهِرِينَ عَلَى الْحَقِّ - মুসলমানদের একটি দল সবসময়-ই সত্যের ওপর অটল, অবিচল থাকবেন। এ হাদীস অন্ততঃ ১৬ জন সাহাবী বর্ণনা করেছেন, যাঁদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন সর্ব-হযরত মুগীরা, সওবান ও জাবের (আল্লাহ তাঁদের সবার প্রতি সন্তুষ্ট হোন)। বর্ণনাকারীদের পূর্ণ তালিকার জন্যে দেখুন #১৪৫। নমুনা বর্ণনাগুলোর জন্যে দেখুন মুহাম্মদ ইবনে ইসমাঈল আল-বুখারী কৃত ’সহীহ আল-বুখারী’, ’ফাতহুল বারী’ সংস্করণ #৭৩১১; মুসলিম ইবনে হাজ্জাজ প্রণীত ’সহীহ মুসলিম’, ৫ম খণ্ড, দারুল ফিকর, কায়রো, মাতবা’আ ঈসা আল-বাবি আল-হালাবী কর্তৃক পুনর্মুদ্রিত ১৯৫৬ সংস্করণ, ১৯৮৩ সংস্করণ, #১৫৭, ১৯২০-২১, ২৩; আহমদ বিন হাম্বল রচিত ’আল-কিতাব আল-মুসনাদ’, ৫:২৭৮, ২৭৯; এবং অন্যান্য কেতাব। - অনুবাদক মূসা ফার্বারের নোট]

প্রারম্ভিক বক্তব্য:

কেউ একজনের তিরস্কার আমার কাছে পৌঁছেছে; বর্তমানকালের কিছু মানুষ যারা ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ:) বা অন্য কোনো বিখ্যাত ইমামের মযহাবের অনুসারী হওয়ার দাবি করে কিন্তু বিভিন্ন বিষয়ে তাঁদের মযহাবগুলো থেকে বিচ্যুত হয়, আমি যে তাদের সমালোচনা করে থাকি তারই প্রতি এই ভর্ৎসনা উদ্দিষ্ট হয়েছে। তিনি দাবি করেন, যে ব্যক্তি এরকম করে তার সমালোচনা করা যাবে না। কেননা, ওই ব্যক্তি হয়তো ’মুজতাহিদ’ [এজতেহাদ হচ্ছে ধর্মীয় জ্ঞানে যোগ্য ও কর্তৃত্বসম্পন্ন কোনো বিদ্বানের প্রয়োগকৃত গবেষণালব্ধ সিদ্ধান্ত; মুজতাহিদ এরকম এজতেহাদ প্রয়োগে যোগ্য আলেম। এব্যাপারে আরো বিস্তারিত জানার জন্যে ’মাতন আল-ওয়ারাকাত’ ও ‘শরহে মাতন আল-ওয়ারাকাত’ গ্রন্থগুলো দেখুন। - অনুবাদক মূসা ফার্বারের নোট] হতে পারে, তার কাছে সত্য বলে প্রতীয়মান কোনো কিছুকে সে অনুসরণ করছিল; নতুবা অন্য আরেকজন মুজতাহিদকে সে অনুকরণ করছিল, যার দরুন তাকে এর জন্যে দায়ী করা যায় না।

এমতাবস্থায় আমি বলি, সাফল্য একমাত্র আল্লাহতা’লার কাছ থেকেই আগত; সাহায্য তাঁর কাছেই চাওয়া হয়, আর তাঁরই ওপর নির্ভর করা হয়, এবং তাঁর (প্রদত্ত) মাধ্যম ব্যতিরেকে কোনো শক্তি-ই নেই।

এতে কোনো সন্দেহ নেই যে মহান আল্লাহতা’লা এই উম্মতের জন্যে তাঁদের ধর্মকে হেফাযত করেছেন, যে হেফাযত অন্য কোনো ধর্মকে তিনি মঞ্জুর করেননি। এই উম্মতের ধর্ম হতে যে সব রীতি অদৃশ্য হয়ে যাবে, তা নবায়নের জন্যে আর কোনো নবী/পয়গম্বর আসবেন না, যেমনটি এসেছিলেন আমাদের (মহানবীর) পূর্ববর্তী পয়গম্বর (আ:)-বৃন্দ তাঁদের ধর্ম নবায়নের বেলায়। ওই সময় যখন-ই কোনো পয়গম্বরের তিরোধান হতো, অমনি আরেকজন তাঁর পরে ধর্ম নবায়ন করতে আবির্ভূত হতেন। [সর্বশক্তিমান আল্লাহ বলেন -  مَّا كَانَ مُحَمَّدٌ أَبَآ أَحَدٍ مِّن رِّجَالِكُمْ وَلَـٰكِن رَّسُولَ ٱللَّهِ وَخَاتَمَ ٱلنَّبِيِّينَ وَكَانَ ٱللَّهُ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيماً - মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) তোমাদের পুরুষদের মধ্যে কারো পিতা নন, বরঞ্চ তিনি আল্লাহর রাসূল এবং সমস্ত পয়গম্বরের মধ্যে সর্বশেষ (আল-কুরআন, ৩৩:৪০)। মহানবী (দ:) এরশাদ করেন - لاَ نَبِيَّ بَعْدِي - নিশ্চয় আমার পরে আর কোনো নবী নেই (সহীহ আল-বুখারী, #৪৪১৬; সহীহ মুসলিম, ২৪০৪; আহমদ বিন হাম্বল কৃত আল-মুসনাদ, ১:১৮২, ১৮৩; ৩:৩৩৮; ৬:৩৬৯, ৪৩৮। - অনুবাদক মূসা ফার্বারের নোট] 

আল্লাহতা’লা এই দ্বীনকে হেফাযতের নিশ্চয়তা দিয়েছেন এবং ওয়াদা করেছেন এ মর্মে যে এতে চরমপন্থী তথা সীমা লঙ্ঘনকারীদের পরিবেশিত দূষণীয় প্রথা, দ্বীন নির্মূলের অপচেষ্টাকারীদের কূট-কৌশল এবং গণ্ডমূর্খদের ভ্রান্ত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ পরিশুদ্ধির লক্ষ্যে প্রতিটি যুগেই সংস্কার প্রবর্তিত হবে। [মহানবী (দ:) এরশাদ ফরমান, “সত্যপন্থী মুসলমান প্রজন্ম প্রত্যেক (পূর্ববর্তী) উত্তরাধিকারীর কাছ থেকে এই জ্ঞান গ্রহণ করে তা বহন করবেন। তাঁরা সীমা লঙ্ঘনকারীদের বিচ্যুতি, ধর্ম নির্মূলের অপচেষ্টাকারীদের কূট-কৌশল ও গণ্ডমূর্খদের অপব্যাখ্যা রহিত করবেন।” এই হাদীসটি বর্ণনা করেন সর্ব-হযরত আবূ হুরায়রা (রা:), আবূ মাসউদ (রা:), আলী (ক:), উসামা বিন যায়দ (রা:) এবং মু’আয বিন জাবাল (রা:)। - অনুবাদক মূসা ফার্বার]

সর্বশক্তিমান আল্লাহতা’লা এরশাদ করেন:

إِنَّا نَحْنُ نَزَّلْنَا ٱلذِّكْرَ وَإِنَّا لَهُ لَحَافِظُونَ

অর্থ: “নিশ্চয় আমি অবতীর্ণ করেছি এই কুরআন এবং নিশ্চয় আমি নিজেই সেটার সংরক্ষক” (আল-কুরআন, ১৫:৯)। এই আয়াতে তিনি তাঁর ঐশী কেতাব সংরক্ষণের অঙ্গীকার করেছেন। ফলে কেউই আজ পর্যন্ত এ কেতাব থেকে একটি বাক্যও সংযোজন বা বিয়োজন করতে সক্ষম হয়নি।

কুরআন মজীদের হেফাযত 

মহানবী (দ:)-এর (যাহেরী/প্রকাশ্য) জিন্দেগীতে তাঁর উম্মত যাতে সহজে আল-কুরআন শিখতে ও মুখস্থ করতে পারেন, সেজন্যে তিনি বিভিন্ন ‘হুরূফ’ তথা পঠন-রীতি বা পদ্ধতি ব্যবহার করে তা তেলাওয়াত করতেন। তাঁর উম্মতের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিলেন বয়স্ক মানুষ, মহিলা, কম বয়সী ছেলে ও মেয়ে এবং সেসব পুরুষ যাঁরা (জীবনে) কখনোই কোনো বই পড়েননি। তাই তাঁদের খাতিরে তিনি কুরআন হেফয তথা মুখস্থ করার এমন এক সুবিধাজনক পদ্ধতি খুঁজে বের করেন যা দ্বারা সাতটি ‘হুরূফ’ তথা পঠন-রীতির সাহায্যে তিনি তাঁদের কাছে তেলাওয়াত করতেন। এটা হযরত উবাই বিন কায়স (রা:) ও অন্যান্যদের বর্ণিত হাদীসে বিবৃত হয়েছে। [সর্বজনবিদিত একটি মতানুযায়ী, এই সাতটি ’আহরূফ’ বা পঠন-পদ্ধতি কুরআন অবতীর্ণ হওয়ার সময়কার সবচেয়ে জনপ্রিয় তথা বহুল প্রচলিত আরবী ভাষায় চালু হয়েছিল। এসব পদ্ধতির মধ্যকার কিছু পার্থক্য অর্থের দিক দিয়ে কোনো একটি শব্দের মূলগত বিভিন্নতা ব্যতিরেকে স্রেফ উচ্চারণেই বিভিন্নতা ছিল। তেলাওয়াতের এই সাতটি পদ্ধতি প্রসিদ্ধ কেরআত তথা পঠনের মাধ্যমে সংরক্ষিত হয়, যদিও ‘আহরূফ’ ও আমাদের পরিদৃষ্ট বর্তমানকালের সংরক্ষিত প্রথাগত কেরআতের মধ্যে নিখুঁত কোনো মিল নেই। এতে এ কথা বোঝায় না যে আসহাব-এ-কেরাম (রা:) তাঁদের (নিজ নিজ) কথিত ভাষানুযায়ী যেমন খুশি তেমন কুরআন তেলাওয়াত করতেন। কেননা, আল-কুরআনের সারমর্ম ও পঠন উভয়ই এর অবতীর্ণ হওয়া অংশ বটে, আর দুটোই মহানবী (দ:) হতে (আমাদের কাছে) হস্তান্তরিত হয়েছে। অতএব, কোনো সাহাবী (রা:) যিনি মহানবী (দ:)-এর কাছ থেকে সরাসরি একখানা আয়াতের তেলাওয়াত শুনেছেন, তিনি অপর কোনো সাহাবী (রা:) কর্তৃক আরেকটি পঠন-রীতিতে ওই একই আয়াতের তেলাওয়াত শুনলে তাঁর পক্ষে শঙ্কিত হওয়াটাই যুক্তিসঙ্গত। উদাহরণের জন্যে দেখুন সহীহ বুখারী #৪৯৯১; সহীহ মুসলিম #২৮১, ৮১৯;  আহমদ বিন হাম্বল কৃত আল-মুসনাদ, ১:২৬৪, ২৯৯, ৩১৩; ৫:১২৭, ১২৯ - অনুবাদক মূসা ফার্বারের নোট] অতঃপর যখন ইসলামের বাণী পৃথিবীর বিস্তৃত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে এবং মুসলমান সম্প্রদায় দূরবর্তী দেশগুলোতে পৃথক পৃথক দলে বিভক্ত হন, তখন প্রতিটি দলই তাঁদের কাছে যে কুরআন তেলাওয়াতের পদ্ধতি পৌঁছেছিল সে অনুযায়ী তেলাওয়াত আরম্ভ করেন। তাঁরা কুরআন মজীদের পঠন-পদ্ধতির ব্যাপারে ভিন্ন ভিন্ন মত পোষণ করেন এবং যখনই হজ্জ্ব ও অন্যান্য অনুষ্ঠানে তাঁরা মিলিত হতেন, তৎক্ষণাৎ কুরআনে অবস্থিত কিছু শব্দের উচ্চারণ নিয়ে তাঁদের মধ্যে বড় ধরনের মতপার্থক্য দেখা দিতো।

পূর্ববর্তী আম্বিয়া (আ:)-এর উম্মতদের মতো এই উম্মত-ও তাঁদের কেতাব নিয়ে মতপার্থক্যে জড়াতে পারেন, এই আশঙ্কা বোধ করে খলীফা হযরত উসমান (রা:)-এর শাসনামলে সাহাবা-এ-কেরাম (রা:) উম্মতদের দ্বারা কেবল একটিমাত্র পঠন-পদ্ধতিতে কুরআন তেলাওয়াতের ব্যাপারে ঐকমত্য পোষণ করেন। তাঁরা উপলব্ধি করেন যে এটা জনস্বার্থে করা প্রয়োজন, আর তাই তাঁরা অন্য সব পঠন-রীতির ‘মাসাহিফ’ পুড়িয়ে ফেলেন [দেখুন সহীহ আল-বুখারী, ৪৯৮৭]। এটা আমীরুল মু’মেনীন হযরত উসমান বিন আফফান (রা:)-এর অন্যতম একটা গুণ, যার জন্যে সর্ব-হযরত আলী (ক:), হুযায়ফা ইবনে ইয়ামান (রা:) ও অন্যান্য গণ্যমান্য সাহাবী (রা:) খলীফার উচ্চসিত প্রশংসা করেন।

মহানবী (দ:)-এর জমানায় হযরত উমর ফারূক (রা:) একটি আয়াতের (তেলাওয়াত) বিষয়ে হিশাম বিন হাযেম ও জনৈক কাতেবের কড়া সমালোচনা করেন। ওই কাতেব রাসূলুল্লাহ (দ:) হতে প্রাপ্ত আয়াতগুলো লিপিবদ্ধ করতো; তার অন্তরের ঈমান সুদৃঢ় ছিল না এবং সে এ কারণে ধর্মত্যাগ করেছিল, আর ওই অবস্থাতেই মারা গিয়েছিল। [ইমাম ইবনে রাজাব হয়তো আবদুল্লাহ বিন সা’আদ বিন আবি সারব (রা:)-কে উদ্দেশ্য করে থাকতে পারেন। তিনি-ই রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর কাতেবদের মধ্যে প্রথম কুরাইশী লেখক। তিনি কিছুকাল পরে ধর্মত্যাগ করেন, কিন্তু মক্কা বিজয়ের দিনে ধর্মে ফিরে আসেন।- অনুবাদক মূসা ফার্বারের নোট]    

মহানবী (দ:)-এর বেসালের পরে এই উম্মতের মধ্যে যদি আল-কুরআন পাঠের ক্ষেত্রেই উচ্চারণগত মতপার্থক্য বিরাজ করে, তাহলে উম্মত সম্পর্কে আমরা কী ধারণা পোষণ করবো? এ কারণেই উম্মতের জ্ঞান বিশারদবৃন্দ খলীফা উসমান (রা:) মুসলমানদেরকে যে পঠন-রীতির অধীনে সমবেত করেছিলেন, সেটা ছাড়া বাকি সব রীতি পরিত্যাগ করেন। তবে উলামাদের মধ্যে কেউ কেউ মুসলমানদের এ থেকে অব্যাহতি দিয়েছেন: সর্ব-ইমাম আহমদ বিন হাম্বল ও মালেক (আল্লাহ তাঁদের প্রতি করুণা বর্ষণ করুন) হতে এমনি একটি অভিমত বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু তাঁদের মধ্যেও মতপার্থক্য রয়েছে নামাযে কুরআন পাঠ, না অন্যত্র পাঠ, না শুধু নামাযেই কেরআত প্রশ্নে। [বর্ণিত আছে যে হযরত ইবনে মাসউদ (রা:) এ রকম অব্যাহতি দিয়েছিলেন। দেখুন আবূ ঈসা আত্ তিরমিযী প্রণীত ‘সুনানে তিরমিযী’, ৫ম খণ্ড, দারুল এহএয়া আল-তুরাত আল-আরবী, বৈরুত; কায়রোতে পুনর্মুদ্রিত সংস্করণ, ৩১০৩ - অনুবাদক মূসা ফার্বারের নোট]

প্রশ্ন যাই হোক না কেন, এই উম্মত এ ব্যাপারে ভিন্নমত পোষণ করে না যে কেউ যদি (হযরত ইবনে মাসউদের মতো) ধর্মীয় প্রথাসিদ্ধ পঠন-রীতি অনুযায়ী কুরআন এমনভাবে তেলাওয়াত করে, যেটা এই সর্বসম্মতভাবে গৃহীত ‘মুশাফ’-এর সাথে মতভেদ সৃষ্টি করে, এবং যদি সে দাবি করে যে তার পঠন-পদ্ধতিটি হযরত যায়দ ইবনে সাবিত (রা:)-এরই গৃহীত রীতি, যার ওপর খলীফা উসমান (রা:) মুসলমানদেরকে একতাবদ্ধ করেছিলেন, কিংবা যদি সে দাবি করে যে তা হযরত যায়দ (রা:)-এর পঠন-পদ্ধতির চেয়েও যোগ্যতর, তাহলে সে এক অন্যায্য দাবি উত্থাপনকারী, সীমা লঙ্ঘনকারী এবং শাস্তি পাওয়ার যোগ্য ব্যক্তি বলে সাব্যস্ত হবে। এ ব্যাপারে মুসলমান উলামাদের একে অপরের মধ্যে কোনো দ্বিমত-ই নেই।

বস্তুতঃ যে ক্ষেত্রে মতানৈক্য বিদ্যমান তা হলো, ওই লোক হযরত ইবনে মাসউদ (রা:)-এর মতো এমন কোনো অক্ষর পাঠ করে কি না - এ কথা স্বীকার করেই যে হযরত ইবনে মাসউদ (রা:)-এর পঠিত ওই অক্ষরটি-ই খলীফা উসমান (রা:)-এর ‘মুশাফ’-এর খেলাফ।

সুন্নাহ’র সংরক্ষণ 

রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর সুন্নাহ এই উম্মতের মাঝে বিরাজমান এবং আল-কুরআনের মতোই তা তাঁদের অন্তরে হেফয করা (স্মৃতিপটে গেঁথে ফেলা) হয়েছে। কিছু উলামা ‘মুশাফ’ যেভাবে লিখেছেন, তেমনি এটাও লিপিবদ্ধ করেছেন। অপরদিকে, অন্যরা এটার লিপিবদ্ধ করাকে নিষেধ করেছেন। আর এতে কোনো সন্দেহ নেই যে মানুষের দ্বারা এর মুখস্থ করা এবং শুদ্ধতার ব্যাপারে বড় মতপার্থক্য বিদ্যমান।

সাহাবা-এ-কেরাম (রা:)-এর যুগের পরে বেদআতী ও গোমরাহ এক দল লোকের আবির্ভাব হয় যারা নতুন বিভিন্ন বিষয় ধর্মের মধ্যে পরিবেশন করে এবং মহানবী (দ:)-এর ব্যাপারে উদ্দেশ্যমূলকভাবে মিথ্যাচারের আশ্রয় নেয়। রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর সুন্নাহ’কে রক্ষার্থে আল্লাহ পাক-ও একদল আলেম সৃষ্টি করেন যাঁরা (সত্যের বিপরীতে) মিথ্যা, খামখেয়ালিপনা ও ভুল-ভ্রান্তির পার্থক্য বুঝতে সক্ষম হন। তাঁরা সুন্নাহ’কে সর্বোচ্চ মাত্রায় পরিশুদ্ধ করেন এবং তা নিখুঁতভাবে মুখস্থ করেন।

উলামাবৃন্দ এরপর সমস্ত সুন্নাহকে একত্রিত করে সংকলন করেন এবং হাদীসসমূহকেও সংকলন করেন, আর এভাবেই এসব জ্ঞানের শাখার প্রসার ঘটে। সহীহ তথা বিশুদ্ধ হাদীস সংগ্রহের কারণে দুজন ইমামের (সংকলিত) বইয়ের ওপর উলামাবৃন্দ নির্ভর করেন। এঁরা হলেন আবূ আবদিল্লাহ আল-বুখারী (রহ:) ও আবূল হুসাইন [মুসলিম] বিন আল-হাজ্জাজ আল-কুশাইরী (রহ:)। এঁদের পরে সুন্নাহ-সম্পর্কিত বাকি বইগুলো, বিশেষ করে আবূ দাউদের কৃত সুনান, আবূ ঈসা (তিরমিযী)-এর জামেউ’ (তিরমিযী), আন্ নাসাঈ এবং এরপর ইবনে মাজাহ শরীফের ওপর উলামাবৃন্দ নির্ভর করেন।

সহীহ হাদীসের অন্যান্য কেতাব দুজন শায়খের (সর্ব-ইমাম আল-বুখারী ও মুসলিম) হাদীসগ্রন্থগুলোর পরে সংকলন করা হয়, তবে সেগুলো দুজন শায়খের (শর্তের) মানদণ্ড পর্যন্ত পৌঁছেনি। এ কারণে (কতিপয়) মুহাদ্দীস উলামা (মুহাদ্দীস আল-হাকীমকে) তিরস্কার করেন, যিনি ওই দুটি হাদীসগ্রন্থের একখানি পরিপূরক বই লেখেন এবং সেটার নাম দেন আল-মুস্তাদরাক। জনৈক মুহাদ্দীস মাত্রা ছাড়িয়ে অভিযোগ করেন যে ওই বইয়ে তাঁদের, অর্থাৎ, মুহাদ্দেসীনবৃন্দের (দ্বারা হাদীস সহীহ বিবেচিত হওয়ার) শর্ত পূরণ করার মতো একটি হাদীস-ও নেই। অপর এক মুহাদ্দীস (হাদীসশাস্ত্র বিশারদ) তাঁর সাথে দ্বিমত পোষণ করে বলেন যে আল-মুসতাদরাক বইটিতে অনেক সহীহ হাদীস বেছে নেয়া হয়েছে। বাস্তবতা হলো, অনেক সহীহ হাদীস তাতে বেছে নেয়া হয়েছে ঠিকই, যা তাঁদের (অভিযোগকারী উলামাদের) শর্ত পূরণ করে না, কিন্তু আবূ ঈসা তিরমিযী ও তাঁর মতো মুহাদ্দেসীনের শর্ত পূরণ করে; কিন্তু ওইসব উলামার শর্তানুযায়ী এগুলো সহীহ হাদীস নয়।

আল-বুখারী (রহ:) ও মুসলিম (রহ:) উভয় মুহাদ্দেস কর্তৃক কোনো হাদীস পরিত্যাগ করার ঘটনা একেবারেই বিরল, যদি না তাতে কোনো গোপন ত্রুটি বিদ্যমান থাকতো। যেহেতু কোন্ হাদীস ত্রুটিপূর্ণ ও অনির্ভরযোগ্য তা বিচার করার জ্ঞানের ক্ষেত্রে ওই দুজন ইমামের মতো বিদ্বানের অভাব রয়েছে (অর্থাৎ, তাঁরা ক্ষণজন্মা), সেহেতু আমরা তাঁদের দুটো গ্রন্থের ওপর নির্ভর করি, আস্থা রাখি এবং শরণাপন্ন হই; অতঃপর ওপরোক্ত অন্যান্য বইয়ের শরণাপন্ন হই। তাঁদের পরে কোনো হাদীস নির্ভরযোগ্য না দুর্বল, তা শ্রেণিকরণে কারো কথা গৃহীত নয়; ব্যতিক্রম শুধু তাঁরাই, যাঁদের জ্ঞান, দক্ষতা ও হাদীসশাস্ত্রে পাণ্ডিত্য সর্বজনবিদিত, তবে এঁরা বিরল। বাকি সবাই মূলতঃ ওপরোক্ত বইগুলোর ওপরই নির্ভরশীল এবং (হাদীসের) সূত্র সেগুলোতে খুঁজে পেতেই সন্তুষ্ট।

ফেকাহ-বিষয়ক সিদ্ধান্তগুলোর সংরক্ষণ 

বৈধ ও অবৈধ বিষয়াদি সংক্রান্ত শরয়ী সিদ্ধান্তগুলোর ব্যাপারে বলতে হয়, সাহাবা-এ-কেরাম (রা:), তাঁদের উত্তরসূরীবৃন্দ ও তাঁদের পরবর্তী প্রজন্মের উলামাবৃন্দের মধ্যে এসব বিষয়ে অনেক মতপার্থক্য ছিল। প্রাথমিক যুগে ইসলামী জ্ঞান ও ধর্মভিত্তিক ফিক্কহী সিদ্ধান্ত (ফতোওয়া) প্রদানে সর্বজন পরিচিত যে কোনো (মুজতাহিদ) আলেম ওইসব বিষয়ে তিনি যা সত্য বলে বিবেচনা করতেন, সে অনুযায়ী ফতোয়া জারি করতেন; আর ওই আলেমের দলের বাইরে (অনুরূপ এজতেহাদ প্রয়োগকারী) অন্য কেউই তাঁদের সমালোচনা করতে পারতেন না। এটা হযরত ইবনে আব্বাস (রা:)-কে যখন বিভিন্ন বিষয়ে তাঁরই অনন্য সিদ্ধান্তের কারণে সমালোচনা করা হয়, ঠিক তারই অনুরূপ ঘটনা [এতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে মো’তা তথা ক্ষণস্থায়ী বিয়ে। দেখুন মুহাম্মদ ইবনে আহমদ আল-যাহাবী কৃত ‘তাযকেরাতুল হুফফায’, ৪র্থ খণ্ড, ২ দারুল মা’রেফা, বৈরুত (তারিখবিহীন), ১:১৭০-৭১; আল-যাহাবী প্রণীত ‘মীযান আল-এ’তেদাল ফী নাক্কদ আল-রিজাল’, ৪র্থ খণ্ড, দারুল মা’রেফা, পুনর্মুদ্রিত, বৈরুত, ১৩৮২ হিজরী, ২:৬৫৯, ৬:৩৩১ - অনুবাদক মূসা ফার্বারের নোট]। তাঁকে যে ধরনের সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয়েছিল, তাঁর অনুসারীদেরকে তার চেয়েও বেশি সমালোচনা করা হয়। যেমন ইবনে জুরায়জ বসরায় এলে পরে মুসলমান সর্বসাধারণ তাঁকে সেখানকার প্রধান মসজিদে প্রবেশ করতে দেখে হাত তুলে আল্লাহর কাছে মোনাজাত করেন এবং হযরত ইবনে মাসউদ (রা:)-এর সাথীদের কাছ থেকে তাঁরই গৃহীত বিভিন্ন বিষয়ের অনিয়মের ব্যাপারে তাঁর বিরুদ্ধে মহাপ্রভুর দরবারে ফরিয়াদ/অভিযোগ করেন - যতোক্ষণ না তিনি তাঁদের কাছ থেকে বিদায় নেয়ার আগে এগুলোর মধ্য হতে অনেক সিদ্ধান্ত ফিরিয়ে নেন। এটা ছিল এমনই এক যুগ যখন অধিকাংশ মানুষ ধর্ম ও বিবেক দ্বারা পরিচালিত হতেন।

ওই সময় এই বৈশিষ্ট্য-ই সর্বসাধারণকে জ্ঞানের দাবিদার অথচ গণ্ডমূর্খ ও অযোগ্য লোকদের (ধোকাপূর্ণ) কথার খপ্পর হতে রক্ষা করেছিল। অতঃপর এক সময় ধর্ম-ধার্মিকতা ও বিবেক ম্লান হতে থাকে। জ্ঞান ও যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও ফতোওয়া জারি বা তার যোগ্যতা দাবি করাটা সাধারণ ঘটনা হয়ে দাঁড়ায়। পূর্ববর্তী যুগের যে কেউ আপন বিবেচনায় সত্য জেনে ফতোওয়া জারি করার অবস্থাটা যদি পরবর্তী যুগেও বিদ্যমান থাকতো, তাহলে ধর্মের মধ্যে আর কোনো নিয়ম-নীতি অবশিষ্ট থাকতো না; আর এতে হালাল পরিণত হতো হারামে, হারাম পরিণত হতো হালালে [যেমনটি বর্তমানকালের লা-মযহাবী মৌ-লোভীদের মধ্যে দেখা যায় - বঙ্গানুবাদক]। প্রত্যেকেই যা চাইতো তা-ই ফতোওয়া দিতো এবং আমাদের ইসলাম ধর্ম আমাদেরই পূর্ববর্তী দুটি ঐশীগ্রন্থের অনুসারী (ইহুদী ও খৃষ্টান) লোকদের আকীদা-বিশ্বাসে পরিণত হতো।

এমতাবস্থায় আল্লাহতা’লার ঐশী হেকমত তথা জ্ঞান-প্রজ্ঞানুযায়ী তিনি ধর্মকে প্রতিষ্ঠিত করেন এবং হেফাযত করেন, আর মানুষের জন্যে ইমামবৃন্দকেও নিয়োগ করেন। তাঁরা হলেন ফেকাহ-বিষয়ক সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী বিদ্বান ও হাদীস বিশারদদের ইমামমণ্ডলী, যাঁদের জ্ঞান, উপলব্ধি এবং ফিক্কহী সিদ্ধান্ত গ্রহণের বেলায় চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছুনোর যোগ্যতা সম্পর্কে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। শরীয়তের আইনি সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষ তাঁদের ওপর আস্থা রেখেছেন এবং এতদসংক্রান্ত এলমী ফায়সালার জন্যে তাঁদেরই শরণাপন্ন হয়েছেন। আল্লাহ পাক এমন কয়েকজন পুণ্যাত্মা সৃষ্টি করেন যাঁরা ইমামবৃন্দের মযহাবগুলোকে পরিশুদ্ধ করেন এবং মযহাবের নীতিমালাও প্রণয়ন করেন, যার ফলে প্রত্যেক ইমাম আল-মযহাবের ফিক্কহী পদ্ধতি, মৌলিক নীতিমালা ও বিস্তারিত নিয়ম-কানুন প্রতিষ্ঠিত হয় - যতোক্ষণ না হালাল ও হারাম বিষয়গুলোর মৌলিক নীতিমালার সাথে জারিকৃত ফতোওয়াগুলোর যোগসূত্র প্রতিষ্ঠিত হয়।

আল্লাহতা’লার (প্রিয়) ঈমানদার বান্দাদের প্রতি তাঁর এ এক মহা অনুগ্রহ ও দয়া এবং তাঁরই রেওয়াজ-মাফিক নিয়মগুলোর একটি যে তিনি এই ধর্মকে হেফাযত করেছেন। যদি তা না হতো, তাহলে মানুষেরা সবচেয়ে আজব আজব জিনিস দেখতে পেতেন: প্রত্যেক নির্বোধ, মাথা গরম, বে-আদব ও ভণ্ড লোক, যে নিজের মতামত সম্পর্কে উচ্চ ধারণা পোষণ করে, সে নিজেকে সকল ইমামের সেরা এবং উম্মতের পথপ্রদর্শক দাবি করে বসতো; আর এ-ও দাবি করতো যে মানুষদেরকে তারই প্রতি শরণাপন্ন হতে হবে এবং অন্য কারো প্রতি তাঁরা আস্থাশীল হতে পারবেন না।

আল্লাহর প্রশংসা, তাঁরই করুণার বদৌলতে এই মহাবিপদের এবং ভারী বোঝার দ্বার হয়েছে রুদ্ধ। আর এই ব্যাপক বিচ্যুতি-ও হয়েছে রহিত। এটা আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের প্রতি তাঁরই মহা অনুগ্রহ, সুন্দর আচরণ ও করুণা।

এতদসত্ত্বেও কিছু লোকের আবির্ভাব হয় যারা নিজেদেরকে এজতেহাদের পর্যায়ে উন্নীত বলে দাবি করে, আর জ্ঞানের ব্যাপারে কিংবা ওই ইমামবৃন্দের কাউকে অনুসরণ সম্পর্কে লাগামহীন কথাবার্তা বলে। তাদের কারোর কারোর এ জাতীয় আচরণ সহ্য করা হয়, তাদেরই ওই দাবির আপাতঃ প্রতীয়মান সত্যতার কারণে। অন্যান্যদের বেলায় তাদের বক্তব্য প্রত্যাখ্যাত হয় এবং তাদের দাবির ব্যাপারে তাদেরকে মিথ্যেবাদী সাব্যস্ত করা হয়। (এজতেহাদের) এই পর্যায়ে পৌঁছুতে অক্ষম অন্যান্যদের বেলায় ওই (চার) ইমামের যে কোনো একজনের তাকলীদ তথা অনুসরণ করা এবং উম্মতের বাকি সবার মতোই ধর্মের অনুশীলন করা একান্ত অপরিহার্য।

কোনো নির্বোধ বে-আদব লোক হয়তো বলতে পারে:

আপত্তি: নির্দিষ্ট (মুজতাহিদ) উলামাবৃন্দের মতামত অনুসরণে মানুষদেরকে কীভাবে আটকে রাখা যায়? আর তাঁদেরকে কীভাবেই বা এজতেহাদ প্রয়োগ, বা ধর্মের অন্যান্য মুজতাহিদবৃন্দের অনুকরণ হতে বিরত রাখা যায়?

জবাব: সাহাবা-এ-কেরাম (রা:) যেভাবে সব অঞ্চলের মানুষদেরকে কুরআন তেলাওয়াতের একটি পঠন-রীতির ওপর ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন এবং বাকি পদ্ধতিগুলোর ব্যবহার রহিত করেছিলেন এই বিবেচনায় যে এ ছাড়া সার্বিক স্বার্থ অপূর্ণ থেকে যাবে, আর বাকি পঠন-রীতিগুলো চালু থাকলে মানুষেরাও ক্ষতিগ্রস্ত হবেন, এজতেহাদের বিষয়টিও ঠিক সে রকম একটি ব্যাপার।

হালাল ও হারামসম্পর্কিত ফতোওয়া ও ফিক্বহী সিদ্ধান্ত-ও এই রকম বিষয়। যদি নির্বাচিত ইমামদের এজতেহাদের অধীনে সাধারণ মানুষকে না আনা হতো, তাহলে ধর্মের মধ্যে বিচ্যুতি (গোমরাহী) দেখা দিতো; ব্যক্তিগত নেতৃত্বের খায়েশ লালনকারী প্রত্যেক নির্বোধ গোস্তাখ লোকই নিজেকে মুজতাহিদবৃন্দের দলে অন্তর্ভুক্ত বলে মনে করতো; সে কোনো নতুন ধারণার জন্ম দিয়ে তা প্রাথমিক যুগের পূর্বসূরীদের প্রতি আরোপ করতো; হয়তো তা হতে পারতো বাঁকা (পথ), যেমনটি যাহেরীয়্যা গোষ্ঠীর কারো কারো বেলায় ঘটেছিল অহরহ; অার এটা হতেও পারে (তাদের) পূর্বসূরীদের কারো ভুল, যার দরুন তাদের একটি দল (তা) পরিত্যাগের ব্যাপারে একমত হয়েছিল। 

আল্লাহতা’লা যা (অমোঘ) বিধান করেছেন এবং প্রসিদ্ধ ইমামবৃন্দের চার মযহাব অনুসরণে মানুষদেরকে যেভাবে পরিচালিত করেছেন, সার্বিক কল্যাণ তাতেই নিহিত রয়েছে।

আপত্তি: আল-কুরআনের সাতটি পঠন-রীতির একটির ওপর মানুষদেরকে ঐক্যবদ্ধ করা আর তাঁদেরকে মযহাবগেুলোর চার ইমামের (আইম্মায়ে মযাহিববৃন্দের) মতামতের অধীনে আনার মধ্যকার পার্থক্য হলো, ওই সাতটি পঠন-রীতির অর্থসমূহ (প্রায়) অনুরূপ বা কাছাকাছি  কোনো বিষয় ছিল এবং এসব অর্থ এই (একটিমাত্র) অক্ষর হতেই গৃহীত হয়েছিল। পক্ষান্তরে, চার মযহাবের (চার) ইমামবৃন্দের মতামত কিন্তু একই বিষয় নয়, কেননা তাঁদের ঐকমত্য এমন ক্ষেত্রেও প্রতিষ্ঠিত হওয়া সম্ভব যা সত্য হতে বহু দূরে। 

জবাব: একদল উলামা এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তাঁরা বলেন, এই উম্মত (মুসলিম সমাজ)-কে আল্লাহতা’লা কখনোই দালালাত তথা পথভ্রষ্টতার ওপর ঐক্যবদ্ধ করবেন না। এর সপক্ষে অনেক হাদীস বিদ্যমান।

কিন্তু যদি ধরেও নেয়া হয় যে এরকম (বিভ্রান্তি) ঘটেছে, তথাপিও তা অত্যন্ত বিরল এক ঘটনা; আর তা একমাত্র এমন এক মুজতাহিদের চোখেই ধরা পড়তে পারে যিনি তাঁদের (আইম্মায়ে মযাহিবের) চেয়েও বেশি জানেন। এটা একেবারেই অনুপস্থিত বা বিরল। অধিকন্তু, ওই মুজতাহিদ যদি থেকেই থাকেন, তাহলে তাঁর দৃষ্টিতে যা সত্য বলে বিবেচিত, তা-ই তার অনুসরণ করা বাঞ্ছনীয় হবে। কিন্তু বাকি সবার ক্ষেত্রে (চার মযহাবের চার ইমামের) তাকলীদ তথা অনুসরণ বাধ্যতামূলক; আর তা নিঃসন্দেহে গ্রহণযোগ্য-ও। তাঁদেরকে অনুসরণকারী মানুষেরা তাঁদের সবাইকে বা কয়েকজনকে অনুসরণ করলে পাপ হবে না।

আপত্তি: কিন্তু এতে তো ভুল কোনো কিছুর অনুসরণে কতিপয় ইমামকে অনুকরণের দ্বার উন্মুক্ত হবে।             

জবাব: একটা গোটা সমাজ (উম্মাহ) মিথ্যেবাদী হতে পারেন না, বরঞ্চ যারা মতভেদ করে তারাই নিশ্চয় তিরস্কারযোগ্য। উপরন্তু, কোনো ভুল এই উম্মতের ওপর অপ্রত্যাশিতভাবে এসে পড়তে পারে না। আর যদি তা এসেই পড়তো, তবে তা অধিকাংশ সময় একেবারেই বিরল বিষয়ের ক্ষেত্রে হতো। কিন্তু মুসলমানদের সর্বজনীন প্রয়োজনীয় বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে এটা তাঁদের বিশ্বাস করার অনুমতি নেই যে চার মযহাবের ইমামবৃন্দ, যাঁদেরকে ইসলামের সুদীর্ঘ সময়কাল যাবত অনুসরণ করা হয়ে আসছে, তাঁরা কোনো গোমরাহী বা ভ্রান্তির ওপর ঐকমত্য পোষণ করেছেন। কেননা, এটা এই উম্মতের প্রতি জঘন্য অপবাদ, যা থেকে আল্লাহ পাক একে রক্ষা করেছেন।

আপত্তি: আমরা স্বীকার করি যে সাধারণ মানুষের দ্বারা এজতেহাদ প্রয়োগকে বাধা দিতে হবে। কেননা, এতে সবচেয়ে বড় ধরনের বিভ্রান্তি দেখা দিতে পারে। কিন্তু বিখ্যাত ওই চার ইমাম ছাড়াও অন্যান্য অনুকরণীয় মুজতাহিদ ইমামের অনুসরণকে বাধা দেয়ার বিষয়টি আমরা স্বীকার করি না।         

জবাব: এ ধরনের কর্মকাণ্ডে বাধা দেয়ার কারণগুলো আমরা ইতিপূর্বে ব্যাখ্যা করেছি। এটা এই কারণে যে অন্যান্য অখ্যাত মযহাবগুলোকে সংস্কার করা হয়নি; আর হয়তো তাদের প্রতি এমন কিছু আরোপ করা হয়েছে, যা তারা বলেনি, কিংবা (তাদের কথা থেকে) ধরে নেয়া হয়েছে যা তারা উদ্দেশ্য করেনি। তাদের মযহাবগুলোর পক্ষ সমর্থনের জন্যে কেউই অবশিষ্ট নেই, অথবা সেগুলোতে যেসব ভুল-ভ্রান্তি হয়েছিল, তা-ও চিহ্নিত করার কেউ নেই, যা প্রসিদ্ধ চার মযহাবের সাথে বৈপরীত্য রাখে।

আপত্তি: চার মযহাবের মতোই যদি অন্য কোনো ইমামের মযহাবকে সংরক্ষণ, সংস্কার ও স্মৃতিভুক্ত করা হয়, তাহলে সে সম্পর্কে আপনি কী বলবেন? 

জবাব: প্রথমতঃ এক্ষণে এরকম কোনো কিছুর অস্তিত্ব-ই খুঁজে পাওয়া যায় না। আমরা যদি ধরেও নেই যে এ ধরনের কিছু ঘটেছিল, আর সেটাকে অনুসরণ করার এবং সেটার সাথে সংশ্লিষ্ট হওয়ার অনুমতিকে যদি স্বীকারও করে নেই, তথাপিও তা অনুমতিপ্রাপ্ত হবে না - যতোক্ষণ না কেউ (মানে মুজতাহিদ ইমাম) দৃশ্যতঃ সেটার সাথে নিজেকে সংশ্লিষ্ট করে, আইন-কানুন মেনে ফতোওয়া জারি করে এবং সেটার পক্ষ সমর্থন করে।

প্রখ্যাত (চার ইমামের) কোনো একজন ইমামের প্রতি যদি কোনো ব্যক্তি বাহ্যিকভাবে সংশ্লিষ্টতা (আনুগত্য) প্রদর্শন করে কিন্তু গোপনে অন্য কারো সাথে সংশ্লিষ্ট থাকে এবং তারই মযহাব তথা পদ্ধতির প্রতি দৃঢ় আস্থা রাখে, তাহলে এর অনুমতি একেবারেই নেই। এটা এক ধরনের মোনাফেকী/কপটতা এবং অসত্য বিবরণ প্রদান-ও বটে। বিশেষ করে এমন ব্যক্তি যদি ওই বিখ্যাত মযহাবের অনুসারীদের জন্যেই নির্ধারিত দানের অর্থ গ্রহণ করে, কিংবা মানুষদেরকে ধোকা দেয় এ বিষয়ে বিশ্বাস করিয়ে যে সে গোপনে যে মযহাবের প্রতি অনুগত সেটার অনুসরণে জারিকৃত তার ফতোওয়াগুলো বুঝি (প্রকৃত-ই) প্রসিদ্ধ ওই ইমামের মযহাব অনুযায়ী দেয়া হয়েছে।

এটা নিশ্চিতভাবে অনুমতিপ্রাপ্ত নয়। বরঞ্চ এটা উম্মাহ’র সাথে ধোকাবাজি এবং উম্মতের উলামাবৃন্দের প্রতি মিথ্যেচার [দেখুন (মূল বইয়ের) পৃষ্ঠা ৫৪১ - অনুবাদক মূসা ফার্বার]। ইসলাম ধর্মের ইমামবৃন্দ যা বলেননি তা যে ব্যক্তি তাঁদের প্রতি আরোপ করে, কিংবা তাঁরা যা বলেছেন তার পরিপন্থী কোনো কিছু তাঁদের প্রতি আরোপ করে, তবে সে মিথ্যেবাদী সাব্যস্ত হবে এবং শাস্তিযোগ্যও হবে। একই অবস্থা বিরাজ করবে যদি সে কোনো নির্দিষ্ট মযহাবের অনুসরণে একখানি কেতাব লেখার সময় ওই মযহাবের প্রসিদ্ধ ইমামের কোনো কথাকে তারই গোপনে অনুসরণকৃত ইমামের বক্তব্য বলে চালিয়ে দেয়। আর এক্ষেত্রেও একই অবস্থা হবে যদি ওই বইটি কোনো নির্দিষ্ট মযহাবে সীমাবদ্ধ না হয় এবং লেখক বাহ্যতঃ কোনো ইমামের অনুসারী হয়ে গোপনে অপর কোনো ইমামের অনুসরণ করে; আর তার গোপনে অনুসরণকৃত ইমামের অভিমত ব্যক্ত করার সময় বাহ্যিকভাবে অনুসরণকৃত মযহাবের সাথে সেটার মতপার্থক্য খোলাসাভাবে ব্যাখ্যা না করে।

এগুলোর সবই অনুমতির অযোগ্য জালিয়াতি ও ধোকাবাজি, যা (মুজতাহিদ) উলামাবৃন্দের মযহাবগুলোর প্রতি কলঙ্ক লেপন করে এবং বিভ্রান্তি ছড়ায়।

অধিকন্তু, ওই ধরনের লোক যদি এজতেহাদ প্রয়োগের সামর্থ্য দাবি করে, তবে তা আরো কূটচালপূর্ণ ও তিক্ততর এবং দুর্নীতিগ্রস্ত ও একগুঁয়েমিপূর্ণ হবে। এটা (এজতেহাদের যোগ্যতার দাবি) একেবারেই অনুমতিপ্রাপ্ত নয়, ব্যতিক্রম কেবল সেই ব্যক্তি-ই যিনি এজতেহাদের সমস্ত গুণ ধারণ করেন: আল-কুরআন, সুন্নাহ, সাহাবা-এ-কেরাম (রা:) ও তাঁদের উত্তরসূরীদের যাবতীয় শরয়ী সিদ্ধান্ত, তাঁদের এজমা’ (ঐকমত্য) ও মতপার্থক্য এবং এজতেহাদের বাকি সমস্ত সর্বজনবিদিত শর্ত সম্পর্কে যিনি জানেন। এর প্রয়োজনীয় পূর্বশর্ত হলো সুন্নাহ-সম্পর্কিত গবেষণা ও পর্যবেক্ষণ, সুন্নাহ’র নির্ভরযোগ্য ও অনির্ভরযোগ্য দলিলগুলো জানা, সাহাবা-এ-কেরাম (রা:) ও তাঁদের উত্তরসূরীদের মযহাবগুলো সম্পর্কে জ্ঞান রাখা এবং এতদসংক্রান্ত বিষয়ে তাঁদের বর্ণনাগুলোও জানা।

এই কারণেই ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ:) ফতোওয়া প্রদানের ব্যাপারে খুব কঠোর ছিলেন; তিনি এমন লোকদেরকে তা থেকে বাধা দিতেন যারা এক লাখ, বা দুই লাখ, বা ততোধিক হাদীস মুখস্থ করতো না [তুলনা করুন (মূল বইয়ের) ৫১৪ পৃষ্ঠার সাথে - মূসা ফার্বার]। তাঁর এ দাবির দালিলিক প্রমাণ হলো, বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর সিদ্ধান্তগুলোর ব্যাপারে তিনি ছিলেন স্বাধীন, ঠিক যেমনটি ছিলেন অপরাপর (তিন) ইমাম; তাঁর (ইমাম আহমদের) সিদ্ধান্তগুলো অন্য কারো কাছ থেকে নেয়া হয়নি (মানে ধার করা নয়)। কিন্তু যে ব্যক্তি স্রেফ অন্য কারো সিদ্ধান্তের (ফতোওয়া বা দলিলসমৃদ্ধ ফতোওয়ার) ওপর নির্ভর করে, তার ওই প্রচেষ্টার লক্ষ্য হবে সেটা (সিদ্ধান্ত) উপলব্ধি (মানে মূল্যায়ন) করা। হয়তো সে তা ভালোভাবে বুঝতে পারেনি, ফলশ্রুতিতে তা ত্রুটিপূর্ণ করেছে, কিংবা তাতে পরিবর্তন সাধন করেছে। এমতাবস্থায় তার এই সিদ্ধান্ত এজতেহাদ থেকে কতোই না দূরে অবস্থিত! এ যেন নিচের প্রবাদের মতোই -

فدع عنك الكتابة لست منها

ولو سودت وجهك بالمداد

লেখা বন্ধ করো, তা তোমার কাজ নয়
যদিও কালি দ্বারা তোমার মুখ ছাওয়া হয়। [ভাবানুবাদ] 

আপত্তি: তাহলে ইমাম আহমদ (রহ:) ও অপরাপর ইমামবৃন্দ (রহ:) যে অন্যান্য সবাইকে তাঁদের তাকলীদ মানতে (অনুসরণ/অনুকরণ করতে) এবং তাঁদেরই সিদ্ধান্তগুলো লিপিবদ্ধ করতে বারণ করেছিলেন, সে ব্যাপারে আপনি কী বলবেন? অধিকন্তু, ইমাম আহমদ (রহ:)-এর ভাষ্য ছিল “আমার বাণী লিপিবদ্ধ করো না, অমুক এবং তমুকের বাণীও নয়; বরঞ্চ আমরা যেভাবে শিক্ষা করেছি, সেভাবেই শিক্ষা গ্রহণ করো।” এ কথা ঘনঘন-ই তাঁরা বলতেন। এই ব্যাপারটাকেই বা কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন আপনি?

জবাব: এতে কোনো সন্দেহ নেই যে ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ:) মুজতাহিদবৃন্দের সিদ্ধান্তগুলো যাচাই করা এবং সেগুলো মুখস্থ ও লিপিবদ্ধ করাকে নিষেধ করতেন। তিনি কুরআন ও সুন্নাহ নিয়ে ব্যাপৃত থাকার পক্ষেই নির্দেশ দিতেন: এ দুটো উৎসকে মুখস্থ, লিপিবদ্ধ ও অধ্যয়নের জন্যে বলতেন; সাহাবা-এ-কেরাম (রা:) ও তাঁদের উত্তরসূরীবৃন্দের বর্ণনাগুলো লিপিবদ্ধ করতে বলতেন, কিন্তু তাঁদের পরবর্তী প্রজন্মের বাণী সংরক্ষণ করতে মানা করতেন; আর আদেশ দিতেন সহীহ (বিশুদ্ধ) ও যয়ীফ (দুর্বল) রেওয়ায়াতগুলো এবং তাদের উৎসগুলো সম্পর্কে জানতে, আর এর পাশাপাশি অপ্রাসঙ্গিক ভাষ্য/বক্তব্যগুলো বাদও দিতে বলতেন। অতএব, এটা এমন এক বিষয় যার ক্ষেত্রে সর্বাগ্রে শিক্ষাগ্রহণে মনোনিবিষ্ট হওয়াটাই একান্ত প্রয়োজন।

যে কেউ এ বিষয়টি জানলে এবং (ইমাম আহমদের নির্দেশিত) সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছুলে তাঁর জ্ঞান ইমাম আহমদ (রহ:)-এর জ্ঞানের কাছাকাছি উপনীত হবে। তাঁর বেলায় এই নিষেধাজ্ঞা কাজ করবে না এবং এসব কথা তাঁকে উদ্দেশ্য করেও বলা হয়নি। বস্তুতঃ এসব কথা সে ব্যক্তিকে উদ্দেশ্য করেই বলা হয়েছে, যে এই উচ্চস্তরে উঠতে পারেনি এবং (কাঙ্ক্ষিত) লক্ষ্যে পৌঁছুতে পারেনি, বরং (এ জ্ঞানের) তাৎপর্যহীন একটি অংশ-ই কেবল উপলব্ধি করতে পেরেছে। যেমনটি হলো এই যুগের মানুষদের হালত তথা অবস্থা। এটা সত্য যে যুগ যুগ ধরে অধিকাংশ মানুষেরই এই অবস্থা বিরাজ করছে, যদিও তাদের মধ্যে অনেকে উচ্চস্তরে পৌঁছুনোর দাবি করেছেন এবং সর্বোচ্চ পর্যায়ে উন্নীত হয়েছেনও; অথচ যেখানে তাদের (সর্বসাধারণের) বেশির ভাগই প্রারম্ভিক পর্যায়ে থেকে গিয়েছেন।

ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ:)-এর জ্ঞান      

এই বিষয়টি আপনি নিজেই যাচাই করার উদ্দেশ্যে কুরআন ও সুন্নাহ-সংক্রান্ত ইমাম আহমদ (রহ:)-এর এলম তথা জ্ঞানের দিকে লক্ষ্য করুন। কুরআন মজীদ-বিষয়ক জ্ঞানের ক্ষেত্রে তিনি এ ঐশীগ্রন্থের প্রতি মনোযোগী ছিলেন; এটার এবং এটার সাথে সংশ্লিষ্ট শাস্ত্রগুলো উপলব্ধিতেও তিনি ছিলেন মনোনিবিষ্ট। তিনি তাঁর শিষ্যদের প্রতি অনুযোগের সুরে বলতেন, “(আফসোস) মানুষেরা আল-কুরআন উপলব্ধির (প্রচেষ্টা) পরিত্যাগ করেছে।”

হযরত ইমাম (রহ:) আল-কুরআনসম্পর্কিত অনেকগুলো গ্রন্থ সংকলন করেন, যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে ‘কিতাব আল-নাসেখ ওয়াল-মানসূখ’ (রহিতকারী ও রহিতকৃত আয়াতসমূহ), ‘আল-মুকাদ্দাম ওয়াল-মু’আখখার’ (বিন্যাসকৃত আয়াতসমূহ)। তিনি কুরআন মজীদের একটি বড় তাফসীর-ও সংকলন করেন যা’তে সন্নিবেশিত হয়েছে সাহাবা-এ-কেরাম (রা:) ও তাঁদের উত্তরসূরীদের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ। 

ইমাম সাহেব (রহ:)-এর তাফসীরের ধরন ছিল তাঁরই পূর্বসূরীদের পদাঙ্ক অনুসরণে: যেমন তাঁর শায়খবৃন্দ সর্ব-ইমাম আবদুর রাযযাক (রহ:), ওয়াকী’ (রহ:), আদম বিন এয়াস (রহ:) ও অন্যান্যদের কৃত তাফসীর; এছাড়া তাঁরই সমসাময়িক ইমাম এসহাক্ক (রহ:) ও অন্যান্যদের কৃত তাফসীর; আর সবশেষে তাঁর পরবর্তীদের থেকে গৃহীত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ, যাঁদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিলেন সর্ব-ইমাম নাসাঈ (রহ:), ইবনে মাজাহ (রহ:), ইবনে আবি হাতেম (রহ:) এবং অন্যান্য মুহাদ্দেসীনে কেরাম (হাদীসবেত্তা)। এঁদের সবাই কুরআনের তাফসীরগুলোতে নিজেদের মতামত যোগ না করেই পূর্বসূরীদের (সাহাবা-এ-কেরাম ও তাবেঈন/তাবে’তাবেঈন-মণ্ডলী) কাছ থেকে প্রাপ্ত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ সংকলন করেছিলেন।

সুন্নাহ-বিষয়ক জ্ঞানে ইমাম আহমদ বিন হাম্বল (রহ:)-এর পাণ্ডিত্য ছিল সর্বজনবিদিত ও সর্বত্র প্রসার লাভকৃত। এব্যাপারে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং সর্বসম্মতি-ও রয়েছে। এটা সত্য যে তিনি কুরআন ও সুন্নাহর নিশান-বরদার (ধ্বজাধারী) এবং মহানবী (দ:), তাঁর সাহাবা-এ-কেরাম (রা:) ও তাঁদের উত্তরসূরীদের বাণীসম্পর্কিত জ্ঞানে তাঁরই যুগের অন্যতম সেরা বিদ্বান ব্যক্তি ছিলেন।

হযরত ইমাম (রহ:)-এর সমসাময়িকদের থেকে তাঁকে তাঁর স্বকীয় বৈশিষ্ট্যের কারণে আলাদা করা গিয়েছিল বিভিন্ন বিষয়ে, যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল তাঁর প্রখর স্মরণশক্তি। কথিত আছে যে তিনি তিন লাখ হাদীস মুখস্থ করেছিলেন।

সহীহ (নির্ভরযোগ্য) হাদীস হতে অনির্ভরযোগ্য হাদীস বা রেওয়ায়াত (বর্ণনা) পৃথক করার জ্ঞানও তাঁর স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যেগুলোর একটি ছিল। এটা হচ্ছে কথনো কখনো অনির্ভরযোগ্য বর্ণনা হতে নির্ভরযোগ্য বর্ণনাকে আলাদাভাবে চিনতে পারার ক্ষমতা; আর এক্ষেত্রে তিনি ছিলেন রাবী (বর্ণনাকারী)-দের অনুমোদন বা তাঁদের ব্যাপারে সন্দেহ পোষণের বিদ্যায় চূড়ান্ত কর্তৃত্ব (’জারহ ওয়া তা’দিল’)। আর কখনো কখনো এটা হাদীসের এসনাদ (পরম্পরা) ও সেগুলোর বিভিন্নতাবিষয়ক জ্ঞান দ্বারাও চেনা যায়, এবং হাদীসের গোপন ত্রুটি (’এলাল আল-হাদীস’) দ্বারাও চেনা যায়। তিনি এক্ষেত্রেও ছিলেন চূড়ান্ত কর্তৃত্ব। যদিও অনেক মুহাদ্দীস ইমাম মহানবী (দ:)-এর প্রতি আরোপিত কোনো ‘মারফু’ (উন্নীত) হাদীসের ত্রুটিবিষয়ক জ্ঞানে তাঁর সমকক্ষ ছিলেন, তবুও কোনো ’মাকতু’ তথা সাহাবীদের পরবর্তী প্রজন্মগুলোর বর্ণনাকৃত কর্তিত (বিচ্ছিন্ন) পরম্পরার রেওয়ায়াত যা মহানবী (দ:)-এর পরে কারো প্রতি আরোপিত ছিল, সেটার জ্ঞানের ব্যাপারে কেউই তাঁর সমকক্ষ ছিলেন না। এ বিষয়ে তাঁর বাণী সম্পর্কে যে কেউ গবেষণা করলে বিস্ময়কর জিনিস দেখতে পাবেন এবং এই বিদ্যায় তাঁর উপলব্ধির সমকক্ষ হওয়া কতো যে বিরল একটি ব্যাপার, তাতেও প্রত্যয় (নিশ্চিত বিশ্বাস) পোষণ করবেন।

ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ:)-কে স্বকীয় বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করেছিল যে বিষয়টি, তার অংশ ছিল হাদীসের ফেক্বাহ-সম্পর্কিত জ্ঞান: আহাদীস উপলব্ধি বা বোঝা, জায়েয ও না-জায়েয বিষয়গুলো সম্পর্কে এর বিধি-বিধান, এবং (পাশাপাশি) এর অর্থ। এক্ষেত্রে তিনি তাঁর সমসাময়িক ইমামদের মাঝে সবচেয়ে বেশি জ্ঞানী ছিলেন, যেমনটি সাক্ষ্য দিয়েছিলেন সর্ব-ইমাম এসহাক্ক (বিন রাহুইয়াহ), আবূ উবায়দ প্রমুখ।

ইমাম সাহেব (রহ:)-এর ফিক্বহী সিদ্ধান্ত ও তাঁর পদ্ধতি ও অন্তর্দৃষ্টি সম্পর্কে যে ব্যক্তি গবেষণা করবেন, তিনি তাঁর উপলব্ধি ও গৃহীত সিদ্ধান্তগুলোর শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে জানতে সক্ষম হবেন। তবে এক্ষেত্রে তাঁর বক্তব্যের সূক্ষ্মতার কারণে তাঁরই মযহাবের অনেক ইমাম যারা বইপত্র লেখেন, তাঁদের পক্ষে তাঁকে বোঝাটা কষ্টসাধ্য হতে পারে; এর দরুন তাঁরা তাঁদের মযহাবের বাইরে অন্যান্য মানুষের গৃহীত অপরাপর দুর্বল পদ্ধতির প্রতি ঝুঁকতে পারেন। ইমাম সাহেব (রহ:)-এর কথা বোঝার বেলায় বহু বিচ্যুতি এ কারণেই দেখা দেয় এবং ওইসব ফকীহ (ফতোওয়াবিদ) তাঁর কথা ভুলভাবে ব্যাখ্যা করে থাকেন। হযরত ইমাম (রহ:)-এর মযহাবের শিক্ষার্থীদের জন্যে তাঁর প্রভাষণের সযত্ন বিশ্লেষণ ও উপলব্ধি ভিন্ন অন্য কোনো কিছু করারই প্রয়োজন নেই।

ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ:)-এর উপলব্ধি ও জ্ঞান হতে এমন অনেক বিষয় দেখা গিয়েছে যা সত্যি বিস্ময়কর। তা হবেই বা না কেন যখন সাহাবা-এ-কেরাম (রা:) ও তাঁদের উত্তরসূরীবৃন্দ (রহ:) যাবতীয় বিষয় সম্পর্কে যতো কথা বলেছিলেন, তার সবই তিনি জানতে ও বুঝতে পেরেছিলেন এবং তিনি সেসব বিষয়ের মূল চিনতে পেরে উপলব্ধিও করেছিলেন? একইভাবে বুঝেছিলেন সর্ব-ইমাম মালেক (রহ:), আল-আওযাঈ (রহ:), আস্ সাওরী (রহ:) প্রমুখের মতো  সকল অঞ্চল ও রাজ্যের ফক্বীহ ও ইমামবৃন্দের বাণীও। এঁদের সবার (ইসলামী) জ্ঞানপ্রসূত ফতোওয়াসমূহ তাঁর সামনে পড়ে শোনানো হয়েছিল। তিনি তাঁর সিদ্ধান্ত (সে মোতাবেক) প্রদান করেন, কখনো ঐকমত্য পোষণ করে, কখনো বা দ্বিমত পোষণ করে। বস্তুতঃ ইমাম মুহান্না বিন ইয়াহইয়া বিন মনসূর (রহ:) তাঁর সামনে ইমাম সুফিয়ান সাওরী (রহ:)-এর সমস্ত ফিক্বহী বিষয় তথা ফতোওয়া পড়ে শোনান, আর তিনি এব্যাপারে তাঁর ফিক্বহী সিদ্ধান্ত দেন। (ফকীহদের) একটি দল তাঁর সামনে ইমাম মালেক (রহ:)-এর ‘মুওয়াত্তা’ ও অন্যান্য গ্রন্থ হতে বিভিন্ন বিষয় ও তাঁরই শরয়ী ফায়সালা (ফতোওয়া) পড়ে শোনান, আর ইমাম আহমদ (রহ:) তাঁর নিজস্ব রায় দেন [এটা ইমাম হাম্বল (রহ:) ও অন্যান্যরা বর্ণনা করেন - অনুবাদক মূসা ফার্বার]। ইমাম সাওরী (রহ:)-এর সমস্ত বিষয় হযরত এসহাক্ক বিন মনসূর তাঁর সামনে পড়ে শোনান, আর তিনি সেগুলোর ব্যাপারেও সিদ্ধান্ত দেন। প্রাথমিক পর্যায়ে ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ:) ইমাম আবূ হানিফা (রহ:)-এর শিষ্যদের বইপত্র পাঠ করে সেগুলো অনুধাবন করেন, ফেকাহ-বিষয়ে সেগুলোর পদ্ধতি ও অন্তর্নিহিত জ্ঞান-ও অনুধাবন করেন। তিনি ইমাম শাফেঈ (রহ:)-এর সাথে বিতর্ক-ও করেন এবং বেশ কিছু সময় তাঁর সাথে বসে তাঁরই কাছ থেকে পাঠগ্রহণ করেন।

ইমাম শাফেঈ (রহ:)  সেসময় ফেকাহ ও ইসলামী জ্ঞানে ওইসব বড় বড় বিষয় প্রত্যক্ষ করেছিলেন; পক্ষান্তরে, ইমাম আহমদ (রহ:) ছিলেন স্রেফ এক যুবক যিনি তখনো জীবনের তুঙ্গে ওঠেননি।

এটা একটা জ্ঞাত ব্যাপার, যে ব্যক্তি এসব বিদ্যা শিক্ষা করেছেন এবং তাতে পাণ্ডিত্য-ও অর্জন করেছেন, তিনি নিখুঁতভাবে শেখা এসব মৌলনীতি ও ভালোভাবে জানা পদ্ধতিগুলোর ভিত্তিতে নতুন বিষয়গুলো সম্পর্কেও জানবেন এবং সেগুলো সম্পর্কে সিদ্ধান্ত-ও দিতে পারবেন। এ কারণে ইমাম আবূ সাওর (রহ:) বলেন, “ইমাম আহমদ (রহ:)-কে যখন-ই কোনো বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হতো, তখন (মনে হতো) যেন দুনিয়ার সমস্ত জ্ঞান তাঁরই দুচোখের সামনে কোনো তক্তার ওপর (লেখা) হয়েছে” (কিংবা যেভাবেই এ কথা বলা হয়েছিল)। [আমি ইমাম আবূ সাওর হতে এ উদ্ধৃতি বা অনুরূপ কিছু কোথাও খুঁজে পাইনি, এমন কি তাতেও নেই যেখানে লেখক ইমাম ইবনে রাজাব “শরহে ‘এলাল” গ্রন্থে ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ:)-এর সংক্ষিপ্ত জীবনী তুলে ধরেছেন। ইমাম ইবনে রাজাব স্বয়ং যোগ করেন “কিংবা যেভাবেই এ কথা বলা হয়েছিল”, যার দরুন তিনি বুঝিয়েছেন যে এই ভাষণের শব্দচয়নের ব্যাপারে তাঁর প্রশ্ন ছিল, কিন্তু স্বয়ং বক্তব্যটির সত্যতার ব্যাপারে নয়। ইমাম আবূ সাওর (রহ:) ইমাম আহমদ (রহ:)-কে “আমাদের ইমাম” বলে সম্বোধন করেছিলেন। - অনুবাদক মূসা ফার্বারের নোট]

মহানবী (দ:)-এর এমন কোনো নির্ভরযোগ্য সুন্নাহ’র কথা আমরা জানি না যেটা ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ:)-এর জ্ঞানের পরিধির বাইরে ছিল। সহীহ বা বিশুদ্ধ হলে এবং এর পরিপন্থী শক্তিশালী কোনো দলিল না থাকলে তিনি সেই সুন্নাহ পালনে ছিলেন বদ্ধপরিকর। বস্তুতঃ তিনি তখন-ই কোনো রেওয়ায়াত পরিহার করতেন, যখন তা নির্ভরযোগ্য হতো না, কিংবা যখন তার বিপক্ষে শক্তিশালী দলিল থাকতো।

পূর্বসূরীদের সময়কাল নবুওয়্যতের কাছাকাছি জমানায় হওয়ার কারণে এবং তাঁদের দ্বারা সাহাবা-এ-কেরাম (রা:), তাঁদের উত্তরসূরী ও উত্তরসূরীদের পরবর্তী প্রজন্মের বাণী অন্বেষণের ফলে তাঁরা অনুশীলিত নয় এমন অপছন্দনীয় হাদীসগুলোর বিষয়ে সম্যক অবহিত ছিলেন। তাঁরা তাই সেগুলো এড়িয়ে তাঁদের পূর্ববর্তী (মানে সাহাবা, তাবেঈন, তাবে’ তাবেঈনবৃন্দ)-দের চর্চা জারি রাখতেই রাজি ছিলেন। এক্ষেত্রে তাঁরা (সরাসরি অভিজ্ঞতার আলোকে) সুন্নাহ-ভিত্তিক বিষয়গুলো সম্পর্কে জেনেছিলেন, যা তাঁদের পরে আগত প্রজন্মগুলো উৎস হতে সময়ের দূরত্বের কারণে হাদীসের বইপত্র পড়েই কেবল পরোক্ষভাবে জানতে পেরেছেন।

শিক্ষার্থীদের প্রতি উপদেশ

ওহে ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ:)-এর মযহাবের শিক্ষার্থী সকল! তোমরা ওপরে উপস্থাপিত ভাষ্য একবার বুঝতে ও আত্মস্থ করতে পারলে তোমাদের জন্যে নিম্নের এই উপদেশ বিহিত। আমি তোমাদেরকে এ খেদমত আঞ্জাম দিচ্ছি একমাত্র আল্লাহতা’লার সন্তুষ্টি অর্জনের খাতিরেই। কেননা, (হাদীসে বর্ণিত হয়েছে),

لَا يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ حَتَّى يُحِبَّ لِأَخِيهِ مَا يُحِبُّ لِنَفْسِهِ

অর্থ: “তোমাদের মধ্যে কেউই ঈমানদার হতে পারবে না, যতোক্ষণ না সে নিজের জন্যে যা পছন্দ করে তার (দ্বীনী) ভাইয়ের জন্যেও তা-ই পছন্দ করে।” [দেখুন সহীহ বুখারী, # ১২; সহীহ মুসলিম, # ৪৫; ইমাম আহমদ বিন হাম্বল কৃত ‘আল-মুসনাদ’, ৩:১৭৬, ২০৬, ২০১, ২৭২, ২৭৮, ২৮৯ - অনুবাদক মূসা ফার্বারের নোট]  
          
এক মুহূর্তের তরেও এ কথা বিশ্বাস করো না যে তোমরা এমন বিষয় উপলব্ধি করতে পেরেছো যা এই মহান ইমাম সাহেব (রহ:) জানতেন না বা বুঝতেন না; (কেননা) তিনি এমনই একজন (বিদ্বান) যাঁকে তাঁর পরবর্তীকালে আগত সবচেয়ে জ্ঞানী-গুণীজনদেরও শীর্ষে তুলে ধরা হয়েছে। অতএব, জ্ঞানের সকল বিষয়ে তাঁর ভাষ্য উপলব্ধি করার সর্বাত্মক চেষ্টা করবে, (স্রেফ) ইসলাম ধর্মের বিষয়গুলো (হালাল ও হারাম) নিয়ে ব্যাপৃত থাকবে না।

আকায়েদ তথা আকীদা-বিশ্বাসসস্পর্কিত বিদ্যাটিকে (যথা - আল্লাহতে বিশ্বাস, তাঁর ফেরেশতামণ্ডলী, আসমানী কেতাবসমূহ, পয়গম্বরবৃন্দ এবং শেষ বিচার দিবস ইত্যাদিতে বিশ্বাস) অনেক আলেম-উলামার অনুসৃত নামকরণপদ্ধতি অনুযায়ী বলা হয় “সুন্নাহ-বিষয়ক জ্ঞান।” বস্তুতঃ ইমাম সাহেব (রহ:) ছিলেন ওই বিদ্যার সর্বোচ্চ শিখরে অধিষ্ঠিত। তাঁর এসব বিষয়ে জ্ঞানের কারণে তাঁকে নির্যাতনের শিকারে পরিণত করা হয়, আর ওই নিপীড়নের সময় তিনি আল্লাহরই খাতিরে ধৈর্য ধারণ করেন। তিনি যে অবস্থান গ্রহণ করেন তাতে সকল মুসলমান-ই রাজি ছিলেন। তাঁরা সাক্ষ্য দেন যে তিনি সুন্নাহেরই ইমাম, আর তিনি না (আবির্ভূত) হলে মানুষেরা অবিশ্বাসী হয়ে যেতো। সুন্নাহের জ্ঞানে যিনি এরকম উচ্চ মর্যাদার অধিকারী, তাঁর কাছ থেকে গ্রহণের পরিবর্তে অন্য কোনো আলেমের কাছ থেকে তা গ্রহণের চেষ্টা কতোটুকু প্রয়োজনীয় হতে পারে, বিশেষ করে তাঁরই মযহাবের অনুসারীদের পক্ষে?

অতএব, এই বিষয়াধীন সব কিছুতেই হযরত ইমাম (রহ:)-এর বাণীকে শক্তভাবে আঁকড়ে ধরো! আর অনর্থক নতুন বিষয়গুলো হতে মুখ ফিরিয়ে নাও! মুসলমানদের এসব বিষয়ে কাজ নেই। বস্তুতঃ এটা উপকারী জ্ঞান থেকে ফিরিয়ে রাখে, মুসলমানদের মধ্যে পারস্পরিক হিংসা-বিদ্বেষের জন্ম দেয়, আর এ পার্থিব জীবনে বিস্তর তর্ক-বিতর্কেরও সৃষ্টি হয়, যা ইমাম সাহেব (রহ:) ও পূর্বসূরী অন্যান্য ইমামের (রা:) মতানুযায়ী নিষিদ্ধ।

অনুরূপভাবে, এহসান-শাস্ত্র যেটা (আল্লাহর সামনে অন্তরে) সদা হাযের/উপস্থিত ও বিনয়সংক্রান্ত বিদ্যা, তাতেও হযরত ইমাম (রহ:) ছিলেন সর্বোচ্চ শিখরে - ঠিক যেমনটি তিনি ছিলেন ইসলাম ঈমানের ক্ষেত্রে এক খোদায়ী আয়াত (নিদর্শন)। তবে এক্ষেত্রে তিনি ছিলেন কাজে বিশ্বাসী, রূহানী হাল তথা আধ্যাত্মিক অবস্থাগুলো সম্পর্কে প্রাঞ্জল ভাষায় বর্ণনা দেয়ার কেউ ছিলেন না তিনি। এরই দরুন তিনি পূর্বসূরীদের (সালাফ আস্ সালেহীনের) প্রতি যা আরোপিত হয়েছিল, কেবল তা-ই আওড়েছিলেন; খালাফ তথা উত্তরসূরীবৃন্দ যা প্রবর্তন করেন, তা বলেননি। তাঁর চর্চিত সকল বিদ্যার শাখায়, বিশেষ করে ঈমানএহসান-শাস্ত্রে, তিনি সুন্নাহ দ্বারা তাঁর বক্তব্যকে সমর্থন করেন, আর পূর্বসূরীবৃন্দ যে অভিমত ব্যক্ত করেননি, তা উচ্চারণ করাকেও পছন্দ করেননি।

ইসলাম ধর্মসম্পর্কিত জ্ঞানে ইতিপূর্বে আলোচিত হয়নি অথচ জরুরি বিভিন্ন নতুন বিষয়ের জবাব ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ:) দিয়েছেন, যদিও তিনি তাঁর শিষ্যদেরকে দলিল না থাকলে কোনো বিষয়ে কথা বলতে বারণ করেছিলেন। সাধারণতঃ তিনি এমন সব বিষয়ে জবাব দিতেন যেগুলো ইতিপূর্বে আলোচিত হয়েছিল; যেগুলো ছিল প্রয়োজনীয়, (প্রকৃতপ্রস্তাবেই) যেগুলোর সংঘটিত হওয়ার নজির ছিল এবং যেগুলোর কোনো জ্ঞাত সিদ্ধান্ত (রায়) বিদ্যমান ছিল। অার যেসব বিষয় ফেক্বাহবিদমণ্ডলী প্রবর্তন করেছিলেন কিন্তু কদাচিৎ ঘটেছিল, যদি আদৌ কখনো ঘটে থাকে, সেগুলোর প্রতি জবাব দেয়ার ব্যাপারে হযরত ইমাম (রহ:) ঘনঘন বারণ করেছিলেন; কেননা এগুলো সামান্য-ই উপকারী ছিল এবং যা যা জানা অবশ্যকর্তব্য  ও জরুরি, তা থেকে এগুলো মানুষকে অন্যমনস্ক করেছিল।

ইমাম সাহেব (রহ:) অতিমাত্রায় তর্ক-বিতর্ককে পছন্দ করেননি; যে কারো দ্বারা জ্ঞান, উপলব্ধি ও হাল তথা অবস্থার ব্যাপারে কোনো কথা বলার ক্ষেত্রে তা পুনরাবৃত্তির সুযোগ তিনি দেননি। বস্তুতঃ তিনি সুন্নাহ ও সাহাবা-এ-কেরাম (রা:)-এর বর্ণনার প্রতি রাজি ছিলেন, আর দীর্ঘ বাক্যব্যয় ব্যতিরেকে সেগুলোর অর্থ উপলব্ধির প্রতি তাকিদ দিয়েছিলেন। তিনি কথা বলা থেকে বিরত ছিলেন অক্ষমতা বা অজ্ঞতার কারণে নয়, বরঞ্চ বিবেক, প্রখর ধীশক্তি ও সুন্নাহের প্রতি রাজি থাকার কারণেই। বাস্তবিক-ই সুন্নাহ ও পুণ্যবান পূর্বসূরী হযরতে সাহাবা-এ-কেরাম (রা:) এবং তাঁদের উত্তরসূরীদেরকে অনুসরণ করাটা একটা সম্পূর্ণতা বটে; আর হেদায়াত তথা সঠিক পথপ্রাপ্তি তো তাঁদেরকে অনুসরণ করেই অর্জিত হয়।

(ওহে শিক্ষার্থীবর্গ), তোমরা যদি এই উপদেশ গ্রহণ করো এবং সঠিক রাস্তা অনুসরণ করো, তবে আল-কুরআন ও সুন্নাহ (আহাদীস) হেফয তথা মুখস্থের মাধ্যমে তোমাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা পূরণ করো; অতঃপর (পুণ্যবান) পূর্বসূরীবৃন্দ ও এই উম্মাহ’র ইমামমণ্ডলীর প্রদত্ত ভাষ্যের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ এতদসংক্রান্ত অর্থগুলোর সাথে পরিচিত হও। এরপর সাহাবায়ে কেরাম (রা:) ও তাঁদের উত্তরসূরীদের (রহ:) শরয়ী সিদ্ধান্ত এবং বিভিন্ন অঞ্চলের ইমামবৃন্দের ফতোওয়াগুলো মুখস্থ করে নাও; আর ইমাম আহমদ বিন হাম্বল (রহ:)-এর বাণী হুবহু মুখস্থের মাধ্যমে তাঁরই ব্যাখ্যাকৃত অর্থসহ জেনে, তাঁরই জ্ঞান ও উপলব্ধির অনুসরণে নিষ্পত্তিকারক যুক্তির অবতারণা করো। [এই প্যারাগ্রাফের আগের প্যারাগ্রাফটি ছিল ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ:)-এর সময়কালকে ঘিরে। কিন্তু এটা ইমাম ইবনে রাজাবের সময়কাল সংক্রান্ত। এই দ্বিতীয় প্যারাগ্রাফটি ভিন্নতর, কেননা এটা পরবর্তী যুগগুলোতে ইমাম আহমদ (রহ:)-এর পদ্ধতির সম্প্রসারণকে নির্দেশ করেছে। আল্লাহতা’লাই সবচেয়ে ভালো জানেন। - অনুবাদক মূসা ফার্বারের নোট]

 এসব বিষয়ে তোমরা যদি উচ্চ শিখরে আরোহণ করো, তাহলে মনে করো না যে তোমরা সবকিছুর শেষপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছো; বাস্তবে তোমরা হলে অনেক শিক্ষার্থীর মাঝে একজনের মতোই; আর যদি তোমরা ইমাম আহমদ (রহ:)-এর যুগে আবির্ভূত হতে, তাহলে তোমাদেরকে শিক্ষার্থীদের ভিড়ে গণনা-ই করা হতো না। এরপরও তোমরা নিজেরা যদি নিশ্চিত হও যে তোমাদের (শিক্ষাগ্রহণ) সমাপ্ত হয়েছে, কিংবা পূর্বসূরীবৃন্দ যেখানে পৌঁছেছিলেন সেখানে তোমরা পৌঁছে গিয়েছো, তাহলে তোমরা সত্যি মহাভ্রান্তিতে পতিত হয়েছো।

ওপরে উল্লেখিত বিভিন্ন বিদ্যাশাস্ত্র হেফয তথা মুখস্থকরণ এবং শাস্ত্রলিপি ও নির্ভরযোগ্য বর্ণনাগুলো নিখুঁতভাবে রপ্ত করার ক্ষেত্রে অবহেলা করো না; আর অধিক তর্ক-বিতর্কে বিক্ষিপ্তচিত্ত হয়ো না, যে কারো কথা পুনরাবৃত্তি-ও করো না; তোমাদের মস্তিষ্কের মর্জি-মাফিক কিছু ভাষ্যকে অন্যগুলোর ওপর প্রাধান্য দিও না, যদিও বাস্তবতা হলো তোমরা জানো না কারা ওই উক্তিগুলো করেছে এবং তারা কি মূল্যবান বাণীর ধারক ও বাহক (পুণ্যবান) পূর্বসূরীবৃন্দের মধ্য হতে আবির্ভূত হয়েছে, না-কি গোমরাহ-পথভ্রষ্টদের মধ্য হতে।

আল্লাহর কেতাব (আল-কুরআন) কিংবা রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর কোনো হাদীস সম্পর্কে (পুণ্যবান) পূর্বসূরীবৃন্দ যা বলেছেন, তার অন্যথা কোনো কথা বলার দুঃসাহস দেখিও না, ঠিক তোমাদেরই ইমাম সাহেব (রহ:) যেমনটি নির্দেশ দিয়েছেন; নচেৎ উপকারী জ্ঞান তোমাদেরকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে পারে এবং তোমাদের দিনগুলো-ও বরবাদ হতে পারে। বস্তুত উপকারী জ্ঞান হচ্ছে অন্তরের গভীরে স্থাপিত এবং তা মহানবী (দ:) ও পুণ্যবান পূর্বসূরীবৃন্দ হতে প্রাপ্ত; ওই উপকারী জ্ঞান “তোমার মতামত কী?” কিংবা “এই হলো আমার মতামত” এসব কথার ওপর নির্ভরশীল নয়। হযরতে সাহাবা-এ-কেরাম (রা:) ও তাঁদের উত্তরসূরীমণ্ডলী যাঁদেরকে অনুসরণ করা হলে হেদায়াত পাওয়া যায়, তাঁরা এটা (এ ধরনের মতামত গ্রহণ) নিষেধ করেছিলেন। কোনো (মুজতাহিদ) ইমামের আনুগত্য করার পক্ষে তোমাদের দাবি কীভাবে নির্ভরযোগ্য হতে পারে, যখন তোমরা তাঁর সাথে নিরন্তর দ্বিমত পোষণ করে চলেছো, আর তাঁরই বিদ্যা, আমল (কর্ম) ও মযহাব হতে পালিয়ে বেড়াচ্ছো?

জেনে রাখো (আল্লাহ তোমাদের হেদায়াত দিন), যখন তোমরা এ পথের ওপর পরিচালিত হবে, যা আল্লাহর কাছে পৌঁছুনোর সঠিক মাধ্যম, আর যখন তোমরা তাক্বওয়া (খোদাভীরুতা) অনুশীলন করবে এবং পূর্ববর্তী ইমামবৃন্দের আহওয়াল তথা আধ্যাত্মিক অবস্থাগুলোর দিকে উত্তম ফলাফল লাভের প্রত্যাশায় প্রতিনিয়ত লক্ষ্য রাখবে, এমতাবস্থায় আল্লাহতা’লা ও তাঁর ঐশী বিধানসম্পর্কিত তোমাদের জ্ঞান-প্রজ্ঞা (আধ্যাত্মিক দর্শনক্ষমতা) বৃদ্ধি পাবে। তোমাদের নফস (একগুঁয়ে সত্তা)-কে খাটো এবং দমন করার সামর্থ্য-ও বৃদ্ধি পাবে। উপরন্তু, তোমাদের আপন সত্তার কাছ থেকেও এমন জিনিস পাবে যা তোমাদেরকে মুসলমানদের সাথে দ্বন্দ্ব-সংঘাতে জড়ানো হতে বিরত রাখার ক্ষেত্রে ব্যস্ত রাখবে।

সকল কিসিমের ঈমানদারকে তোমরা এমনভাবে বিচার করবে না যেন তোমাদেরকে যে জ্ঞান প্রদান করা হয়েছে তা তাঁদেরকে দেয়া হয়নি, অথবা তোমরা যে হালত তথা (আধ্যাত্মিক) অবস্থায় উন্নীত হয়েছো, তাতে তাঁরা উন্নীত হননি। আল্লাহতা’লা সে ব্যক্তির প্রতি করুণা বর্ষণ করেন যিনি নিজের জ্ঞান, আমল ও হাল-অবস্থাকে নিম্ন পর্যায়ের ভাবেন এবং পূর্বসূরীবৃন্দকে সেরা জ্ঞান করেন; যিনি জানেন ঘাটতি তাঁরই এবং পূর্ণতা পূর্বসূরীদেরই; যিনি (চার মযহাবের) ইমামমণ্ডলীকে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেন না, বিশেষ করে ইমাম আহমদ বিন হাম্বল (রহ:)-এর অনুসারী হওয়ার দাবি করে তাঁকেই আক্রমণ করেন না।

(ওহে শিক্ষার্থীবর্গ), তোমরা এই বিশ্বস্ত উপদেশ প্রত্যাখ্যান করলে এবং বিতর্ক ও বিরোধের পথ গ্রহণ করলে, আর অন্যদের প্রতি ‘তাশাদ্দুক্ব’ তথা মানহানিকর কথাবার্তা বলার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করলে এবং ‘তাফায়হুক্ব’ তথা উদ্ধত ও দাম্ভিক আচরণ করলে, আর মুখে ‘শিক্বশিক্বাত আল-কালাম’ তথা হেয় প্রতিপন্নকারী বাক্য [এটা ‘সুনানে তিরমিযী’ গ্রন্থের ২০১৮ নং হাসান পর্যায়ের হাদীসে বর্ণিত। - অনুবাদক মূসা ফার্বারের নোট] উচ্চারণ করলে - যে পর্যন্ত মুসলমান সমাজের ইমামমণ্ডলীর খণ্ডন এবং তাঁদের দোষচর্চা তোমাদের আসল কাজে পরিণত না হয় - এমতাবস্থায় তোমাদের আত্মাগুলো অতিমাত্রায় আত্মগর্ব দ্বারা ফুলে ওঠবে এবং দুনিয়ার বুকে অত্যাচার-নিপীড়নের প্রতি তোমাদের মায়া-ও বৃদ্ধি পাবে, আর সত্য থেকে তা তোমাদেরকে আরো দূরে সরিয়ে মিথ্যার কাছাকাছি নিয়ে যাবে। এমতাবস্থায় তোমরা জিজ্ঞেস করবে, “আমি যা ব্যক্ত করছি তা কেন বলতে পারবো না, যেখানে আমি-ই কথা বলার ও সিদ্ধান্ত নেয়ার বেলায় অন্য যে কারো চেয়ে বেশি যোগ্য? আমার চেয়ে আর কে বেশি জ্ঞানী (’আফক্বাহ’) আছে?” ঠিক যেমনটি হাদীস শরীফে উল্লেখিত হয়েছে। এই উম্মাহ’র মধ্যে জাহান্নামের ইন্ধন যে ব্যক্তি, কেবল সে-ই এ ধরনের কথা বলতে পারে!

আল্লাহ পাক তাঁর করুণা ও দয়া দ্বারা আমাদেরকে এই উপদেশ গ্রহণ করে তাঁরই প্রদত্ত বে-ইজ্জতী হতে রক্ষা করুন এবং আমাদেরকে সাফল্য-ও দান করুন (আমীন)।

কিন্তু যদি তোমরা এই ধারণার বশবর্তী হয়ে একগুঁয়ে মনোভাব গ্রহণ করো যে, জ্ঞান ও সমঝদারি (’আল-তাফাক্ক্বুহ’) হচ্ছে বিভিন্ন মতের উদ্ধৃতি দেয়া, চুল টেনে ছেঁড়া এবং তর্কাতর্কি করা, আর এই ধারণাও পোষণ করা যে এটা যে ব্যক্তি করতে পারে এবং (মযহাবের) ইমামমণ্ডলীর দোষত্রুটি খুঁজে বের করতে পারে, সে ওই ব্যক্তির চেয়ে সেরা যে তা পারে না, অথবা যে ব্যক্তির এব্যাপারে কোনো ভাষ্য নেই সে কিছুই জানে না, তাহলে আমরা তোমাদের বলবো:

এই আকীদা-বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করেই পথভ্রষ্ট কিছু দল মনে করেছিল যে খালাফ তথা পরবর্তী প্রজন্মের উলামাবৃন্দ সালাফ তথা পূর্ববর্তী প্রজন্মের উলামাদের চেয়ে বেশি জ্ঞানী, কেননা যে যা ব্যক্ত করেছিলেন তা অবিরত লিপিবদ্ধ করার ক্ষেত্রে খালাফ-বৃন্দ (পূর্ববর্তী সালাফদের সাথে) ভিন্নমত পোষণ করেছিলেন। আমরা আল্লাহরই ওয়াস্তে এধরনের (ভ্রান্ত) বক্তব্য হতে নিজেদেরকে দূরে সরিয়ে নিচ্ছি। যদি বাস্তবে তা-ই হতো, তবে মু’তাযেলা ও রাফেযী (শিয়া) গোষ্ঠীর ধর্মগুরুদের জ্ঞান এই উম্মতের সালাফবৃন্দ ও ইমামমণ্ডলীর চেয়েও বেশি হতো!

মু’তাযিলা গোষ্ঠীর আবদুল জাব্বার বিন আহমদ হামদানী ও অন্যান্য শায়খদের কথা চিন্তা করো, তাদের গভীর অনুসন্ধান, তর্ক-বিতর্ক এবং অসংখ্য মতের ছড়াছড়ি সম্পর্কেও চিন্তা করো; উপরন্তু অন্যান্য দলের কালাম-শাস্ত্রবিদদের যে কারো কথাও চিন্তা করো। ধর্মীয় ও ফেকাহর বিভিন্ন মযহাবের লেখকদের অবস্থাও তাই; তারা প্রতিটি বিষয়েই মাত্রাতিরিক্ত বাগাড়ম্বরপূর্ণ ছিল। অথচ তাদের নিজেদের ইমামবৃন্দ-ই এসব বিষয়ে কথা বলেননি কিংবা এমন বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেননি এবং বাগাড়ম্বরপূর্ণ আচরণ-ও করেননি। এমতাবস্থায় এ কথা বিশ্বাস করার কি কোনো অনুমতি আছে যে সর্ব-ইমাম সাঈদ বিন মুসাইয়্যেব (রা:), আল-হাসান (রা:), ’আতা’ (রা:), আল-নাখাঈ’ (রহ:), আস্ সাওরী (রহ:), আল-লায়েস্ (রহ:), আল-আওযাঈ (রহ:), মালেক (রহ:), আশ্ শাফেঈ (রহ:), আহমদ বিন হাম্বল (রহ:), এসহাক্ক (রহ:), আবূ উবায়েদ (রহ:)-এর মতো ইসলামের ইমামবৃন্দের চেয়ে তারা শ্রেষ্ঠ ছিল? বরঞ্চ সাহাবা-এ-কেরাম (রা:)-এর চেয়ে তাঁদের উত্তরসূরীবৃন্দ নিজেদের ব্যাখ্যামূলক বক্তব্যে মোটামুটি এগিয়ে ছিলেন। কিন্তু তাতে কি কোনো মুসলসান এমনটি বিশ্বাস করবেন যে বিদ্বান সাহাবা (রা:)-দের চেয়ে তাঁদের উত্তরসূরীবৃন্দ বেশি জ্ঞানী হয়ে গিয়েছিলেন?

ভেবে দেখো মহানবী (দ:)-এর সে হাদীসটি সম্পর্কে, যেখানে তিনি এরশাদ ফরমান:

الإِيمَانُ يَمَانٍ وَالْفِقْهُ يَمَانٍ وَالْحِكْمَةُ يَمَانِيَةٌ

অর্থ: “ঈমান ইয়েমেন হতে, উপলব্ধি-ও ইয়েমেন হতে, আর জ্ঞান-প্রজ্ঞাও ইয়েমেন হতে” [দেখুন আল-বুখারী, # ৪৩৮৮-৯০; সহীহ মুসলিম, # ৫২; আহমদ বিন হাম্বল, আল-মুসনাদ, ২:২৩৫, ২৫২, ২৫৬, ২৭০, ২৭৭, ২৭৮, ৩৭২, ৩৮০, ৪০৭, ৪২৬, ৪৫৭, ৪৭৪, ৪৮০, ৪৮৪, ৫৪৬ - অনুবাদক মূসা ফার্বারের নোট]। তিনি ইয়েমেনীদের ও তাঁদের গুণের প্রশংসায় এ কথা বলেছিলেন। তিনি সাক্ষ্য দিয়েছিলেন যে তাঁরা ঈমানদারী ও উপলব্ধির অধিকারী। তাঁরা ফেক্বাহ (উপলব্ধি), ঈমান (বিশ্বাস) ও হেকমত (জ্ঞান-প্রজ্ঞা) বিষয়ে সর্বোচ্চ পর্যায়ে উন্নীত হওয়ার কারণেই তিনি তাঁদের প্রতি এটা আরোপ করেছিলেন।

ইয়েমেনীদের চেয়ে স্বল্প-ভাষী ও স্বল্প-যুক্তিতর্ককারী আর কোনো মুসলিম পণ্ডিত-দলের কথা আমরা জানি না, হোন তাঁরা  সালাফ (পূর্বসূরী প্রজন্ম) কিংবা খালাফ (উত্তরসূরী প্রজন্ম)-এর মধ্য হতে। এটা ইঙ্গিত করে যে ঐশী বিধানদাতার ভাষায় প্রশংসিত জ্ঞান ও উপলব্ধি হচ্ছে আল্লাহতা’লারই জ্ঞান যা তাঁকে ভালোবাসতে, প্রশংসা করতে এবং সম্মান করতে পরিচালিত করে; এগুলো মৌলিক/অাবশ্যিক জ্ঞান, আল্লাহ পাকের আদেশ ও নিষেধের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। ঠিক যেমনটি ছিলেন নিম্নে উল্লেখিত অতীতকালের ইয়েমেনী বিদ্বানবৃন্দ: সর্ব-হযরত আবূ মূসা আশআরী (রা:), আবূ মুসলিম আল-খাওলানী (রা:), উয়াইস্ আল-করণী (রা:) প্রমুখ। তেমনটি তাঁরা ছিলেন না অন্যরা যা যুক্ত করেছিল, যথা - ইমামবৃন্দের কথা তালগোল পাকিয়ে এবং একত্রিত করে ঘনঘন তাঁদের গোপন দোষত্রুটি খুঁজে বের করার চেষ্টারত থাকা।

এটা সত্য যে অধিকাংশ ইমাম-ই ছোট-খাটো বিষয়ে (এজতেহাদী) ভুল করেছিলেন, যা তাঁদের মকাম (উচ্চমর্যাদা) ও জ্ঞানকে ম্লান করে না। এতে কী-ই বা এসে যায়? তাঁদের সততা, ত্রুটিহীনতার প্রাচুর্য, উদ্দেশ্যের মাহাত্ম্য ও দ্বীনকে সহায়তার সৎ গুণ দ্বারা ওই ভুল ঢাকা পড়ে গিয়েছিল।  

(মযহাবের) ইমামবৃন্দের ভুলত্রুটির স্বনিয়োজিত তদন্তকর্তা সেজে বসাটা প্রশংসনীয় কোনো কাজ নয়, আবার ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য-ও নয়; এটা বিশেষ করে প্রযোজ্য অসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে, যেখানে ভুল-ভ্রান্তি কোনো ক্ষতিসাধন-ই করে না, আর তাই তাঁদের ভুলত্রুটি খুঁজে বের করার মধ্যে কোনো ফায়দা বা উপকার-ই নিহিত নেই। এর অনুরূপ অবস্থা বিদ্যমান অধিক খোঁজাখুঁজির সেসব বাহুল্য বিদ্যায়, যেগুলো ধর্মীয় দিক থেকে উপকারী নয় এবং আল্লাহর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে তাঁরই যিকির (তথা স্মরণ) হতে অন্তরকে (পাথরের মতো) কঠিন করে দেয়, আর মানুষের ওপর মর্যাদা ও নেতৃত্ব লাভের মায়া জাগিয়ে তোলে। এগুলোর কোনোটাই প্রশংসাযোগ্য নয়। রাসূলুল্লাহ (দ:) সবসময় ফায়দাহীন জ্ঞান হতে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাইতেন:

اللهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنْ عِلْمٍ لَا يَنْفَعُ

[দেখুন সহীহ মুসলিম, # ২৭২২; আহমদ ইবনে হাম্বল কৃত আল-মুসনাদ, ২:১৬৭, ৪৫১, ৩:১৯২, ৪:৩৭১ - অনুবাদক মূসা ফার্বারের নোট]। তিনি এরশাদ ফরমান, “উপকারী জ্ঞানের জন্যে (আল্লাহর দরবারে) প্রার্থনা করবে, আর উপকারী নয় এমন জ্ঞানের ক্ষেত্রে (তাঁর কাছে) আশ্রয় চাইবে” [দেখুন মুহাম্মদ ইবনে মাজাহ প্রণীত সুনানে ইবনে মাজাহ, ২য় খণ্ড, দারুল ফিকর, বৈরুত, তারিখবিহীন, #৩৮৪৩ - অনুবাদক মূসা ফার্বারের নোট]।    

মহানবী (দ:) এরশাদ ফরমান,

سَلُوا اللهَّ عِلْمًا نَافِعًا، وَتَعَوَّذُوا بِاللهِ مِنْ عِلْمٍ لَا يَنْفَعُ

অর্থ: “নিশ্চয় এক ধরনের জ্ঞান আছে যা (স্রেফ) অজ্ঞতা” [দেখুন আবূ দাউদ সাজেস্তানী লিখিত সুনানে আবি দাউদ, ২য় খণ্ড, দারুল ফিকর, বৈরুত, ১৯৯০ খৃষ্টাব্দ, #৫০১২; আহমদ ইবনে আলী ইবনে হাজর আসকালানী কৃত ফাতহুল বারী শরহে সহীহ আল-বুখারী, ১৩তম খণ্ড, দারুল মা’রেফাত লিল তিবা’আহ, বৈরুত, ২য় সংস্করণ, ৯:২০৩; এবং মুহাম্মদ ইবনে ইসমাঈল আল-বুখারী আহমদ ইবনে আলী ইবনে হাজর আসকালানী প্রণীত ফাতহুল বারী বি-শরহে সহীহ আল-বুখারী, ১৪তম খণ্ড, মাকতাবাত আল-সালাফিয়্যা, কায়রো, ১৯৭০ খৃষ্টাব্দ, ৯:২০৩ - অনুবাদক মূসা ফার্বারের নোট]। তিনি ঘনঘন ও দীর্ঘ বাক্যব্যয় পছন্দ করতেন না, বরং সংক্ষিপ্ত কথাবার্তা পছন্দ করতেন। এ বিষয়ে অনেক হাদীস আছে (যেমন - وَإِنَّ مِنَ الْعِلْمِ جَهْلًا - নিশ্চয় এক ধরনের জ্ঞান আছে যা স্রেফ অজ্ঞতা - আবূ দাউদ, আস্ সুনান, ৪:৩০৩, হাদীস নং ৫০১২)। এখানে সেগুলো উল্লেখ করলে (পুস্তিকার) কলেবর বৃদ্ধি পাবে।

একই অবস্থা বিরাজমান হবে যদি কেউ বেদআতীদের কথাকে খণ্ডন করতে একই ধরনের কথা বলে, অথবা সাদৃশ্যপূর্ণ যুক্তি-প্রমাণের অবতারণা করে। ইমাম আহমদ (রহ:) ও মুহাদ্দেসীন-এ-কেরাম (যেমন সর্ব-ইমাম ইয়াহইয়া আল-কাত্তান, ইবনে মাহদী প্রমুখ) এটা অপছন্দ করতেন। তাঁরা শুধু আল-কুরআন ও সুন্নাহ এবং লভ্য হলে পূর্ববর্তী ইমামবৃন্দের বাণী দ্বারাই বেদআতীদের খণ্ডনকে বিবেচনায় নিতেন। নতুবা নিশ্চুপ থাকাই তাঁদের বিচারে অধিকতর নিরাপদ ছিল।

হযরত (আবদুল্লাহ) ইবনে মুবারক (রহ:) ও অন্যান্য ইমামমণ্ডলী বলতেন, “আমাদের দৃষ্টিতে আহলুস্ সুন্নাহ সেসব লোক নয়, যারা খামখেয়ালিপূর্ণ আচরণকারীদের রদ করে থাকে, বরঞ্চ সেসব মানুষ-ই যাঁরা ওদের ব্যাপারে নিশ্চুপ থাকেন।” হযরত ইবনে মুবারক (রহ:) তীব্র না-রাজি হতেই এ কথাটি বলেছিলেন, যখন খামখেয়ালিপূর্ণ আচরণকারী লোকেরা মহানবী (দ:)-এর নিয়ে আসা জ্ঞান এবং এরই ফলশ্রুতিতে অর্জিত ধর্মীয় অনুশীলন হতে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। বস্তুতঃ এটাই যথেষ্ট। আর কারো ক্ষেত্রে এটা যদি পর্যাপ্ত না হয়, তাহলে আল্লাহতা’লা তাকে কখনোই পর্যাপ্ত না দিন!

আমি এ পুস্তিকায় যা যা উল্লেখ করলাম, জানি তর্ক-বিতর্ককারী লোকেরা তার কঠোর সমালোচনা ও প্রতিবাদ করবে। কিন্তু সত্যের যখন উদয় হয়, তখন তাকে অনুসরণ করা আবশ্যক হয় এবং তার সাথে বিভেদ সৃষ্টিকারী, বিতর্ককারী ও উস্কানিদাতাদের পরিত্যাগ করাও জরুরি হয়ে পড়ে।

এ থেকে জানা যায় যে ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ:) ও তাঁর মযহাবের অনুসারী ইমামবৃন্দের জ্ঞান এই উম্মতের মাঝে সেরা বিদ্যাচর্চা, আর আল্লাহতা’লা যাঁকে সত্য পথের দিকে হেদায়াত দেন তাঁর জন্যে এতে নিহিত রয়েছে এক পূর্ণতা।

مَن لَّمْ يَجْعَلِ ٱللَّهُ لَهُ نُوراً فَمَا لَهُ مِن نُورٍ

অর্থ: “এবং আল্লাহ যাকে নূর (আলো) দান করেন না, তার জন্যে কোথাও আলো নেই।” [আল-কুরআন, ২৪:৪০, মুফতী আহমদ এয়ার খান সাহেব কৃত নূরুল এরফান বাংলা সংস্করণ]

                                         *সমাপ্ত*
  

অনুবাদক পরিচিতি   

জনাব মূসা ফার্বার ফতোওয়া প্রদানের যোগ্যতাপ্রাপ্ত। তিনি এই সনদ লাভ করেন মিসরের দারুল ইফতা মিসরিয়্যা প্রতিষ্ঠানের শায়খবৃন্দের কাছে, যাঁদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত মিসরীয় গ্র্যান্ড মুফতী (আলী জুমুআহ)। তিনি ১৫ বছরেরও অধিক সময় যাবৎ দামেশক, কায়রো ও অন্যান্য এলাকার অসংখ্য আলেমের অধীনে সুন্নী ইসলামী বিদ্যাশাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। এছাড়াও তিনি পোর্টল্যান্ড স্টেট ইউনিভারসিটি হতে ফলিত ভাষাতত্ত্ব বিষয়ে বি,এ, ডিগ্রী এবং দুবাই স্কুল অফ গভর্মেন্ট হতে এম,পি,এ, সনদ লাভ করেন। বর্তমানে তিনি সংযুক্ত আরব আমীরাতের আবূধাবীতে বসবাস করছেন।
            

   



     

বৃহস্পতিবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৫

ঈদে মীলাদুন্নবী (দ:)-সম্পর্কিত ভ্রান্ত ধারণা ও ভুল বোঝাবুঝি

মূল: ইমাম সাঈদ সোহরাওয়ার্দী, ইসলামিক সুপ্রিম কাউন্সিল কানাডা
অনুবাদ: কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন

[Bengali translation of Islamic Supreme Council Canada's Online article "Misconceptions and Misunderstandings about Eid Milad-un-Nabi"]

মহান প্রভু আল্লাহর নামে আরম্ভ, যিনি দয়ালু ও দাতা।

ঈদে মীলাদুন্নবী (দ:)-সম্পর্কিত ভ্রান্ত ধারণা ও ভুল বোঝাবুঝি 

বেশ কিছুদিন যাবত ইসলাম-আতঙ্কে আক্রান্ত একটি গোষ্ঠী ইসলাম সম্পর্কে নেতিবাচক এক ধারণা তৈরির অপচেষ্টায় সক্রিয় রয়েছে। তারা আমাদের মহানবী (দ:) ও কুরআন মজীদকে গালমন্দ করে থাকে এবং মানুষকে বিভ্রান্ত করতে চায়। মহানবী (দ:)-এর প্রতি মিথ্যে অপবাদ দিয়ে তাঁকে আক্রমণ করে থাকে এই চক্র। তাই এসময় মুসলমানদের জন্যে একতাবদ্ধ হওয়া এবং বিদ্বেষ প্রচারকারীদেরকে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রত্যুত্তর দেয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক বাস্তবতা হলো, বর্তমানে মুসলমান সমাজ বহুধা বিভক্ত, এমন কি সেসব আকীদা-বিশ্বাস ও আচার-অনুষ্ঠান অনুশীলনের ব্যাপারেও, যেগুলো নিয়ে বিগত ১৩ শতকেরও অধিক সময়ে সমগ্র মুসলিম বিশ্বের কেউই বিরোধিতা করেননি। মুসলিম উম্মাহ’র মৌলিক বিষয়গুলো নিয়ে ভাবার পরিবর্তে আমরা সেসব বিষয় নিয়ে একে অপরের বিরুদ্ধে সময় ও সম্পদ অপচয় করছি, যেগুলো কখনোই কোনো বিতর্কের বিষয় ছিল না। প্রতি বছর রবিউল আউয়াল মাস এলে রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর পবিত্র বেলাদত তথা ধরাধামে শুভাগমন দিবস ঈদে মীলাদুন্নবী (দ:)-এর বিরুদ্ধে সবচেয়ে অনর্থক ও বিভ্রান্তিকর একটি অপপ্রচার অভিযানের সূচনা হয়। কী পণ্ডশ্রম!

বেদআত (ধর্মে নতুন প্রথা প্রবর্তন)

মীলাদুন্নবী (দ:)-এর বিরোধীরা অপযুক্তি প্রদর্শন করে থাকে যে মহানবী (দ:) নিজে এবং তাঁর সাহাবা-এ-কেরাম (রা:) তাঁর মীলাদ দিবস পালন করেননি। তাদের মতে, এটি ইসলামে একটি নতুন সংযোজন এবং রাসূল (দ:) ইসলামে নতুন কিছু পরিবেশন নিষেধ করেছেন। ইসলামে নতুন কোনো কিছু সন্নিবেশিত করাই বেদআত। বিরোধীদের মতানুযায়ী, হুযূর পাক (দ:) কিংবা তাঁর সাহাবী (রা:)-বৃন্দ মীলাদ দিবস পালন করেননি; তাই এই বেদআত বর্জনীয়। তাদের দৃষ্টিতে এটি পাপও।

ঈদে মীলাদুন্নবী (দ:)-এর বিরুদ্ধে ফতোওয়ার প্রকৃতি 

বস্তুতঃ ঈদে মীলাদুন্নবী (দ:) উদযাপনকে নিষেধকারী কোনো কুরআনের আয়াত কিংবা হাদীস শরীফ নেই। কিন্তু এর বিরোধিতাকারী লোকেরা উক্ত দুটি শরীয়তের উৎস থেকে অনেক উদ্ধৃতি দেয়; স্বল্প জ্ঞানী মুসলমানদের সামনে ভাবখানা যেন এই যে মীলাদুন্নবী (দ:) উদযাপন প্রকৃতপ্রস্তাবেই নিষিদ্ধ। তারা কুরঅান-হাদীসের অর্থ বিকৃত করে নিজেদের একপেশে মতামত তাতে সন্নিবেশিত করে থাকে। কয়েক সপ্তাহ আগে এক দ্বীনী ভাই মীলাদুন্নবী (দ:)-বিরোধী একটি ফতোওয়া-ইশ্তেহার আমাকে দিয়ে বলেন, “মীলাদুন্নবী (দ:)-বিরোধী কুরআন-হাদীসের অনেক দলিল এতে দেয়া আছে।”

আপনারা এ ধরনের ফতোওয়া-ইশ্তেহার পাঠ করলে কখনোই তাতে একটিও কুরআনের আয়াত বা হাদীস শরীফ দেখতে পাবেন না, যেটিতে আল্লাহতা’লা কিংবা রাসূলুল্লাহ (দ:) মীলাদুন্নবী (দ:) পালনকে নিষেধ করেছেন। ওইসব আয়াত ও হাদীসের বিকৃত ব্যাখ্যাই সব সময় করা হয়, যেগুলো এমন কি বিষয়টির সাথে সম্পৃক্ত-ও নয়। এটি-ই হলো ধোকাবাজি, যা মুসলমান সর্বসাধারণ বুঝতে পারেন না। তাঁরা দেখেন কেবল কুরআন-হাদীসের দলিলের সংখ্যা, এ কথা তাঁরা জানেন না যে এর সাথে মীলাদুন্নবী (দ:)-এর কোনো সম্পর্ক-ই নেই। মীলাদ-বিরোধীরা উদ্দেশ্যমূলকভাবে এসব দলিল বিকৃতভাবে উদ্ধৃত করে, যাতে মুসলমানদেরকে বিভ্রান্ত করা যায়। এক্ষেত্রে তাদের আচরণটি কাদিয়ানী সম্প্রদায়ের মতোই, যারা নিজেদের ভণ্ড নবীকে বৈধতা দেয়ার জন্যে কুরআনের আয়াত ও হাদীস শরীফের বিকৃত ব্যাখ্যা দেয়।

ঈদে মীলাদুন্নবী (দ:) কী?

মহানবী (দ:)-এর ধরাধামে শুভাগমন দিবসকে ঈদে মীলাদুন্নবী (দ:) বলে। মুসলমান সমাজ কর্তৃক এ দিনটির উদযাপন খৃষ্টানদের ক্রিসমাস (ঈসা আলাইহিস সালামের জন্মদিন) পালন হতে একেবারেই ভিন্ন প্রকৃতির। মুসলমানবৃন্দ এই দিনে কী করেন? তাঁরা মহানবী (দ:)-এর বেলাদত, জীবন ও কর্ম এবং তাঁর ঐশীবাণী প্রচারের মিশন নিয়ে আলোচনা (যিকর-তাযকেরা) করেন; গরিব ও মেহমানদের খাবার পরিবেশন করেন; কুরআন তেলাওয়াত করেন এবং আলেম-উলেমার কাছ থেকে কুরআন শিক্ষা করেন; মহানবী (দ:)-এর প্রশংসায় না’ত-নাশীদ পরিবেশন করেন; আর অ-মুসলমানদের কাছে ধর্মের বাণী পৌঁছে দেন। এই দিনটি ইসলামী জিন্দেগীর খাঁটি ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক দিকগুলো চর্চার মাধ্যমেই পালিত হয়ে থাকে। এই শুভলগ্নে মুসলমান সমাজ দৈনন্দিন জীবনে রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর প্রতি মহব্বত এবং তাঁকে অনুসরণ-অনুকরণের কথা স্মরণ করেন। ঈদে মীলাদুন্নবী (দ:) হচ্ছে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (দ:)-কে স্মরণ করার উদ্দেশ্যে মুসলমানদের জন্যে অন্য যে কোনো ধর্মীয় সমাবেশের মতোই একটি অনুষ্ঠান।

ইসলাম ধর্মের পয়গম্বর (দ:)-এর বেলাদত (ধরাধামে শুভাগমন), সীরাহ (জীবনচরিত) ও ঐশীবাণী প্রচার মিশন সম্পর্কে আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন স্বয়ং তিনি এবং তাঁর সাহাবা-এ-কেরাম (রা:) করেননি বা অন্যদেরও তা আয়োজন করতে বলেননি বিধায় এটি বেদআত বলে অজুহাত দেখানো হলে আমাদেরও ওই সব কাজ করা মোটেই উচিত হবে না, যেগুলো মহানবী (দ:) কিংবা তাঁর সাহাবী (রা:)-বৃন্দ আদৌ করেননি। তাহলে মুসলমান সমাজ সেগুলোর আয়োজন ও চর্চা করেন কেন? নিম্নে উল্লেখিত প্রথা ও উৎসবগুলো মহানবী (দ:) বা তাঁর মহান সাহাবা-এ-কেরাম (রা:) অথবা ইসলামী ইতিহাসে কোনো আলেম কখনোই করেননি; অতি সম্প্রতি এগুলো চালু হয়েছে। কিন্তু ঈদে মীলাদুন্নবী (দ:)-এর চর্চা হয়ে আসছে গত চৌদ্দ’শ বছর যাবত এবং এটি নিয়ে কখনোই কোনো ইসলামী আলেম দ্বিমত পোষণ করেননি, যতোদিন পর্যন্ত না ইহুদী গোত্রবাদী গোষ্ঠী ও খৃষ্টান ক্রুসেডার চক্র মুসলমান রাজ্যগুলো জবরদখল করে ১৮০০/১৯০০ খৃষ্টাব্দে ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিল। গত শতাব্দীতেই ঈদে মীলাদুন্নবী (দ:)-কে বিতর্কিত করা হয়। যারা এই ধর্মীয় প্রথাকে বেদআত বলেন, তাদের পালিত বেদআতগুলো আমরা এক্ষণে আপনাদের সামনে তুলে ধরবো। তাহলে তাদের এসব কাজ ও প্রথাগুলো বেদআত নয় কেন?

ঈদে মীলাদুন্নবী (দ:)-এর বিরোধীদের সংঘটিত বেদআত

বেদআত নং - ১/ আল্লাহতা’লার আদিষ্ট ও মহানবী (দ:)-এর চর্চাকৃত একমাত্র মুসলিম সমাবেশ হলো হজ্জ্ব। ইসলামে অন্য কোনো আন্তর্জাতিক সমাবেশ নেই। এমতাবস্থায় তাবলীগের নামে বিশ্বব্যাপী মুসলিম সমাবেশের পক্ষে কুরঅান-হাদীসের দলিল কোথায় খুঁজে পাবেন? পাকিস্তান ও বাংলাদেশে বার্ষিক তাবলীগী এজতেমা’য় এমন কি হজ্জ্বের চেয়েও বেশি মুসলমান যোগ দেয়। এটি কি বেদআত নয়? রাসূলুল্লাহ (দ:) অথবা তাঁর সাহাবী (রা:)-বৃন্দ কিংবা মুসলিম আলেম-উলেমা কবে এরকম বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের সমাবেশের আয়োজন করেছিলেন? বিশ্ব তাবলীগী এজতেমা’ শুরু হয়েছে মাত্র কয়েক দশক আগে; ভারতের গুজরাটের মৌলোভী ইলিয়াস তাবলীগ জামা’আত প্রতিষ্ঠা করে। কিন্তু ঈদে মীলাদুন্নবী (দ:)-এর ইতিহাস গত চৌদ্দ’শ বছরের। এর যেমন নির্দিষ্ট দিন-তারিখ ধার্য করা আছে, তেমনি তাবলীগ জামা’আতের এজতেমা’রও দিন-তারিখ নির্দিষ্টকৃত। উভয় অনুষ্ঠানেই মানুষ যোগ দেয়, দোয়া-খায়র করে এবং দ্বীন সম্পর্কে জানতে চেষ্টা করে [যদিও তাবলীগে তা শেখার সুযোগ নেই, কারণ তাতে সহীহ আকীদা-বিশ্বাসের কোনো আলেম-উলেমা নেই - অনুবাদক]। এমতাবস্থায় তাবলীগ জামা’আতের কার্যক্রম বেদআত না হলেও ঈদে মীলাদুন্নবী (দ:)-এর চর্চা বেদআত হবে কেন?

বেদআত নং - ২/ পাকিস্তানে ১৯৭০-এর দশকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো সাহেব কা’বা শরীফের ইমামকে পাকিস্তান সফরে অামন্ত্রণ করেন। ঈদে মীলাদুন্নবী (দ:)-এর ঘোর বিরোধী ওই সৌদি ইমাম পাকিস্তান এলে মুসলমান সর্বসাধারণ সমস্ত মসজিদ ত্যাগ করে তার ইমামতিতে বড় স্টেডিয়ামে জুম’আর নামায পড়েন। ইসলামে কি এমন ধর্মীয় সমাবেশের কোনো পূর্ব-নজির আছে? মহানবী (দ:) ও তাঁর সাহাবা (রা:)-বৃন্দ কখনোই এ রকম করেননি। মুসলমানদের ইতিহাসে এরকম ঘটনা কখনোই ঘটেনি যে মুসলমান সাধারণ নিজেদের মসজিদগুলো ত্যাগ করে স্রেফ সৌদি আরব থেকে আগত হওয়ার কারণে কোনো ইমামের পেছনে নামায আদায় করেছিলেন। এটি নিঃসন্দেহে এক বড় বেদআত। কেন তাহলে কা’বা শরীফের ইমাম ও তার ইমামতিতে নামায আদায়কারী মুসূল্লীদের বিরুদ্ধে কোনো ফতোওয়া জারি করা হয়নি?

বেদআত নং - ৩/ ভারতের অন্যতম পুরোনো মাদ্রাসা দারুল উলূম দেওবন্দের আলেম-উলেমাবর্গ ও শিক্ষার্থীরা (কিছু বছর আগে) প্রতিষ্ঠানটির ১০০তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী পালন করেছিল। আর তা উদযাপিত হয়েছিল ওই রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী ও হিন্দু ধর্মাবলম্বী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর সভাপতিত্বে। আমাদের প্রিয়নবী (দ:) কিংবা তাঁর সাহাবা-এ-কেরাম (রা:) কি কখনো মসজিদে কুবা অথবা মসজিদে নববীর প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উদযাপন করেছিলেন? তাও আবার এক ভিন্ন ধর্মাবলম্বীকে দিয়ে উলামা-এ-ইসলামের সমাবেশে সভাপতিত্ব করিয়ে? এটি নিশ্চিত যে ঈদে মীলাদুন্নবী (দ:)-বিদ্বেষী চক্রটি মহানবী (দ;)-এর বেলাদত দিবসের চেয়ে নিজেদের দারুল উলূম ও ভিন্ন ধর্মাবলম্বী সভাপতির প্রতি বেশি ভক্তিশ্রদ্ধা রাখে।

বেদআত নং - ৪/ কিছু বছর আগে যুক্তরাজ্যে অবস্থিত আহলে হাদীস দলটি ‘তাওহীদে সুন্নাত’ শিরোনামে এক সভার আয়োজন করেছিল এবং তাতে কা’বা শরীফের ইমাম ও অন্যান্য আলেম-উলেমাকে দাওয়াত করে এনেছিল। তারা বর্তমানে প্রতি বছরই এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে। রাসূলুল্লাহ (দ:) বা তাঁর সাহাবী (রা:)-বৃন্দ কি কখনো ‘তাওহীদে সুন্নাত’ শিরোনামে কোনো কর্মসূচির আয়োজন করেছিলেন এবং তাতে বক্তব্য রাখতে সফর করে গিয়েছিলেন? তাহলে একে বেদআত বলা হবে না কেন? ‘সালাফী’ চক্র (স্বঘোষিত আহলে হাদীস সম্প্রদায়) দ্বীন ইসলামের অন্তর্ভুক্ত অন্য যে কোনো (ভ্রান্ত) ফেরকাহ হতে বেশি পরিমাণ বেদআত সংঘটন করে এবং হাদীস-ও বেশি বেশি অস্বীকার করে।

বেদআত নং - ৫/ মুসলমান সাধারণ যখন কোনো বিষয় বা দ্বন্দ্ব-সংঘাতে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন, তখন তারা রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ সমাবেশ করে থাকেন। মুসলমান (রাজনৈতিক) নেতৃবৃন্দ ও (রাজনৈতিক দলের) আলেম-উলেমা তাতে ভাষণ দেন। ওই সব র‌্যালীর আয়োজক ও নেতৃবৃন্দের মধ্যে অনেকে ঈদে মীলাদুন্নবী (দ:)-কে বেদআত মনে করেন। আমি তাদেরকে একটি অত্যন্ত সহজ প্রশ্ন করতে চাই। এ ধরনের দ্বন্দ্ব-সংঘাত বা আগ্রাসন অথবা (রাজনৈতিক) ইস্যূতে কি কখনো আমাদের মহানবী (দ:), তাঁর সাহাবা-এ-কেরাম (রা:) কিংবা ইসলামের মহান আলেম-উলেমা প্রতিবাদ সমাবেশ করতে রাস্তায় র‌্যালী বা ব্যানার ব্যবহার করেছিলেন? ক্রুসেডার গোষ্ঠী যখন আল-কুদস্ দখল করে নেয়, তখন কি মুসলমানবৃন্দ কোনো র‌্যালীর আয়োজন করেছিলেন? কুরআন, হাদীস বা ইসলামী ইতিহাসে এসব র‌্যালীর ভিত্তি কোথায়? [মওদূদীবাদী জামা’আত ও হেফাযতীদের এ প্রশ্ন করা উচিত - অনুবাদক]। এসব র‌্যালী কি বেদআত নয়? ঈদে মীলাদুন্নবী (দ:)-বিদ্বেষীরা মুসলমানদের প্রতি তাদের র‌্যালীতে যোগ দেয়ার জন্যে আমন্ত্রণ জানিয়ে থাকে। তারা মুখে বলে, “এসব র‌্যালীতে অংশগ্রহণ করাটা জ্বেহাদ এবং অংশগ্রহণকারীদেরকে আল্লাহতা’লা পুরস্কৃত করবেন।” অথচ প্রিয়নবী (দ:)-এর বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টির জন্যে কোনো সমাবেশের আয়োজন করা হলে তা হয়ে যায় (তাদের দৃষ্টিতে) একটি বেদআত। হায় লজ্জা!

বেদআত নং - ৬/ পাকিস্তানে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জামা’আতে ইসলামী নামের রাজনৈতিক দলটি ‘এয়াওমে শওকতে ইসলাম’ নামে বড় বড় মিছিল সমাবেশ করেছিল। এই নামটি খোদ দ্বীন-ইসলামকে খাটো করেছে। জামা’আতে ইসলামী যখন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে না, তখনো প্রতিদিনই এয়াওমে শওকতে ইসলাম (ইসলাম ধর্মের শান-শওকতের দিবস) বিরাজমান। এমন ‘এয়াওমে শওকতে ইসলাম’ কবে মহানবী (দ:) ও সাহাবা (রা:)-মণ্ডলী আয়োজন করেছিলেন? তাহলে জামা’আতের এই আয়োজন কি বেদআত নয়? ওই সব বড় মিছিলের বিরুদ্ধে (তাদের) কেউ কি ফতোওয়া জারি করেছিল? এগুলোর সবই ইসলামের নামে করা হয়েছিল। অথচ ঈদে মীলাদুন্নবী (দ:)-এর জুলূসে (ধর্মীয় মিছিলে) অংশগ্রহণ করা হলে তা বেদআত বলে সাব্যস্ত হয়! সত্যি, (মোনাফেক) আবদুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের অনুসারীরা (না-কি প্রেতাত্মা?) আমাদের যুগেও অস্তিত্বশীল!

বেদআত নং - ৭/ সৌদি আরব রাজ্যটি ‘এয়াওম-উল-ওয়াতানী’ (জাতীয় দিবস) উদযাপন করে থাকে। টেলিভিশন চ্যানেলগুলো বিশেষ অনুষ্ঠান সম্প্রচার করে; খবরের কাগজগুলো বিশেষ সংখ্যা (ক্রোড়পত্র) প্রকাশ করে; আর বেসরকারি কোম্পানিগুলো নিজেদের কর্মীদের একদিনের ছুটি মঞ্জুর করে। সৌদি জাতীয় দিবস পালনের বিরুদ্ধে তাদের কোনো রাষ্ট্রীয় মৌলোভীকে ফতোওয়া দিতে আমি কখনোই দেখিনি। কিন্তু তারা ঈদে মীলাদুন্নবী (দ:)-এর বিরুদ্ধে ফতোওয়া জারি করতে এক মুহূর্ত-ও দেরি করে না। রাসূলুল্লাহ (দ:) বা তাঁর সাহাবা-এ-কেরাম (রা:) মদীনায় প্রতিষ্ঠিত ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী কি কখনো পালন করেছিলেন? সৌদি মোল্লা-পুরোহিতবর্গ যারা ঈদে মীলাদুন্নবী (দ;)-এর বিরোধিতা করে, তারা সৌদি আরবে মার্কিন বাহিনীর অবস্থানের ন্যায্যতা প্রতিপাদন করার জন্যে (ইতিপূর্বে) ফতোওয়া জারি করেছিল; কিন্তু তারা নিজেদের সরকারের সংঘটিত বেদআত সম্পর্কে কোনো ফতোওয়াই বর্তমানে দিতে পারছে না। এটি-ই হচ্ছে ইসলাম ধর্মের মৌলিক বিকৃতি সাধন।

বেদআত নং - ৮/ উত্তর আমেরিকায় ISNA, ICNA. CAIR-সহ আরো অনেক মুসলমান সংস্থা নিজেদের বার্ষিক সভার আয়োজন করে থাকে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মানুষদেরকে বিভিন্ন পণ্ডিতের ভাষণ শোনার জন্যে টিকেট কিনতে হয়। এই পুরো ব্যবস্থাটি কি বেদআত নয়? রাসূলুল্লাহ (দ:) অথবা তাঁর সাহাবা (রা:)-বৃন্দ কিংবা তৎপরবর্তী ইসলামী উলেমা-মণ্ডলী কবে এ ধরনের সভা আয়োজন করেছিলেন? ইসলামী জ্ঞান বিশারদদের ভাষণ শোনার জন্যে মানুষজনকে অর্থ পরিশোধ করতে হবে কেন? এর ভিত্তি কোথায় আছে? মহানবী (দ:) কি তাঁর ধর্মীয় উপদেশমূলক ভাষণ শোনার জন্যে কোনো চার্জ নিতেন? তাঁর কোনো সাহাবী (রা:) কি নিজের ভাষণ দানের আগে মানুষদেরকে কোনো নেক আমল তথা পুণ্যদায়ক কর্মের জন্যে অর্থ পরিশোধ করতে বলতেন? অবশ্যই না! ওই পুণ্যাত্মাবৃন্দ কখনোই এরকম কিছু করতেন না। তবে মীলাদুন্নবী (দ:)-বিরোধীদের জন্যে এ কাজ সিদ্ধ। সত্য বটে, এটি এক বড় বেদআত। কিন্তু তারা এটিকে বেদআত বলতে রাজি নয়; নতুবা তাদেরকে তাদের দোকান (ব্যবসা) গুটাতে হবে।

বেদআত নং - ৯/ জামা’আতে আহলে হাদীস, সালাফী দল, জামা’আতে ইসলামী, WAMY, রাবেতা-এ-আলম-এ-ইসলামী, ISNA, ICNA, CAIR ইত্যাদি (ফিতনা সৃষ্টিকর) সংস্থা গঠনের ধারণাটাই একটা বেদআত। মহানবী (দ:) বা তাঁর সাহাবা (রা:)-বৃন্দ কখনোই এরকম সংস্থা গঠন করে সেগুলোর নাম দেননি। সারা বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের যে প্রতিষ্ঠান থাকা বাঞ্ছনীয়, তা হলো “মুসলিম”। কেবল আল্লাহ পাকই মানুষদেরকে গোত্র ও জাতিগোষ্ঠীতে বিভক্ত করেছেন। ঈদে মীলাদুন্নবী (দ:)-এর এসব বিরোধিতাকারীরা উম্মাহকে বিভক্ত করেছে। কতোই না নিকৃষ্ট বেদআত তারা সংঘটন করেছে! [অনুবাদকের নোট: মুসলিম উম্মাহকে বিভক্ত করে এমন সংস্থা-সংগঠন অবৈধ হলেও ইসলামে মানবকল্যাণমূলক সংস্থা-সংগঠন জায়েয। যেমন - মহানবী (দ:) নিজেই ‘হিলফুল ফুযূল’ নামের একটি সংগঠন করেছিলেন]

বেদআত নং - ১০/ জনৈকা পাকিস্তানী মহিলা বর্তমানে কানাডায় বসবাস আরম্ভ করেছেন, যদিও তিনি পাকিস্তানেও কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকেন। তিনি নিজেকে ইসলামী জ্ঞান বিশারদ বিবেচনা করেন। শুধু ঈদে মীলাদুন্নবী (দ:)-এর বিরুদ্ধে ফতোওয়া-ই তিনি দেন না, কুরআন-খানী (সমবেতভাবে কিতাবুল্লাহ পাঠ) ইত্যাদির মতো ঐতিহ্যবাহী ইসলামী রসম-রেওয়াজের বিরুদ্ধেও তিনি ফতোওয়া জারি করেন। তিনি শুধুমাত্র মহিলাদের জন্যে নামাযের জামাতের আয়োজন করেন; এতে সালাতুত্ তাসবীহ ও তারাবীহ নামায-ও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। তিনি নিজে ইসলামের মধ্যে কেবল মহিলাদের জন্যে অনেক নতুন প্রথা প্রবর্তন করেছেন, কিন্তু ঈদে মীলাদুন্নবী (দ:) তার মতে বেদআত। তার প্রবর্তিত ধারায় ইসলাম প্রচার করার ভিত্তি কোথায় বিদ্যমান? মহানবী (দ:)-এর শিক্ষার পরিপন্থী মহিলা সমাবেশের আয়োজন তিনি করে থাকেন, যেটি সবচেয়ে নিকৃষ্ট ধরনের বেদআত। তিনি মুসলিম মহিলাদের উগ্রপন্থায় দীক্ষা দিয়ে ইসলামের নামে অনেক পরিবারের ধ্বংস সাধনও করেছেন। বস্তুতঃ তার পুরো সংগঠন-ই একটি বেদআত।

বেদআত নং - ১১/ আজকে উত্তর আমেরিকায় মুসলিম সংস্থাগুলো মসজিদ, ইসলামী বিদ্যালয় বা মানবকল্যাণমূলক কার্যক্রম পরিচালনার লক্ষ্যে তহবিল গঠনমূলক নৈশভোজের আয়োজন করে থাকে। তারা টিকেট বিক্রি করে এবং বক্তাদের আমন্ত্রণ জানায়। তহবিল গঠনের জন্যে নৈশভোজের আয়োজন মহানবী (দ:) বা তাঁর সাহাবা-এ-কেরাম (রা:) কবে করেছিলেন? কোনো একটি লক্ষ্যে তাঁরা কবে ৫, ২৫, ১০০ ডলার মূল্যের খাবারভর্তি প্লেট বিক্রি করেছিলেন? এগুলোর সবই কি বেদআত নয়? এই তহবিল গঠনমূলক নৈশভোজ দিয়ে তাদের ফায়দা হয় বলে তারা এর আয়োজন করে, কিন্তু মীলাদুন্নবী (দ:)-এর আয়োজন তাদের মর্মপীড়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায়! কী অদ্ভূত!

জনৈক উর্দু কবি বলেন:

“হাম আহ্ ভী কারতে হ্যায় তো হোজাতে হ্যায় বাদনাম
উয়ো ক্কাতল ভী কারদেয় তো চার্চা নাহী হোতা।”

অর্থাৎ, আমি বেদনার্ত হয়ে ‘উফ’ শব্দটি করলেও আমার বদনাম হয়; আর তারা খুন-খারাবী করলেও কেউ আপত্তি উত্থাপন করে না।

মহানবী (দ:)-এর বেলাদত দিবস যদি তাঁর বা তাঁর সাহাবী (রা:)-দের দ্বারা উদযাপিত না হওয়ার কারণে বেদআত বলে ধরা হয়, তাহলে নিম্নোক্ত বেদআতগুলো কেন বহু শতাব্দী আগে প্রবর্তন করা হয়েছিল এবং সেগুলো কেন আজো চর্চা করা হয়? কেন ঈদে মীলাদুন্নবী (দ:)-বিরোধীরা সেগুলোকে নিন্দা করে না এবং অবিলম্বে সেগুলোর অনুশীলন পরিত্যাগ করে না?

বেদআত নং - ১২/ রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর প্রতি যখন কুরআন মজীদ অবতীর্ণ হয়, তখন তা ত্রিশ সিপারা ছিল না। তিনি বা তাঁর সাহাবা-এ-কেরাম (রা:) এই ত্রিশ সিপারা প্রবর্তন করেননি। এটি কয়েক শতাব্দী পরে শাসক ও আলেম-উলেমাদের দ্বারা প্রবর্তন করা হয়, যাতে ঐশীগ্রন্থ মুখস্থ করতে হুফফায (কুরঅানে হাফেয)-দের সুবিধা হয়। রমযান মাসে তারাবীহ নামায আদায়ের সময় কুরআন তেলাওয়াতে হাফেযদের জন্যে এই পদ্ধতি সহায়ক হয়েছে।

বেদআত নং - ১৩/ নবী করীম (দ:) কিংবা তাঁর মহান সাহাবা-এ-কেরাম (রা:)-এর কেউই পবিত্র কুরআন শরীফে রুকূ বা সেগুলোর সংখ্যা বসাননি। এগুলো বহু শতাব্দী পরে শাসকবৃন্দ ও আলেম-উলেমা যুক্ত করেছিলেন, যাতে মসজিদের ইমাম ও কুরআনে হাফেযদের পবিত্র কুরআন মুখস্থ করতে সুবিধা হয়; এতে তারা প্রাত্যহিক ৫ ওয়াক্ত নামায ও সালাতে তারাবীহ পড়ানোর সময় শুদ্ধভাবে কুরআন তেলাওয়াত করতে সক্ষম হন।

বেদআত নং - ১৪/ রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর যুগে পবিত্র কুরঅান মজীদে কোনো এ’রাব (ফাতা/কাসরা/দাম্মা, অর্থাৎ, জের/জবর/পেশ) যুক্ত ছিল না। এগুলো নিষ্ঠুর মুসলমান শাসক হাজ্জাজ বিন ইউসূফের নির্দেশে যুক্ত করা হয়। অনারব মুসলমান সমাজ যাতে শুদ্ধভাবে কুরআন তেলাওয়াত করতে পারেন, সে জন্যে এগুলো সন্নিবেশিত হয়েছিল। এসব এ’রাব হচ্ছে বেদআত। কিন্তু এগুলো যদি কুরঅান মজীদ থেকে অপসারণ করা হয়, তাহলে মীলাদুন্নবী (দ:)-বিরোধীরা আল্লাহতা’লার কেতাব শুদ্ধভাবে পড়তে পারবে না। তাই তাদের এই বেদআতের বড়ই প্রয়োজন, কিন্তু ঈদে মীলাদুন্নবী (দ:)-কে তাদের প্রয়োজন নেই!

বেদআত নং - ১৫/ ইসলামী বিধানানুযায়ী, কোনো মুসলমান নর বা নারীর জন্যে শুধু তিনটি পরিস্থিতিতে অ-মুসলিম রাজ্যে বসবাসের অনুমতি রয়েছে: (১) যখন তিনি তাঁর স্বদেশ মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্যে জুলুম-অত্যাচারের মুখোমুখি হন এবং তাঁর প্রাণনাশের হুমকি দেখা দেয়; (২) যখন তিনি অ-মুসলিম অধ্যুষিত রাজ্যে ধর্মপ্রচার করতে চান। আরেক কথায়, অমুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্যে বসতি স্থাপনের জন্যে ইসলামের ধর্মপ্রচারক হওয়া শর্ত; এবং (৩) যখন তাঁর মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ স্বদেশে তাঁরই অন্বেষণকৃত উচ্চতর শিক্ষা লভ্য হয় না। ওপরোক্ত এই তিনটি শর্ত ছাড়া অ-মুসলিম-প্রধান রাজ্যে বসতি স্থাপনের অনুমতি আমাদের ধর্ম আমাদেরকে দেয় না। “শ্রেয়তর অথনৈতিক সুবিধাগুলো গ্রহণের” উদ্দেশ্যে মহানবী (দ:) বা তাঁর সাহাবা-এ-কেরাম (রা:) অমুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্যে বসবাসের জন্যে যাননি। তাঁরা শুধু ওই তিনটি কারণেই গিয়েছিলেন। তবে মীলাদুন্নবী (দ:)-বিরোধীদের কাঙ্ক্ষিত এবং তাদের মাঝে  প্রসার লাভকৃত অন্যতম বেদআত হচ্ছে অ-মুসলিম অধ্যুষিত রাজ্যগুলোতে উন্নততর জীবনযাত্রার অন্বেষণ। বস্তুতঃ এটি এতোই কাঙ্ক্ষিত ও মরিয়া হওয়ার মতো বেদআত যে তারা এটি সংঘটনের জন্যে এমন কি আল্লাহর দরবারেও ফরিয়াদ করে থাকে। আর আল্লাহ ভালোই চেনেন-জানেন মোনাফেকদের।

সবচেয়ে বড় ধোকাবাজি  

আমাদের যুগের মুসলমানদের মধ্যে প্রচলিত অন্যতম বিভ্রান্তি হলো তারা মক্কা মোয়াযযমা ও মদীনা মোনাওয়ারার আলেম-উলেমাকে ইসলামের প্রকৃত জ্ঞান বিশারদ মনে করেন। তারা বিশ্বাস করেন যে মসজিদে হারাম ও মসজিদে নববী শরীফের ইমামবর্গ যা কিছু বলে, তা ‘কোনোক্রমেই ভুল হতে পারে না।’ এরা সারা জাহানের মধ্যে সবচেয়ে পবিত্র মসজিদগুলোর ইমাম। যেহেতু এই ইমামেরা ঈদে মীলাদুন্নবী (দ:)-কে বেদআত ফতোওয়া দেয়, তাই এটি বেদআত-ই হবে নিশ্চয়! সৌদি আরবের মুফতী সাহেব নিশ্চয় সবচেয়ে জ্ঞানী আলেম; তার ফতোওয়া-ই সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য হতে বাধ্য!

এ-ই যদি হয় মাপকাঠি বা মানদণ্ড, তাহলে ইতিহাসের দিকে আমি আপনাদের মনোযোগ আকর্ষণ করবো:

উসমানীয় তুর্কী সালতানাত (শাসকবৃন্দ) সাত শতাব্দী যাবত মক্কা ও মদীনা শরীফ শাসন করেন। ওই সাতটি শতাব্দীতে মসজিদে হারাম ও মসজিদে নববীর ইমামবৃন্দ পবিত্র ঈদে মীলাদুন্নবী (দ:) উদযাপন করতেন (বলে প্রামাণ্য দলিলে সাব্যস্ত)। সৌদি আরবীয় রাজতন্ত্র ক্ষমতায় আসীন হওয়ার আগে হারামাঈন শরীফাইনসহ পুরো আরব উপদ্বীপেই ঈদে মীলাদুন্নবী (দ:)-এর অনুশীলন ছিল। বস্তুতঃ ঈদে মীলাদুন্নবী (দ:)-এর সর্ববৃহৎ সমাবেশ হতো মক্কার মসজিদে হারামে। অতঃপর সৌদি ওহাবীদের ক্ষমতা দখলের পর এই প্রথা বন্ধ করে দেয়া হয়। আপনারা যদি উসমানীয় তুর্কী শাসনামলে জন্মগ্রহণ করতেন, তাহলে আপনারা হারামাঈন শরীফাইনে সর্ববৃহৎ মীলাদ অনুষ্ঠান প্রত্যক্ষ করতে পারতেন।

সরকার পরিবর্তন হলেও আমাদের (মুসলমানদের) ধর্মীয় ঐতিহ্য ও রীতি-নীতি পরিবর্তন করা আমাদের মোটেও উচিত নয়। আমাদের এই ঐতিহ্য ও রীতি-নীতি পবিত্র কুরঅান, মহানবী (দ:)-এর সুন্নাহ ও উলামা-এ-ইসলামের ‘এজমা’র ওপর দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত। আজকে যদি সৌদি সরকারের বদলে অন্য কোনো সরকার ক্ষমতাসীন হয়, তাহলে ঈদে মীলাদুন্নবী (দ:)-বিরোধীদের কী অবস্থা হবে? তারা কি মীলাদুন্নবী (দ:) উদযাপন আরম্ভ করবে?

ঈদে মীলাদুন্নবী (দ:) মুসলমানদেরকে ঐক্যবদ্ধ করে, আর এর অস্বীকার তাদেরকে বিভক্ত করে। গত চৌদ্দ’শ বছরের ইতিহাস-ই সাক্ষী। মহানবী (দ;)-এর বেলাদত দিবস যখন তাঁরা উদযাপন করতেন, তখন তাঁরা ছিলেন একতাবদ্ধ; আর যখন থেকে এ বিষয়ে মুসলমান সমাজ বিতর্কে জড়িয়েছেন, তখন-ই অনৈক্য দেখা দিয়েছে। মুসলমানদের যা বিভক্ত করেছে তা ঈদে মীলাদুন্নবী (দ:) পালন নয়, বরং ঈদে মীলাদুন্নবী (দ:)-এর অস্বীকার-ই তাদেরকে বিভক্ত করেছে।

ঈদে মীলাদুন্নবী (দ:)-বিরোধীদের প্রদর্শিত একটি ধোকাপূর্ণ যুক্তি হচ্ছে এই যে, জাতীয় দিবস পালন, সংস্থা-সংগঠন প্রতিষ্ঠাকরণ এবং নির্বাচনে অংশগ্রহণ দুনিয়াবী তথা পার্থিব বিষয়। এগুলো ইসলামী শরীয়তের অংশ নয়; কিন্তু যারা মহানবী (দ:)-এর বেলাদত দিবস পালন করেন তাঁরা এটিকে ইসলাম ও ইসলামী শরীয়তের অংশ হিসেবেই উদযাপন করেন। অতএব, ঈদে মীলাদুন্নবী (দ:) বেদআত, কেননা মহানবী (দ:) এটিকে ইসলামের অংশ বানাননি। মীলাদুন্নবী (দ:)-বিরোধীদের প্রদর্শিত এটি কতোই না অদ্ভূত ও ধোকাবাজিপূর্ণ এবং অনৈসলামী যুক্তি!

আল্লাহতা’লা এরশাদ ফরমান: “হে ঈমানদার সকল! (তোমরা) ইসলামে পূর্ণাঙ্গভাবে প্রবেশ করো এবং শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। নিঃসন্দেহে সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।” [আল-কুরঅান, ২:২০৮; তাফসীরে নূরুল এরফান]

অর্থাৎ, একজন ঈমানদার মুসলমানের জীবনে কখনোই এমন একটি মুহূর্ত নেই, যখন তিনি ইসলাম বা ইসলামী শরীয়তের বাইরে অবস্থান করেন। আমরা মুসলমান সর্বসাধারণ বিশ্বাস করি যে, কোনো ঈমানদারের যাবতীয় আমল তথা কাজ-কর্ম, পরিবারকে সময় দেয়া, বন্ধু-বান্ধবের সাথে সময় কাটানো, স্বামী-স্ত্রী সম্পর্ক, ঘুমোনো, এমন কি শরীরচর্চাও এবাদতের অংশবিশেষ - যতোক্ষণ পর্যন্ত ওই ঈমানদার ব্যক্তি আল্লাহরই খাতিরে, তাঁরই রেযামন্দির উদ্দেশ্যে তা করে থাকেন।

আল্লাহতা’লা আরো এরশাদ ফরমান: “হে রাসূল আপনি বলুন, নিঃসন্দেহে আমার নামায, আমার সমস্ত কোরবানী, আমার জীবন এবং আমার মরণ - সবই আল্লাহ জন্যে, যিনি রব সমগ্র জাহানের।” [আল-কুরআন, ৬:১৬২]

এর মানে হলো, প্রত্যেক মুসলমানের জন্যে তার সমস্ত পার্থিব বা অপার্থিব কর্ম আল্লাহরই উদ্দেশ্যে নিবেদিত। তার মানে কি মীলাদুন্নবী (দ:)-বিদ্বেষী চক্র যখন তাদের ‘পার্থিব কর্ম’ সম্পাদন করে তখন তা নিজেদের খাতিরেই করে এবং আল্লাহর ওয়াস্তে করে না? এতে তারা ইসলাম ধর্ম থেকে খারিজ হয়ে যাবে, যদি তারা ‘পার্থিব কর্ম’-গুলোকে শরীয়তের অংশ হিসেবে গণ্য করতে না চায়; কেননা তা শরীয়তেরই আওতাধীন। আমি মনে করি না তারা এই বিশ্বাস অন্তরে পোষণ করে। এমতাবস্থায় ঈদে মীলাদুন্নবী (দ:)-বিরোধীদের ওপরোক্ত সমস্ত বেদআত-ই তারা আল্লাহর ওয়াস্তে করে থাকে। তাই তারা এসব অনুশীলনকে (যেগুলো বাস্তবিকই বেদআত) “শর’ঈ” (ইসলামে বৈধ) বিবেচনা করে। তাহলে মীলাদুন্নবী (দ:)-কে “শর’ঈ” (ইসলামে বৈধ) বিবেচনা করা হবে না কেন? 

উপসংহার

এই গোটা বিশৃঙ্খলা আরম্ভ হয়েছিল সৌদি আরব রাজ্যে ওহাবী বিপ্লবের ফলে। ওই বিপ্লবের আগে মুসলমান সমাজ কোনো দ্বিধা অথবা বাধা ছাড়াই ঈদে মীলাদুন্নবী (দ:) উদযাপন করতেন। বর্তমানে মুসলমান সর্বসাধারণ হজ্জ্ব ও উমরাহ’র জন্যে সৌদি আরব সফর করছেন এবং বিশ্বের নানা অঞ্চলের অনেক মুসলমান সেখানে কর্মরত আছেন। তারা মনে করেন ওই দেশে যা কিছু অনুশীলিত হয়, তা-ই বুঝি সঠিক। ভেবে দেখুন, আপনারা যদি ওহাবী বিপ্লবের আগে জন্মাতেন, তাহলে এমন কি মক্কা মোয়াযযমা ও মদীনা মোনাওয়ারায়ও ঈদে মীলাদুন্নবী (দ:)-এর উদযাপন প্রত্যক্ষ করতে সক্ষম হতেন। আব্বাসীয়, ফাতেমীয়, উসমানীয় ও অন্যান্য শাসকবৃন্দ হারামাঈন শরীফাইন এবং মুসলিম বিশ্বের অধিকাংশ এলাকা শাসন করেছেন বিগত ১৩’শ বছর ধরে। এই তেরো’শ বছরে কোনো ইসলামী আলেমই ঈদে মীলাদুন্নবী (দ:) নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করেননি; এদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে সৌদি ওহাবীদের কাছে গ্রহণযোগ্য ফেকাহবিদ ইবনে তাইমিয়াও।

ইসলাম ধর্মে যদি সকল বেদআত-ই পাপ হতো, তাহলে আমীরুল মো’মেনীন সাইয়্যেদুনা উমর ইবনে আল-খাত্তাব (রা:) কখনোই তারাবীহ নামায জামাআতে আদায়ের ক্ষেত্রে “নে’মাতুল বিদ’আ” (সুন্দর নতুন প্রথা) শব্দটি ব্যবহার করতেন না।

ইসলামী খেলাফতের পতনের অন্যতম কারণ ছিল ওহাবী বিপ্লব। সারা মুসলিম বিশ্বে একমাত্র সৌদি আরবেই পবিত্র ঈদে মীলাদুন্নবী (দ:)-কে রাষ্ট্রীয়ভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে [কাতার-ও সৌদি ওহাবীদের জ্ঞাতি-গোষ্ঠী হওয়ার দরুন একে নিষিদ্ধ করেছে - অনুবাদক]। তবে লক্ষ লক্ষ সৌদি মুসলমান মুতাওওয়া’ তথা ওহাবী মতবাদী পুলিশের দ্বারা হয়রানির আশঙ্কায় নিজেদের ঘর-বাড়িতে (গোপনে) ঈদে মীলাদুন্নবী (দ:) পালন করে থাকেন। আপনারা যদি মহানবী (দ:)-এর সহস্র সহস্র আহলে বায়ত (রা:) ও আসহাবে কেরাম (রা:)-এর হন্তা খাওয়ারিজ (খারেজী) চক্রের আকীদা ও ধর্ম অনুশীলনের দিকে লক্ষ্য করেন, তাহলে তাদের সাথে ঈদে মীলাদুন্নবী (দ:)-বিরোধীদের হুবহু মিল দেখতে পাবেন।

অনুগ্রহ করে ইবনে বতুতার ভ্রমণ কাহিনী (সফরনামা-এ-ইবনে বতুতা) পাঠ করুন। তিনি তাতে মক্কা মোয়াযযমায় অবস্থিত হারাম শরীফের অভ্যন্তরে এবং শহরের অন্যত্র পবিত্র ঈদে মীলাদুন্নবী (দ:) উদযাপনের প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে এক বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছেন। তিনি স্রেফ একজন ভ্রমণকারী ছিলেন। তিনি মক্কায় যা ঘটেছিল তা-ই লিখেছিলেন।

পথভ্রষ্ট ও উগ্রবাদীদের সৃষ্ট ফিতনা’র প্রতি আমাদের মনোযোগ দেয়া উচিত নয়। চলুন, ইসলামী ঐতিহ্যপূর্ণ সেসব প্রথাগুলোর দিকে আমরা ফিরে যাই, যেগুলো মুসলমান সমাজ আগে চর্চা করতেন; এর ব্যতিক্রম শুধু ইহুদীবাদী গোত্র ও ক্রুসেডার-চক্রের দালাল গোষ্ঠী, যারা তা অনুশীলন করে না।

আমি আপনাদের প্রতি সর্বান্তঃকরণে পবিত্র ঈদে মীলাদুন্নবী (দ:) উদযাপনের উদাত্ত আহ্বান জানাই।

[এই পর্যায়ে লেখকের প্রদত্ত কিছু রেফারেন্স আর অনুবাদ করা হলো না। কেননা, এগুলো আমরা ইতিপূর্বে “ইসলামী উলামাবৃন্দের দৃষ্টিতে মীলাদুন্নবী (দ:)” শীর্ষক অনূদিত প্রবন্ধে প্রকাশ করেছিলাম। দেখুন - www.rodelaanubad800.blog.com]   
 
                                                                 *সমাপ্ত*




      

     

শুক্রবার, ২৫ ডিসেম্বর, ২০১৫

সাহাবা (রা:)-বৃন্দ কি মীলাদুন্নবী (দ:) উদযাপন করেছিলেন?

মূল: সুফফাহ ফাউন্ডেশন
অনুবাদ: কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন
[Bengali translation of Suffah Foundation's Online article "Did the Sahaba celebrate Mawlid?" Translator: Kazi Saifuddin Hossain]

আল্লাহর নামে অরম্ভ, যিনি অত্যন্ত দয়ালু, দাতা।
আমাদের আকা ও মওলা হযরত রাসূলুল্লাহ (দ:), তাঁর আহলে বায়ত (রা:) ও আসহাবে কেরাম (রা:)-এর প্রতি সালাত ও সালাম।


সাহাবা (রা:)-বৃন্দের আমলের আলোকে মীলাদুন্নবী (দ:) উদযাপনের শরয়ী বৈধতা 

আমাদের মধ্যে একটি সংখ্যালঘু দল সাহাবা-এ-কেরাম (রা:) কর্তৃক মীলাদুন্নবী (দ:) পালনের প্রমাণ প্রদর্শনের জন্যে প্রায়ই আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’আতকে চ্যালেন্জ করে থাকে। এসব সংকীর্ণ মস্তিষ্কের লোক যা উপলব্ধি করে না তা হলো, প্রতিটি এবাদত-বন্দেগী, প্রতিটি পুণ্যদায়ক কর্ম যা আমরা অনুশীলন করি, তা প্রকৃতপক্ষে মীলাদেরই উদযাপন তথা যিকর-তাযকিরাহ। কেননা, প্রিয়নবী (দ:)-এর বেলাদত তথা মীলাদ না হলে আমরা এমন কি মুসলমানও হতে পারতাম না। ইসলামের পথে আমরা যদি এমন কি মুসলমান-ই না হতে পারি, তাহলে আমাদের হৃদস্পন্দনের কী-ই বা মূল্য থাকবে? আমাদের নেয়া প্রতিটি নিঃশ্বাস যে মহানবী (দ:)-এর মীলাদ (ধরাধামে শুভাগমন)-এর কারণে আল্লাহতা’লার দানকৃত এক রহমত (করুণা)-বিশেষ, সে কথা যারা বুঝতে পারে না, আল্লাহতা’লা যেন তাদেরকে হেদায়াত দান করেন।

সাহাবা (রা:)-বৃন্দ এই বিষয়ে যে আমল পালন করেছেন, এ দলটি তার সপক্ষে প্রামাণ্য দলিল দেখতে চায়। আমরা মীলাদের বিষয়টি আপাততঃ স্থগিত রেখে এই সংখ্যালঘু দলকে জিজ্ঞেস করতে চাই, আপনারা পালন করেন এমন যে কোনো একটিমাত্র আমল দেখান, যেটি মহানবী (দ:)-এর সাহাবী (রা:)-বৃন্দের আমলের মতো একই জযবাত, শক্তি ও মহিমা ধারণ করে? সত্যি, তারা এর জবাব কখনোই দিতে সক্ষম হবে না; কারণ সাহাবা-এ-কেরাম (রা:) শ্রেষ্ঠত্বের আসনে ছিলেন আসীন, যাঁদের এবাদত ও আমল সরাসরি মহানবী (দ:)-এর শিক্ষা দ্বারা পূর্ণতাপ্রাপ্ত হয়েছিল।

হয়তো এসব লোক অনুধাবন করতে পারে না যে মহানবী (দ:)-এর বেলাদত না হলে হযরত আবূ বকর (রা:) নবী দাবিদার ভণ্ডদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ-ই করতেন না; হযরত উমর ফারূক (রা:) আফ্রিকা ও ইউরোপে মুসলিম সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তন-ও করতেন না; হযরত উসমান (রা:) তাঁর সমস্ত সম্পদ মুসলমানদের জন্যে দান-ও করতেন না; আর হযরত আলী (ক:)-ও খারেজী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে লড়তেন না।

আজকে কেউই বাস্তবিকভাবে শীর্ষস্থানীয় সাহাবা-এ-কেরাম (রা:)-এর আমল অনুসরণের দাবি করতে পারে না, কেননা ইসলামের জন্যে তাঁদের খেদমত ও ত্যাগ অতুলনীয় ছিল। তবে আমরা কুরআন ও সুন্নাহ অনুযায়ী আমাদের আমলকে নিশ্চিত করতে পারি। অতএব চলুন, আমরা সত্যকে মিথ্যে দাবি হতে এক্ষণে পৃথক করি; মীলাদ-সংক্রান্ত যাবতীয় আমলকে আমরা যাচাই করি এবং পর্যবেক্ষণ করি সাহাবা-এ-কেরাম (রা:) কখনো এগুলো পালন করেছিলেন কি না।

জরুরি জ্ঞাতব্য: প্রামাণ্য দলিল উপস্থাপনের আগে পাঠকদের অনুরোধ করা হচ্ছে শরীয়তের বিধানের এই বিষয়টির দিকে খেয়াল রাখতে যে, মহানবী (দ:)-এর সামনে কোনো ঘটনা বা কর্ম সংঘটিত হওয়ার সময় তাঁর মৌনতা-ই ওই বিষয়ের প্রতি তাঁর সমর্থন বলে বিবেচিত হবে (যদি না তিনি তাতে বাধা দেন বা স্পষ্টভাবে নিষেধ করেন); অার সেটি তাঁর অনুমোদিত আমল (সুন্নাতে তাকরিরী) হিসেবেও সাব্যস্ত হবে। বর্তমানকালে এটি খুবই হতাশাব্যঞ্জক যে মীলাদ মাহফিলে বা মজলিশে মুসলমানদেরকে শেরেক (অংশীবাদ) সংঘটনের দোষারোপ করা হচ্ছে। এই দোষারোপ একেবারেই বৃথা, কেননা মুসলমান হওয়ার মানেই হলো এক আল্লাহর এবাদত-বন্দেগী করা, যিনি সর্বশক্তিমান।

উদাহরণস্বরূপ, শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে হাজর হায়তামী মক্কী (রহ:)-এর বক্তব্য উদ্ধৃত করা যায়। তিনি বলেন:

আমাদের সময় মওলিদ বা মীলাদের যে সমাবেশ হয়, সেগুলো মূলতঃ নেক আমল। যেমন, এতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে দান-সদকাহ, যিকর-আযকার, মহানবী (দ:)-এর প্রতি দরুদ-সালাম পাঠ ও তাঁর প্রশংসা......আর মীলাদের দ্বিতীয় ধরনের মজলিশ হলো সুন্নাত, যা যিকর-আযকার সংক্রান্ত হাদীসসমূহে বর্ণিত হয়েছে। ইমাম মুসলিম বর্ণিত একটি হাদীসে রাসূলুল্লাহ (দ:) এরশাদ ফরমান: মানুষেরা আল্লাহর যিকির-তাযকেরায় উপবিষ্ট থাকাকালীন ফেরেশতাকুল তাদের ঘিরে রাখে এবং তাদের ওপর শান্তি নেমে আসে। [ফাতাওয়া অাল-হাদিসীয়্যা, ২০২ পৃষ্ঠা; এই ফতোওয়ায় নিষিদ্ধ কাজগুলো সম্পর্কেও সতর্ক করা হয়েছে, তবে ওপরের এ বক্তব্য সারা বছর ওই হারাম কাজ থেকে বাঁচার এক মানদণ্ড বটে] 

মীলাদুন্নবী (দ:)-এর সংজ্ঞা

মীলাদ শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে (আরবী) ‘বেলাদত’ শব্দটি থেকে। সুতরাং আরবী ভাষায় মীলাদ শব্দটির অর্থ জন্মের স্থান ও সময়। শরীয়তের অালোকে আমরা বুঝি, মহানবী (দ:)-এর ধরাধামে শুভাগমনের সময় যেসব ঘটনা ঘটেছিল, তা-ই হচ্ছে মীলাদ; আর আমরা এই শুভলগ্নে তাঁর সীরাহ (জীবন ও কর্ম) আলোচনার সুযোগও পেয়ে থাকি। এছাড়াও মীলাদে আমরা মহানবী (দ:)-এর প্রতি হাদীয়া হিসেবে দরুদ ও সালাম পেশ করে থাকি। মানুষের কাছে প্রিয়নবী (দ:)-এর অনুপম বৈশিষ্ট্যাবলী বর্ণনা এবং তাঁর প্রশংসাও করা হয়। আমরা বিশ্বাস করি না যে মীলাদ মাহফিল কোনো নির্দিষ্ট দিনে সীমাবদ্ধ রাখা চাই, বরং রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর যিকর-তাযকেরা (স্মরণ) প্রতিটি মিনিট ও প্রতিটি সেকেন্ডেই করা চাই। মীলাদুন্নবী (দ:) হচ্ছে ধর্মপ্রচারের এক মহা উৎস। এটি দাওয়াহ কার্যক্রমের একটি মোক্ষম সুযোগ এবং এই শুভলগ্নে উলামাবৃন্দ মুসলমানদেরকে ধর্মশিক্ষা দিতে পারেন; মহানবী (দ:)-এর নৈতিক আচার-ব্যবহার, সৌজন্য, তাঁর বিষয়াদি ও সীরাত, তাঁর লেনদেন ও শামায়েল সম্পর্কেও তাঁরা শেখাতে পারেন।

১/ - ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে কোনো নির্দিষ্ট দিন-তারিখ নির্ধারণ 

মুসলিম উম্মাহ (জাতি) ১২ই রবিউল আউয়াল তারিখ যেভাবে উদযাপন করে থাকেন, সাহাবা-এ-কেরাম (রা:)-ও কি ইসলাম প্রচারের জন্যে এরকম দিন-তারিখ ঠিক করতেন? সহীহ বোখারী শরীফের উদ্ধৃতিটি দেখুন:

আবূ ওয়াইল বর্ণনা করেন যে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা:) প্রতি বৃহষ্পতিবার মানুষের কাছে ধর্মীয় ওয়ায-নসীহত করতেন। একবার এক ব্যক্তি আরয করেন, “এয়া আবা আবদ্ আর্ রাহমান, আল্লাহর কসম! আমি চাই আপনি যদি আমাদের মাঝে প্রতিদিনই ধর্মের বাণী প্রচার করতেন।” তিনি উত্তর দেন, “আমাকে এ কাজে বাধা দিচ্ছে একমাত্র যে জিনিসটি, তা হলো আমি তোমাদের বিরক্তির কারণ হওয়াকে অপছন্দ করি; আর নিঃসন্দেহে আমি তোমাদের মাঝে ধর্মের বাণী প্রচারে যত্নবান বিধায় এমন উপযুক্ত সময়ই বেছে নিয়েছি, যেমনটি একই বিরক্তির আশঙ্কায় মহানবী (দ:) আমাদের (সাহাবীদের) মাঝে ধর্মপ্রচারের সময়-ক্ষণ বেছে নিয়েছিলেন।” [সহীহ বোখারী, ১ম খণ্ড, ৩য় বই, হাদীস নং ৭০]

অবশ্যঅবশ্য মীলাদুন্নবী (দ:)-এর উদযাপন কেবল ১২ই রবিউল আউয়াল তারিখেই সীমাবদ্ধ রাখা উচিত নয়, বরং সর্বদা আল্লাহতা’লা ও তাঁর রাসূল (দ:)-এর যিকর-তাযকেরায় আমাদের প্রতিটি নিঃশ্বাসে স্মরণ করা উচিত।

২/ - আল্লাহতা’লা ও তাঁর রাসূল (দ:)-এর যিকর-তাযকেরার উদ্দেশ্যে সমাবেশ

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা:) হতে বর্ণিত যে, একবার একদল সাহাবী (রা:) সমবেত হয়ে মজলিশে বসেছিলেন এবং রাসূলুল্লাহ (দ:) তাঁদের দিকে আসার সময় তাঁদেরকে বলাবলি করতে শুনতে পান। তাঁদের কেউ কেউ বলছিলেন যে আল্লাহতা’লা হযরত ইব্রাহীম (আ:)-কে বন্ধু (খলীলউল্লাহ) হিসেবে গ্রহণ করেন; আবার অন্য সাহাবী (রা:)-বৃন্দ বলাবলি করছিলেন যে আল্লাহ পাক হযরত মূসা (আ:)-কে কালীমউল্লাহ (আল্লাহর সাথে সরাসরি আলাপকারী) হিসেবে গ্রহণ করেন; আরো কিছু সাহাবী (রা:) বলেন যে অাল্লাহ সোবহানাহু ওয়া তা’লা হযরত ঈসা (আ:)-কে ‘আল্লাহর বাক্য’ হিসেবে গ্রহণ করে নেন; অপর কিছু সাহাবী (রা:) মতামত ব্যক্ত করেন যে আল্লাহতা’লা হযরত আদম (আ:)-কে পছন্দ করে নেন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (দ:) তাঁদেরকে বলেন, “আমি তোমাদের এ আলাপ শুনতে পেয়েছি। তোমরা আশ্চর্যান্বিত হচ্ছো হযরত ইব্রাহীম (আ:)-এর খলীলউল্লাহ হওয়ার বিষয়ে, এবং এটি সত্য; আর হযরত মূসা (আ:)-এর নাজীউল্লাহ (আল্লাহ কর্তৃক নাজাতপ্রাপ্ত) হওয়ার বিষয়েও, এবং এটিও সত্য; আর হযরত ঈসা (আ:)-এর রূহুল্লাহ হওয়ার বিষয়েও, এবং এটিও সত্য; আর হযরত আদম (আ:)-এর আল্লাহ কর্তৃক পছন্দকৃত হওয়ার বিষয়েও, এবং এটিও সত্য; কিন্তু আমি হলাম হাবীবউল্লাহ (আল্লাহর বন্ধু), এবং আমি এ কথা গর্ব না করেই বলছি (হাবীবুল্লাহ ওয়া লা ফাখর); আর শেষ বিচার দিবসে আমি-ই হবো প্রশংসার পতাকাবাহক; আর হযরত আদম (আ:) ও তাঁর বংশের (অর্থাৎ, মানবকুলের) সবাই ওই দিন আমার পতাকাতলে থাকবেন, এবং আমি এ কথা গর্ব না করেই বলছি; শেষ বিচার দিবসে আমি-ই হবো প্রথম শাফায়াত তথা সুপারিশকারী এবং সর্বপ্রথম সুপারিশ আমি-ই করবো, এবং আমি এ কথা গর্ব না করেই বলছি; আর আমি-ই সর্বপ্রথম বেহেশতের দরজার চাবি খুলবো এবং আল্লাহ আমার জন্যে বেহেশত উন্মুক্ত করবেন, আর আমি-ই সর্বপ্রথম তাতে প্রবেশ করবো; আর আমার সাথে থাকবে আমারই উম্মতের গরিব ও বিনয়ী ঈমানদারবৃন্দ, এবং আমি এ কথা গর্ব না করেই বলছি; আর সৃষ্টিকুলের মাঝে প্রথম হতে শেষ জনের মধ্যে আমাকেই সর্বপ্রথম সম্মানিত করা হবে, এবং আমি এ কথা গর্ব না করেই বলছি।” [তিরমিযী শরীফ: কিতাবুল মানাকিব; বাবুন্ ফী ফযল আন্ নবী (অনুপম বৈশিষ্ট্যাবলী অধ্যায়); ইমাম দারিমী, হাফেয ইবনে কাসীর, ইমাম সৈয়ুতী ও অন্যান্য উলামাও এ হাদীস বর্ণনা করেন]

সন্দেহ পোষণকারীদের বোঝা উচিত, মীলাদুন্নবী (দ:)-এর প্রকৃত মজলিশ হলো মসজিদে (বা অন্যত্র) সমবেত হয়ে সাইয়্যেদুনা মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের যিকর-তাযকেরা করা, ঠিক যেমনটি সাহাবা-এ-কেরাম (রা:) অন্যান্য নবী-রাসূল (আ:)-বৃন্দের যিকর-তাযকেরা করেছিলেন। 

হযরত আবূ হোরায়রা (রা:) বর্ণনা করেন মহানবী (দ:)-এর বাণী, যিনি বলেন: “আল্লাহ পাক ঘোষণা করেন, ‘আমার (প্রিয়) বান্দা আমার প্রতি যে আকাঙ্ক্ষা রাখে, আমি তা পূরণ করি; সে আমার যিকর করলে আমি তার সাথে থাকি; সে নিভৃতে আমায় স্মরণ করলে আমিও তাকে নিভৃতে স্মরণ করি; অার দলবদ্ধভাবে স্মরণ করলে অামি তার চেয়েও উত্তম এক দলে তাকে স্মরণ করি...।” [একটি বড় বর্ণনার অংশ এটি; সহীহ বোখারী, ৯ম খণ্ড, ৯৩তম বই, হাদীস নং ৫০২]

হযরত আবূ সাঈদ খুদরী (রা:) বর্ণনা করেন যে হযরত মোয়াবিয়া (রা:) মসজিদে অনুষ্ঠিত একটি হালাকায় (যিকরের সমাবেশে) উপস্থিত হয়ে জিজ্ঞেস করেন, “তোমরা কী কারণে এই মজলিশে বসেছো?” তারা উত্তর দেন, “আমরা আল্লাহতা’লার যিকর করতেই এখানে উপবিষ্ট।” তিনি বলেন, “আমি তোমাদের শপথ করেই বলতে বলছি (তোমরা এই উদ্দেশ্যেই এখানে বসেছো কি)?” তারা উত্তর দেন, “আল্লাহর নামে শপথ, আমরা এই বিশেষ উদ্দেশ্যেই বসেছি।” এমতাবস্থায় হযরত মোয়াবিয়া (রা:) বলেন, “আমি এ কারণে তোমাদেরকে শপথ করতে বলিনি যে তোমাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ আছে, বা রাসুলুল্লাহ (দ:)-এর দৃষ্টিতে হাদীস বর্ণনাকারী হিসেবে আমার কোনো মর্যাদার খাতিরেও তা দাবি করিনি, যেহেতু আমি এতো স্বল্প সংখ্যক হাদীসের রাবী। (কিন্তু) সত্য হলো রাসূলুল্লাহ (দ:) একবার তাঁর সাহাবী (রা:)-বৃন্দের হালাকায় উপস্থিত হয়ে তাঁদের জিজ্ঞেস করেন, ‘তোমরা কেন এখানে বসেছো?’ তাঁরা উত্তর দেন, ‘আমরা এখানে আল্লাহতা’লার যিকর ও প্রশংসা করতে জমায়েত হয়েছি, কেননা তিনি-ই আমাদেরকে ইসলামের দিকে হেদায়াত দিয়েছেন এবং আমাদের প্রতি রহমত তথা করুণা বর্ষণ করেছেন।’ এমতাবস্থায় হুযূর পাক (দ:) আল্লাহর নামে শপথ করে তাঁদেরকে বলতে বলেন তাঁরা সত্যি ওই উদ্দেশ্যে সেখানে উপবিষ্ট হয়েছেন কি না। তাঁরা শপথ করে বলেন, ‘আমরা আল্লাহর নামে কসম করছি, এছাড়া আর কোনো উদ্দেশ্যে এখানে বসিনি।’ অতঃপর মহানবী (দ:) বলেন, ‘আমি শপথ করতে বলেছি এ কারণে নয় যে তোমাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ আছে; বরং এ কারণে যে জিবরীল (আ:) আমার কাছে এসে আমাকে জানিয়েছেন, মহান আল্লাহ পাক ফেরেশতাদের কাছে তোমাদের (অর্থাৎ, সাহাবীদের) শ্রেষ্ঠত্ব ও মাহাত্ম্য সম্পর্কে আলোচনা করছিলেন’।” [সহীহ মুসলিম, ৩৫তম বই, হাদীস নং ৬৫৩১] 

ভালোভাবে লক্ষ্য করুন যে সাহাবা (আ:)-বৃন্দ আল্লাহর যিকর, হেদায়াত, ইসলাম ও রহমত তথা করুণার কথা উল্লেখ করেছিলেন; আর এতে কোনো সন্দেহ নেই যে প্রিয়নবী (দ:) হলেন আল্লাহতা’লার সর্বশ্রেষ্ঠ করুণা (রহমত) এবং যে ব্যক্তি আল্লাহ পাকের এই করুণাপ্রাপ্তিতে তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ হয়, তিনিও তার প্রতি সন্তুষ্ট হন। এটি নিশ্চিত যে ওই সাহাবা (রা:)-বৃন্দকে এই ধরনের যিকরের দল গঠনের কোনো সুনির্দিষ্ট নির্দেশ দেয়া হয়নি - আর তাঁদের সাক্ষী ছিলেন স্বয়ং মহানবী (দ:) যিনি তাঁদেরকে এই নেক আমলের ব্যাপারে (নেয়ামতের) সুসংবাদ দিয়েছিলেন। আল্লাহ পাক আমাদেরকেও (অর্থাৎ, মুসলমানদেরকেও) অনুরূপ জ্ঞান-প্রজ্ঞা মঞ্জুর করুন, আমীন।

যিকরের সমাবেশ সম্পর্কে ইবনে তাইমিয়ার অভিমত

ইবনে তাইমিয়াকে জিজ্ঞেস করা হয় সেসব মানুষ সম্পর্কে যারা মসজিদে সমবেত হয়ে যিকর করেন এবং কুরআন তেলাওয়াত করেন; আর আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি করে প্রার্থনা করার সময় মাথা থেকে পাগড়ী অপসারণ করেন (খালি মাথায় থাকেন)। এ সময় তাঁদের নিয়্যত অহঙ্কার নয়, বা রিয়া তথা প্রদর্শনীও নয়, বরঞ্চ আল্লাহর নৈকট্য হাসিল করাই একমাত্র ধ্যান-জ্ঞান। এটি গ্রহণযোগ্য কি না?

ইবনে তাইমিয়া উত্তর দেয়: এটি গ্রহণযোগ্যই শুধু নয়, বরং উত্তম ও প্রশংসনীয় (নেক) আমল। [মজমু’আয়ে ফাতাওয়ায়ে ইবনে তাইমিয়া, ২২তম খণ্ড, ২৫৩ পৃষ্ঠা, বাদশাহ খালেদ বিন আবদ্ আল-আযীয সংস্করণ]

/ - দান-সদকাহ

হযরত আসমা (রা:) বর্ণনা করেন রাসূলে পাক (দ:)-এর হাদীস, যিনি বলেন: “দান-সদকাহ করো এবং অনিচ্ছাসহ তা করো না, যাতে আল্লাহতা’লা তোমাদের প্রতি তাঁর দান সীমিত না করে দেন; আর তোমাদের অর্থ (দান-খয়রাত হতে) আটকে রেখো না, যাতে আল্লাহতা’লা তোমাদের কাছ থেকে তা আটকে না রাখেন।” [সহীহ বোখারী, ৩য় খণ্ড, ৪৭তম বই, হাদীস নং ৭৬৪]     

হযরত আবূ হোরায়রা (রা:) হতে বর্ণিত; একবার এক ব্যক্তি মহানবী (দ:)-কে প্রশ্ন করেন, “এয়া রাসূলাল্লাহ (দ:)! কোন্ ধরনের দান-সদকাহ সবচেয়ে ভালো?” তিনি উত্তর দেন, “দান-সদকাহ করা ঠিক ওই সময়ে, যখন তুমি স্বাস্থ্যবান এবং সম্পদ আহরণের উচ্চাকাঙ্ক্ষা রাখো, আর গরিব হওয়ার ব্যাপারে শঙ্কিত থাকো। দান-সদকাহ করায় বিলম্ব করো না যতোক্ষণ না তুমি মৃত্যু শয্যায় শায়িত হয়ে বলো, ‘অমুককে এইটুকু দেবে, তমুককে ওইটুকু দেবে’; কেননা ওই সময় সহায়-সম্পত্তি আর তোমার নেই, বরং তা অমুক-তমুকের হয়ে গিয়েছে (মানে উত্তরাধিকারীদের মালিকানাধীন হয়েছে)।” [সহীহ বোখারী, ৪র্থ খণ্ড, ৫১তম বই, হাদীস নং ১১]   

তাহলে দান-সদকাহ করা কি বেদআত? অবশ্যই নয়! আর এই দান করার জন্যে কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দেয়া হয়নি যে কখন হালাল হবে আর কখন তা হারাম হবে। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যে দান-সদকাহ করা বছরের প্রতিটি দিন-ই জায়েয। এই নেক তথা পুণ্যদায়ক কাজ হতে মানুষদেরকে বাধা দেয়ার চেষ্টা করাই হলো খোদ এক বেদআত! অতএব, আপনারা নিজেরাই দেখুন কারা বেদআতী!

৪/ - মহানবী (দ:)-এর প্রতি দরূদ-সালাম পাঠ 

আল্লাহতা’লা এরশাদ ফরমান: “নিশ্চয় আল্লাহ ও তাঁর ফেরেশতাবৃন্দ দরূদ প্রেরণ করেন ওই অদৃশ্য বক্তা (নবী)-এর প্রতি। হে ঈমানদার মুসলমান সকল! তোমরাও তাঁর প্রতি দরূদ ও (ভক্তিসহ) সালাম প্রেরণ করো।” [আল-কুরআন, ৩৩:৫৬; তাফসীরে কানযুল ঈমান বাংলা সংস্করণ]

হযরত আবদুল্লাহ বিন আমর বিন আল-’আস্ (রা:) বর্ণনা করেন যে তিনি মহানবী (দ:)-কে বলতে শুনেছেন, “কেউ আমার প্রতি একবার সালাওয়াত পাঠ করলে আল্লাহতা’লা তার প্রতি দশটি নেকী বর্ষণ করেন।” [সহীহ মুসলিম] 

তাহলে মহানবী (দ:)-এর প্রতি দরূদ-সালাম পাঠ করা কি বেদআত? অবশ্যই নয়! আর এই সালাওয়াত পাঠ করার জন্যে কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দেয়া হয়নি যে কখন হালাল হবে আর কখন তা হারাম হবে (কিছু নির্দিষ্ট সময় ছাড়া)। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যে রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর প্রতি দরূদ-সালাম পাঠ করা বছরের প্রতিটি দিন-ই জায়েয। এই নেক তথা পুণ্যদায়ক কাজ হতে মানুষদেরকে বাধা দেয়ার চেষ্টা করাই হলো খোদ এক বেদআত! অতএব, আপনারা নিজেরাই দেখুন কারা বেদআতী!

বস্তুতঃ কেউ যতো বেশি সালাত-সালাম পাঠ করবেন, তিনি ততোই পুরস্কৃত হবেন, যেমনটি বিবৃত হয়েছে নিচের হাদীসটিতে:

হযরত ইবনে মাসউদ (রা:) বর্ণনা করেন রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর বাণী, যিনি বলেন, “নিশ্চয় কেয়ামত ময়দানে আমার সবচেয়ে নৈকট্যপ্রাপ্ত হবে সে-ই, যে ব্যক্তি আমার প্রতি সর্বাধিক দুরূদ-সালাম প্রেরণ করেছে।” [তিরমিযী, ২য় খণ্ড, হাদীস নং ৪৮৪]

৫/ - পদ্য, নাশীদ ও না’ত আবৃত্তি

হযরত উবাই বিন কা’আব (রা:) বর্ণনা করেন নবী পাক (দ:)-এর হাদীস, যিনি বলেন: “কিছু কাব্য জ্ঞান ধারণ করে।” [সহীহ বোখারী, ৮ম খণ্ড, ৭৩তম বই, হাদীস নং ১৬৬] 

সাহাবা-এ-কেরাম (রা:) পারস্পরিক দেখা-সাক্ষাৎ করে একে অপরকে রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর শানে কবিতা (না’ত শরীফ) শোনানোর অনুরোধ করতেন। এতে প্রমাণিত হয় যে মীলাদ সাহাবা (রা:)-বৃন্দের সুন্নাত (রীতি)। সাইয়্যেদুনা আতা’ ইবনে এয়াসার (রা:) বলেন, “আমি আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আ’স (রা:)-এর সাথে দেখা করে তাঁকে তৌরীত ঐশীগ্রন্থে পাওয়া যায় প্রিয়নবী (দ:)-এর শানে এমন একখানি না’ত শোনানোর অনুরোধ করি। তিনি আমাকে তা আবৃত্তি করে শোনান।” [মেশকাত, বাবু ফাদায়েলিস্ সাইয়্যেদিল মুরসালীন, ১ম অনুচ্ছেদ]

হযরত সালামা বিন আল-আকওয়া (রা:) হতে বর্ণিত; তিনি বলেন: আমরা রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর সাথে খায়বারের উদ্দেশ্যে রওয়ানা করি এবং রাতে ভ্রমণ করি। মানুষদের মধ্যে এক ব্যক্তি আমির বিন আল-আকওয়া (রা:)-কে বলেন, “আপনি কি আমাদের আপনার কবিতা আবৃত্তি করে শোনাবেন না?” আমির ছিলেন কবি, তাই তিনি (সওয়ার থেকে) নেমে মানুষের জন্যে হেদায়াতমূলক কবিতা আবৃত্তি করতে থাকেন; এই কাব্যের গতি উটের পা ফেলার সাথে তাল মিলিয়ে এগোতে থাকে আর বলতে থাকে, “হে আল্লাহ! আপনি ছাড়া আমরা সঠিক পথে পরিচালিত হতাম না, দান-সদকাও করতাম না, নামায-দোয়াও পড়তাম না। অতএব, অনুগ্রহ করে আমাদের কৃতকর্ম ক্ষমা করে দিন। আপনার উদ্দেশ্য সাধনে আমাদের উৎসর্গ করুন। আর আমরা যখন শত্রুর মোকাবেলা করবো, তখন আমাদের পাগুলোকে সুদৃঢ় রাখুন এবং আমাদের মাঝে শান্তি ও স্থিরতা মঞ্জুর করুন। আর যদি শত্রুরা আমাদেরকে অন্যায় কোনো কিছুর প্রতি আহ্বান করে, তবে আমরা তা প্রত্যাখ্যান করবো। কাফেররা আমাদের বিরুদ্ধে অন্যদের কাছে সাহায্য চাওয়ার বেলায় অনেক হৈচৈ করেছে।” এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ (দ:) জিজ্ঞেস করেন, “(উটের) ওই চালক কে?” সাহাবা (রা:)-বৃন্দ উত্তর দেন, “তিনি আমির বিন আল-আকওয়া।” এমতাবস্থায় রাসূল (দ:) বলেন, “আল্লাহ তার প্রতি রহমত বর্ষণ করুন।” [সহীহ বোখারী, ৮ম খণ্ড, ৭৩তম বই, হাদীস নং ১৬৯]  

রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর চাচা হযরত আব্বাস (রা:) একটি কবিতা রচনা করেন যা’তে তিনি হুযূর পূর নূর (দ:)-এর বেলাদত শরীফের ভূয়সী প্রশংসা করেন। ওই পদ্যে নিচের কয়েকটি চরণ পাওয়া যায় -
  
“(হে নবী) আপনার বেলাদত হয়েছিল যবে
ভুবন ও দিগন্ত আলোকিত হয়েছিল আপনারই নূরের বৈভবে
সেই নূরের আলোয় ও ন্যায়ের পথেই চলেছি আমরা সবে।”



[ইবনে সাইয়্যেদ আল-নাস নিজের এসনাদ-সহ আত্ তাবারানী ও আল-বাযযার হতে এটি বর্ণনা করেন তাঁরই ‘মিনাহ আল-মায’ গ্রন্থে (১৯২-৩ পৃষ্ঠা); এছাড়াও ইবনে কাসীর নিজের ‘আল-সীরাহ আন্ নাবাউইয়্যা’ (মোস্তফা আবদ্ আল-ওয়াহিদ সংস্করণ ৪:৫১) পুস্তকে এটি উদ্ধৃত করে; মোল্লা আলী কারী নিজ ‘শরহে শেফা’ গ্রন্থে (১:৩৬৪) বলেন যে এ বর্ণনা আবূ বকর শাফেঈ ও আত্ তাবারানীর; আর এটি উদ্ধৃত করেছেন আবদুল বর্র তাঁর ‘আল-এস্তে’য়াব’ পুস্তকে, ইবনে কাইয়্যেম নিজ ‘যাদ আল-মা’আদ’ বইয়ে এবং ইবনে হাজর তাঁর ‘ফাতহুল বারী’ গ্রন্থে]

ওপরোক্ত পদ্যে হযরত আব্বাস (রা:)-এর উল্লেখিত ‘নূর’ তথা জ্যোতি শব্দটি স্বয়ং নবী পাক (দ:) নিশ্চিত করেছেন তাঁরই বেলাদত-সম্পর্কিত একটি বিখ্যাত হাদীসে। হযরত এরবাদ ইবনে সারিয়্যা (রা:) ও আবূ উমামা (রা:) বলেন যে মহানবী (দ:) এরশাদ করেন: “আমি হলাম পিতা ইব্রাহীম (আ:)-এর দোয়া এবং আমার ভাই হযরত ঈসা (আ:)-এর প্রদত্ত শুভ সংবাদ। যে রাতে আমার বেলাদত হয়, সে সময় আমার মা একটি নূর দেখতে পান, যেটি দামেশকের প্রাসাদগুলোকে এমনভাবে আলোকিত করেছিল যে তিনি সেগুলো দেখতে পাচ্ছিলেন।” [এ হাদীস বর্ণনা করেন আল-হাকীম (২:৬১৬-১৭), ইমাম আহমদ নিজ ‘মুসনাদ’ গ্রন্থে; আরো বর্ণনা করেন আল-বায়হাকী তাঁর ‘দালাইল আন্ নবুওয়া’ পুস্তকে (১:১১০, ২:৮), ইবনে জাওযী উদ্ধৃত করেন নিজ ‘আল-ওয়াফা’ বইয়ে; আর ইবনে কাসীর উদ্ধৃত করেছে নিজ ‘মওলিদ-এ-রাসূল আল্লাহ’ এবং ‘তাফসীরে কাসীর’ গ্রন্থে (৪:৩৬০)। আল-হায়সামী (৮:২২১) বলেন যে আত্ তাবারানী ও ইমাম আহমদ এটি বর্ণনা করেছেন, যার মধ্যে ইমাম আহমদের এসনাদ তথা সনদ ‘হাসান’। এছাড়াও ইবনে হিশাম নিজ ‘সীরাতে রাসূল-আল্লাহ’ (দারুল উইফাক সংস্করণ ১/২:১৬৬) এবং আত্ তাবারী তাঁর ইতিহাস পুস্তকে এই রেওয়ায়াত উদ্ধৃত করেন]   

প্রিয়নবী (দ:) বিখ্যাত খন্দকের যুদ্ধের সময় হযরত আনাস (রা:) ও অন্যান্য সাহাবী (রা:)-দের নবী-বন্দনাসূচক কবিতা ও গান শোনেন, যা’তে তাঁরা বলছিলেন: “আমরাই জ্বেহাদের উদ্দেশ্যে মহানবী (দ:)-এর হাতে বায়াত হয়েছি - যতোদিন বেঁচে আছি।” [ইমাম বোখারী এবং ইবনে কাইয়্যেম আল-জাওযিয়্যা নিজ ‘মাদারিজ আস্ সালেকীন’ পুস্তকের ১ম খণ্ড]

ইবনে কাইয়্যেম আল-জাওযিয়্যা আরো উদ্ধৃত করে হযরত ইবনে রাওয়াহা (রা:)-এর দীর্ঘ কবিতা, যা তিনি মক্কায় প্রবেশের সময় মহানবী (দ:)-এর শানে আবৃত্তি করেন; এমতাবস্থায় রাসূলুল্লাহ (দ:) তাঁর জন্যে দোয়া করেন। তিনি অপর কবি ও সাহাবী হযরত হাসান বিন সাবেত (রা:)-এর জন্যেও দোয়া করেন, যাতে তিনি যতোদিন কবিতা দ্বারা মহানবী (দ:)-কে সাহায্য করবেন, ততোদিন তাঁকে আল্লাহতা’লা পবিত্র রূহ দ্বারা সমর্থন দেন। অনুরূপভাবে, তিনি হযরত কা’আব ইবনে যুবায়র (রা:)-কে তাঁর কবিতার জন্যে খুশি হয়ে নিজ চাদর মোবারক দান করেন। ইবনে কাইয়্যেম এ প্রসঙ্গে বলে, “হযরত আয়েশা (রা:) সব সময়ই তাঁর প্রশংসাসূচক কবিতা আবৃত্তি করতেন এবং তিনি তাঁর প্রতি রাজি ছিলেন।” [ইবনে কাইয়্যেম আল-জাওযিয়্যা কৃত ‘মাদারিজ আস্ সালেকীন’]

রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর কবি হযরত হাসান বিন সাবেত (রা:) বলেন: আল্লাহর কসম! কোনো নারী-ই জন্ম দেয় নি পয়গম্বর ও মানুষের হেদায়াতদাতা মহানবী (দ:)-এর মতো কাউকে; আর অাল্লাহতা’লা-ও তাঁর সৃষ্টিকুলের মাঝে সৃষ্টি করেননি মহানবী (দ:)-এর মতো আমাদের (হেদায়াতের) নূরের উৎসস্বরূপ আরেকজন বিশ্বাসীকে, যিনি তাঁরই সান্নিধ্যপ্রাপ্ত ও ওয়াদা (-এর বহিঃপ্রকাশ)।” [ইবনে হিশাম কর্তৃক তাঁর ‘সীরাতে রাসূল-আল্লাহ’ গ্রন্থের শেষ কয়েক লাইনে উদ্ধৃত]  

এর পরও কি আশীর্বাদধন্য রাজাধিরাজের (ধরাধামে) শুভাগমন উদযাপনে কবিতা আবৃত্তি করা বিদআত বলে মনে হয় এর বিরোধিতাকারীদের কাছে? তারা এই দালিলিক প্রমাণগুলো যখন হজম করতে ব্যস্ত, আমরা তখন সৃষ্টির সেরা মহান সত্তার প্রতি সালাওয়াত পাঠে নিজেদের প্রবৃত্ত করবো এবং সারা রাত-দিন তাঁরই নূরের বন্দনা করবো যেভাবে তাঁর আনসার সাহাবা (রা:)-বৃন্দ আদর্শ স্থাপন করেছেন নিচের পদ্যে:

“হেদায়াতের পূর্ণচন্দ্র আমাদের ভাগ্যাকাশে ‘আল-ওয়াদা’য় হয়েছেন উদিত
যতোদিন আল্লাহর কোনো এবাদতকারী থাকবেন আমরা শোকর করতে হবো বাধিত।” 

[এটি বর্ণনা করেন আত্ তাবারী তাঁর ‘আল-রিয়াদ আন্ নাদিরা’ (১:৪৮০) গ্রন্থে এবং ইবনে কাসীর নিজ ‘আল-বেদায়া ওয়ান্ নেহায়া’ (মা’আরিফ সংস্করণ, ৩:১৯৭, ৫:২৩) পুস্তকে]  

৬/ - প্রিয়নবী (দ:)-এর প্রতি মহব্বত প্রকাশ ও জশনে জলূস

হযরত সাইয়্যেদুনা আনাস বিন মালেক (রা:) বর্ণনা করেন: মহানবী (দ:) মদীনায় হিজরত করে এলে আবিসিনীয় (আফ্রিকী) লোকেরা এই খুশিতে বর্শা নিয়ে (ঐতিহ্যবাহী) খেলায় মেতে ওঠে। [সুনানে আবি দাউদ, ৪১তম বই, হাদীস নং ৪৯০৫]

হযরত আয়েশা (রা:) হতে বর্ণিত: ....মদীনার মুসলমানবৃন্দ (হিজরতের সময়) যখন রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর মক্কা ছেড়ে মদীনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হওয়ার সংবাদ পান, তখন তাঁরা প্রতিদিন সকালে হাররায় গমন করতে থাকেন। তাঁরা সেখানে অপেক্ষা করতেন যতোক্ষণ না মধ্যাহ্ন সূর্যের খরতাপ তাঁদেরকে ফেরত আসতে বাধ্য করতো। একদিন দীর্ঘ সময় অপেক্ষার পর তাঁরা বাড়ি ফিরলে জনৈক ইহুদী কোনো জিনিস খুঁজতে তাঁর গোত্রের দুর্গের একটি ছাদে ওঠেন এবং দূরে মরু-মরীচিকার অন্তরাল থেকে বেরিয়ে আসা সাদা পোশাক পরিহিত আল্লাহর রাসূল (দ:) ও তাঁর সাহাবীদের দেখতে পান। ওই ইহুদী তাঁর সাধ্যানুযায়ী উচ্চস্বরে চিৎকার করে বলেন, “ওহে আরবকুল! তোমাদের সেই মহান ব্যক্তিত্ব এখানে উপস্থিত, যাঁর জন্যে তোমরা অপেক্ষা করছো।” এমতাবস্থায় সকল মুসলমান ব্যক্তি হাররার চূড়ায় ছুটে যান এবং সেখানে মহানবী (দ:)-কে স্বাগত জানান। রাসূলুল্লাহ (দ:) তাঁদের সাথে ডান দিকে ফেরেন এবং বনূ আমর বিন আউফ গোত্রের বসতস্থানে (সওয়ার হতে) নেমে যান; আর এটি ছিল রবিউল আউয়াল মাসের এক সোমবার দিন।.....(একটি দীর্ঘ হাদীসের অংশ এটি)। [সহীহ বোখারী, ৫ম খণ্ড, ৫৮তম বই, হাদীস নং ২৪৫] 

হযরত আনাস বিন মালেক (রা:) বর্ণনা করেন: ....হুযূর পাক (দ:)-এর মদীনায় আগমনের খবর প্রচার হয়ে যায়। মানুষেরা ঘর থেকে বেরিয়ে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকাতে থাকেন এবং বলতে থাকেন, “আল্লাহর রাসূল (দ:) এসেছেন! আল্লাহর নবী এসেছেন!” এমতাবস্থায় মহানবী (দ:) চলতে থাকেন যতোক্ষণ না তিনি হযরত অাবূ আইয়্যুব আনসারী (রা:)-এর ঘরের সামনে (সওয়ার থেকে) নামেন।...(একটি দীর্ঘ হাদীসের অংশ এটি)। [সহীহ বোখারী, ৫ম খণ্ড, ৫৮তম বই, হাদীস নং ২৫০] 

হযরত আল-বারা’ বিন আযিব (রা:) বর্ণনা করেন: মদীনায় আমাদের কাছে সর্বপ্রথম যে ব্যক্তিবৃন্দ আসেন তাঁরা হলেন সর্ব-হযরত মুস’আব বিন উমর (রা:) ও ইবনে উম্মে মাকতুম (রা:); এঁরা মানুষদেরকে কুরআন মজীদ শিক্ষা দিচ্ছিলেন। এর পর এলেন হযরত বেলাল (রা:), সা’দ (রা:) ও আম্মার ইবনে এয়াসীর (রা:)। অতঃপর হযরত উমর ফারূক (রা:) তাঁর সাথে আরো বিশজন সাহাবী (রা:)-কে নিয়ে মদীনায় আসেন। এরই পরবর্তী পর্যায়ে মহানবী (দ:) মদীনায় তাশরীফ আনেন এবং তাঁর আগমন উপলক্ষে মদীনাবাসী মানুষ যতোখানি আনন্দে উদ্বেলিত হয়েছিলেন, অতোটুকু উৎফুল্ল হতে আমি তাঁদেরকে আগে কখনোই দেখিনি। এমন কি দাসী মেয়েরাও গান করছিল, “রাসূলুল্লাহ (দ:) আগমন করেছেন।” তাঁর তাশরীফ আনার আগেই আমি “আপন রবের নামের পবিত্রতা বর্ণনা করো, যিনি সবার ঊর্ধ্বে” (আল-কুরঅান, ৮৭:১)-সহ মুফাসসিলের অন্যান্য সূরা পাঠ করেছিলাম। [সহীহ বোখারী, ৫ম খণ্ড, ৫৮তম বই, হাদীস নং ২৬২]   

সহীহ বোখারী শরীফ ও অন্যান্য সীরাহ-গ্রন্থে উদ্ধৃত এসব হাদীস থেকে আমরা জানতে পারি যে মহানবী (দ:) যখন মক্কা মোয়াযযমা হতে মদীনা মোনাওয়ারায় হিজরত করেন, তখন ওই নগরীর মানুষ তাঁকে মহা উৎসাহে স্বাগত জানান। মদীনায় এক আনন্দ-উৎসবের পরিবেশ সৃষ্টি হয়, যার নজির ইতিপূর্বে কখনোই দেখা যায়নি। তাঁকে অভ্যর্থনা জানানোর উদ্দেশ্যে সর্বসাধারণ রাস্তার দুই পাশে সারিবদ্ধভাবে জড়ো হন; নারী-পুরুষ ও শিশু সবাই উৎফুল্লচিত্তে তাঁকে সম্ভাষণ জানান। এই সময় অবিরাম দফ বাজিয়ে গান করা হয় -

“হেদায়াতের পূর্ণচন্দ্র আমাদের ভাগ্যাকাশে ‘আল-ওয়াদা’ এলাকায় হয়েছেন উদিত
যতোদিন আল্লাহর কোনো এবাদতকারী থাকবেন আমরা শোকর করতে হবো বাধিত
হে রাসূল, আপনি আমাদের মাঝেই হয়েছেন (খোদা কর্তৃক) লালিত, পালিত 
এসেছেন নিয়ে এক কর্তব্য যা হতে হবে মান্যকৃত
আপনি এনেছেন এ নগরীর জন্যে মাহাত্ম্য
তাই স্বাগতম, আল্লাহর রাস্তার দিকে সেরা (ওই) আহ্বান, উদাত্ত।"  

ইনশা’আল্লাহ, পুনরুত্থান দিবসেও রাস্তাগুলো মহানবী (দ:)-এর প্রতি সাহাবা-এ-কেরাম (রা:)-এর ভালোবাসার সাক্ষ্য প্রদান করবে।

সোবহানাল্লাহ! আর ভেবে দেখুন কতো তারিখে মহানবী (দ:) মদীনায় প্রবেশ করেন এবং সাহাবা-এ-কেরাম (রা:) উৎসবে মাতেন! এটি ছিল সোমবার, ১২ই রবিউল আউয়াল, ঠিক একই তারিখ যেদিন তাঁর ধরাধামে শুভাগমন হয়েছিল। রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর মাহাত্ম্যকে স্বীকার করার উদ্দেশ্যে এ দিনটিতে উৎসবের আয়োজন করাটা এই দলিলে সিদ্ধ ও জায়েয প্রমাণিত হয়।

সোবহানাল্লাহ! জুলূস তথা মিছিলসহ রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর প্রশংসাসূচক না’ত-পদ্য-নাশীদ ইত্যাদি করা যে জায়েয, তার অনুমতি হিজরতের সময় স্বয়ং হুযূর পাক (দ:)-ই দিয়েছেন (কেননা, মদীনার আনসার সাহাবীবৃন্দ খুশিতে মিছিল করছিলেন - অনুবাদক)। অধিকন্তু, মক্কা বিজয়ের সময়ও তিনি সেখানে প্রবেশ করলে সাহাবা-এ-কেরাম (রা:) আনন্দে  তাঁরই প্রশংসাসূচক না’ত/পদ্য উচ্চস্বরে আবৃত্তি করেন। এই শুভলগ্নে হযরত আবদুল্লাহ বিন রওয়াহা (রা:) ইসলামী বাহিনীর অগ্রভাগে হাঁটছিলেন এবং উচ্চস্বরে না’ত-পদ্য গাইছিলেন। হযরত উমর তাঁর কাছে এসে জিজ্ঞেস করেন, “তুমি যে রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর সামনে এতো জোরে না’ত গাইছো, তা কি যথার্থ?” এমতাবস্থায় খোদ মহানবী (দ:) হযরত উমর (রা:)-কে থামিয়ে দিয়ে বলেন, “ওকে বাধা দেবে না। কেননা, তার পদ্যগুলো কাফেরদের অন্তরে তীরের মতো বিঁধছে।” [সর্ব-ইমাম তিরমিযী, নাসাঈ ও ‘সুনানে কুবরা’; ইমাম ইবনে হাজর আসকালানীও এটি উদ্ধৃত করেন] 

৭/ - মসজিদ আলোকসজ্জা

বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে, বিশেষ করে রমজান মাস, লায়লাতুল কদর উপলক্ষে কুরআন খতম কিংবা ঈদে মীলাদুন্নবী (দ:)-তে মসজিদগুলো উজ্জ্বল রাখা তথা আলোকসজ্জা করা একটি বড় এবাদত। এ সম্পর্কে অনেক প্রামাণ্য দলিল বিদ্যমান, যেগুলো এখানে আলোকপাত করা হলো।

সর্বশক্তিমান আল্লাহতা’লা এরশাদ ফরমান: “আল্লাহর মসজিদসমূহ তারাই আবাদ করে, যারা আল্লাহ ও কিয়ামতের প্রতি ঈমান আনে, নামায কায়েম রাখে, যাকাত প্রদান করে এবং আল্লাহ ভিন্ন অন্য কাউকেও ভয় করে না; সুতরাং এটাই সন্নিকটে যে এসব মানুষ সৎপথ প্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে।” [আল-কুরআন, ৯:১৮; তাফসীরে নূরুল এরফান বাংলা সংস্করণ] 

মুফাসসিরীনে কুরআন (ব্যাখ্যাকারীবৃন্দ) বিবৃত করেন যে মসজিদে (জামাআতে) সালাত আদায়, তা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা, উন্নতমানের ম্যাট বিছানো, আলোকসজ্জা করা ইত্যাদি কার্যক্রম মসজিদের উন্নয়নে সহায়ক। হযরত সোলা্য়মান (আ:) ‘কিবরীত-এ-আহমার’ (এক ধরনের দাহ্য পদার্থ) দ্বারা মসজিদে বায়তুল মোকাদ্দাস আলোকিত করে রাখতেন। এর এমনই উজ্জ্বলতা ছিল যে বহু দূরে অবস্থিত মহিলাবর্গ তাদের সুতো কাটতে পারতেন! [তাফসীরে রূহুল বয়ান] 

হযরত আবূ সাঈদ খুদরী (রা:) বলেন: “সাহাবী হযরত তামীম দারী (রা:)-ই ছিলেন সর্বপ্রথম ব্যক্তি, যিনি মসজিদগুলোতে চেরাগ জ্বালান।” [সুনানে ইবনে মাজাহ]

উম্মুল মো’মেনীন সাইয়্যেদাহ মায়মুনাহ (রা:) মহানবী (দ:)-কে জিজ্ঞেস করেন: “বায়তুল মোকাদ্দাস মসজিদ সম্পর্কে আমাদের নির্দেশ দিন।” তিনি উত্তরে বলেন, “সেখানে যেয়ে সালাত আদায় করো।” ওই সময় সেখানে একটি যুদ্ধ চলছিল। এই কারণে মহানবী (দ:) বলেন, “তোমরা যদি মসজিদে পৌঁছুতে না পারো এবং নামায পড়তে না পারো, তবে সেখানে তেল প্রেরণ করো, যাতে তা মসজিদের প্রদীপ জ্বালাতে ব্যবহৃত হয়।” [সুনানে আবি দাউদ]
  
ওপরের এই রেওয়ায়াত থেকে চারটি বিষয় উপলুব্ধ হয়:


/ বায়তুল মোকাদ্দাস মসজিদে সালাত আদায়ের জন্যে ভ্রমণ করা স্বয়ং একটি সুন্নাত। সাইয়্যেদুনা রাসূলুল্লাহ (দ:) মে’রাজ রাতে অন্যান্য সকল পয়গম্বর (আ:)-এর ইমাম হয়ে সেখানে নামায পড়িয়েছিলেন। এই কারণেই তিনি সেখানে ভ্রমণ করে গিয়েছিলেন।


/ মসজিদে বায়তুল মোকাদ্দাসে অনেক প্রদীপ জ্বালানো হতো; এ কথা হাদীসটিতে ব্যবহৃত ‘ক্কানাদীল’ শব্দটি থেকে বোঝা যায়।

/ মসজিদটিকে আলোকিত করাটা সেখানে নামায পড়ার সওয়াবের সাথে তুলনীয়। আরেক কথায়, এটি এক মহা সওয়াবদায়ক এবাদত।

/ মসজিদ আলোকিত করার জন্যে দূর-দূরান্ত থেকে তেল প্রেরণ করা সাহাবা (রা:)-বৃন্দের সুন্নাত।

মোহাদ্দীস ইবনে শাহীন উদ্ধৃত করেন হযরত আবূ এসহাক হামদানী (রা:)-কে, যিনি বলেন: প্রতি রমযান মাসের প্রথম রাতে খলীফা আলী (ক:) মসজিদে নববীতে প্রবেশ করতেন। ওতে হারিকেন/প্রদীপ জ্বলতো এবং কুরআন তেলাওয়াত করা হতো। তিনি সম্ভাষণ জানাতেন, “হে উমর ইবনে খাত্তাব (রা:)! আল্লাহ আপনার মাযার আলোকিত করুন, যেমনটি আপনি মসজিদকে আলোকিত করেছেন কুরআন তেলাওয়াতের সময়।” [ইবনে শাহীন]

এতে প্রমাণিত হয় যে রমযান মাসে মসজিদ আলোকিত করার প্রথা খলীফা উমর (রা:)-এর শাসনামল হতেই অনুশীলিত হয়ে এসেছিল। আরো লক্ষণীয় যে অন্যান্য সাহাবী (রা:)-বৃন্দ এতে আপত্তি উত্থাপন করেননি। যদি আল্লাহর আশীর্বাদরূপী পবিত্র কুরঅান মজীদ অবতীর্ণ হওয়ার মাস উদযাপনে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ ও মসজিদ আলোকিত করার আয়োজন জায়েয হয়, তাহলে আল্লাহতা’লার সর্ববৃহৎ আশীর্বাদ ও করুণা আমাদের প্রিয় মহানবী (দ:)-কে ধরাধামে পাওয়ার মাস (রবিউল আউয়াল) উদযাপনে মসজিদগুলো আলোকিত করায় কোনো আপত্তি থাকতে পারে না।


কিছু কিছু মোহাদ্দেসীন (হাদীস-শাস্ত্র বিশারদ) হযরত আলী (ক:)-এর কথা উদ্ধৃত করেন, যিনি বলেন: “আল্লাহ পাক খলীফা হযরত উমর (রা:)-এর মাযারকে আলোকিত করেন, যেভাবে তিনি আমাদের মসজিদকে আলোকিত করেছিলেন।” [সহিহুল বিহারী]

অতএব, আমরা জানতে পারলাম যে মসজিদগুলো আলোকিত করার প্রতিদানস্বরূপ আমাদের কবরগুলোকেও ইনশা’আল্লাহ আলোকিত করা হবে। এমতাবস্থায় এই প্রথা অনুশীলনে যে ব্যক্তি বাধা দেবে, সে শুধু তার কবরকেই অন্ধকারাচ্ছন্ন করবে না, বরং সাহাবা-এ-কেরাম (রা:)-এর সুন্নাহর বিরোধিতাও করবে। আল-কুরআন এসব লোক সম্পর্কে সতর্কবাণী উচ্চারণ করে: “এবং তার চেয়ে অধিকতর যালেম কে, যে ব্যক্তি আল্লাহর মসজিদগুলোতে বাধা দেয় সেগুলোতে আল্লাহর নামের চর্চা হওয়া থেকে, আর সেগুলোর ধ্বংস সাধনে প্রয়াসী হয়?” [আল-কুরঅান, ২:১১৪; তাফসীরে নূরুল এরফান] 

যারা মসজিদে সালাত আদায়, সর্বশক্তিমান আল্লাহতা’লার যিকর-তাযকেরা, কুরঅান শরীফ তেলাওয়াত বা না’ত/নাশীদ আবৃত্তি করাকে নিষেধ করে এবং এর পাশাপাশি মসজিদের শোভা বর্ধনের উদ্দেশ্যে প্রদীপ জ্বালানো, আলোকসজ্জা করা, ম্যাট/কার্পেট বিছানো ইত্যাদিতে বাধা দেয়, তাদেরকে ওপরোক্ত আয়াতে করীমায় তিরস্কার করা হয়েছে; কেননা তাদের এই নিষেধ করা ও বাধা দেয়া  প্রকৃতপক্ষে আল্লাহতা’লার মসজিদ ধ্বংসে ইন্ধন-ই যুগিয়ে থাকে।

বর্তমান যুগে মসজিদ অলঙ্করণ, তা সর্বদা আলোকোজ্জ্বল রাখা এবং গুরুত্বপূর্ণ তারিখে তাতে বিশেষ আয়োজন করা এমন কি সাধারণ জ্ঞানেও উত্তম বলে বিবেচিত হয়। তা এ কারণে যে আমরা অহরহ আমাদের বাড়িঘর সাজিয়ে রাখি এবং বিয়ে-শাদীর মতো বিশেষ অনুষ্ঠানগুলোতে সাধারণের বাইরে গিয়ে আলোকসজ্জা করে থাকি। আমাদের ঘরবাড়ি যদি সুশোভিত ও আলোকিত হওয়ার যোগ্যতা রাখে, তাহলে অবশ্যঅবশ্য খোদাতা’লার মসজিদ, যা সব ঘরের মধ্যে উত্তম, তা সুশোভিত হওয়ার দাবি রাখে। কেননা, এতে মসজিদের মাহাত্ম্য মানুষের অন্তরে প্রোথিত হবে। এই প্রথা দ্বীন ইসলাম প্রচারের একটি মাধ্যম এবং মুসলমানদের মাঝে ভক্তিশ্রদ্ধার অনুভূতি জাগিয়ে তোলে।

এছাড়া, অনেক মানুষ মঞ্চ সজ্জিত ও আলোকিত করার বেলায় সর্বাত্মক ব্যবস্থা নেয় এবং একে ‘শান্তি সভা’ বা ‘সীরাহ (সীরাতুন্নবী) সেমিনার’ বলে ডাকে। আল-হামদুলিল্লাহ! আমরা আমাদের অনুষ্ঠানকে মীলাদুন্নবী (দ:) বলে থাকি।

                                                           *সমাপ্ত*